গীতায় ও উপনিষদে ব্রহ্ম

আমাদের জন্মরহস্য জানা দরকার। এটা যে জানতে পারে, কেবল সে-ই বোঝে, অন্যকে ঠিক বোঝাতে পারে না। কোন পথে এটা জানা যায়? ধরে নিই, এক দুর্গম অরণ্য প্রদেশে এর জ্ঞান লুকিয়ে আছে। ওখান থেকে এই জ্ঞানকে উদ্ধার করতে হবে। সেখানে পৌঁছোতে চাইলে অনেক কষ্ট সহ্য করে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। তা-ও সবাই আবার সে পথে হাঁটতে পারে না। যাঁরা সেই পথে চলাচলে অভ্যস্ত, তাঁরা দয়া করে দিলে তাঁদের কাছ থেকে কিছু পথনির্দেশ পাওয়া যায়; অর্থাৎ, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গুরুর শরণাপন্ন হতেই হয়। ওসব নির্দেশ নিজের গ্রহণসামর্থ্য অনুযায়ী ধারণ করতে হয়।




যে-পথে চলে এই গূঢ় সমস্যার মর্মোচ্ছেদ করা যায়, সেই পথে চলার নির্দেশসমূহ সবসময়ই অভিনব এবং অবিশ্বাসযোগ্য হয়ে থাকে। সুতরাং তা সাধারণত কারও বোধগম্য হয় না। 'হয় না' কেন? অধিকারীর গ্রহণ করার সামর্থ্য, বাসনা ও প্রস্তুতির অভাবে। তাহলে উপায়? উপায় একটাই—ভগবদ্‌স্মরণ। ভগবদ্‌স্মরণের পরই ভগবদ্‌‌শরণ।




'জন্ম' শব্দটির সাথে 'শরীর' অনিবার্যভাবে আসবেই। আর অমনিই এসে পড়ে দেহাভিমানী (নিজের অবস্থান ও অস্তিত্বের বড়াই করেন যাঁরা) 'আমি'র পেছনের নিরভিমান 'আত্মা'র কথাও। শরীরকে স্বাভাবিকভাবে আমরা ‘ভোগায়তন’ বলেই জানি; এটা ‘যোগায়তন’-ও বটে। বহির্মুখীনতায় ভোগ, অন্তর্মুখীন অনুসন্ধানে যোগ। এই অনুসন্ধানটা কার? আমার নিজের, অর্থাৎ আত্মার। কেবল আত্মাই খাঁটি সত্তা। এই শরীর সেই আত্মোপলব্ধির দ্বার—সুতরাং ব্রহ্মোপলব্ধির দ্বার, কেননা আত্মাই ব্রহ্ম। ব্রহ্মসাধনার শুরুটা সবসময়ই শরীর থেকেই হয়।




কোনো একটা অনির্বচনীয় শক্তির প্রভাবে আমাদের মুখ্য শুদ্ধচৈতন্য আবৃত আছে। জাগ্রতচৈতন্য নিদ্রায় যেমন আবৃত থাকে, মুখ্যচৈতন্য‌ও আমাদের জাগ্রতাবস্থায়—শুধু জাগ্রতাবস্থায় কেন, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি অর্থাৎ আমাদের পরিচিত তিন অবস্থাতেই—তেমনি করেই আবৃত রয়েছে। শুধু যদি আবৃতই থাকত, তবে হয়তো কোনো একসময় সেই আবরণ উন্মোচিত‌ হতেই পারত—এই আবরণশক্তির সাথে এখানে আর একটা শক্তি রয়েছে, যাকে বিক্ষেপশক্তি বলা যায়।




বিক্ষেপের জন্যই সকল বহির্মুখীনতা—অন্তরের বিপরীতে গতি। এই বিক্ষেপশক্তির কারণেই আমাদের চৈতন্য-প্রতিবিম্ব ভুলপথে অগ্রসর হয়। বিক্ষেপশক্তির এমন প্রভাবের সময়েও আবরণশক্তি রয়েছে। আবরণশক্তির প্রভাবে তত্ত্বের 'অগ্রহণ' এবং বিক্ষেপশক্তির ফলে 'অন্যথাগ্রহণ' হয়—"জানতে পারছি না।"...এই বোধটার নাম 'অগ্রহণ' এবং "এটা তো এমনই!"...এরকম যে ভুলজ্ঞান, তার নাম 'অন্যথাগ্রহণ'। এর দৃষ্টান্ত হলো জাগরণ ও নিদ্রা—এখানে স্বপ্ন নিজেই জাগরণের অন্তর্ভুক্ত।




সুষুপ্তি আবরণ-অবস্থা, সেখানে শুধু অগ্রহণ। 'আমি' নামক মুখ্যবস্তু, যার কখনও কোনো অপলাপ (গোপন বা অস্বীকার) করা যায় না, তা-ও অগৃহীত থাকে। জাগরণে সেই অগ্রহণ তো রয়েই গেল; বাস্তবিক অর্থে আমি কী, কে, কোথায়, কেন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাতই রয়ে গেল। তার উপর এই তো আমি মানুষ, অমুক তারিখে এভাবে আমার জন্ম, আমি বুদ্ধিমান, আমি স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বিত্তশালী, গৃহস্থ, চেতনপুরুষ ইত্যাদি বহু উপাধিতে আমি আমাকে গ্রহণ করে থাকি—আবার একই ‘আমি’-ই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়; এর ফলে মুখ্য বস্তুর অন্যথাগ্রহণ হয়ে যায়। বিক্ষেপ-জাত অন্যথাগ্রহণে আবরণশক্তির প্রভাব আরও বাড়ে।




'ভুল'—এটা জানি কেমন করে? আমার ওই বিক্ষেপ-অনুভূত  জাগ্ৰতবোধই তো ঠিক হতে পারে। চার্বাকপন্থীর বা জড়বাদীর এমন আপত্তির উত্তরে বলা যায়—এটা যে ভুল, তা জানি, কেননা ওই অনুভবে অনাবিল চিত্তপ্রসাদ আসে না! অজ্ঞাত জিনিস জানলে আনন্দ অনিবার্য। জ্ঞান ও আনন্দ অবিচ্ছেদ্য। ওরা পৃথক সত্তা নয়। একই জিনিসের দ্বিবিধভাবের যুগপৎ একটি উপস্থিতি। আর এক কথা—অজ্ঞান জ্ঞাননাশ্য, অর্থাৎ কোনো বিষয়ে জ্ঞান উপস্থিত হলে তা সম্পর্কিত অজ্ঞান নষ্ট হতে বাধ্য। অজ্ঞানের নাশ হলে অজ্ঞান আবারও আক্রমণ করতে পারে না।




ভুলবশত দড়িকে সাপ মনে করতে করতে যদি সাপ বিষয়ক এই অজ্ঞানের নাশ ঘটে দড়ির জ্ঞানের দ্বারা, তাহলে আবারও সেই দড়ির টুকরোকে সাপ বলে আর ভুল হয় না। আমার জাগ্রত অবস্থার স্বাভাবিক আমি আমাকে তেমনিভাবে পুনরাক্রমণের হাত হতে রক্ষা করে না, যদি না আমি সচেতনভাবে অজ্ঞানকে নাশ করি; আমার শাশ্বত প্রশ্ন পুনরুত্থিত হয়। সুতরাং সেক্ষেত্রে জন্ম, আত্মা বা ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে অনুসন্ধানের নিবৃত্তি হয় না।




সপ্তর্ষির অন্যতম ভৃগু তাঁর পিতা বরুণের সমীপে উপস্থিত হয়ে বললেন, “হে ভগবান, আমায় ব্রহ্ম উপদেশ দান করুন।” পিতা তাঁকে বললেন, "শরীর, প্রাণ, চোখ, কান, মন, বাক্—এরাই ব্রহ্মোপলব্ধির দ্বার।" আরও বললেন,— “যতো না ইমানি ভূতানি জায়ন্তে, যেন জাতানি জীবন্তি, যৎ প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসস্ব, তদ্‌ব্রহ্ম।” (তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/১)—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদে: "যাঁর থেকে সমস্তই জন্মাচ্ছে, যাঁর দ্বারা জীবন ধারণ করছে, যাঁতে প্রয়াণ ও প্রবেশ করছে, তাঁকে জানতে ইচ্ছা করো, তিনিই ব্রহ্ম। অতএব উপনিষদের ব্রহ্মবাদী বলেন, ব্রহ্মই সমস্ত ক্রিয়ার আধার।" ('কর্ম' নিবন্ধ থেকে নেওয়া)




ভৃগু পিতৃবাক্য একাগ্রতার সাথে বারবার আবৃত্তি করে—"অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ" (তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/২)—"অন্নই ব্রহ্ম, এটা জানলেন।" এর কারণ, তিনি পিতৃপ্রদত্ত সঙ্কেত মিলিয়ে দেখলেন যে, অন্ন হতেই ভূতবর্গ জাত হয়, জন্মের পর অন্নের দ্বারা জীবনধারণ করে এবং (বিনাশকালে) অন্নাভিমুখে প্রতিগমন করে এবং অন্নেই বিলীন হয়। এটা জেনে ভৃগু বুঝলেন, অন্নের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে, তাই অন্ন ব্রহ্ম নয়। তিনি আবারও পিতার কাছে উপস্থিত হলে পিতা বুঝলেন, ভৃগু অন্ন বলতে পাঞ্চভৌতিক শরীরকে বুঝছে, কেননা শরীরের উৎপত্তি, গঠন ও বিনাশ, তিনটিই অন্নের মাধ্যমেই। তখন বরুণ বললেন, একাগ্রতার সাহায্যে ব্রহ্মকে বিশেষরূপে জানার চেষ্টা করো; একাগ্র তপস্যাই ব্রহ্ম। ভৃগু তখন কঠোর তপস্যা করে অনুধাবন করলেন—সকল জায়গাতেই একটি মহাপ্রাণ-প্রবাহ রয়েছে। সুতরাং সেই—"প্রাণো ব্রহ্মতি ব্যজানাৎ" (তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/৩)—"প্রাণই ব্রহ্ম, এটা জানলেন।" (এর সাথে জড়বাদের Cosmic Force বা Cosmic Life-এর কিছু সামঞ্জস্য থাকতেও পারে।)




পিতৃপ্রদত্ত নির্দেশ অনুধাবন করে ভৃগু মেলালেন— প্রাণ হতেই এই ভূতবর্গ উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন হয়ে প্রাণের দ্বারা বর্ধিত হয় এবং অবশেষে প্রাণাভিমুখে গমন করে প্রাণেই বিলীন হয়। পিতা তখন দেখলেন, ইন্দ্রিয়াদিবেষ্টিত প্রাণশক্তিকেই ভূতচেতন বলে পুত্র ভৃগু ধারণা করেছে। সে বোঝেনি যে, প্রাণ অচেতন, তাই সেটি ব্রহ্ম নয়। তিনি জানেন, নিজের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছাড়া অনুভূতি লাভ করা যায় না। ভৃগু বরং আরও অনুসন্ধান করুক। তাই তিনি পূর্বোক্ত সেই এক কথারই পুনরুক্তি করলেন – “তপস্যার সাহায্যে ব্রহ্মকে বিশেষরূপে জানার চেষ্টা করো, তপস্যাই ব্রহ্ম।”




ভৃগু আবারও তপস্যা করলেন। এরপর নিজেই বুঝতে পারলেন যে, অচেতন বস্তু (প্রাণ) ব্রহ্ম হতে পারে না। তাঁর মনে হলো—"মনো ব্রহ্মতি ব্যজানাৎ" (তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/৪)—"মনই ব্রহ্ম, এটা জানলেন।" এখানেও আগের সঙ্কেতটি বেশ খাটে। মন হতেই এই ভূতবর্গ জাত হয়, জাত হয়ে মনের দ্বারা বর্ধিত হয় এবং বিনাশকালে মনেরই অভিমুখে প্রতিগমন করে ও মনেই বিলীন হয়। এটা জেনে ভৃগু আবারও পিতা বরুণের কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি এবারেও আবার তপস্যা করতে বললেন। তখন ভৃগুর খেয়াল হলো, মনও অচেতন। (চেতন আত্মার অতিসান্নিধ্যে থাকে বলে মনকে আমরা চেতন বলে ভুল করি।) ভৃগুর আরও খেয়াল হলো, মন অনিশ্চয়াত্মক সংকল্প বিকল্পাত্মক অন্তঃকরণবৃত্তি, অন্তরিন্দ্রিয়।




স্বামী পরমানন্দ লিখছেন: "...মনের সংজ্ঞা দিয়েছেন ঋষিরা৷ “সংকল্প-বিকল্পাত্মক” ক্রিয়া যেখানে সাধিত হয়—তা-ই ‘মন’৷ মনে নিয়তই সংকল্প ও বিকল্প শক্তির ক্রিয়া চলছে। ‘এটা করব’ অথবা ‘না, করব না’, ‘যাব’ অথবা ‘যাব না’, ‘দেখব’ অথবা ‘দেখব না’— এরকম অসংখ্য-অসংখ্য সংকল্প উঠছে এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই মনোজগতেই তার বিকল্প তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এবার, তুমি ওই ক্রিয়াটি করবে অথবা করবে না—এটা ‘নিশ্চয়’ করে তোমার চিত্তের বুদ্ধিবৃত্তি। ঋষিরা বললেন, বুদ্ধি “নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি”। বুদ্ধি sixth dimension-এ স্থিত। আধাররূপ চিত্ত স্থির হলে যে বৃত্তিগুলি স্থির থাকবেই—সেকথা বলাই যায়! তাই মন বা বুদ্ধিকে স্থির করার চেষ্টা না করে, চিত্ত স্থির করাটাই ঠিক ঠিক সাধনা। যোগসাধনায় ওই জন্য‌ই ‘নিরূদ্ধ চিত্ত’ অবস্থা প্রাপ্ত হবার কথা বলা হয়েছে।"




অতিসূক্ষ্ম হলেও মন শরীরধর্মী, অর্থাৎ ক্ষণপরিণামী, নাশ্য—দৃশ্য পদার্থবর্গের অন্যতম। দৃশ্য অর্থ: যার প্রভাব বা পরিণাম চোখে দেখা যায়। ভৃগু এবার বুঝলেন, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি বা ঈশ্বর সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞান-ই ব্রহ্ম।—"বিজ্ঞানং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ।" (তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/৫) এভাবে সমস্ত জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি—বিশিষ্ট আদিপুরুষ পর্যন্ত পৌঁছোবার পরেও পিতা তপস্যার নির্দেশ দেওয়ায়, বিচারে ভৃগু দেখলেন, বুদ্ধিতেও সুখদুঃখের অনুভূতি থাকে, কিন্তু পরম-আনন্দে তো সুখদুঃখ নেই। এসব চিন্তা করে ভৃগু—"আনন্দো ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ।" (তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ৩/৬)—জানলেন, পূর্ণানন্দই ব্ৰহ্ম।




আনন্দ হতেই ভূতবর্গ জাত হয়, জাত হয়ে আনন্দের দ্বারা বর্ধিত হয় এবং অবশেষে আনন্দাভিমুখে প্রতিগমন করে ও আনন্দে বিলীন হয়। ভৃগুকর্তৃক জাত ও বরুণকর্তৃক বিশেষরূপে উক্ত ও নির্দেশিত এই বিদ্যা অন্নময় কোষ হতে আরম্ভ করে হৃদয়াকাশে অবস্থিত পরমানন্দে এসে পরিসমাপ্ত হয়েছে। যিনি এই প্রকারে জানেন, তিনি আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত হন, প্রভূত-অন্নশালী ও অন্নভোজী হন। তিনি ব্রহ্মতেজে এবং খ্যাতিতেও মহান হন। লোকদৃষ্টিতে এ-সকল ফল উল্লিখিত হলেও ব্রহ্মজ্ঞের দৃষ্টিতে লাভালাভ বলে কিছু নেই। মরীচিকা মিথ্যা বলে জ্ঞাত হবার পরও যেমন উপলব্ধ হয়, মিথ্যা জগৎ‌ও তেমনি জীবন্মুক্তের (জীবিতাবস্থাতেই যিনি মুক্তির সন্ধান পেয়েছেন) কাছে (বাধিতের পুনরাবৃত্তিরূপ দ্বৈতাভাসরূপে) প্রতিভাত হতে পারে। কিন্তু তিনি সে-সবে লিপ্ত হন না। ব্যাপারটা একটু ভেঙে বলা যাক।




যদিও ব্ৰহ্ম নিজে বাস্তবিক নির্বিকার, তবু তিনি আপন মায়া দ্বারা আপনাকে দ্রষ্টা ও দৃষ্টরূপে বিবর্তিত করে এই জগৎ সৃষ্টি করেন। জগৎ ব্রহ্মের বিকার নয়, কিন্তু বিবর্ত (মায়াময় রূপে স্থিতি বা ভ্রম)। দুধের বিকারে দধির উৎপত্তি হয়; এখানে দধির উৎপত্তির জন্য দুধের স্বরূপ বিকৃত হয়ে যায়, দধিতে আর দুধের স্বভাব থাকে না। দ্রষ্টার ভ্রমবশত এক বস্তু আরেকরূপে দৃষ্ট হলে সেই বস্তুটা বিবর্তিত হয়েছে বলা যায়। কোনো বস্তুর বিবর্ত হলে সেই বস্তুর নিজের স্বরূপে কোনোরূপ বিকৃতি হয় না। রশিকে সাপ-ভাবে দর্শন, মরুভূমিকে জল-ভাবে দর্শন প্রভৃতি প্রাপ্তিমূলক দৃষ্টি বিবর্তের দৃষ্টান্ত।




নির্বিকার ব্রহ্মই আপন মায়ার প্রভাবে দ্রষ্ট-দৃশ্য-দর্শন সমন্বিত জগৎরূপে বিবর্তিত হয়েছেন। এই বিবর্তনে ব্রহ্মের কোনোরূপ বিকার হয়নি। জাদুকরের মায়ার মতো এবং স্বপ্নকালের দৃষ্টির মতো ঈশ্বরের মায়াবশে এই মিথ্যা জগৎ সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মে সত্যরূপে প্রতিভাত হয়। ব্রহ্মের স্বরূপ উপাসনা পারমার্থিক সত্যমূলক ও তটস্থলক্ষণ (ঈশ্বরের সৃষ্টিরূপ বাহ্য লক্ষণ) উপাসনা ব্যাবহারিক সত্যমূলক। সুতরাং ব্রহ্মের তটস্থলক্ষণ-উপাসনা স্বরূপ-উপাসনার চেয়ে সহজে আয়ত্ত করা যায় বলে শাস্ত্ৰ অনেক জায়গায় তটস্থলক্ষণ ব্রহ্মের উপাসনার বিধান করেছেন। তটস্থলক্ষণ উপাসনায় নির্গুণ ও অচিন্ত্য ব্রহ্ম সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর, অন্তর্যামী, আদ্যাশক্তি, জগদ্ধাত্রী, দুর্গা প্রভৃতি সগুণ-রূপে উপাসিত বা পূজিত হন। এই উপাসনায় ব্রহ্মের অব্যক্ত-অচিন্ত্য স্বরূপ সচ্চিদানন্দ-ভাব প্রধান-ভাবে এবং তাঁর সৃষ্টি, কর্তৃত্ব প্রভৃতি লক্ষণ এবং তাঁর সৃষ্ট জগৎ অবলম্বন-ভাবে উপাসকের মনে বর্তমান থাকে। এটাই বাধিতের পুনরাবৃত্তিরূপ দ্বৈতাভাস।




লৌকিক বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষজনিত (ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয় বা অর্থের সংযোগজনিত) যে-আনন্দ—তা পূর্ণানন্দ দূরস্থ, খণ্ডানন্দ‌ও নয়! এটা আনন্দের আভাসমাত্র। এই আনন্দাভাস ভয়শূন্য নয়। যেখানে ভয়, সেখানে আনন্দ নেই! রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি থেকে ধার করছি:




"যে-দিন তুমি অগ্নিবেশে  সব-কিছু মোর নিলে এসে,
সে দিন আমি পূর্ণ হলেম ঘুচল আমার দ্বন্দ্ব।
দুঃখসুখের পারে তোমায় পেয়েছি আনন্দ॥"




ভৃগুর উপাখ্যানটি রূপক নয়। পুরাকালে তত্ত্বদর্শী পিতা পুত্রকে ব্রহ্মবিদ্যা দিতেন। তবে উপাখ্যানটিকে যুক্তিপরম্পরা ধরে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হতে হয়। অবশ্য অতিস্থূলত্বেও এর অনুরূপ ভাব একটু চিন্তা করলেই পাওয়া যায়। অন্নময়-প্রাণময়-মনোময়-বিজ্ঞানময়-আনন্দময় সমন্বিত পঞ্চকোষবিশিষ্ট শারীর-পুরুষ এখানে উপলক্ষ্যমাত্র।




ব্রহ্মজিজ্ঞাসুর পক্ষে ভৃগুর মতোই তপস্যা করা উচিত; কারণ ওটাই ব্রহ্মলাভের উপায়। যা-ই হোক, এই ভৃগুসম্বন্ধী (ভার্গবী) বিদ্যা হতে জানা যায় যে, জন্মবৃত্তান্তের সম্যক আলোচনার ফলে ধাপে ধাপে মুখ্য বস্তুতে পৌঁছানো যায় এবং এটাও জানা যায় যে, সাধারণত আমরা ‘আমি’ বলতে যে স্থূল বস্তুটিকে বুঝে থাকি, ওটাই ওই সম্বন্ধে শেষ কথা নয় এবং ওটা আদৌ ঠিক কথাই নয়। তবে হ্যাঁ, ওটা ঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। সেই হিসেবে, দেহতত্ত্বের সাধনা শেষমেশ যোগসাধনাই।




দেখা গেল, আমরা অন্ন-প্রাণ-মন-জ্ঞান-আনন্দ…এই পঞ্চকোষের মধ্যে আবদ্ধ থেকে প্রত্যেকটিকেই 'আমার', 'আমি' বস্তু বলে ভুল করছি। পঞ্চকোষ গণনায় পঞ্চম কোষ আমাদের শরীর সম্বন্ধীয় বলে তা মুখ্য আনন্দ নয়, বরং ওটার ওপারেই মুখ্য আনন্দ—দার্শনিকেরা এটা এভাবে বুঝিয়ে থাকেন। কোষের মধ্যে ব্রহ্ম বা পূর্ণানন্দ নয়, কোষের ওপারেই ব্রহ্ম বা পূর্ণানন্দ, তবে সেখানে পৌঁছাতে চাইলে কোষের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। আমাদের শরীর তিনটি—স্থূল শরীর, সূক্ষ্ম শরীর, কারণ-শরীর। অন্নময় কোষে গঠিত হয় স্থূল শরীর। পশু-পাখি, সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ নির্বিশেষে সাধারণভাবে সকল ভূতদেহ‌ই এর অন্তর্ভূক্ত। এল, থাকল, বাড়ল—বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলো, পরিণমিত হলো, শেষে নষ্ট হলো, অর্থাৎ এটা এই ছয় রকমের ভাব-বিকারী। উল্লেখ্য, পরিণমন হচ্ছে, রূপান্তরিত বা কাঁচা অবস্থা হতে পঞ্চাবস্থা তথা উত্তরাবস্থা প্রাপ্তি; যেমন নয়টি ভাব হতে বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী দ্বারা পরিণমিত হয়ে নয়টি রস উৎপন্ন হয়ে থাকে। রতি হতে শৃঙ্গাররস, হাসি হতে হাস্যরস, শোক হতে করুণরস, ক্রোধ হতে রৌদ্ররস, উৎসাহ হতে বীররস, ভয় হতে ভয়ানকরস, জুগুপ্সা হতে বীভৎসরস, বিস্ময় হতে অদ্ভুত রস এবং শম হইতে শান্তরস উৎপন্ন হয়ে থাকে।




ব্রহ্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—ব্রহ্মে উপরিলিখিত ষড়-বিকার ঘটে না। পরিদৃশ্যমান জগৎপ্রপঞ্চের যে অনন্ত বৈচিত্র‍্য, তার মূলে রয়েছে জন্ম (এল) প্রভৃতি ছয়টি ভাববিকার। নিরুক্তকার যাস্ক তাঁর গ্রন্থে আচার্য বার্ষ‍্যায়ণির মত উল্লেখ করে বলেছেন—




"ষড়ভাববিকারা ভবন্তীতি হ স্মাহ ভগবান্ বার্ষ‍্যায়ণিঃ। জায়তে অস্তি বিপরিণমতে বর্ধতে অপক্ষীয়তে বিনশ‍্যতীতি। অর্থন‍্যে ভাববিকারা এতেষামেব বিকারাঃ।”




মহর্ষি পতঞ্জলিও এই মতের সমর্থন করেছেন তাঁর 'মহাভাষ‍্য' গ্রন্থে।




এখন জন্ম, বিদ্যমানতা, পরিবর্তন, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও নাশ—এই ছয় ভাববিকারের অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রথমে ভাববিকার বিষয়ে জ্ঞান আবশ‍্যক। ভাববিকারের অর্থ বুঝতে গেলে, ভাব ও বিকারের আলাদা আলাদা অর্থ জানা দরকার। এই দুটি শব্দের অর্থ টীকাকারদের মতে বিভিন্ন।




১) এক পক্ষের মতে, ভাব শব্দের অর্থ ক্রিয়া। বিকার শব্দের অর্থ প্রকার।
২) অপরপক্ষের মতে, ভাব শব্দের অর্থ পদার্থ। বিকার শব্দের অর্থ অবস্থা।
৩) তৃতীয়পক্ষের মতে, ভাব শব্দের অর্থ শব্দ বা অর্থযুক্ত শব্দসমষ্টি, এবং বিকার শব্দের অর্থ অবস্থানভেদ।
৪) সর্বশেষ মতটি হলো: ভাব শব্দের অর্থ সত্তা বা মহাসামান‍্য, যার অপর নাম আত্মা বা পরব্রহ্ম। বিকার শব্দের অর্থ অবস্থান্তর প্রাপ্তি।




ছয়টি ভাববিকার হলো—




i) জায়তে: "জায়তে ইতি পূর্বভাবস‍্যাদিমাচষ্টে, নাপরভাবমাচষ্টে, ন প্রতিষেধতি।"
অর্থাৎ ‘জায়তে’ শব্দটি প্রথম বিকারের আদিকে (উপক্রম থেকে পরিসমাপ্তি পর্যন্ত প্রতিটি ক্রিয়ার শুরুর ব‍্যাপারসমূহকে) বোঝায়। এটি পরবর্তী অস্তিত্ব বা ভাবকে বোধও করায় না, আবার নিষেধও করে না।




ii) অস্তি: “অস্তীতুৎপন্নস‍্য সত্ত্বস‍্যাবধারণম্।”
অর্থাৎ 'অস্তি' কথাটি বললেই বোঝা যায়: যা জন্মেছে, তা বিদ‍্যমান আছে, তার ধ্বংস হয়নি। অস্তি-এর দ্বারা বিপরিণামের গ্রহণও হচ্ছে না, প্রতিবেধও হচ্ছে না।




iii) বিপরিণমতে: "বিপরিণমত ইত‍্যপ্রচ‍্যবমানস‍্য তত্ত্বাদ্বিকারম্।"
অর্থাৎ 'বিপরিণমতে' শব্দটি স্বরূপ হতে অবিচ‍্যুত দ্রব‍্যের তদ্ভাব অথবা স্বরূপ থেকে অন‍্যথাভাব বা পরিবর্তন বোধ করায়। তাই কোনো বস্তুর বিপরিণাম হয়েছে বললে বুঝতে হবে, অস্তিত্বরূপ স্বরূপ থেকে বস্তুটির বিচ‍্যুতি ঘটেনি, কিন্তু শুদ্ধ অস্তিত্ব থেকে তার বিক্রিয়া বা পরিবর্তন ঘটেছে। ‘বিপরিণমতে’ পদের দ্বারা বৃদ্ধির গ্রহণ বা প্রতিবেধ হচ্ছে না।




iv) বর্দ্ধতে: "বর্দ্ধত ইতি স্বাঙ্গাভ‍্যুচ্চয়ং সাংযৌগিককানাং বার্থানাম্।"
অর্থাৎ 'বর্দ্ধতে' পদটি স্বীয় অঙ্গের দ্বারা বৃদ্ধি অথবা সংযোগ সম্বন্ধে অবস্থানশীল দ্রব‍্যের দ্বারা বৃদ্ধিকে বোঝায়। 'বর্দ্ধতে' শব্দের দ্বারা অপক্ষয়ের গ্রহণও হচ্ছে না, প্রতিবেধও হচ্ছে না।




v) অপক্ষীয়তে: "অপক্ষীয়ত ইত‍্যনেনৈব ব‍্যাখ‍্যাতঃ প্রতিলোমম্।"
বৃদ্ধি শব্দের বিপরীত, অর্থাৎ 'অপক্ষয়' শব্দের অর্থ স্বীয় অঙ্গের অপচয়ে অথবা সাংযৌগিক (Compound) দ্রব‍্যের অপচয়ে অপচয় বা হানি। অপক্ষয় শব্দের দ্বারা বিনাশের গ্রহণ ও প্রতিষেধ হচ্ছে না।




vi) বিনশ‍্যতি: "বিনশ‍্যতীত‍্যপরভাবস‍্যাদিমাচষ্টে ন পূর্বভাবমাচষ্টে ন প্রতিষেধতি।"
অর্থাৎ 'বিনশ‍্যতি' শব্দটি অপরভাবের (প্রমাণে প্রমেয়ের অনুপস্থিত তবে সম্ভাব্য ভাব) আদি বা শুরুকে বোধ করায়; এটি পূর্ববর্তী ভাবকে অর্থাৎ অপক্ষয়কে বোধও করায় না, প্রতিবেধও করে না।




এই ভাববিকারবশত পদার্থের বৈচিত্র‍্য ও নানাত্ব সম্ভব হয়। কিন্তু জন্মাদি বিকারক্রিয়া বা ভাবস্বরূপ যা, তা পরিবর্তনযোগ‍্য। সেটা সিদ্ধ নয়, তার বহু বিভাগ ও তাদের পৌর্বাপর্য বা ক্রম-পরম্পরা বর্তমান। সুতরাং ভাব বা ক্রিয়া কালিক পৌর্বাপর্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। ভাববিকার বা ক্রিয়ার ভিত্তিস্বরূপ এই যে-ক্রম, তার মূলে যে-কাল, তা শব্দব্রহ্মেরই স্বতন্ত্র শক্তি। শব্দব্রহ্ম এই কালশক্তির প্রভাবে জন্মাদি ষড়বিধ ভাববিকারের উল্লাসের সাহায‍্যে বিশ্বের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে সমর্থ হন।




কাল অখণ্ড হলেও উপাধিভেদবশত অতীত, বর্তমান ও ভবিষ‍্যৎ—এই ত্রিবিধভেদ কল্পিত হয়, যার ফলে কালেতেও ভেদ আরোপিত হয় এবং এই কল্পিত ভেদ অবশেষে শব্দব্রহ্মে আরোপিত হয়। এর ফলে শব্দব্রহ্ম অদ্বৈত এবং ক্রমশূন্য হলেও কালের কল্পিত ভেদ আরোপের ফলে তিনিও নানান এবং পূর্বাপর ভাববিশিষ্টরূপে প্রতিভাত হন। এভাবেই জগৎ সৃষ্টি হয়।




এখন প্রশ্ন হতে পারে, কালশক্তি কীভাবে জন্মাদি ষড়ভাববিকারের নিয়ামক হয়?




এর উত্তরে ভর্তৃহরি বলেন, কালের দুইটি প্রধান শক্তি— প্রতিবন্ধ (বাধা দেওয়া) ও অভ্যানুজ্ঞা (অনুমতি দেওয়া) দ্বারা কাল জন্মাদি ছয়টি ভাববিকারের নিয়ামক হয়। সুতরাং আচার্য ভর্তৃহরি কালকেই লোকযন্ত্রের (বিবিধ স্থান-নিয়ামকের) সূত্রকার বা নিয়ামক বলে একটি উদাহরণ দিয়েছেন—




"প্রতিবদ্ধাশ্চ যাস্তেন চিত্রা বিশ্বস‍্য বৃত্তয়ঃ।
তাঃ স এবানুজানাতি যথা তন্তুঃ শকুন্তিকাঃ।।” (বাক‍্যপদীয়, ৩/১৫)




তন্তুর সাহায্যে যেমন শকুন্তিকার (ছোটো পাখির) গতি নিয়মিত হয়, অনুরূপভাবে কালশক্তিই প্রতিবন্ধ ও অভ‍্যানুজ্ঞারূপ ব‍্যাপার বলে বিশ্বের যাবতীয় বৃত্তিকে পরিচালনা করছেন। কালের কোনো স্বাতন্ত্র্য না থাকলেও কালাখ্য স্বাতন্ত্র‍্যশক্তির (যে-শক্তিতে সকলে শক্তিমান) আশ্রয় যে-শব্দব্রহ্ম, তিনি যথার্থই স্বতন্ত্র, অতএব এই বিশ্বপ্রপঞ্চের কর্তা।




শব্দব্রহ্ম মূলত অদ্বৈত হলেও কালাখ‍্য শক্তির আশ্রয়বশতই তিনি যেমন নানারূপে প্রতিভাত হন, ঠিক সেইভাবেই এক শব্দব্রহ্ম সকল পদার্থের বীজ অর্থাৎ কারণস্বরূপ হয়েও ভোক্তা, ভোগ‍্য এবং ভোগরূপে নানাভাবে বিরাজ করেন। ভর্তৃহরিকৃত এই বিষয়ে কারিকাটি হলো:




"একস‍্য সর্ববীজস‍্য যস‍্য চেয়মনেকথা।
ভোক্তৃ ভোক্তব‍্য রূপেন ভোগরূপেন চ স্থিতিঃ।।” (বাক‍্যপদীয়, ১/৪)




স্থূলশরীরে যখন 'আমরা' ব্যবহার করি, তখন আমাদের জাগ্রতাবস্থা—যদিও দার্শনিক দৃষ্টিতে এটাও নাকি একধরনের স্বপ্নাবস্থা—নিদ্রান্তভুক্ত বা ঘুমের শেষভাগভুক্ত। তখন স্থূল, সূক্ষ্ণ ও কারণ শরীর পিণ্ডিতভাবে অপৃথক হয়ে বিজড়িত থাকে। সেই জন্যই এই অন্নময় স্থূল শরীর হতে আমাদের ছুটি কম। এবং এরই সাহায্যে আমাদেরকে পার হতে হবে। সেই জন্যই বরুণ বলেছেন, শরীরই ব্রহ্মোপলব্ধির দ্বার।




ঠিক এরকমই আকৃতিবিশিষ্ট আমাদের সূক্ষ্ণশরীর—প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়—এই তিন কোষের একত্রীভূত সূক্ষ্মপদার্থ। আমাদের স্থূলশরীরের প্রথম অনুপস্থিতি বোঝা যায়, যখন আমরা স্বপ্ন দেখি। সেখানে শুধু সূক্ষ্ণশরীরের ব্যবহার। তখনকার শরীরটি তৈজস বা তেজোময় শরীর—নিজেই গড়ে, নিজেই দেখে; নিজেই উপাদানকারণ, নিজেই নিমিত্তকারণ, নিজেই দ্রষ্টা। আমাদের সেই সূক্ষ্মশরীরটি বর্তমান জন্মে সৃষ্ট হয়নি বটে, তবে তা পূর্ববর্তী অন্যান্য জন্মের সূক্ষ্ণশরীরের সাথে তুলনীয়ও নয়।




আমাদের এই জন্মের এই শরীরের যেমন শৈশব-কুমারাবস্থা-যৌবনাদি পরিবর্তন হয়, সূক্ষ্ণশরীরেও তেমনি প্রতিজন্মে এবং প্রতিজন্মের মধ্যেও নিয়ত বাসনাজনিত সংস্কারের হ্রাসবৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছে ও হচ্ছে। কিছু কিছু বোঝা কমে এবং কিছু কিছু বেড়ে ক্রমান্বয়ে অভিনবত্ব প্রাপ্ত হয়ে আসছে। জন্মে জন্মে এর এমন আচরণ। আদি‍ সৃষ্টিতে এর উৎপত্তি। সেই দৃষ্টিতে আমরা “অমৃতস্য পুত্রাঃ” বা অমৃতের পুত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুবাদ করছেন:




শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা।
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূঃ॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ২/৫)




বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্‌
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়॥
(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ, ৩/৮)




পদ্যানুবাদ:
“শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো, অন্য পথ নাহি।”




কেন এই উৎপত্তি, তা কেউ জানে না। যখন অজ্ঞাত কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তখনই জানে। শুধু স্থূল শরীর হতে অব্যাহতি পেলেই বা নিলেই কোনো লাভ নেই। লাভ নেই, অলাভ থাকতে পারে। জোঁক যেমন এক তৃণখণ্ড ছেড়ে অন্য তৃণে আশ্রয় করে, দূরের যাত্রী যেমন প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন পরিবর্তন করে, সূক্ষ্মশরীর তেমনি অন্য একটি অবলম্বন গ্রহণ করে। এই জন্যই ধীর-জ্ঞানী ব্যক্তিরা দেহান্তরকে যৌবন-বার্ধক্যাদি পরিবর্তনের অন্যতম বলেই গ্রহণ করেন; শোকগ্রস্ত হন না।




দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি॥
(গীতা, ২/১৩)




অর্থ: যেমন দেহীর (আত্মার) এই দেহে কৌমার, যৌবন ও জরা ক্রমে উপস্থিত হয়, তাহাতে দেহীর কোনো পরিবর্তন হয় না, সেইরূপ দেহান্তরপ্রাপ্তিতে (মৃত্যুতে) দেহী অবিকৃত থাকেন। মৃত্যু দৈহিক বিকারমাত্র। এইজন্য দেহান্তর-প্রাপ্তি বিষয়ে জ্ঞানীগণ মোহগ্রস্ত হন না।




বাল্যবিস্তারের পরে যৌবনাবস্থা উপস্থিত হয়, তা অবস্থান্তরমাত্র, এজন্য কেউ শোক করে না। তেমনি এক দেহ ত্যাগ করে অন্য দেহ গ্রহণও জীবাত্মার একটি অবস্থান্তর মাত্র। সুতরাং এতেও শোকের কারণ নেই।




এখানে 'মৃত্যু' না বলে বলা হয়েছে—'দেহান্তর-প্রাপ্তি', সুতরাং মেনে নেওয়া হলো যে, মরলেও জন্ম হয়। এটাই জন্মান্তরবাদ। আত্মার অবিনাশিতা ও পুনর্জন্ম, হিন্দুধর্মের এই দুইটি প্রধান তত্ত্ব। এখন প্রশ্ন এই: আত্মা যদি অবিনাশী, তবে দেহনাশের পরে এর কী গতি হয়?




স্বর্গ বা নরক ভোগ জীবের চরম গতি নয়। যা হতে জীবের উদ্‌ভব, সেই পরব্রহ্মে লীন হওয়া বা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়াই জীবের পরম লক্ষ্য ও চরম গতি। যে পর্যন্ত জীব তার উপযোগী না হয়, সে পর্যন্ত তাকে কৃতকর্মানুসারে বারবার দেহ ধারণ করে কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভোগ করা ছাড়া প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয় না। জীবের এই যে জন্মমৃত্যুচক্রে পরিভ্রমণ, এরই নাম সংসার (সং-সৃ: গমন করা)। এই সংসার ক্ষয় হয়ে কীভাবে জীবের ব্রহ্মনির্বাণ বা ভগবৎ-প্রাপ্তি হতে পারে, তা-ই সমগ্র হিন্দুদর্শন ও হিন্দুশাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়।




অবশ্য হিন্দুশাস্ত্রে, জীবের কৃতকর্মানুসারে স্বর্গাদি ভোগের ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু তা অনন্তকালের জন্য নয়। যে-কর্মবিশেষের ফলে স্বর্গাদি লাভ হয়, সেই কর্মের ফলভোগ শেষ হলে তাকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। মোক্ষ বা ভগবৎ-প্রাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত জন্মপ্রক্রিয়ার নিবৃত্তি নেই। গীতার ৮/১৬ শ্লোকেও এটি বলা হয়েছে।




আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোহর্জুন।
মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।।
(গীতা, ৮/১৬)




অর্থ: হে অর্জুন, পৃথিবী হতে ব্রহ্মলোক (ব্রহ্মভুবন) পর্যন্ত সপ্ত-লোকই পুনরাবর্তনশীল (অর্থাৎ ওই সকল লোক হতে মানুষ সংসারে পুনরাগমন করে)। কিন্তু হে কৌন্তেয়, আমাকে লাভ করলে আর পুনর্জন্ম হয় না।




জ্ঞানীগণ অনেকসময় মৃত্যুকে বরং ভালোই মনে করেন। ছেঁড়া কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরার মতো, এমনটা বলেন; পুরাতন ডিজাইনের গহনা ভেঙে নতুন ডিজাইনের গহনা পরার মতো বলেন। সুতরাং এই সূক্ষ্মশরীরকে ঠিকপথে চালিত করে এর ভার-বোঝা কিছু কমিয়ে দেবার চেষ্টা করা উচিত। স্বপ্নের মধ্য দিয়ে স্থূলশরীরেই সূক্ষ্মশরীরের অস্তিত্ব জানা যায় বলে স্বপ্নকে আমাদের শিক্ষক বা গুরু বলা যায়। স্বপ্ন আমাদেরকে বোঝায় যে, কোনো কিছু প্রতীতিকালে (ঘটনাটি ঘটার তথা ঘটনাটির অভিজ্ঞতালাভের সময় যে-প্রত্যয় জন্মে) সত্য হলেও তা প্রকৃতপক্ষে মিথ্যাও হতে পারে। তাই জাগ্রত প্রতীতিকেও (উপলব্ধি, জ্ঞান, প্রত্যয় বা বিশ্বাস) বরং দৃষ্টান্ত অনুযায়ী মিথ্যা সাব্যস্ত করাই সংগত। যে আমাকে একবার মিথ্যা কথা বলে ঠকায়, তাকে যেমন আমরা আর বিশ্বাস করতে পারি না, তেমনি আমাদের প্রতীতিকে আমরা কীভাবে বিশ্বাস করি?




সূক্ষ্মশরীর আমাদের স্বপ্নের আধার। এমনও তো হতে পারে যে, আমাদের স্থূল-সূক্ষ্ম-মিশ্রিত জাগ্রত শরীরটা, 'ভিন্ন আর-এক রকম' স্বপ্নের আধার। যদিও-বা তা না হয়, তবু দেখা যাচ্ছে যে, সূক্ষ্ণশরীর থাকলে প্রবাহক্রমে শরীররূপ স্বপ্নের পর স্বপ্ন চলতে থাকবে। বোঝা ক্রমান্বয়ে কিছু কিছু হালকা না করলে স্বপ্ন-পরম্পরা চলতেই থাকবে। স্বপ্নভঙ্গেই আনন্দ, আর আনন্দেই ছুটি। ভারীত্ব নিয়ে মুক্ত হওয়া যায় না।




এই সূক্ষ্মশরীরের অভ্যন্তরেও আমাদের আনন্দময় কোষ। যখন স্থূলসূক্ষ্ণমিশ্রিত বা শুধু সূক্ষ্ণশরীরের ব্যবহার করি, অর্থাৎ জাগ্রত-ক্রীড়াদি (‘নানাবিধ কর্ম’ অর্থে) করি বা স্বপ্ন দেখি, তখনও আনন্দময় কোষ তাতে ব্যাপ্ত থাকে। যখন সূক্ষ্মশরীরের উপাদান যেগুলি, সেই উপদ্রবকারী (‘পরিচালনাকারী’ অর্থে) ইন্দ্রিয়গণ এবং কামনাবাসনা আদি-অনর্থরাশির (যার মাধ্যমে মূঢ় ব্যক্তিগণ পরিচালিত হন) কারণে সাময়িক লীন হয়ে অনুপস্থিত থাকে, তখন আমরা শুধু আনন্দময় কোষ ব্যবহার করি। এতে শুধুই আনন্দানুভূতি। এটাই আমাদের দৈনন্দিন নিদ্রা—স্বপ্নহীন সুপ্তি। এখানেই আমরা সর্ব-উপদ্রবরহিত, নিশ্চিন্ত, অভয়।




কিছুকাল নিবৃত্ত থেকে আমাদের কর্মফল আবার আমাদেরকে ঠেলে কার্য-ব্যবহারে (কর্মফল ভোগের নিমিত্তেই কর্মে আবারও প্রবৃত্ত হতে) প্রণোদিত করে। ঠিক যেমন যেমন গচ্ছিত রেখেছিল, ঠিক তেমনই ফেরত দেয়—বদল হবার কোনো উপায় নেই—কর্মেই তার ফল নিহিত। এজন্যই একে কারণ-শরীর বলা হয়। স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীরের ব্যবহারাদি (অব্যক্ত, অখণ্ডিত) কারণ-শরীরে লীন থাকে মাত্র, যথাকালে তা যথারূপে প্রকাশিত হয়।




উপদ্রবরহিত বলে এই সুষুপ্তি আমরা অপছন্দ করি না। তবু কর্মজগতে আমাদের মনে হতে থাকে যে, এটা কিছুটা আমাদের বিনাশস্বরূপ। ঘুম ভাঙলে আমরা বলি, বেশ সুখে ঘুমিয়ে ছিলাম। (অর্থাৎ তখন শুধুই আনন্দময় কোষে ছিলাম।) কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও বলি— "কিছুই জানতে পারিনি।” আমাদের সে-কথার উদ্দেশ্য: আমরা যা জানতে চাই, তা জানতে পারিনি। মহাভ্রমবশত গতিবেগে (প্রবৃত্তি ও কালের প্রভাবে) ইন্দ্রিয়মারফত যে-বিষয়াদি আমরা (ভুল করে) জানতে চাই, তা জানতে পারিনি। সেটাই আফসোসের বিষয় হয়। কিন্তু এর তাত্ত্বিক ইঙ্গিত এই যে, মুখ্যত যা আমাদের একমাত্র জ্ঞাতব্য, তা জানা হয়নি। অজ্ঞানাবৃত সুষুপ্তিতে কী লাভ হলো তবে? বস্তু তো অগৃহীতই র‌ইল—আগে যা ছিল, তা-ই।




তাহলে কী চাই? গ্রহণ কীসে হবে? চাই সচেতন সুষুপ্তি। একেই সমাধি বলা হয়। যোগসমাধি যোগলভ্য বটে, কিন্তু সমাধি বিচারলভ্যও বটে; পদার্থ যদিও একই। উভয়ই ভগবৎ-কৃপাসাপেক্ষ। সেজন্য চাই জাগরবিক্ষেপ হতে জাগ্রদ্‌বিরতি, অর্থাৎ পার্থিব চেতনায় জেগে ওঠার তাড়না থেকে মুক্তি। ঘড়ির মতো অবিরত বিষয়-ইন্দ্রিয়-সংযোগে আকাঙ্ক্ষা ও তার সাধনে আমরা লিপ্ত থাকি ৷ তাই সময় সময় ছুটি নিতে হয়। ছুটিটা উৎসবের দিন। উৎসব আনন্দের জন্য, আনন্দসাপেক্ষ। আনন্দই তো ভগবান। তাই সেই ভগবদ্‌চেতনায় জন্মের দিনে ভগবদ্‌স্মরণ দ্বারা বিরতিলাভ এবং আনন্দোৎসবই বিধেয়।




আপত্তি তোলা যায়—কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না—পঞ্চকোষ ত্রিবিধ শরীর, জাগ্রদাদি বিবিধ অবস্থা, জন্মমৃত্যুপ্রবাহ ইত্যাদি কথা হচ্ছিল, ভালো কথা—কিন্তু এখানে ভগবান এসে উপস্থিত হলেন কী করে? তার উত্তর এই যে, ভগবানের স্বভাবই এই— সর্বদাই উপস্থিত—নিজেকে অব্যাহত রেখে অতিবিরুদ্ধ বস্তুর মধ্যেও যুগপৎ সম্যক উপস্থিতি। এ এক অত্যাশ্চর্য স্বভাব। ভগবান তো এসে পড়বেনই—ডাকলেও আসবেন, না ডাকলেও আসবেন। জানলে তো এসেছেনই, না জানলেও এসেছেন। তাঁর যাওয়া নেই, সেজন্য আসাও নেই। আসা-যাওয়াই নেই—"একং সদৈকরসম্" (ভাস্করানন্দ)। বুদ্ধি অহঙ্কার, সব ধরনের উপাধি বিনির্মুক্ত এবং পঞ্চকোষাতীত 'আমি'র-ও তো মনে হতে পারে… একং সদৈকরসম্—যাক, আমি থাকি না থাকি, তিনি সর্বদাই আছেন। তিনি নেই, তা যখন অসম্ভব, তখন আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণই—




ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি॥
(গীতা, ৫/২৯)




অর্থ: কর্তা ও দেবতারূপে আমি যজ্ঞ ও তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সকলের উপকারী সুহৃদ—এই প্রকারে আমাকে স্বীয় আত্মরূপে জেনে যোগী শান্তি (মুক্তি) লাভ করেন।




'আমাকে জেনে' অর্থাৎ ভগবানকে জেনে শান্তিলাভ করেন। ভগবান লাভ করলে শান্তিলাভ হবে। আনন্দময় ভগবান—সুতরাং আনন্দে তিনি ব্রহ্মলোকে থাকবেন—ঈশ্বরীয় ভোগলাভ হবে। পুনর্জন্ম হবে না। তবে যদি ঈশ্বরকে নিজ আত্মার সঙ্গে অভিন্নরূপে অনুভব করেন, তাহলে তাঁর শান্তি অর্থে মুক্তিলাভ হবে। তা না হলে 'যজ্ঞ ও তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোক মহেশ্বর ও সকলের উপকারী সুহৃদ'—শ্রীভগবান‌-ই, তাঁকে অর্থাৎ সগুণ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হলে ক্রমমুক্তি হবে। এখানে ক্রমমুক্তিই বলা হয়েছে। মাধবাচার্যের দ্বৈত এবং রামানুচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত অনুসারে, ব্রহ্মকে সগুণ ব্রহ্ম (ব্যক্তিগত দেবতা) বা ঈশ্বর (মহাবিশ্বের প্রভু) রূপে অসীম গুণাবলী-সহ কল্পনা করা হয়েছে।




এই অনাহূত অতিথিকে খুঁজে বের করে সম্যক সংবর্ধনা করা যাক। এর ফল কী? যুক্তিতে বোঝা যায় না। ঋষিদের অভিজ্ঞতাই এখানে গ্রাহ্য। ভগবান নিজমুখেই তো বলেছেন—




তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে॥
(গীতা, ১০/১০)




তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ।
নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা॥
(গীতা, ১০/১১)




অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্॥
(গীতা, ৯/২২)




অর্থসমূহ:
(গীতা, ১০/১০)
আমাতে সদাযুক্ত প্রেমভাবে ভজনশীল সেই সাধকদের আমি বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমাকে লাভ করেন।




(এখানে ‘বুদ্ধিযোগ' শব্দে ভগবানের তত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞানকে বোঝানো হচ্ছে, যার দ্বারা সে-সকল ভক্ত সকলের আত্মভূত পরমেশ্বরকে জানতে পারেন।)




(গীতা, ১০/১১)
তাঁদের প্রতি অনুকম্পার জন্যই আমি তাঁদের আত্মভাবে স্থিত হয়ে বিবেকজ্ঞানরূপ ভাস্বর প্রদীপ দিয়ে তাঁদের অজ্ঞান থেকে জাত মিথ্যা বোধরূপ মোহান্ধকার দূর করি।




(এরূপ ভগবদ্‌প্রেমী ভক্তদের কৃপা করে তাঁদের অজ্ঞান-জাত তমঃ ভগবান নাশ করেন, এবং ভক্ত তখন ভগবদ্‌কৃপায় জ্ঞানলাভ করেন। ভক্তি এভাবেই জ্ঞানেতে পর্যবসিত হয়।)




(গীতা, ৯/২২)
অনন্যচিত্ত হয়ে আমার চিন্তা করতে করতে যে-ভক্তগণ আমারই উপাসনা করেন, আমাতে নিত্যযুক্ত সেই-সমস্ত ভক্তের যোগ ও ক্ষেম আমি বহন করে থাকি, (অর্থাৎ তাঁদের প্রয়োজনীয় অলব্ধ বস্তুর সংস্থান এবং লব্ধ বস্তুর রক্ষণ করে থাকি)।




(সকলের খাবারের ব্যবস্থাই তো ভগবান করে রেখেছেন—তবে জ্ঞানীর জন্য এই বিশেষ কথা বলার প্রয়োজন কী? জ্ঞানী—আত্মা ভিন্ন অন্য কিছু সত্য নয়, এটা জেনে নিজ জীবনরক্ষার জন্যও চেষ্টা করেন না—অপরের মুখাপেক্ষীও হন না। তাই ভগবান বলছেন, ওসব জ্ঞানীর ভার আমি নিই। জ্ঞানী অনেকে অজগর বৃত্তি বা আলসেমি ধারণ করেন—তাঁদের জীবনধারণোপযোগী সকল বস্তু তবু ঠিকই এসে যায়। বহু মহাত্মার জীবনে এটি প্রমাণিত সত্য। ভক্তের ভার ভগবানই বহন করেন—এটা যদি না হতো, তবে ভগবদ্‌ভক্ত সন্ন্যাসীগণ অনাহারেই মৃত্যুবরণ করতেন।




দিনরাত ঈশ্বরচিন্তা করব বা সর্বভূতের হিতসাধনে, দেশের কাজে, দশের কাজে ব্যস্ত থাকব, তবে সংসার-চিন্তা, দেহের চিন্তা করব কখন? দেহরক্ষা না হলে ঈশ্বরচিন্তাও হয় না, দশের কাজও হয় না— এটাই হলো সংসারীর সংশয় ও প্রশ্ন। এ-সম্বন্ধে নজিরস্বরূপ অনেক মহাজনবাক্যও তিনি উপস্থিত করতে পারেন। যেমন ‘জীবন্ ধর্মমবাপ্নুয়াত্’—নিজে বাঁচলে তবে ধর্ম (বিশ্বামিত্র); ‘আত্মানং সততং রক্ষেৎ’—’আত্মায় না রক্ষিলে দুঃখ যে অপার’ (মনু); ‘আত্মার্থে পৃথিবীং ত্যজেৎ'—আত্মাকে বাঁচাতে পৃথিবীকেও ত্যাগ করা যায় (বিদুর); ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম্'—শরীর-মন সুস্থ না থাকলে জাগতিক বা পারমার্থিক কোনো কর্মই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব নয় (কালিদাস) ইত্যাদি।




এর উত্তরে শ্রীভগবান বলছেন, যাঁরা নিত্যযুক্ত হয়ে সতত আমারই চিন্তায়, আমারই কর্মে মগ্ন থাকে, তাঁদের যোগক্ষেম আমিই বহন করি, অর্থাৎ দেহাদি-রক্ষণের ভার আমিই গ্রহণ করি।




তবে কি অন্যের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা ঈশ্বর—তাঁর ভক্ত না হলে—করেন না? না, সে-ব্যবস্থাও তিনি করেন; তিনিই ভূতধারক, ভূতপালক, সর্বভূতের সুহৃদ। তবে তাঁদের চেষ্টা করতে হয়, নিত্যযুক্ত ভগবদ্‌ভক্তের চেষ্টা করতে হয় না—কোনো-না-কোনো এক উপায়ে সকল সংস্থান হয়েই যায়—এখানেই পার্থক্য। প্রকৃতপক্ষে, সুকৃতিবলে যাঁদের ঐকান্তিক ভগবদ্‌ভক্তি বা সর্বত্র সাম্যবুদ্ধি উৎপন্ন হয়, তাঁরা ব্যাবহারিক বুদ্ধি-সহকারে হিসাব-নিকাশ করে ভগবদ্‌কর্মে নিযুক্ত হন না; তাঁরা স্বভাববশে অবশভাবেই সেই ভগবদ্‌কর্মে লেগে থাকেন। সহজ কথায়, অন্য চিন্তায় তাঁদের মন যায় না, তাঁদের নিজ দেহরক্ষা বা পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনাদির ব্যবস্থাও ঠেকে থাকে না। তবে এমন দৃষ্টান্ত অতি বিরল; এর কারণ, এরূপ অনন্যচিত্ততাও অতি বিরল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মহাপ্রাণ শ্রীলালদাসবাবাজি বিরচিত 'শ্রীভক্তমাল' গ্রন্থের চরিত্র শ্রীঅর্জুন মিশ্রের রূপকাশ্রয়ী বিখ্যাত দৃষ্টান্তটি মাথায় আনা যেতে পারে।




শ্রীধরস্বামীর মতে, 'যোগক্ষেম' শব্দের অর্থ মুক্তি। কঠোপনিষদে (১/২/২) 'যোগক্ষেম' শব্দটি 'শ্রেয়' অর্থে ব্যবহৃত। বৌদ্ধশাস্ত্রেও 'যোগক্ষেম' শব্দটি 'নির্বাণ' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ধম্মপদে আছে—




তে ঝায়িনো সাততিকা নিচ্চং দল্বহপরক্কমা। ফুসন্তি ধীরা নিব্বানং যোগক্ষেমং অনুত্তরং॥
(অপ্পমাদো বগ্ গো, ৩)




সেই সকল সতত চেষ্টাশীল এবং নিত্য দৃঢ়পরাক্রম ধ্যানীগণ পরম শান্তিরূপ নির্বাণ লাভ করেন। বৌদ্ধ নির্বাণ ও বৈদিক মুক্তি একার্থ-বাচক। শ্রীধরস্বামী প্রদত্ত অর্থ অধিকতর সমীচীন মনে হয়। কারণ, মুক্তিই মুমুক্ষুর একমাত্র কাম্য ও প্রয়োজনীয়—যা দান করার সমস্ত দায়িত্ব ভগবান নিজেই নিয়ে নিয়েছেন গীতার এই শ্লোকমুখে। ভগবানের শ্রীচরণাশ্রিত হয়ে মুক্তির সামীপ্যেই রয়েছেন যিনি, তাঁর আর কীই-বা অপূর্ণতা থাকতে পারে!