ছিন্নস্মৃতি

বুঝলি রেণু, আজ‌ও মনে হয়, বছরকতক আগের কথা...
সবে ঘন স্বর, শক্ত চোয়াল, এখানে-ওখানে দাড়ির ছিটেফোঁটায় আমি বাড়ন্ত কিশোর এক।
অনুভূতির ক্ষুধায় উন্মত্ত দিন কাটে কীসের যেন প্রতীক্ষায়!
ঠিক কীসের জন্য এত প্রতীক্ষা, ঠাওর করতে পারিনি সেসময়।




পাড়ার কাকিমারা চোখ উঁচিয়ে বলত, বিয়ে কর, ছোকরা!
এ-পাড়ার বীণা, ও-পাড়ার রাধা, বামুনপাড়ার শৈলী কিংবা খানবাড়ির মৌরি...
লাল-দেঁতো কাশেম দারোয়ান হেসে বলত,
দাদাবাবু, যাবেন নাকি রমণপাড়ায়? খাসা পাখি আছে!
বলত আর বলত...
বিদঘুটে দেখতে লালসার সঙ্গে ওই প্রথম পরিচয়।




আহা রেণু, অমন ভুরু কোঁচকালি যে!
পাপের তাপ লেগেছে বুঝি গায়ে?
পরিচিত হলাম বটে, ছুঁইনি কখনও ওই শীতল পাপ!
তিন গাঁয়ের লোক জানত, বাপ আমার বেশ সম্ভ্রান্ত।




সেদিন পৌষের তেরো, কানাগলি ঘুরে হঠাৎ তিন-মুখর-সন্ধেয় কাজল ভেবে ছুঁয়েছিলাম অভিশাপ।
সেই থেকেই তো পালানো শুরু। পালাচ্ছিই তো পালাচ্ছি...
তারপর অনেক ঘুরেছি আমি মহাকাল জুড়ে, অনেক গিলেছি ব্যথা,
যাপিত জীবনে দেখা দিয়েছে অনেক দিনের শেষে বলিরেখা,
এবং এ-ক্ষণে আমি অশীতিপর এক বৃদ্ধ যাযাবর!




যা ছিল না, হয়নি কখনও, তার জন্য নেই আফসোস।
আর যা আছে ওর, তার কিছুই নেই হারাবার।
শিরদাঁড়া বেয়ে ক্রমশ ধেয়ে আসছে মরণ,
অবশিষ্ট যে ক'টা নিঃশ্বাস, তার সব‌ই জড়ো করেছি আজ।
যাবার আগে তবে লিখে যাচ্ছি বিবরণ সবিশেষ...
আহ্! কাঁটাতারে ঝুলছে ওই আমার স্বপন...যতখানি রেখেছি স্মরণ!




জানিস, আমি কী দেখেছি! দেখেছি, গল্পের পাতাভর্তি তৃষ্ণা!
জল নয়, সে চাইত অশ্রু...থকথকে লোনা অশ্রু!
এ তৃষ্ণা আদিম, মাংসের প্রতি হিংস্র হায়েনাদের আজন্ম ক্ষুধার মতন তীব্র!




আমি দেখেছি, স্বপ্নের ডালাভর্তি শুধুই কামনা!
স্নেহ নয়, তার চাই বিছানায় মাখানো শরীরের স্বাদ! 
ওই দৃষ্টি ঘন কাদার মতন অস্বচ্ছ, পথ ধরে যতটা এগোয়,
লোহার বর্মচ্ছেদ করে গভীর থেকে গভীরে ততোধিক নগ্নতা ছড়ায়!




আমি শুনেছি বাগানে বাগানে তার স্বরে ফুলেদের গোঙানি...
তার চাই মধু...বুঝেছিস, সৌরভ নয় রে!
চুমুকে চুমুকে আত্মাসুদ্ধ খেয়ে ফেলার উগ্র মাদকতা!
ভুল করিস না। আদতেই নয় এ প্রেমের উষ্ণতা; এ মাদকতা, যা শুধুই রক্ত ঝরায়!




আমি উঠে এসেছি বাঁক-ঘোরানো ইতিহাস থেকে ওর ত্রাস-জাগানিয়া ডাক শুনতে...
গ্রামোফোনে খসখসে উল্লাসধ্বনি...যেন আগুনের শিখাতেও হিম জমিয়ে যায়!
এ ছিল না মোটেই রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, ছিল শ্বাসরুদ্ধকর শীতল হিংস্রতা!




সে গাইত চোখে সুরমা মেখে, আমি শুনতাম রক্তের বুদবুদ-ফাটা শব্দ!
আধফোটা জ্যোৎস্না পেলে সে খিলখিল করে হাসত,
আমি দেখতাম, হাওয়া বড়োই উষ্ণ, অথচ রাতটা ভয়ানক শীতল!
আকাশে মেঘ করলেই সে বৃষ্টিতে ভিজত, আমি স্পষ্টই বুঝতাম, সে অনুভূতির খেলায় মত্ত!




আলস্যে-ভরা সকালগুলো সে গন্ধরাজে করেছে পূর্ণ,
সে ফুলের গন্ধে জেনেছি, তার প্রতিটি কলি আঁচড়ে আঁচড়ে জর্জরিত!
শরৎ এলেই অক্ষরের গর্ভে সে কবিতার জন্ম দিত,
ফেলে-দেওয়া কলমটা সাক্ষ‍্য দিয়ে গেছে,
প্রতিটি খোঁচায় কবিতা কীরকম নিদারুণ কষ্ট পেত!
প্রতি সন্ধেয় নিয়ম করে তার দীপ জ্বালা চাই,
পুড়তে-থাকা সলতে ধোঁয়ার ঘোরে রেখে গেছে লিখে,
বারোটা শিখায় বারোটা বসন্ত নিমিষেই পুড়ে ছাই!




পূর্ণিমা হলেই আলতা পরত পা'য়,
নূপুরে টুংটাং সুর তুলে হেঁটে যেত পাঁচিল ধরে,
আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখতাম,
সদ্যগজানো আগাছাগুলো কীভাবে সম্ভ্রম নিয়ে ধায়!
বেলা গড়ালে যখন ঝিমিয়ে পড়ত পাড়ার ভবঘুরে কোকিলটা, তখন দেখেছি তাকে,
বীণায় ঝড় তুলে মধ্যদুপুরে পাতা সংসার ভেঙে তাড়িয়ে বেড়াত ওঁকে...
লোক‍ে বলত, নাম ছিল তার অখিলদা।




বুঝলি রেণু, গুনে গুনে ক'টা বসন্ত গেল হিসেব রাখতে আর পারিনি!
কতখানি আলতা জলে ধুয়ে হয়েছে বিধবা, তার রাখতে পারিনি খোঁজ, লিখিনি একটাও কবিতা!




তোর ঠাম্মা বলত, অনামিকার ডগায় হুল ফুটিয়ে লোনাজলে ভিজিয়ে রাখ।
রূপের ঘায়ে সুর হারিয়ে বোবা হয়েছিস, এখন কী আর ঠাকুরঘরে দীপ জ্বালবি!
আমি কলম উঁচিয়ে বলতাম,
মা, তাকিয়ে দ্যাখো, চৌকাঠে কাচের গুঁড়ো, বিছানায় রক্তের গন্ধ,
বালিশের নিচে ধোঁয়া-ওঠা ওম,
জানালায় বিক্ষিপ্ত মগজ, টেবিল জুড়ে কথার স্তূপ, 
বইয়ের পাতায় খণ্ড খণ্ড হৃদয়, আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে অবিশ্বাসের তিক্ত ছোঁয়া,
আয়নায় আয়নায় চলছে ছায়াবাজির খেলা,
ফুলদানিটাতে পড়ে আছে আবেগের শুকনো ডালপালা,
মোমবাতিটাও ছেয়ে গেছে বিষাদের নীলে!
স্থির শিখা থেকে থেকে দেয়ালের ঘাড়ে ফেলছে তপ্ত শ্বাস...
কেউ একটু জল এনে দেবে?




ফেলে-যাওয়া আলতার কৌটোয়, ওই দ্যাখো মূর্ছিত সুখ,
বাগানের ল্যান্টানা ফুলে ফুলে অযাচিত সুগন্ধ,
স্থির দোলনায় ঝিমুতে থাকা আমার স্বপ্ন...
মা, দীপ জ্বলেনি বহুবছর হেরে-যাওয়া আমার দু-চোখে!
বলতে পারো, ঠাকুরঘরে দীপ জ্বালাব আমি কোন সুখে?




ভাঙাচোরা দু-খানা বাহুতে শত বৎসরের মরচে, ঘন নিঃশ্বাসের ঝাপটা, ক্ষতবিক্ষত আমার আত্মা,
কালশিটে শিরা, ঘুণেধরা দৃষ্টি, কপালের ভাঁজে লুকানো চিঠি,
হাড়গিলে দেহটাও মুড়েছি শতছিন্ন বস্ত্রে! 
বুঝলি রেণু, আমি এক হাতে-লেখা কাব্য
...মহাকালের।