আগে পজিশন, পরে পরিণয়

এ পৃথিবীতে বিয়ে এক অদ্ভুত জিনিস। একটা মানুষকে চেনার জন্য অনেকগুলো রাস্তা থাকতে পারে। সবচাইতে অব্যর্থ রাস্তাটি হচ্ছে: তাকে বিয়ে করা। অর্থাৎ একমাত্র কাউকে বিয়ে করলেই জানা যায়, মানুষটা আসলে কেমন!




আপনি একটা মানুষের সঙ্গে দশ বছর‌ও প্রেম করতে পারেন! সেই দশ বছর প্রেমের পর তাকে বিয়ে করলে তিন মাসের মধ্যেই বিয়েটা ভেঙে যেতে পারে! হয়তোবা আপনি যেরকম, মানুষটা সেটা পছন্দ করে না। মানুষটা যেরকম, আপনি সেটা পছন্দ করেন না। বিস্ময়ে বলতে পারেন, দশ বছরের মধ্যে মানুষটাকে তো এরকম কখনও দেখিনি!




এর কারণ কী? খুব সহজ! সেই দশ বছর তো আপনাকে পাবার জন্য তার একটা ইচ্ছা ছিল। যখন সে আপনাকে পেয়ে গেছে, তখন তার প্রকৃত চেহারা দেখাতে আর অসুবিধা কোথায়! সে তখন তার চেহারাটা দেখিয়ে ফেলে। আপনি যখন বিয়ে করবেন, শ্বশুরের ফ্যামিলিতে যাবেন, তখন কিন্তু আপনি হয়তোবা সেই ফ্যামিলির একটা ভিন্ন রকমের চেহারা দেখতে পাবেন, সেই ফ্যামিলির কিছু ছোটোলোকি আপনি দেখতে পাবেন!




স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে যৌতুকের জন্য শ্বশুরবাড়িতে নিগৃহীত হতো! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মেয়ের শ্বশুরেরবাড়িতে যখন গিয়েছিলেন, তখন তাঁকে ঠিকমতো বসতে দেওয়া হয়নি, তাঁকে সম্মানের সাথে আপ্যায়ন করা হয়নি! ভাবতে পারেন! সেখানে আপনি আমি আমরা কোন ছার যে আমরা এই ব্যাপারটা নিয়ে এত এত ভালো ভালো কথা ভাবছি! যে ফ্যামিলিতে আপনার বিয়ে হবে, সে ফ্যামিলিতে যৌতুকের জন্য হোক বা অন্য কোন‌ও বিষয়ের কারণে হোক, হয়তোবা আপনি অত্যাচারিত হতেও পারেন, অন্যায়ভাবে! তখন যদি আপনার কোনও খুঁটির জোর না থাকে, আর্থিক সাপোর্ট না থাকে, তাহলে আপনি সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেলে করবেনটা কী!?




আরও একটা সত্য কথা বলি। যেসমস্ত মেয়ের একটা আর্থিক সাপোর্ট রয়েছে, চাকরি রয়েছে, তারা কিন্তু শ্বশুরের ফ্যামিলিতে অধিক সম্মানিত হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের স্বামীও বুঝেশুনে কথা বলে, শ্বশুরের ফ্যামিলির লোকজনও চিন্তা করে কথা বলে! পয়সা একটা বড়ো মোটিভেশন প্রায় মানুষের‌ই---এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। আপনি শুধু পয়সার জন্যই চাকরি করবেন না, চাকরি করলে আপনার একটা সামাজিক অবস্থান‌ও তৈরি হবে। তখন আপনাকে একটা কথা বলার সময় লোকজন অন্তত দশ বার চিন্তা করবে।




আমার নিজের কথাই ধরি। আমাকে ফেইসবুকে, কমেন্টে অনেকগুলো কথা বলে যাওয়াটা সোজা। কিন্তু আমার অফিসে গিয়ে কথাগুলো বলে আসাটা খুব কঠিন---এটা মনে রাখবেন। আপনাদের চ্যালেঞ্জ করছি। আপনাদের সাহস থাকলে অফিসে এসে অমন কল্পনাপ্রসূত আজেবাজে কথাগুলো বলে যান। আমি অফিসে সবসময়ই থাকি, প্রতিদিন নয়টা থেকে কমপক্ষে পাঁচটা পর্যন্ত আমাকে অফিসে পাবেন। কাজের চাপে ৮টাও বাজে বের হতে হতে। আপনি আমার অফিসে আসুন! রং-চা খেতে খেতে কথাগুলো বলুন, যদি আপনার বুকে সাহস থাকে। সামনাসামনি বসেই নাহয় গল্পটা জমে উঠুক!




একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার একজন বিশিষ্ট কমেন্টনিষ্ঠ হেইটার; সে ফেইসবুকে আমার ওয়ালে, নিজের ওয়ালে এবং বিভিন্ন জায়গায় আমাকে নিয়ে বিভিন্ন ফালতু কথাবার্তা লেখে; তাকে আমি চিনি। আমার অফিস তখন আগ্রাবাদে। একদিন দেখলাম, সে কোন‌ও একটা কাজে অফিসে এসেছে। অফিসে আসার পরে আমি তাকে কমিশনার স্যারের রুমে ঢুকতে দেখলাম এবং আমি সেই ভদ্রলোককে বললাম, ভাই, কেমন আছেন? আমাদের ওই অফিসের বারান্দায় থতমত খেয়ে সে বলে, স্যার, ভালো আছি। আমি বললাম, আপনি তোতলাচ্ছেন কেন? উত্তরে সে বলে, স্যার স্যার...! আমি আপনার অনেক ফ্যান! অনেক ভক্ত! আপনাকে সামনাসামনি দেখে ঠিকভাবে কথা বলতে পারছি না, স্যার!




ফ্যান-ভক্ত-ফক্ত এগুলো শুনলে ভীষণ ফালতু লাগে, বাজে অনুভূতি হয়! এগুলো আমার কাছে বিশ্বাস হয় না। মানে আমি আসলে বুঝে ফেলি, আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন এসব বলে-টলে। তাকে বললাম, ওহ আচ্ছা! থ্যাংক ইউ, ভাই! থ্যাংক ইউ! আমি বোধ হয় আপনাকে চিনি। হ্যাঁ, তাকে আমি খুব ভালো করেই চিনতে পেরেছিলাম। কারণ তার কাজ হচ্ছে, সুশান্ত পালের প্রত্যেকটা পোস্টে গিয়ে গিয়ে বাজে কমেন্ট করে আসা। সে একটা কোম্পানির এক্জিকিউটিভ। সে আমাদের একজন সম্মানিত স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধি, ট্যাক্সপেয়ার।




তখন আমি তাকে বললাম, ভাই, আপনি কাজ শেষ করে যাবার সময় আমার রুমে একটু আসবেন। আমার রুম হচ্ছে ওটা, ওখানে আমি বসি, একটু আসবেন, কেমন? আমরা দুই ভাই মিলে চা খাবো।...একদম এইভাবেই বলেছি কথাটা যে...ভাই, আমরা দুই ভাই মিলে চা খাবো, আপনার সঙ্গে গল্প করব। ওদিকে তার কিন্তু মনটা পুলিশ-পুলিশ! চোরের মন তো, তাই পুলিশ-পুলিশ! সে তো আমার রুমে কিছুতেই আসবে না। এদিকে আমি আমার সিপাইকে বলছি, ভাই, একটু দেখুন, উনি কমিশনার স্যারের রুম থেকে বের হবার পর আমার রুমে একটু নিয়ে আসবেন, আমরা একসঙ্গে বসে রং-চা খাবো। আপনি প্লেটে বিস্কুট দিয়েন, আমি একটু কথা বলব। আমি তাঁকে চিনি। উনি আমার বন্ধু।




সেই লোকটার কাছে গিয়ে আমার সিপাই তাকে এত অনুরোধ করল এই বলে, ভাই, আপনাকে সুশান্ত স্যার ডাকছেন, একটু আসুন। প্রিয় পাঠক, আপনারা বিশ্বাস করুন, আমার সিপাইয়ের কথা শুনে সে পালাতে পারলে বাঁচে! সে বলে, আজ আমি আসব না। আমার কাজ আছে! আমার সিপাই বলে, স্যার, উনি আসবেন না। উনার নাকি অফিসে কাজ আছে! আমি রুম থেকে বের হলাম! বের হয়ে বললাম, ভাই, আপনি একটু আসুন, আপনার সঙ্গে দুইটামিনিট কথা বলব! আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা বলা দরকার। কিছু বিষয় জানা দরকার।




তাকে ওভাবে ডাকার কারণ, আমি দেখেছি, সে এত বাজে বাজে কথা বলে আমার ওয়ালে এসে, আমাকে নিয়ে এত বিশ্রী বিশ্রী পোস্ট ও কমেন্ট করে বিভিন্ন জায়গায়, এই ব্যাপারটা আমার জন্য একটু অস্বস্তিকর! আমি তাকে বলি, ভাই, আপনি আসুন, কোনও অসুবিধা নেই, আমরা শুধু চা খাবো। তখন সে কী বলে জানেন! কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলে, স্যার, আমার একটু বড়ো বাথরুম পেয়েছে, আমাকে একটু বাথরুমে যেতে হবে! এদিকে আমিও নাছোড়বান্দা! বললাম, ভাই, আমাদের এখানে ওয়াশরুম আছে, আপনি ওয়াশরুমে যান। শুনে সে বলে, না, স্যার! আমার অফিসেও কাজ আছে। আমাকে ফোন করছেন এমডি স্যার। আমাকে যেতে হবে এখন‌ই।




এটুক বলেই আক্ষরিক অর্থেই সে ওখান থেকে পালাল! তাই বলছি, সুশান্ত পালের সামনে এসে কথা বলা কঠিন। ওরকম কমেন্টে অনেক কথা লিখতে পারবেন, সামনে এসে সাহস করে তেমন কিছুই বলতে পারবেন না! আমি সেই অবস্থানে চলে গেছি, সৃষ্টিকর্তা আমাকে সেই অবস্থানে নিয়ে গেছেন, আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আপনিও সেই অবস্থানে যেতে পারবেন। সেই অবস্থানে যাবার চেষ্টা করুন! ভালো কথা, আমার ধারণা ছিল, সেই ছেলেটি বেকার, ওর একটাই কাজ: আমার হেইটার হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্বপালন করা। পরে দেখলাম, না, সে বেকার নয়, সে একজন বিশিষ্ট পলায়নশিল্পী!




মেয়েদের বলছি, তোমরা একটা ভালো পজিশনে যাবার আগে যদি শ্বশুরবাড়িতে ঢুকে যাও, তবে অনেকগুলো রিস্ক মাথায় নিয়েই তোমাকে শ্বশুরবাড়িতে সংসার করতে হবে! সেই রিস্কগুলো তুমি কতটা সামলাতে পারবে, কতটা মাথায় নিতে পারবে---এর সব‌ই তোমার ব্যাপার। তোমাকে যে যা-কিছুই বলুক না কেন, মেয়ে, তুমি যখন কষ্ট পাবে, তুমি যখন সাফার করবে---আমার কথাটা কোথাও লিখে রাখো, যদি তোমার সামনে কাগজ থাকে, তবে সত্যি সত্যি লিখে রাখো---তখন তোমার পাশে তুমি কাউকেই পাবে না। তখন তোমার দুঃখগুলো শোনানোর জন্য মানুষ পাবে না! তখন তোমার কষ্টগুলো শেয়ার করার জন্য মানুষ পাবে না! যারা এখন বড়ো বড়ো কথা বলছে, ধর্মীয় বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা দাঁড় করাচ্ছে ইচ্ছেমতো, তাদের কাউকে একটা ফোন করে দেখো, তারা ফোনটাও তখন রিসিভ করবে না। অবশ্য রিসিভ করলেও যে তোমার খুব একটা লাভ হবে, তা নয়। ওরকম ধরনের লোকজনের বেশিরভাগই অপদার্থের দলভুক্ত।




মেয়ে, নিজের ভাগ্যটা নিজেই গড়ে তোলার চেষ্টা করো। নিজের দায়িত্বটা নিজেই নেবার চেষ্টা করো। তোমার দায়িত্ব কেউ নেবে না! কেউই নেবে না, নো ওয়ান, নো ওয়ান! আমি যে এখন এত কথা বলছি, আমিও তখন তোমাকে চিনতেও পারব না! আমার তো সময়ই নেই, আমি কোথা থেকে ফোন রিসিভ করব! কিন্তু এই যে আমি কথাগুলো বলছি, এই কথাগুলো মাথায় রাখো। কথাগুলো মাথায় রাখলে শেষমেশ তোমার ভালো হবে, তোমার মঙ্গল হবে, তোমার জীবনটা সুন্দর হবে, তোমার ফিউচারটা সুন্দর হবে, তুমি কিছু ফালতু কষ্ট থেকে বেঁচে যাবে, তুমি কিছু তীব্র অসম্মান থেকে বেঁচে যাবে। নিজের আর্থিক নিরাপত্তা থাকলে তোমার শ্বশুরের ফ্যামিলিতে তুমি সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে। এইগুলো মাথায় রাখো।




জীবনে বিয়ে করাটা সবকিছু নয়। জীবনে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাটাই সবকিছু। জীবনে শ্বশুরবাড়ি, সংসার সবকিছু নয়। জীবনে সুন্দর করে বাঁচাটাই সবকিছু। এসব মাথায় রাখো। পদে পদে অপমান সহ্য করে করে বেঁচে থাকার জন্য তুমি পৃথিবীতে আসোনি। তোমার জীবনটা সুন্দর হোক। তোমার জীবনটা সুন্দর হলে আমার কিছুই এসে যায় না! তুমি আমাকে একবেলা রান্না করে খাওয়াবে না। তোমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আমি একবেলাও খাবো না। কিন্তু তুমি ভালো থাকলে আমার ভালো লাগবে। আমার একটা কথায় যদি তোমার লাইফটা চেইঞ্জ হয়, তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত সঠিক সময়ে নিতে পারো, তবে আমার আনন্দ লাগবে, শান্তি লাগবে। ওই জায়গা থেকেই কথাগুলো বলা। তোমাকে সুখে ও শান্তিতে দেখার লোভ থেকেই কথাগুলো বলা। আর কোনও কিছু নয়!