- আচ্ছা, বলো তো, ‘চিরায়িত সুন্দর’ বললে কী বলা হয়? - প্রকৃতির বহুমাত্রিক রূপের খেলা হতে পারে। আবার হতে পারে লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিক অগ্রায়ণ। আমাদের শাশ্বত পল্লীর বিবাহ সংস্কৃতি যেমন গীত, নৃত্য, রংখেলা, জামাই-ঠকানো আয়োজন ইত্যাদি। - বাহ্! লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু বলো, বিষয়টা নিয়ে আমার কিছুটা কৌতূহল আছে বটে। - পৌষপার্বণ, নবান্ন, বৈশাখী মেলা, নৌকাবাইচ, পিঠা-পার্বণ, এক্কাদোক্কা, বউচি, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, হা-ডু-ডু, কবিগান, পালাগান, যাত্রা, মাটির তৈজসপত্র, ঢেঁকি, তাঁত, গোরুর নাঙল, নকশিকাঁথা, এমন কিছু চিরায়ত আনন্দ-আয়োজন একসাথে লোকসংস্কৃতি। আসলে কাজেকর্মে জীবনের আনন্দ ঢালাই আমাদের লোকসংস্কৃতি। - হুম… পৌষ-পার্বণটা মূলত কী নিয়ে? তুমি নিজে কখনো প্রত্যক্ষ উপভোগ করেছ? - এটা আসলে চৈত্রের দাবদাহে সোনালি আঁশের আয়োজন, বর্ষা অবধি একটা ব্যস্ত শ্রমঘন সময় কাটানোর পর কৃষকেরা একটু বিশ্রামে যায়। এ সময় একটা বৈঠকি আনন্দে কৃষিসমাজ মত্ত থাকে। এরপর একটা আড়মোড়া ভেঙে, আমন ধান কেটে ঘরে তোলার আনন্দোৎসবে গ্রামীণ জীবন মেতে ওঠে। এটা পৌষে এসে একটু সুখবিশ্রামে রূপ নেয়। ঘরে ঘরে নতুন ধানের সোঁদাগন্ধ আর খেজুর রসের মনমাতানো রসনাব্যঞ্জন এক অনাবিল আনন্দধারা সৃষ্টি করে। এই পর্বটি বাংলার চিরায়িত এক আনন্দোৎসব। এটাই পৌষপার্বণ, শীতের মদির উষ্ণতা একে ভিন্ন এক নতুন মাত্রা দেয়।
- আমি এসব কখনও উপভোগ করিনি! শুধু বইতে অল্পস্বল্প পড়েছি! আর নবান্ন?
- নবান্ন মানে নতুন ধান ঘরে তোলার পরে পিঠা উৎসব। আমাদের গ্রামীণ জীবনে এ সময় পা চেপে চেপে হাঁটুজলে বিলে-বাওড়ে মাছ ধরা, কিশোর-কিশোরীর খালে-বিলে ঢ্যাপ, শালুক খুঁটে আনা—এমন সব প্রাকৃতিক আনন্দ চিন্তায়-মননে মানুষকে সুখ-সুখ অনুভবে বিমোহিত রাখে। - আমি এসব কিচ্ছু পাইনি শুধু শাপলা-শালুক তুলে আনা ছাড়া।
- লোকসংস্কৃতির উৎস নিয়ে কিছু বলো না! লোকসংস্কৃতির উৎসটা কি কৃষি এবং কৃষক? - লোকসংস্কৃতির উৎস মূলত জীবিকা-নির্ভরতা, এর সঙ্গে লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কিত। এটিকে কোনো একক পেশা না বলে বলা যায়, মানুষের বিবর্তন ধারায় অগ্রসরমান জীবিকার বহুমাত্রিকতার সাথেই লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কিত। কৃষি এক্ষেত্রে লিড ফ্যাক্টর—মাটির তৃষ্ণা গো, মাটির তৃষ্ণা…বুঝলে, নীল! তুমি যেমন আমার তৃষ্ণা, আমি যেমন কৃষ্ণচূড়ার তৃষ্ণা, ঠিক তেমনি। পক্ষপাতিত্ব মনে হলো কি? - না, কীসের পক্ষপাতিত্ব? বিনিময় কীসের? আসলে তুমি আলোড়িত করতে জানো! - বিনিময়টা করলে কোথায়? করলে না তো! নিষ্ফল পথচলা, তবু ছুঁতে দিলে আর কই! হা হা হা
- আমার একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের সঙ্গে প্রেম ছিল, তখন আমার বছর তেরো বয়স। বয়সের চেয়ে বোধ কিছুটা বেশি ছিল, তাই গাছটার সঙ্গে শুধুই উদ্ভিদ আর প্রাণের সম্পর্ক নয়, আরও বেশি কিছু ছিল, তা বেশ বুঝতে পারতাম। গাছটা আকাশছোঁয়া ছিল। পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইতে গেলে মাথা উঁচিয়ে দেখতে হতো, তা-ও চূড়ার হদিস পেতাম না। দু-হাতে জড়িয়ে ধরে প্রায়ই স্পন্দন কোথায় খোঁজার নিষ্ফল চেষ্টা করতাম, যদিও আমার ছোট্ট হাতে বেড় পেতাম না। গাছটার জন্ম ছোটো দাদুর খিড়কির পাশে, সেখানেই এখনও দাঁড়িয়ে। আমরা বন্ধুরা সবাই জড়ো হতাম গাছের নিচে; গান হতো, নাচ হতো, গল্প আর সংসার সংসার খেলা হতো, ফুল আসতে শুরু করলে দিন গুনতাম। বাতাসে ফুল ঝরে পড়ত আমাদের উপর, সবাই আকাশপানে চেয়ে থাকতাম, ফুলের ভূপাতন দেখতাম। ফুলবৃষ্টিতে স্নাত ছোট্ট আমি ঘরে ফিরতাম রাজ্যের শোভা কুড়িয়ে। একসময় আমি আরেকটু বড়ো হলাম, এরপর সভ্যতা বলল, পরিবর্তন দরকার, তবে আমি শুনলাম না। আরও কিছুদিন থেকে গেলাম। সার্টিফিকেট বলল, এবার যেতেই হয়! মা বলল, অন্য একটা কৃষ্ণচূড়ার খোঁজেই বেরুব আমরা। এরপর আর পেলাম না কিছু খুঁজে! ভাবতাম, আবার দেখা হলে, চট করে হাঁটুমুড়ে বলে দেবো দু-হাত বাড়িয়ে, তোমাকে ভালোবাসি, কৃষ্ণচূড়া! বলা হলো না! কতকাল হলো জড়িয়ে ধরি না, জানো! গাছের কি সত্যিই হৃদয় থাকে না?
- থাকে, নীল; গাছ মানুষের মতোই। জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রবীণত্ব সবকটা পর্ব পার করে ওরাও। গাছের দুঃখ আছে—সবুজ হারানোর দুঃখ। আনন্দ আছে—জন্ম দেবার আনন্দ। যন্ত্রণা আছে—তোমায় হারানোর যন্ত্রণা। দেখে এসো, তোমার ছোঁয়া কেমন অশ্রু হয়ে ঝরে শীতে-বসন্তে… একা দাঁড়িয়ে কেমন রুক্ষ দৃষ্টিতে খোঁজে, একজন নীলমানুষ কোথায় চলে গেল নীরবে। এসো বলাকার সাথে বিহঙ্গবিহারে; এসো, দু-জন মিলে সবুজময় হয়ে যাই। দেখো, অমলিন সন্ধেটা সায়াহ্নে ডেকে যায়; বলে, একবার শুভ্রতা ছুঁয়ে দাও, বলাকাবধূ! মন খারাপ কোরো না, সময় দিচ্ছ, এটাই তোমাকে প্রশ্নহীন করবে। - ঠিক! সবুজ সময়ের বিহঙ্গমানুষ তুমি, অদ্ভুত কায়দায় ভালো থাকা শিখে ফেললে! - নব রসে সিক্ত মানুষ কিন্তু নিপাট অশুদ্ধ। - শুদ্ধ-অশুদ্ধ বুঝি না। দেখো, তোমাকে তো অনেকভাবেই দেখছি, হতবাক অনেকবার হয়েছি, আবার ধাতস্থ হয়ে ভেবেছি, মানুষের রকমভেদ মাত্রাহীন। - অসময়ের মানুষের মতো পড়ে থাকি ধাতব যুগে, বৃক্ষের সবুজ আমায় ছুঁতে পারে না। তোমার নিরাকারে এত উদাসীনতা জমে আছে! - সব কিছু খুঁটিয়ে দেখার, জানার দায়টা কে দিয়েছে আমায়! এ আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় সবার বেলায়। আমার বেলাতেও সবাই তা-ই ভাবুক, এমনটাই চাই।
- ভুল বানানের মানুষ হতে চাও বুঝি, নীল? - কিছুই চাই না। অত চাওয়া-পাওয়াতে আমি নেই গো। - বিনিময়হীন মানুষ কি দ্বিতীয় হয়? আসলে কী, তুমি যান্ত্রিক কাঠামো থেকে সরে আসতে চাও না। - সত্যিই চাই না। এটা আমাকে ভালো রাখে। - আত্মমহত্ত্বের একটা নিজস্ব রূপ থাকে, বুঝি, নীল! জলসমুদ্রের নিঃসঙ্গ মানুষ যদিও জলের অতীত গল্প থেকে উঠে আসে, তবু ভালোবাসি বলতে বাধা কোথায়! - কৃষ্ণকলি যাকে বলা যায়, সে মানুষও অন্ধকারে হেঁটে যায়। - ব্যাকরণহীন জীবনটাকে আমি অনেক পথ পার করে এনেছি, তবুও তোমার ব্যাকরণহীন ভালো থাকার বিষয়টা খুঁজে পাইনি। এটা তোমার একান্ত সহজাত ঔদার্যবোধ। থাকে, এমন বিশেষায়িত মানুষ থাকে। তুমি ভেতরে ভেতরে এত বিশাল, একটু ঠাঁই পাওয়া বড্ড হ্যাপা! - ভাবি, খুব সাধারণ না হলে কেউ কি অত গভীর হয়! তোমার সুন্দর কিছু ব্যস্ততা দেখি, তখন নিজের সাথে কাটাকুটি খেলি। - কোনো একদিন অনেক উঁচু ঘন নীল আকাশ আর চকচকে রোদ্দুর, তার নিচে বিভাজিত দু-জন মানুষ হেঁটে যায়, গন্তব্য তখনও নিরুদ্দেশ!