জলঘড়ি পাখা (৪র্থ অংশ)

- আচ্ছা, একটা মানুষের দ্বিসত্তা বললে কী বলা যায়? একটা না-মানুষ আর একটা অতি-মানুষ, এমন কি?
- একটা মানুষের দুইটা সত্তা বলা যায়। মানুষের ভিন্ন দুই সত্তা তার জীবনে অন্যান্য মানুষের গুরুত্ব এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আবর্তিত হয়।
যেমন ধরো, একটা মানুষ বাইরে থেকে ভীষণ গম্ভীর, প্রয়োজনের তুলনায় কম কথা বলে, পূর্ণদৃষ্টিতে কারুর দিকে তাকিয়ে কথা অবধি বলে না। 
দেখলেই মনে হবে, সমস্ত লাভা বুঝি সবসময়ই এমন ফুটন্ত! 
সেই একই মানুষটাই তার প্রাণের মানুষের কাছে সরল শিশু… অপ্রয়োজনীয় আর অযৌক্তিক যত কথার তুবড়ি ছুটিয়ে চলছে; খুব সাধারণ কথা, অথচ হেসে লুটিয়ে পড়ছে; দৃষ্টিতে এত মায়া, এত প্রেম সাজিয়ে বসে আছে! 




- সে তো গল্পের এক মেয়ে, গতকাল যার জন্ম হয়নি।
- তা-ই বুঝি!
- তুমি তবে অরণ্য নও, নারী!
তুমি নিজেই জলের গল্প!
আজ এ মেঘলাদিনে, সখী, থেকো না বিরহে,
হৃদয়ের উষ্ণতায় ওম তুলে রাখো যতনে।
শুভময় রাত্রির সুন্দর শুভেচ্ছা, নীল। 




- আমাদের সময়গুলো মুখোমুখি হতে প্রচণ্ড ব্যর্থ, ইচ্ছে হলেই তোমায় ঠিক ঠিক ছোঁয়া যায় না!
সব নিষিদ্ধের ধ্রুপদী প্রেমিকমানুষ তুমি, তাই কি?
- শুধু দু-জন, অসীম নিস্তব্ধতায় চোখের ভাষায় জীবন এঁকে চলা। ইদানীং, সমাপ্তিবলয় বলে…আর কত!
আচ্ছা, আমাদের বলা 'ভালো আছি', তা কি অর্থবহ?
- কারুর 'ভালো আছি'-র অর্থে—তার ভালো না থাকা, কারুর কষ্টে থাকা, কারুর হয়তো অভিমানে থাকা, কারুর নিজের অবস্থা প্রকাশে  অনিচ্ছে, কারুর আবার খুব বেশি ভালো থাকাও থাকে।
- তুমি কি জানো, আমি এখন কতটা নিরাকার মানুষ হয়ে বেঁচে আছি?
জানো না বোধ হয়, তাই না, নীল!
- জানাওনি তো কখনও!
- কী সহজ প্রতিক্রিয়া! খুব পাশ কেটে হাঁটতে জানো তুমি!
- তুমি বর্মবেষ্টিত মানুষ, তোমার নাগাল পাওয়া আর কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়ে যাওয়া, একই ব্যাপার! 
- মনে হয় সেরকম কোনো ব্যাপার নেই এতে। তুমি অযথা বাড়িয়ে ভাবছ!
- আমি তো এমনই দেখছি… যাকে কাচস্বচ্ছ জলের তলেও খুঁজতে হয় নিবিষ্ট হয়ে।
- কী জানি, ভাবি না অত!
- তুমি এত সরল দাবি করো বলেই তোমাকে খুঁজতে নেমে পথ ভেঙে যায় বার বার।
- দাবি না ঠিক, সত্যটাই বললাম।
- সত্য তো বড়ো বেশি আপেক্ষিক। 
- হতে পারে।
- তুমি বেশ উপনীত মাত্রায় কথা বলতে জানো, এটা তোমার নিজস্ব বিশেষত্ব। সময়টা কেমন যাচ্ছে?
- ঠিক আগে যেমন যেত।
- বৃত্তবন্দি বলছ?
- আমি তাহলে বৃত্তে আবর্তিত মানুষ, তাই না?
- বাকিরাও তা-ই!
- নীল, কথা এগোয় না আর, তাই না!
দেখো,
একদিন ঠিক জানা যাবে,
আমাদের আর কথা হবে না,
একদিন সব কথা জেনে যাবে,
শেষ কথা বলা হয়ে গেছে,
অথচ শেষ কথাটা শেষ পর্যন্ত বলা হয় না।
আমরা একটা আনন্দনগরের গল্প লিখতে নেমে
কেমন মসৃণভাবে…
বিরহশহরে ঢুকে গেলাম!
আমায় একতরফা মানুষ করে রাখো তুমি! কিছু তো বলবে!
- ভাবছি, পৃথিবীর মানুষগুলো কেমন! মানুষ আর ঈশ্বর একই সত্তা? না কি বলব, মানুষের মাঝে ঈশ্বর শুধু বাস করেন, নিজের সত্তাটা একান্ত নিজেরই?




- মানুষ, তোমাকে যথার্থ ঈশ্বর হতে হবে। এর চেয়ে বেশিদূর আমি এগোব না, নীল। 
ভ্রান্ত মানুষ আমি, অভ্রান্ত ঈশ্বরবাদের আল ভেঙে হাঁটব কেমন করে!
জানো, একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস, আমি যত কথা বললাম, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি প্রকাশ করতে পারে।
সেই নিঃশ্বাসটা যখন জমাট বেঁধে বুকে জমা হয়, তখন মানুষ আর নিজের থাকে না। মানুষ মূলত ভাববাদী। ভাববাদই মানুষকে একটু বাঁচিয়ে রাখে।
আমি আমার আমি-টার সাথে কথা বলে দেখেছি, সে-ও অপেক্ষার পক্ষে।
আমার অনেক নিঃসঙ্গতা তুমি পার করবে, তুমি না চাইলেও আমি তোমার করতলে করতল ছুঁয়েই হাঁটব—হয়তো বিমূর্ত সময়ের শরীর ছুঁয়ে।
বাদামি বিকেলের মানুষগুলো আদৌ জোছনার শহর খুঁজে পায় কি না জানি না, আমি তবুও পথ চলব…যদি একটুখানি পাওয়া যায় অবশেষ!
হুঁ, এ অপেক্ষার কোনো বিকল্প আমার নেই, এ চলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
- ভুলে গেছি, মনে পড়ে না, অমাবস্যার ঠিকানা কোথায় লিখেছি!




- 'ভুলে গেছি সব'—এমন যারা বলে, তারা কি আদৌ কিছু ভুলতে পারে?
ভোলা আসলে যায় না, নীরব থাকা যায়, আত্মদহনে পুড়ে যাওয়া যায়।
ভুলতে পারে না বলেই মানুষ আশায় বাঁচে।
না, তোমাকে জোর করে জাগাব না, তুমি জাগ্রত হবে ভেবে অপেক্ষা করব,
হয়তো এমন অপেক্ষায় শেষ অপেক্ষার সাথে দেখা হয়ে যাবে।
- হেমন্ত এসেছে, টের পাও? কখনো শিউলি খুঁটেছ?
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি জঞ্জাল মানুষ; বলা যায়, বিরক্তিকর মানুষ।
নিজের সাথে আমার বনিবনা হয় না, সেটা কোনো বিষয় না।
কিন্তু মানুষের চোখে যখন নৈরাশ্যের ছবি ঝুলিয়ে দিই, তখন মনে হয়, এমনটা না করলেও হতো।
তারপরও ভুল করি, আবার একটা বিজাতীয় নৈরাশ্য খুঁজে আনি!
আমি পারি না জীবনের সেই গল্পের কথা বলতে… যে-গল্পে মানুষ বিশুদ্ধ হয়, নান্দনিক হয়।
আমি গল্পের কোনো প্রয়োজন নই, আমাকে গল্পের প্রয়োজন হয় না, একপাশেই পড়ে থাকি!
তবুও অন্যের গল্পে ঢুকে যাই, বেহায়া মানুষ বলা যায় আর কি! তারপর হঠাৎ তোমার মুখোমুখি, জীবনের একটা ভিন্ন স্রোতের যেন দেখা পেলাম। 
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তোমাকে হোঁচট দিলাম। তুমি বললে, আমার শুদ্ধতায় প্রশ্ন আছে, অথবা আমি কথাগত মানুষ নই।
আমি কষ্ট পেলাম। নিজেকে বললাম, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা এবার হ্রাস করো।
আমি-টা হয়তো বয়সের ভারে দুর্বল।
তাই তোমাকে সরল কথা, যা প্রকৃত, তা-ই আমি বললাম। তুমি প্রশ্ন তুললে, যে নিজের কথার সহযাত্রী নয়, তার সত্যমাত্রা প্রশ্নবিদ্ধ।
আমি মেনে নিতে বললাম আমার নিজেকেই, অনেক করে বললাম, বোঝালাম।
সে বলল, শেষ জীবনে পরাজয়টা শুদ্ধ হলে ভালো হয়। আমি আবার তোমাকে বললাম, আমার সব শব্দে শাব্দিকতা থাকে না, তৃতীয় অর্থে বলে ফেলি, যা লেখার সময় ছাড়া আমিও বুঝি না!
তুমি মানলে না।
বললে, বড়োজোর বন্ধুত্ব দিতে পারো।
এই তো, এভাবে একটা অলিখিত, হয়তো অপাঠ্যও, ছোটোগল্প।




- ছোট্ট একটা ভুল…আমি কখনও বলিনি, মানুষ বিশুদ্ধ হয়।
তোমার শুদ্ধতা নিয়েও আমার কোনো প্রশ্ন নেই, ছিল না। আমি নিজে শুদ্ধ মানুষ নই।
মানুষ নির্জলা শুদ্ধ হয় না।
তোমার শুদ্ধতা নিয়ে সজ্ঞানে কোনো প্রশ্ন তুলেছি কি না জানি না, তুলে থাকলে তা ভুলবশত। 
সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি। আমি অনেক বার কথাপ্রসঙ্গে বলেছি, বিশুদ্ধ মানুষ হয়, আমি এতে বিশ্বাসী নই। 
তবে কেন তোমার শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি,  এখনও বুঝতে পারছি না।
আমি আমার কথাটা বললাম; বলতে পারো, আত্মপক্ষ সমর্থন।
- তোমার কথা ঠিক আছে, তুমি এমন বলেছ… মানুষ কখনও পূর্ণ শুদ্ধ হয় না।
- আমি আমার  অবস্থানের কথা বললাম।
আমার প্রত্যাশা, তুমি আমাকে বুঝবে। তবে নিজস্বতা পার হয়ে আমাকে জায়গা দাও, এটা বলব না।
বহুবিধ ভুলের জীবন নিয়ে বাকি সময়টা পার হতে হবে, এটাই আমি আমাকে বলতে পারি।