জলঘড়ি পাখা (২য় অংশ)

- নীল, আমি কৃষ্ণচূড়ার শরীর-ছোঁয়া একজন। মনে পড়ে কখনো আমার গল্পগুলো?
কতটা পথ যেতে পারব জানি না, তবে একপশলা আদর ঠিকই পাঠাব।
মন বলে, একদিন পাশাপাশি বহুদূরে চলে যাব…
শুধু নিঃশব্দের বাড়িঘরগুলো সাথী হবে। 
এমন কষ্ট হয় কেন, বলতে পারো?




- কষ্টের কারণ জানতে পারলে কখনো কখনো ভালো, উপশম করা যায়। কখনো কখনো না জানাই ভালো, নতুন করে যোগ হয়।
বরং অন্য কোনো গ্রহে চলো ভেসে বেড়াই। 
- সত্যিই যেতে চাও? মানুষ বুঝি খুব অসহ্য?
- ক্লান্তিকর।
- তা-ই মনে হয়। 
আসলে জীবনদর্পনের কদর্যতা থেকে ক্লান্তি আসে বটে, তার পরেও কেন জানি অলক্ষ্যে মানুষের গৃহই শেষ গন্তব্য।
- গৃহ সবার থাকে?
- না; যেমন তোমার গৃহ নেই।
তুমি তো আপন শহরেই পরবাসী একজন।
- গৃহহীন মানুষের গৃহে ফেরার দায় থাকে না। তবে একটা গৃহ হোক—সে-ও খুব করে চায়। 
বলতে পারো, এ হচ্ছে কৌতূহলে অসম্ভবের প্রতি ঝুঁকে চলা।
- গৃহ বুঝি আয়ুবিন্যাসে বেশ অনেকটা? না না, অনেকটা কেন! একজীবন পার করে আমি বুঝি, গৃহ সবার থাকে না, থাকতেও নেই, গৃহহীন বিহঙ্গ-বালিকাই সুখীজন।
- অন্তত স্বাধীন। 
- পরাধীন সুখ তুমি খুঁজতে পারো।
- না, সুখের অমন জটিল গুরুপাক আমার সইবে না।
- কেন নয়? পরাধীন নির্জনেও একটা সুখ-গল্প লেখা যায়; যায় না বুঝি!
তোমার বিমূর্তে ভবঘুরে পুরুষ হাঁটে না বুঝি? না কি তুমি অবরুদ্ধ সীমানায় সীমানায় নিষেধ লিখে যাও?
চোখ খুলে দুঃখ ডাকো…
সব দুঃখের এত সুখ লুটে যাও
বেহালা-নারী!




- কী সুন্দর লেখো তুমি!
- যখন তুমি কথার পড়শি হও।
ভাবনার কত বিপরীত মেরুকরণ থাকে, নীল…
জীবন তো বর্ণ হারাচ্ছে, তবু
মনে হয়, টিকে-থাকা মানুষগুলো
ভালোই আছে!
- জীবন বর্ণ হারায়, হারাবে। তুমি কতটা রাঙিয়ে নিতে পারবে, এটা তোমার উপর।
বাড়ি গেছি যখন, বড়ো আম্মাকে দেখে কান্না পেয়েছে, কেঁদেছি; ফোনটা আমার অনেক কিছুই, হারিয়ে গেছে যখন, কান্না পেয়েছে, বিষণ্ণ হয়েছি।
কিন্তু বাগানগুলোতে ফিরে গিয়েছি, কাছের মানুষগুলোকে কাছে পেয়েছি, ওই দুটো বর্ণহীনতা কিছু মনে হয়নি, জীবনটা দিনশেষে রঙিনই।
বাড়িতে সময়টা ভালো কেটেছে।
মানুষের জীবনে আয়োজনের একটা জায়গা থাকে, সেই আয়োজন বহুমাত্রিক। সেখানে
হঠাৎ বিপন্নতা আসতে পারে, উল্লাস এসে বলতে পারে, কেমন আছ? স্মৃতিভ্রষ্টতা থমকে দেয়, ফিরে-পাওয়া সময়গুলো রঙিন গল্প বলতে পারে।




- এত তন্ময়তা ঘিরে থাকে তোমায়! জীবনের এত ভাঁজে বিচরণ তোমার!
এসো, নগ্ন পায়ে শিশির ভাঙি।
সবশেষে, বিশুদ্ধ বাতাস বেচে সমুদ্র অভিমুখে ফিরে চলি।
- বাগানে গোলাপ ফুটেছে হলদে আভায়! রাতশেষে দেখি, মেরুন রঙের ছড়াছড়ি! খানিকটা দ্বিধান্বিত মনে হলো; খুঁটিয়ে দেখি, কার্নিশে তার রূপের বাহার!




- ওটা রং-পরিবর্তনকারী গোলাপ।
- এই পরিবর্তন কি তবে বহুমাত্রিকতার স্বপক্ষ প্রতিনিধি?
- এটা যোগ্যতা হতে পারে নন্দনতত্ত্বে, আবার জীবনবিন্যাসে এটাই তর্কিত বিষয়।
কখনোবা বিরূপ মাত্রাও হয়।
নীল গোলাপটা রং বদলায় নিজেকে বৈচিত্র্যময় করতে, তাই না!
- অনেক কিছুই হতে পারে!
হয়তো রং-পরিবর্তন ওর ইচ্ছেতেই নেই…
উজ্জ্বল সোনালি রং আপনাআপনিই পরিবর্তিত হয়ে লাল হচ্ছে! হয়তো এটা ওর বিষাদের পরিমাণ!
অথবা রং-পরিবর্তন প্রাকৃতিক সংকেত!




- এত শূন্যতা কেন ধারণ করো?
- শূন্যতা থাকলেই ধারণ করা যায়।
পূর্ণ মানুষ ধারণ করে আর কই, উপচে পড়ে! পূর্ণ মানুষের কেন্দ্র নেই বোধ হয়।
পৃথিবীর কেন্দ্র জানা সহজ, কিন্তু মানুষের কেন্দ্র… এ বড্ড শক্ত খেলা, পুরাতন মানুষের অব্যক্ত অস্ত্র!




- পুরাতন মানুষগুলো সংসারের অলঙ্কার মনে হয়!
- সময়ের সাথে আমরা যারা পুরাতন হচ্ছি, তারা কিন্তু এমন অলঙ্কার হতে পারছি না। আসলে প্রকৃতির বয়সের সাথে পুরাতন মানুষের রসদযোগ হয়। প্রকৃতি যখন প্রাকৃতিক নির্মলতায় মানুষের বিকাশ ঘটিয়েছে, তখনকার মানুষ আর
অধুনা সময়ের অত্যাচারিত প্রকৃতি কতটা এক হতে পারে, নীল!
আমি বলি, কৃষ্ণচূড়া, তুমি কার?
- কৃষ্ণচূড়া সবুজের।
সবুজ, তুমি কে?
সূর্যের চাহিদা।
সূর্য কি তবে ভয়ঙ্কর?
- নির্ভর করবে, কোন প্রকৃতিতে চাইছ! হিমায়িত প্রকৃতিতে সূর্য বেশ উপাদেয়, উত্তপ্ত প্রকৃতিতে গরলবিশেষ, ভেজা প্রকৃতিতে আবার চমৎকার করিতকর্মা, দ্রোহ-বিদ্রোহে বিজন-সুন্দর।
- নাহ্, তুমি স্ববর্ণে স্বজাত মানুষ।
বসন্ত এল এল,
এখানে আমগাছে ছোটো ছোটো আম,
অথচ আমি চোখ তুলে দেখিনি
এ সৌন্দর্য, নীল!
জীবন এমনই কাটছে।
- তুমি এঁটে গেছ একবিংশের শরীরে।
এই একটা ব্যস্ত জীবন বেশ সস্তায় কিনে ফেললে!
জটিলতার শরীর ছাড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলো… কিন্তু সাগরের ওপারে কি সূর্যে-পোড়া চাঁদের কঙ্কাল, না কি একটা বিশুদ্ধ সময়?
- কোথাও কোথাও চাঁদ ভেঙে যায়, নীল!




- ভারসাম্যহীন টলায়মান বাক্যজাল…
ভালোথাকা শিখে গেল মৌমিতা, ভালো রাখতে ভুলে গেল ময়ূরাক্ষী!
কারণ ময়ূরাক্ষী জানে, কৃত্রিম মানুষকে কখনও  ভালো রাখা যায় না।
কীভাবে তুমি সূর্যের সাথে জীবন মেলাও, নীল? আমি রাতের শরীরে জীবনের অনুবাদ খুঁজি!
আমি বুঝি, নীল, তোমার আড়াল…ও যে
জীবনের অনুবাদ, আমি হয়তো কোনোদিন পাবো না তা।
জীবনটা কেমন নির্বাক সময়ের জলছবি হয়ে যায়, নীল।
তোমার কৃষ্ণচূড়ার কাছে আমি শুধু প্রশ্নবোধক হয়ে র‌ইলাম।
তারপর আর কোনো সুবর্ণনগর নেই যে…
এ বসন্তে ওদের ঘুম ভাঙেনি, নীল!
তুমি!
সেটা বঙ্কিম গদ্য,
নিপাট সরলরেখায় দাঁড়িয়ে-থাকা সমুদ্র—গভীর,
সাধারণ …সেখানে শিশুতোষ গল্প মাত্র।




- কাউকে ভুলে যাওয়া কত সহজ! কিন্তু একটা কাউকে রোজ মনে করে করে বেঁচে থাকাটা কী যে কঠিন, সে বোঝানো যায় না।
বিকট শূন্যতা বলে কিছু যদি বেচে দাও, আমি তা-ও কিনতে পারি।
তোমাকে নিয়ে আমি তুমি মিলে নিকষ কালো অমানিশাময় কথাগুলো একবার লিখব…
দেখো, ঠিক লিখব।
- তোমার বুঝি সময় হবে অত!
- সময় কখনও সময় ধার দেয় না, কিছু সময় কষ্ট বেচেও কিনতে হয়, মেয়ে!
- দুঃখ-কষ্টের ঐশ্বর্যময় একটা কুঁড়েঘর দেবো,
নিঃশব্দের কালো পূর্ণিমা দেবো, যদি ভালো না থাকো, তবে
সব নিষিদ্ধ তোমারই রইল।
- আমি যে সেই আদিম নিষিদ্ধ প্রাণ!
- অতি বিশুদ্ধ জীবনগুলোই নিষিদ্ধ হয়, জানি তা।
আমি কি তবে নিরেট অসময়ের পথ ধরে হাঁটছি?




- অনেক অপেক্ষা অমাবস্যায় জমছে নীরবে… বলতে পারো, জাগতিক বিভ্রাটে বসে আছি!
- চলো, অরণ্য চিরে হেঁটে যাই প্রেমের শহরে।
- তুমি খুব নির্মোহ প্রতিক্রিয়া দিতে পারো, সুজন।
নিঃশব্দে সরে পড়ার কষ্টটা বেচে দিলে, আর একটা গল্প লিখে নিলে। কষ্টটা আমি নিলাম, গল্পটা তুমি একদিন বোলো, কেমন!