জীবনে বন্ধন আছে বলেই মুক্তির ধারণাটা আসে। অন্ধকার আছে মানেই আলোও আছে। দর্শন বলে, বন্ধন হচ্ছে অজ্ঞান বা মোহ। এখানে অজ্ঞান মানে 'না জানা', 'জ্ঞানের অভাব' বা 'বাহ্যিক চেতনাশূন্য' নয়। আমরা জানিই না—আমরা কী, আমরা কেমন, আমরা কোথায়, আর এই না জানাটাই অজ্ঞান। তাই আমরা অজ্ঞানী। বেদান্তে এই অজ্ঞানকে বলা হয় মিথ্যা প্রত্যয়—এটাও প্রত্যয় বা জ্ঞান, তবে তা মিথ্যা বা ভ্রান্ত; সত্য বা যথার্থ নয়।
ধরুন, আপনি কখনোই ঘোড়ার মাংস খাননি। আপনি জানেনই না যে, ওটা খেতে কেমন এবং আপনি যে ওই মাংসের স্বাদ সম্পর্কে জানেন না, তা আপনি জানেন। এর মানে, এই অনভিজ্ঞতা সম্পর্কে আপনি জানেন। আপনার এই জানাটাও জ্ঞান, তবে এটা অজ্ঞান (না জানার ব্যাপারটা জানা) বা মিথ্যা জ্ঞান। একে দূর করতে হলে আপনাকে ঘোড়ার মাংস খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এই চেষ্টার নামই সাধনা এবং মিথ্যা জ্ঞান বা অজ্ঞান নষ্ট হবার সাথে সাথেই সত্য জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে, এবং মনের তখনকার অবস্থার নাম মুক্তি। মুক্তি মনেই থাকে—তাকে খুঁজে পেতে হয়।
দর্শনশাস্ত্রে এই মুক্তির দু-রকম রূপের পরিচয় দেওয়া হয়েছে—জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি। শরীর থাকাকালে যে মুক্তির আশীর্বাদলাভ হয়, তার নাম জীবন্মুক্তি—জীবিত অবস্থাতেই মুক্তি। তত্ত্ববিচারের সাহায্যে সত্য নির্ণয় করতে করতে শরীরপাত বা দৈহিক মৃত্যু হবার পর যে-মুক্তিলাভ হয়, তার নাম বিদেহমুক্তি। দর্শনের ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে এই বিদেহমুক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন মাত্র অল্প কয়েকজন। 'ব্রহ্মসিদ্ধি'কার মণ্ডন মিশ্র, 'সংক্ষেপশারীরক'কার সর্বজ্ঞাত্ম মহামুনি প্রভৃতি কয়েকজন মাত্র শাস্ত্রকার বিদেহমুক্তিকে যথার্থ মুক্তি বলে মানেন। তাঁদের যুক্তি—গীতায় যে স্থিতপ্রজ্ঞ বা ব্রহ্মনিষ্ঠের উল্লেখ আছে, তিনি অনেকের মতে মুক্ত ব্রহ্মজ্ঞানীরূপে স্বীকৃত হলেও, মূলত স্থূলশরীর ধ্বংসের পরে যে-মুক্তিলাভ হয়, তা-ই সত্যিকারের মুক্তি বা বন্ধনহীনতা। তাই একজন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি উচ্চস্তরের সাধক ছাড়া আর কেউ নন। গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ বা স্থিধী ব্যক্তি উন্নত স্তরের সাধক। তিনি সত্যনির্ণয়ের পথে ভ্রমণকালে দেহনাশের পর যে-জ্ঞান লাভ করেন, তা-ই যথার্থ মুক্তি।
একজন মহাপুরুষ দেহত্যাগ করার পরও তাঁর কর্ম ও আদর্শ জগতে টিকে থাকে। মানুষ তাঁকে মান্য করে, শ্রদ্ধা নিবেদন করে, দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। সত্যের খোঁজে পথ চলা—এ এক অনন্ত যাত্রা, এর যেন শেষ নেই। সত্যের বন্ধনে বাঁধা পড়ে যাঁর অন্তর, তাঁর দৈহিক যাত্রার সমাপ্তি কেবল মৃত্যুতেই। মহাত্মাদের দৈহিক মৃত্যুর পর আত্মিক জন্ম যেন মানুষের মাঝে নবতর চেতনায় মুহুর্মুহু ঘটতেই থাকে। তাঁর এমন মুক্তি মেলে মূলত দেহরক্ষার পরেই। এমন পরমজ্ঞান লাভ করা সম্ভব কেবল অবিনাশী আত্মার পক্ষেই, বিনাশশীল দেহ তা উপলব্ধি করতে পারে না। দৈহিক মৃত্যুর আগে আত্মা চূড়ান্ত জ্ঞান বা মুক্তির আস্বাদ পান না।
আচার্য শঙ্কর ও অধিকাংশ শঙ্কর-অনুবর্তী ভাষ্যকার ওরকম মুক্তির ধারণাটি স্বীকার করেন না। শঙ্কর স্পষ্টই বলেছেন: 'অপি চ নৈবাত্র বিবদিতব্যং ব্রহ্মবিদঃ কঞ্চিৎ কালং ধ্রিয়তে ন ধ্রিয়ত ইতি' (ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, ৪-১-১৫)—ব্রহ্মজ্ঞানী যথার্থ জ্ঞানলাভ করার পর শরীর ধারণ করেন কি না করেন, তা বিবাদ বা বিচারের বিষয়ই নয়। . . . শরীর থাকাকালেই ব্রহ্মজ্ঞান উপলব্ধি করা যায়, একথা শঙ্কর স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন। পদ্মপাদ, প্রকাশাত্মযতি, বাচস্পতি মিশ্র, মধুসূদন সরস্বতী প্রভৃতি আচার্য শঙ্করের মতবাদকেই সত্য বলে মেনেছেন। এছাড়া আধুনিক ধর্মনায়ক ও আচার্যগণ—রামকৃষ্ণদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী অভেদানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ, শ্রীনিগমানন্দ, শ্রীঅনির্বাণ, শ্রী রমণ মহর্ষি, মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ, আদি শঙ্করাচার্য, সাধক জ্ঞানেশ্বর, ভক্ত কবীর, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু, স্বামীনারায়ণ প্রমুখ সাধকও জীবন্মুক্তির অনুভূতি স্বীকার করেছেন। বিদেহমুক্তির অবতারণা তাঁদের কাছে নিরর্থক।
'জীবন্মুক্তি' (জীবনমুক্তি) হলো 'জীবন মুক্ত হওয়া'। যে-ব্যক্তি বেদান্তদর্শনে সম্পূর্ণ আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধি লাভ করেছেন এবং কৈবল্য বা মোক্ষ (চৈতন্য ও মুক্তি) অর্জন করেছেন, তিনিই জীবন্মুক্ত। এভাবে জীবিত অবস্থায় মুক্তি—বেদান্ত, যোগ ও হিন্দুধর্মের অন্যান্য দর্শন অনুযায়ী মোক্ষের লক্ষ্য এবং এটিকে জীবন্মুক্তি বা মুক্তি বা আলোকিতকরণ বলা হয়।
জীবন্মুক্ত ব্যক্তিদেরকে ব্রহ্মজ্ঞানী বা আত্মজ্ঞানীও বলা হয়, কারণ তাঁরা তাঁদের প্রকৃত আত্ম (আত্মা) ও সর্বজনীন আত্ম সম্পর্কে জানেন। তাঁদের জীবনের শেষের দিকে, জীবন্মুক্তরা অবশিষ্ট কর্মফলকে ধ্বংস করেন এবং পরমুক্তি (চূড়ান্ত মুক্তি) লাভ করেন। যখন একজন জীবন্মুক্ত অন্যদেরকে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দেন, তাঁদের চূড়ান্ত বাস্তবতা (ব্রহ্ম) ও আত্ম বা আত্মার প্রকৃত প্রকৃতির উপলব্ধি সম্পর্কে শিক্ষা দেন এবং অন্যদের মোক্ষের পথ দেখানোর জন্য একজন গুরুর ভূমিকা গ্রহণ করেন, তখন সেই জীবন্মুক্তকে অবধূত বলা হয়। কিছু অবধূত 'পরমহংস' উপাধি লাভ করেন। যখন একজন ঋষি (দ্রষ্টা ঋষি) জীবন্মুক্ত হন, তখন সেই ঋষিকে ব্রহ্মর্ষি (ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি) বলা হয়।
জীবন্মুক্ত সাধকেরা বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার পথে যাত্রা করে আত্ম অর্থাৎ ঈশ্বরকে তাঁদের জীবদ্দশাতেই উপলব্ধি করে। তাঁরা জ্ঞান, আত্ম-উপলব্ধি, ঈশ্বর-উপলব্ধি, জীবনমুক্তি, আত্ম-জ্ঞান (সমস্ত শব্দই সমার্থক) লাভ করার মাধ্যমে সিদ্ধপুরুষের পর্যায়ে পৌঁছেছেন। জীবন-মুক্ত অবস্থায় পৌঁছোনোর জন্য তাঁরা বর্তমানের সকল কর্মকে শূন্যে বর্জন করেছেন। জ্ঞান লাভের পর, তাঁরা তাঁদের শরীর ধরে রেখেছিলেন জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেবার জন্য। দেহত্যাগ করার পর তাঁরা পরমমুক্তি লাভ করেন।
ব্রহ্মজ্ঞানের সাথে সাধারণ পার্থিব জ্ঞানের বিরোধটি জ্ঞানের দিক থেকে নয়, জ্ঞানের বিষয়ের দিক থেকে। আমরা যখন একটা বই নিয়ে ভাবি, তখন দুইটি ঘটনা ঘটে: এক। বইটিকে আমরা বইটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসমূহের ভিত্তিতে জানতে পারি—ওতে কী বলা আছে, ওটির আকারআকৃতি কেমন, ওটি কেন অন্য অনেক বইয়ের চাইতে (আমাদের জ্ঞানে ও বিবেচনায়) ভালো বা খারাপ, এরকম বেশ কিছু জানা বা জ্ঞান আমাদের হয়ে যায়। দুই। বইটি সম্পর্কে যা-কিছুই জানতে পারি, তার সব কিছুই আমাদের বৃহৎ জ্ঞানের অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং অন্তঃস্থিত জ্ঞানের সামগ্রিক রূপ থেকে ওই বইয়ের জ্ঞানকে আমরা কোনোভাবেই পৃথক করতে পারি না, কেননা জ্ঞান এখানে খণ্ডিত নয়, বরং জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা মিলে এক পরব্রহ্মের সমগ্ররূপে প্রকাশিত। এই দুই ঘটনার প্রথমটিতে পার্থিব জ্ঞান এবং দ্বিতীয়টিতে ব্রহ্মজ্ঞান অর্জিত হয়। জ্ঞান এক ও অভিন্নই, কিন্তু সেই জ্ঞানের প্রকাশ, বিস্তৃতি ও রক্ষণের ধরন ভিন্ন।
এখন কথা হলো, ব্রহ্ম বা ব্রহ্মজ্ঞান তো জ্ঞানের বিষয়ের উপর নির্ভর করে না, তাহলে ব্রহ্ম কেন ব্রহ্মজ্ঞানের বিষয় হবেন? বিষয় থাকলেই বিষয়ী অবশ্যই থাকবে, আর বিষয়-বিষয়ী জ্ঞান ভেদাভেদযুক্ত দ্বৈতজ্ঞানেরই নামান্তর—এই যুক্তিতে তাই ব্রহ্মের জ্ঞান দ্বৈতজ্ঞান নয় কি?
একটু ভেঙে বলি। আমাদের জ্ঞানে ব্রহ্মকে ধারণ করি বিধায় এখানে জ্ঞান আধার ও ব্রহ্ম আধেয়। অদ্বৈতদর্শনের মতে ব্রহ্মজ্ঞান বলতে বোঝায়—ব্রহ্মই জ্ঞান এবং জ্ঞানই ব্রহ্ম; এখানে জ্ঞান ও ব্রহ্ম মিলে একক সত্তায় পরিণত হয়—এই জ্ঞান আধার-আধেয় সম্বন্ধযুক্ত জ্ঞান নয়, তাই এর বিচারে বিষয় ও বিষয়ীর প্রসঙ্গ আসে না—ব্রহ্মজ্ঞান দ্বৈত নয়, বরং অদ্বৈত; তবে পার্থিব জ্ঞানের বেলায় সে যুক্তি দেখানো যেতে পারে।
ব্রহ্মজ্ঞান কেবলই উপলব্ধি বা সত্যনির্ণয় মাত্র। এখানে জ্ঞানলিপ্সু সাধক নিজের থেকে ভিন্ন একটি বিষয়রূপে জ্ঞানকে ত্রিয়ারূপ জ্ঞানের প্রকাশে, অর্থাৎ বিষয়টির নিজস্ব বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা ক্রিয়াসমূহ সম্পর্কে জানার মাধ্যমে উপলব্ধি করেন না—ব্রহ্মজ্ঞানলাভের ধারা বা প্রণালীতে কোনো জ্ঞাতা-জ্ঞেয় বা আধার-আধেয় ভাব নেই, এতে থাকে শুধুই বোধ বা জ্ঞান। এই জ্ঞানই যথার্থ প্রত্যয়, যা…'আছে'—এটুকমাত্র বোঝা যায়—দেশ-কাল-বস্তুপ্রকৃতি-কারণ-সিদ্ধান্ত যুক্ত হয়ে যে আপেক্ষিক 'আছে'-ভাব বা অস্তি (বিদ্যমানতা অর্থে) জাগ্রত হয়, এই জ্ঞান তা নয়; বরং উপলব্ধিরূপ 'আছে'-ভাব বা সুবৃহৎ জ্ঞানের সাথে অঙ্গীভূত তথা 'থাকে'-ভাব মাত্র।
ব্রহ্মজ্ঞান দ্বৈত নয়, পার্থিব সম্পর্কবিহীন (অনাপেক্ষিক) অদ্বৈতজ্ঞান; তবে জ্ঞানের বিষয়ের দিক থেকেই এক জ্ঞানের সঙ্গে অন্য জ্ঞানের মূল বিরোধ বা পার্থক্য বা দূরত্ব হয়—এ কথারই-বা যথার্থতা কীভাবে প্রমাণিত হয়?
কেবল পার্থিব জ্ঞানের দিক থেকেই সমস্ত বিরোধভাবের মীমাংসা বা সামঞ্জস্য করা যায়, অপার্থিব জ্ঞানের দিক থেকে নয়। আমরা ব্রহ্মজ্ঞান থেকে অন্যান্য পার্থিব বিষয়জ্ঞানের যখন ভেদ করি, তখন পার্থিব দৃষ্টি ও বৌদ্ধিক (বুদ্ধিগত) যুক্তিবিচারের দিক থেকে তা করে থাকি। মায়া বা সৃষ্টিকে মেনে নিয়ে এইসব পার্থক্য বা ভেদের অস্তিত্ব প্রতিপন্ন হয়—মায়া বা সৃষ্টির অতীত অবস্থায় কোনো ধরনের ভেদই যেখানে থাকে না, বরং একক অদ্বৈত জ্ঞানমাত্রই থাকে, সেখানে সকল ধরনের পার্থক্য, বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতির ভিন্নতা, জ্ঞানের বৈচিত্র্য, সব কিছুই অদৃশ্য হয়ে এক ও অভিন্ন সুবৃহৎ সত্তায় প্রতিভাত হয়। মায়া বা ভ্রান্তি এলেই অদ্বৈতভাব তিরোহিত হয় এবং দ্বৈতভাবের আবির্ভাব ঘটে।
বটগাছ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বিষয়ের বিবেচনায় ভেদযুক্ত, অর্থাৎ বটগাছ যেমন, অন্য গাছেরা তেমন নয়; তাই বটগাছের কী আছে বা কী নেই, বটগাছ কীরকম বা কীরকম নয়, এমন নানান বিষয় নিয়ে জানা বা জ্ঞানলাভ করা বটগাছ সম্পর্কে পার্থিব জ্ঞানার্জনের পথে সহায়ক। এমন জ্ঞানই হচ্ছে ভেদজ্ঞান। যখন অসংখ্য ভেদজ্ঞান আমাদের আত্মা বা চৈতন্য বা পরব্রহ্মের সাথে মিশে যায়, তখন খণ্ড খণ্ড জ্ঞান আলাদাভাবে প্রকাশিত না হয়ে একক সমগ্রজ্ঞানে উপলব্ধ হয়—আমরা সমুদ্রকে সমুদ্রই বলি, যে-সকল নদীর ধারা গিয়ে ওতে মিশেছে, তাদের নাম ধরে ধরে সমুদ্রকে ডাকি না বা তাদের পরিচয়ে সমুদ্রকে চিনি না। এখানে নদীসমূহ ভেদজ্ঞান এবং সমুদ্র অভেদজ্ঞান।
ছান্দোগ্য উপনিষদ বলছেন, মাটিই সত্য—মাটি থেকে তৈরি বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন নামে পরিচিত, তবে সকলেরই মূল উৎস মাটি। নতুন কোনো মাটির বস্তু নির্মিত হলে তারও নতুন একটি নাম দেওয়া হবে। অর্থাৎ এইসব পার্থিব পরিচয় নিত্য নয়, অনিত্য; সত্য (অভ্রান্ত) নয়, অসত্য (মনগড়া)। পার্থিবজ্ঞান ও ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে ভাবলে দেখব—প্রথমটি অসত্য, দ্বিতীয়টি সত্য; প্রথমটি অপরাবিদ্যা, দ্বিতীয়টি পরাবিদ্যা; প্রথমটি একেক পরিস্থিতিতে একেক রকমের, দ্বিতীয়টি সকল পরিস্থিতিতেই এক ও অভিন্ন; প্রথমটি খণ্ড, দ্বিতীয়টি সমগ্র; প্রথমটি নদীর অসংখ্য ধারা, দ্বিতীয়টি সকল ধারার সমষ্টি বা সমুদ্র; প্রথমটি পরিবর্তনশীল ও ক্ষণভঙুর, দ্বিতীয়টি শাশ্বত ও নিত্য; প্রথমটি বাহ্যজ্ঞান, দ্বিতীয়টি আত্মজ্ঞান।
শুরুতে একটি বিষয়কে ভিন্ন মেনে নিয়েই আমরা বিচারে প্রবৃত্ত হই—উঁচু-নিচু, পার্থিব-অপার্থিব, নিত্য-অনিত্য, ভালো-মন্দ ইত্যাদি ধারণা নিয়েই কেবল ভাবি। এমন ভাবনায় সঙ্গ দেয় আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বিশ্বাস, প্রত্যয় ইত্যাদি অনুষঙ্গ। ব্রহ্মজ্ঞান যতক্ষণ ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে ওঠে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তা বিচারের বিষয়ীভূত। তখন তা অপরাবিদ্যা বা পার্থিবজ্ঞান বা বৃত্তিজ্ঞান। এটিই ব্রহ্মজ্ঞানের প্রাথমিক ধাপ। সমগ্র হবার আগে খণ্ড হতে হয়। পরাতে পৌঁছোতে চাইলে অপরার হাত ধরতে হয়।
সাধক যখন—'অয়মাত্মা ব্রহ্ম' —আমার আত্মা ব্রহ্মের আধারে অবস্থিত; 'অহং ব্রহ্মাস্মি' —আমিই ব্রহ্ম, বা আমি পরম; 'তত্ত্বমসি' —দুটি ভিন্ন প্রকারবিশিষ্ট বা গুণবিশিষ্ট ব্রহ্মের অভেদ তথা 'আমি'তে প্রতিপাদন; 'সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম'—এই সব কিছুই ব্রহ্ম; 'সর্বংখলু ব্রহ্মময়ং ইদং জগৎ'—এই নিখিলচরাচর ব্রহ্মময়…এমন উপনিষদবাক্যসমূহ নিগূঢ়ভাবে উপলব্ধি করেন, তখন তিনি অভেদ বলতে সর্বভূতে ব্ৰহ্মদৃষ্টি বুঝে থাকেন। তৎ ও ত্বম্ বা জীব ও ব্রহ্ম, এই দুইয়ের স্বরূপ বিচারের পর সাধক প্রথম ধাপে নিজেকে ব্রহ্ম বা আত্মা বা চৈতন্য রূপে বিবেচনা করেন ('অহং ব্রহ্মাস্মি') এবং পরের ধাপে অন্য সমস্ত বস্তু বা সত্তা বা ধারণাকেও একই বিবেচনায় স্থাপিত করেন ('সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম')। এই প্রক্রিয়ার পর সাধক নিজের সাথে তাঁর পারিপার্শ্বিক জগতের আর কোনো বিভেদ দেখতে পান না। তখনই জগতের সমস্ত কিছুর সাথে সাধকের প্রকৃত একাত্মতা বা সংযোগ বা সর্বভূতে নিজেকে অভিন্ন রূপে দেখার মতো বোধ-বিবেক-বুদ্ধি-মন তৈরি হয়।
'ঈশাবাস্য মিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ' (ঈশ্বর দ্বারা সমস্ত জগৎ আদ্যোপান্ত আচ্ছাদিত রয়েছে)—ঈশোপনিষদের এই সনাতন শ্রুতি আমাদের অদ্বৈত বা অভেদ সাধনার মূলমন্ত্র। এ অভেদ পরমার্থিক, ব্যাবহারিক নয়। এর অর্থ এ ধরনের কিছু নয় যে: সকলেই মানুষ, তাই সকলে সমান; কিংবা সকল গোরুই গোরু, তাই সকল গোরুই এক—বরং এর অর্থ: সকল জড় ও জীব সত্তাই ব্রহ্ম, তাই সকলই এক ও অভিন্ন সমগ্র জ্ঞানের একেকটি অংশ কেবল, যেগুলি বোধে অংশরূপে নেই—সমগ্ররূপেই উপলব্ধ।
ব্যাবহারিক জ্ঞানে, ভেদই সত্য—এখানে অভেদ কোথায়? ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কিছুই, অভেদ নয়, বরং সবসময় ভেদই প্রতিষ্ঠিত করছে। বর্ণভেদ ও আকারভেদ চোখের প্রাণ—এটা না থাকলে রূপের জ্ঞান অনুভব করা অসম্ভব হতো। সুরভেদ ও লয়ভেদ কানের প্রাণ—এটা না থাকলে শোনা অসম্ভব হতো। ঠান্ডা কি গরম, এই ভেদেই স্পর্শের প্রতিষ্ঠা। মিষ্টি-তেতো-ঝাল-নোনতা ভেদ না থাকলে জিভের কি কোনো কাজ থাকত? সকল ইন্দ্রিয়ই ভেদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। ঠিক এই ভেদের জায়গায় পৌঁছোতে না পারলে অভেদে পৌঁছোনো যায় না। আগে বিষয়জ্ঞানে পারদর্শী হতে হবে, মননে ও ভাবনায় ব্যাবহারিক জগতের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে ভেদেরই জয়ধ্বনি।
সমস্ত ভেদজ্ঞান যখন চৈতন্যে এসে মিশে যায়, তখন ব্রহ্মে ও জগতে আর কোনো তফাৎ থাকে না—জগৎ হয়ে ওঠে ব্রহ্মময়, ব্রহ্ম ছড়িয়ে পড়েন জগৎময়; বিষয় ও বিষয়ীর মধ্যেও আর কোনো পার্থক্য থাকে না, এবং এই জায়গায় নিজেকে উন্নীত করার জন্য সাধককে শুরুতে ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিয়ে দ্বৈত ও পার্থিব জ্ঞানের বাহ্যিক ও প্রায়োগিক দিকগুলি সম্পর্কে ভেদজ্ঞানেই জানতে হয়। শুরুতেই অপরাবিদ্যা অর্জন না করলে পরাবিদ্যামুখী হওয়া দূরে থাক, সুস্থভাবে বাঁচাই কঠিন।
মুক্তি কখনও উৎপন্ন হয় না, মুক্তি আত্মজ্ঞানের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। কোনো কিছুর মাধ্যমে বা কোনো কিছুকে উপলক্ষ্য করে মুক্তির আলোক প্রকাশ পায় না, মুক্তির আলোক সবসময়ই প্রকাশমান—আমরাই অজ্ঞানের (না জানার) ফলে তা উপলব্ধি করতে পারি না। এই উপলব্ধির ব্যর্থতার জন্য আমরাই দায়ী, আমাদের সংস্কারই দায়ী। দর্শনশাস্ত্র এই সংস্কারকে বলছেন 'মায়া', যার সত্তা পরিমাপ বা নির্ধারণ করা যায় না—তা আছেও বটে, আবার নেইও বটে—এই আছে-নেই'র সংশয় প্রায়ই আমাদের ভ্রমে ফেলে দেয়। আচার্য শঙ্কর তাই 'বিবেকচুড়ামণি'তে বলছেন:
অব্যক্তনাম্নী পরমেশশক্তিরানদ্যবিদ্যা ত্রিগুণাত্বিকা পরা। কার্যানুমেয়া সুধিয়ৈব মায়া যয়া জগৎ সর্বমিদং প্রসূয়তে।। (১০৮)
এর অর্থ: মায়া বা অবিদ্যা ব্রহ্মের শক্তি। তাঁকে অব্যক্তও বলা হয়। তিনি আদিরহিত; সত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিন গুণসমন্বিত এবং কারণরূপা। সৃষ্টিরূপ কার্য হতে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্যক্তি তাঁর অস্তিত্ব অনুমান করতে পারেন। এই মায়া হতে সমস্ত জগৎ উৎপন্ন হয়।
তিনি অনির্বচনীয় মায়াকে 'কার্যানুমেয়া' বলেছেন: স্বরূপত তা নেই, কিন্তু তাঁর কার্য আছে, কেননা আমাদের উপর তাঁর প্রভাব পড়ে, আর সেজন্যেই আমরা মায়ার সত্তা জানতে পারি। শাস্ত্র এবং শাস্ত্রদর্শীরা বলেন, মানুষ জ্ঞানস্বরূপ। আর এদিকে আমরা অজ্ঞানীর মতন আচরণ করি। কেন হয় এমন? মায়ার কারণে। নিজের স্বরূপের যথার্থ অবধারণের মাধ্যমে যখন শুভবুদ্ধির বিকাশ হয়, তখনই বিবেকের আলোকে আমরা আমাদের ভুল বা ভ্রমজ্ঞান বুঝতে পারি, আর যখনই তা বুঝি, তখনই তা দূর হবার পথ প্রশস্ত হয় এবং এভাবেই জ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। বেদান্তে বলা হয়েছে যে, এই অজ্ঞাননাশ (আবরণভঙ্গ বা না জানার সমাপ্তি) ও জ্ঞানের (জানার) প্রকাশ একই সঙ্গে ঘটে।
অজ্ঞানের নাশই জ্ঞানের প্রকাশ। মেঘ যখন সূর্যকে ঢেকে ফেলে, তখন চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। মেঘ কেটে গেলে আবার আলো আসে। সূর্যের এই পুনর্প্রকাশ নতুন করে সৃষ্টি হওয়া নয়, বরং আলো আসার পথে যে বাধা বা আবরণ রূপে মেঘ ছিল, তার অপসারণ। সেরকম ব্রহ্মজ্ঞানের প্রকাশ মানেই ভ্রম, মিথ্যা প্রত্যয় ও অজ্ঞানের বিনাশ বা সংশোধন। এই বিনাশের পরেই আসে সত্য-শুদ্ধ-পূর্ণ জ্ঞানের প্রকাশ। এমন প্রকাশের ফলই আত্মজ্ঞান বা জীবন্মুক্তি। এমন মুক্তি মেঘে-ঢাকা সূর্যের মতোই আমাদের অন্তরে মিথ্যা ও ভ্রমের আবরণে বিবেক ও বোধের আড়ালে থাকে। তাই মুক্তিলাভ ও ব্রহ্মজ্ঞানলাভ একার্থক।
আবার যথার্থ বিচারের দৃষ্টিতে, মানুষের মুক্তিও নেই, বন্ধনও নেই; কারণ বন্ধন ও মুক্তি পরস্পর আপেক্ষিক—একটি থাকলে অপরটির অস্তিত্বকে বাধা বা প্রতিবন্ধক হিসেবে কল্পনা করে নিতেই হয়। এজন্য আচার্য শঙ্কর ব্রহ্ম বা ব্রহ্মজ্ঞানকে বন্ধন ও মুক্তির অতীত দ্বৈতাদ্বৈতবিবর্জিত বলেছেন—সে এক অচিন রাজ্য; সে রাজ্যে যিনি যান, এক তিনিই বোঝেন তা কেমন; বাকিরা কেবলই কল্পনার জাল বোনে। সাধনা ও অজ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্বৈতও থাকে, অদ্বৈতও থাকে; বন্ধনও থাকে, মুক্তিও থাকে; শাস্ত্রবিচারও থাকে, বাদানুবাদও থাকে—কে যে কখন ঠিক বা ভুল, কোন পথ যে গ্রহণীয় বা বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা বড়ো শক্ত!
সত্যিকারের ব্রহ্মানুভূতি যে ভাগ্যবান সাধকের হয়, কেবল তিনিই বোঝেন যে, ব্রহ্মবস্তু দ্বৈতও নয়, অদ্বৈতও নয়—ব্রহ্ম দ্বৈতবাদেরও প্রতিপাদ্য নয়, আবার অদ্বৈতবাদেরও প্রাপ্য নয়—ব্রহ্ম এমনই এক অনুভূতি, যাতে পৌঁছোতে পারলেই কেবল তা কেমন টের পাওয়া যায়, যাকে বুদ্ধিবিচার বা জ্ঞান দিয়ে জানা যায় না। বুদ্ধিবিচারের কাজ হচ্ছে জ্ঞানকে নিরাবরণ করা (সূর্য যেমনি নিরাবরণ হয় মেঘ সরে গেলে) এবং তারপর তার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা। এই উদ্দেশ্যটি পূরণ হলে ঠিক তখনই বুদ্ধি—বৃত্তি ও সংস্কারশূন্য হয়ে বোধিতে পরিণত হয়। মায়ায় নিমজ্জিত মন মুক্তির প্রধান অন্তরায়, আর সত্য-শুদ্ধ মন মুক্তির পথপ্রদর্শক। ব্রহ্মকে জানতে হলে জ্ঞানসমৃদ্ধ বুদ্ধি ও মনের প্রয়োজন, আর ব্রহ্মকে অনুভব করতে হলে সত্য-শুদ্ধ বুদ্ধি ও মনের প্রয়োজন।
মানুষ আদতে মুক্ত আছেই—তা সম্পর্কে জানা বা সচেতন হওয়াটাই মানুষের মূলকাজ। তাকে এটা জানানোর জন্যই এত শাস্ত্র, এত বিচার, এত দর্শন, এত অধ্যাত্ম-পথ, এত সাধনা। এক মুক্তিকে কেন্দ্র করেই এত এত মতবাদের সৃষ্টি। এইসকল মতবাদ চরমসত্যকে বোঝার একেকটি উপায়—যুগে যুগে নানান মহাত্মা ধর্মগুরু এবং ধর্মপ্রবর্তক, যিনি যেভাবে মুক্তির আস্বাদ পেয়েছেন, তিনি সেভাবেই মুক্তি তথা ব্রহ্মকে পাবার পথ নির্দেশ করেছেন।
এই পথগুলির কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তার বিচার আমাদের পক্ষে করা অসম্ভব, কেননা আমরা আসলে চরমসত্যে এখনও পৌঁছোতেই পারিনি—পৌঁছোতে পারতাম যদি, তবে দেখতাম, এখানে কোনো সত্য-মিথ্যার বিচার নেই—এ এক বিশুদ্ধ অনুভূতি, যা ব্যাখ্যাতীত ও অনির্বচনীয়, যাকে কেবল নৈঃশব্দ্যের নৈবেদ্যেই প্রণতি নিবেদন করতে হয়। সেই পবিত্র স্থানটির নামই মুক্তি, যা সকল যুক্তি, তর্ক, দর্প, ঈর্ষা, বিবাদ, বিশ্বাস, সংস্কারের অনেক ঊর্দ্ধে।