একজন হরিসাধন স্যার

স্টুডেন্টলাইফে যে-সকল গুরুর পায়ের কাছে বসে শিখেছি, তাঁদের মধ্যে সবচাইতে বেশি মনে পড়ে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক হরিসাধন দত্ত স্যারের কথা।




স্যারের চাইতে সহজসরল এবং পণ্ডিত মানুষের সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। তাঁর পাণ্ডিত্যের সাথে কেবল অসীম আকাশেরই তুলনা চলে। অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি---এই তিন বিষয়ে বাকি শিক্ষকদের যা ছিল, তার নাম জ্ঞান; হরিসাধন স্যারের যা ছিল, তার নাম প্রজ্ঞা। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন; বেদ, গীতা, উপনিষদ থেকে শুরু করে নানান ধর্মের দর্শন নিয়ে তাঁর ছিল প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য। আমার ইংরেজির ভিত্তি ও আগ্রহ গড়ে দিয়েছিলেন তিন জন গুরু: বাবা, সেজোমেসো, হরিসাধন স্যার। আমার দেখা এই তিন জন ছিলেন চলমান অভিধান।




স্যার ঘড়ি পরতেন না, অথচ চাঁদ-সূর্যের অবস্থান বুঝে নিখুঁতভাবে সময় বলতে পারতেন। বড়ো আধ্যাত্মিক ধাঁচের মানুষ ছিলেন তিনি। কথা বলতেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়, খুব একটা স্মার্ট মানুষ ছিলেন না, মুখে মধুও ছিল না তেমন। ক্ষীণস্বরে বলা সেই ছোটো ছোটো কথার ভার ছিল পর্বতসম। ভোর সাড়ে তিনটায় উঠে সারাবছরই ঠান্ডা জলে স্নান করতেন, দিনে আহার করতেন একবেলা, ছিলেন নীরোগ এবং শীর্ণকায়। মাঝারি উচ্চতার ছোটোখাটো গড়নের মানুষটা পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ও যেন কারও চোখে তেমন পড়তেন না; তিনি চলাফেরা করতেন খুব নীরবে, সবার চোখের আড়ালে...নিজেকে লুকিয়ে বাঁচতেই বেশি পছন্দ করতেন। অতিমাত্রায় সাদামাটা জীবনযাপন ছিল তাঁর; টাকা রাখতেন পাঞ্জাবির পকেটে, মানিব্যাগ ইউজ করতেন না। স্যারকে কখনও জুতো পরতে দেখিনি---খুব‌ই অল্প দামের ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে হয় চটি পরতেন, নয় খালিপায়ে হাঁটতেন। যাঁদের পায়ে জুতো ছিল, তাঁদের সবার পা মিলেও স্যারের পায়ের চাইতে ভারী ছিল না।




আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক সিংহতুল্য মানুষ এ কে এম মাহমুদুল হক কেবল হরিসাধন স্যারকেই বেশ সমীহ করে চলতেন, কেবল হরিসাধন স্যারের সাথেই কথা বলার সময় মাথা নিচু করে রাখতেন। স্যারকে তিনি অনুরোধ করে অনেকটা হাতেপায়ে ধরেই আমাদের স্কুলে নিয়ে এসেছিলেন অজপাড়া গাঁয়ের সাধারণ একটি স্কুল থেকে। স্যার শহরে থাকতে একদমই পছন্দ করতেন না, নাগরিক জীবনের উপর খুবই বিরক্ত ছিলেন। বলতেন, আহা, কতদিন মানুষ দেখি না…




স্যার থাকতেন স্কুলের পেছনে ভাঙাচোরা একটা ঘরে। হেডস্যার ঘরটা মেরামত করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হরিসাধন স্যার রাজি হননি। বলেছিলেন, "ওই টাকায় বরং ছাত্রদের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করে দিন।" করা হয়েছিল‌ও তা-ই। আমরা কয়েকজন আক্ষরিক অর্থেই স্যারের পায়ের কাছে নিচে মাটিতে বসে থাকতাম তাঁর কথা শোনার জন্য; আর স্যার বসতেন ঘরের দরোজার ছোট্ট সিঁড়িতে। তাঁর মুখের একটা কথা শত শিক্ষকের হাজার কথার চাইতেও দামি ছিল।




প্রচুর বই পড়তেন হরিসাধন স্যার। সকালে রোদ পোহানোর সময়ও স্যারের হাতে বই থাকত, ক্লাসে যাবার সময় আমরা দূর থেকে দেখতাম। কখনো রেগে গেলে ক্লাসে বা স্কুলের বারান্দায় আমাদের দিকে হাতের ডাস্টারটি ছুড়ে মারতেন। কর্কশ আচরণের কারণে স্যারের ধারেকাছে কেউ তেমন একটা ভিড়ত না। একজন হরিসাধন দত্তের চটির চপেটাঘাত যে সারাজীবনের অমূল্য সঞ্চয় হতে পারে, এই সত্যটা বোঝার বয়সই তো তখন পর্যন্ত আমাদের হয়নি!




হরিসাধন স্যারকে যে দুইটি জিনিস সবচাইতে বেশি বিরক্ত করত, তা হচ্ছে টাকা ও মিথ্যা। তাঁর দু-পায়ের কাছে ছড়িয়ে-থাকা ঐশ্বর্য পায়ের কাছে বসেই নিতে হতো, অর্থ দিয়ে নয়। মজার ব্যাপার, স্যার সত্যিই কখনও মিথ্যা বলতেন না। স্যারের চাইতে সহজ করে ইংরেজি আর জ্যামিতি পড়াতে এ জীবনে আর কাউকেই কখনও দেখিনি। পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটা বলতেন, ধর্ম খুঁজিস না রে, মানুষ খুঁজিস।




আপনার জীবনে আছেন এমন কোনো গুরু?