আমার বুড়োটা!

বুড়োকে খুব মনে পড়ে। ওঁর কথা একটু বলি, রাগ করবেন না।




বুড়োর জন্য এ বুকে একসমুদ্র ভালোবাসা আমৃত্যু রয়ে যাবে। ওঁর অফিসের সামনে গেলে, একদিন আমাকে ভয় দেখিয়েছিলেন যে, পুলিশে ধরিয়ে দেবেন। আমি কি কিছুকে ভয় পাবার মতো মেয়ে? ওঁকে ভয় পেতে দেখে সেদিন খুব হাসি পাচ্ছিল। উনি ভেবেছিলেন, আমি ওঁর ক্ষতি করব। অথচ আমি যে ওঁকে ভালোবাসি, ক্ষতি করার কথা মরে গেলেও কি ভাবা যায়!




বুড়োকে এতটাই ভালোবাসি যে…হ্যাঁ, উনি অন্য কারও হলে আমার কষ্ট হয়, তবু উনি যদি সুখী হন, তাহলে আমার সামনে ওঁকে অন্য কারও সাথে সঙ্গমরত দেখলেও কষ্ট হবে না, বরং সুখ লাগবে উনি সুখী হয়েছেন বলে। কে বলে, নারীরা প্রেমিকের ভাগ অন্য নারীকে দিতে পারে না? ওঁর সুখের জন্য আমি সব পারি—আমার নিজের সমস্ত খুশি এক ওঁর খুশিতেই।




প্রতি বৃহস্পতিবার উনি বাড়ি যান, আগে আমি যেতে দিতাম না। কিন্ত এখন বৃহস্পতিবার এলেই শুক্রবার রাতে কল্পনা করি, উনি বউয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ…! সুখেই আছেন, একটুও কষ্ট হয় না ওঁর, অথচ ওঁকে আমি আকাশসমান ভালোবাসি।




ইচ্ছে করে ওঁর গালে অনন্ত-কোটি চুমু খেতে। মনে হয়, ওঁকে একবার দেখতে পেলে কী যে সুখ পেতাম!




শেষ যেদিন দেখা হয়, উনি আমাকে একজাম দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় বলছিলেন, ডানহাতের আঙুলটা ব্যথা করছে। শুনে আমার ইচ্ছে করছিল আঙুলটা ছুঁয়ে দিতে। বাসায় এলে বললেন, কেন একবার আমার আঙুলটা ছুঁয়ে দিলে না? আমি বারবার চাইছিলাম, একটু ছুঁয়ে দাও। তুমি ছুঁয়ে দিলে সব ব্যথা সেরে যেত।




আঙুল না ছোঁয়ার সেই যন্ত্রণা বুকে আজও জমে আছে।




ইচ্ছে করে, জিজ্ঞেস করি সামনে গিয়ে: "তোমার আঙুলে কি ব্যথা করে? আমি কি একটু ছোঁব?" আচ্ছা, সত্যিই কি আমি ছুঁয়ে দিলে ওঁর ব্যথা সেরে যেত?




আমি ভাবি, আমাকে ছাড়া ওঁর কি শূন্য লাগে না! এই শূন্যতা কি ওঁর স্ত্রীর ছোঁয়ায় পূর্ণ হয়? আমি জানি, কখনোই হয় না। আমার ভাবতে ভালো লাগে যে, আমি বুড়োকে খুব ভালো করে চিনি।




ছাদে উঠে চেয়ারে বসে পুবালি বাতাসে চাঁদ দেখে ও নিশ্চয়ই মনে মনে বলে, সুপ্তা, তুমি আমার একফালি চাঁদ, তুমি আজও এই বুকের ভেতরে বেঁচে আছ। তোমাকে ভোলা যায় না।




সত্যিই কি আমাকে ভুলে থাকা যায়! তবে কেন এত নিষ্ঠুর হয়ে গেল আমার বুড়োটা!




মধ্যবয়সের প্রেম—সমাজ, পরিবার, সবার ঊর্ধ্বে উঠে প্রকাশ করা যায় না; লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসতে হয়। সেই ভালোবাসা ফুলের সৌরভের মতো, রাতজাগা পাখির মতো, আপন পাঁজরের ভেতরে হ‌ওয়া ধুকধুক শব্দের মতো। এ প্রেমকে নিজের থেকে আলাদা করা যায় না।




আমি অন্যের বরকে ভালোবাসি।




অন্যের জিনিসে লোভ করা পাপ ব‌ইকি! কিন্তু পাপের শাস্তি হিসেবে এ আমি কী পাচ্ছি, এত সুখ মাখা যাতে! বুড়োকে না পাবার মাঝেও অনন্ত সুখ। মনে হয়, ও যেন আমার বুকের ভেতরে কোথায় মিশে আছে!




আমি এমন এক বয়স্ক লোককে ভালোবাসি, যে আমার চেয়ে ত্রিশ বছরের বড়ো! ভাবা যায়! যখন ওঁর বয়স ত্রিশ, তখন আমি পৃথিবীতে এসেছি...পুঁচকে একটা! আর উনি তখনই বিবাহিত, ওঁর সাথেই কিনা এতকিছু…!




বুড়োর মেয়ে আমার বান্ধবী, বুড়োর ব‌উ আমার দীর্ঘশ্বাস, আর বুড়ো আমার নিঃশ্বাস। এ-ই ছিল আমার কপালে!




ওঁকে কখনোই আমার বয়স্ক মনে হয় না। ইচ্ছে করে, জোর করে বুকে জড়াই!




উনি প্রায়ই হুমায়ূন আর শাওনের কথা বলতেন, বলতেন আমাকে বিয়ে করার কথা। আমি কখনও ভাবিনি ওসব, কিন্তু উনি যে মিথ্যে বলতেন, তা-ও ভাবিনি।




আচ্ছা, আমার মতো একটা মেয়েকে উনি কীভাবে উপেক্ষা করেন! কীভাবে দূরে থাকেন আমার কাছ থেকে! উপেক্ষা করার এমন অসীম ক্ষমতা উনি কোথায় পেলেন?




আমার আর বাচ্চা ছেলেদের…বাচ্চা মানে ত্রিশের নিচে যারা, তাদের ভালো লাগে না। উপেক্ষাই কি তবে প্রেম? প্রেম কাউকে বানায় মায়াবী, কাউকে বানায় নিষ্ঠুর।




আমার এই দুর্বার আকর্ষণ এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের জন্য। এ নিছক কামনা নয়, এ প্রেম। এ বড়ো সুন্দর, স্নিগ্ধ, তীব্র প্রেম—যেখানে তীব্র কামনা আছে, না পাবার সুখ আছে।




ইচ্ছে করে, ওঁকে তুলে আনি, গৃহবন্দি করে রাখি; তারপর ইচ্ছেমতো আদর করি।




এই বুড়ো বয়সে একটা যুবতী মেয়ের তীব্র ভালোবাসা পাবার সৌভাগ্য লাভ করেও তাকে উপেক্ষা করে যে, সে হতভাগা ছাড়া আর কী! আমি সেই হতভাগার আকুল বাসনাময়ী প্রেমিকা।




আমি তো ঘর চাইনি, শুধু একটু আশ্রয় চেয়েছি—তা-ও পেলাম না!