ধর্মকর্ম বিষয়টি যতটা ব্যক্তিগত রাখা যায়, ততই ভালো। কেন? বলছি। হয়তো আপনি মনে মনে ভাবছেন, আপনি ধর্মের বিষয়গুলি অনেকটাই জানেন এবং বিশুদ্ধভাবে মানার চেষ্টা করেন কিংবা মানেন। একইসাথে আপনি এ-ও ভাবছেন, আপনার সামনের ব্যক্তিটি ধর্মের বিষয়ে অনেকটাই উদাসীন এবং অজ্ঞ। আপনি চাইছেন, আপনি নিজে যেহেতু সৎপথে এসেছেন, স্রষ্টা যেহেতু আপনাকে সৎপথে এনেছেন, তাহলে এখন এটা আপনার অবশ্যকর্তব্য-কর্ম যে অন্য সকল অসৎ এবং পথভ্রষ্ট মানুষকেও আপনি সৎপথ দেখাবেন। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে কাজটি করবেন? এমন মুহূর্তে আপনি সর্বপ্রথম যে কাজটি করবেন, সেটি হচ্ছে, আপনার সামনে-থাকা অসৎ, অজ্ঞ ব্যক্তিটিকে তার অজ্ঞতা সম্পর্কে জানাবেন; সেইসাথে তার যত রকমের ভুল আপনার চোখে ধরা পড়ে, অর্থাৎ তার যে-সকল কাজ কিংবা ব্যবহার, আচার-আচরণ, চলাফেরা আপনার চোখে ও আপনার নীতিতে মন্দ এবং ভুল বলে মনে হয়, সেগুলো সবই বলবেন। কিন্তু এতে কী হয়, জানেন? প্রথমেই যখন আপনি একটা মানুষের সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনেই তার গতিবিধি বিবেচনা করে একটা মনগড়া ধারণার উপর ভিত্তি করে তাকে অপরাধীর কাতারে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেন, তখন আপনাআপনিই আপনি ওই ব্যক্তিটির মন থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরে যান। কেননা আপনি কোনও মানুষের যতই কাছের হোন না কেন, তার পুরোটা জানা আপনার পক্ষে অসম্ভব। আপনি না জেনেই কারও সম্পর্কে এরকম ধারণা যতই করবেন, ততই একজন বিরক্তিকর ফালতু লোকে পরিণত হবেন। 'আসুন আমাদের গাড়ির নিকট, দেখুন আমাদের মলমখানা...' এরকম ফুটপাথের ক্যানভাসারের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কিন্তু খুব সামান্যই। এরকম গায়ে-পড়া স্বর্গের এজেন্টদের সবাই ঘেন্না করে, করুণা করে। নিজের আমলনামা ঠিক করুন, অন্যের আমলনামার জন্য আপনাকে নরকে যেতে হবে না। গায়ে-পড়া স্বভাবের ভালো লোকও সবসময়ই চরম বিরক্তিকর। না জেনে কিংবা অনুমান করে যারা মানুষের সম্পর্কে মন্তব্য করে, তারা নিশ্চয়ই স্রষ্টার কাছে অপ্রিয়। যখন আপনি একটা মানুষের আবেগের, পছন্দের জায়গা থেকে মানসিকভাবে দূরে সরে যান, তখন আপনি তাকে যতই ভালো ভালো কথা বলুন না কেন, পরামর্শ দিন না কেন, সেগুলোর কিছুই তার কান অবধি পৌঁছোবে না, সে আসলে তখন আর আপনার কোনও কথাই মনোযোগ দিয়ে, গুরুত্ব দিয়ে শুনবে না। হয়তো সে তাৎক্ষণিকভাবে আপনার সাথে সঙ্গ দিতে হুঁ-হ্যাঁ করবে, কিন্তু এরপর যখনই আপনি এসব বিষয় নিয়ে কিংবা কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াও তার সামনে যাবেন, সে আপনার কাছ থেকে পালাতে চাইবে, আপনাকে এড়িয়ে চলবে, নিঃসন্দেহে আপনি তার কাছে বিরক্তিকর পাত্রে পরিণত হবেন। সবচাইতে বড়ো কথা, কার শান্তি কীসে আসবে, সেটা ঠিক করে দেবার আপনি আমি কে? কোনও মানুষের দোষ ধরে ধরে তার পছন্দের হওয়া যায় না। একজন মানুষকে অসম্মান করে এবং ছোটো করে নিজেকে তার কাছে বড়ো প্রমাণ করা যায় না। আপনি হয়তো ধর্মের বিষয় যতটা জানেন, সে তার চাইতে অনেক অনেক বেশি জানে, কিন্তু সে সেগুলো নিজের উপরেই প্রয়োগ করে নিভৃতে। হয়তো সে একজন নিভৃতচারী ধার্মিক। হয়তো সে নিজেকে এবং নিজের স্বরূপকে লুকিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। হয়তো সে নিজের কাছেই নিজে বদ্ধপরিকর এবং বিশুদ্ধ। কিংবা এ-ও হতে পারে, সে চাইছে না, কেউ তাকে জোর করে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কিছু করতে বাধ্য করুক। সে হয়তো জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে আরও পোক্ত করে জানতে চাইছে, সে হয়তো বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিজেকে জানতে চাইছে। স্রষ্টাকে জানার পথ হয়তো তার কাছে কিছুটা ভিন্ন। হয়তো সে আপনার মতন গলায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে পথে পথে ধর্মের চানাচুর ফেরি করে বেড়ায় না। বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষই স্রষ্টার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন একান্তে, নিভৃতে, নীরবে। সবাই একই পথে হাঁটতে পছন্দ করে না এবং সবাই একই পথ ধরে হেঁটে গেলে, সেখান থেকে ভিন্ন কিছু আসেও না। যদি আমাদের প্রত্যেকের পথ আলাদা হয়, তাহলে এমনটাই সমীচীন যে, নিজের পথ নিজেই নির্ধারণ করা। যে পথে হেঁটে গেলে সকল মানুষের মঙ্গল হয়, সে পথই স্রষ্টার পথ। এমন পথের সংখ্যা নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই একাধিক! আবার এমনও হয়, সবাই মিলে ধরেবেঁধে কোনও একজন মানুষকে ঠিক করতে চাইলে স্রষ্টার প্রতিই তার বিতৃষ্ণা চলে আসে, তাঁকে জানতে কোনও কৌতূহল তার মধ্যে আর জাগে না। কাউকে এভাবে জোর করে স্রষ্টাবিমুখ করে ফেলা নিঃসন্দেহে বড়ো পাপ। প্রত্যেকটা মানুষকে তার নিজের ধারণায় নিজের মতো করে বাঁচতে দেওয়া একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য তার জন্মগত অধিকার, যে অধিকার স্বয়ং স্রষ্টাই মানুষকে দিয়েছেন। আর এ কারণেই একটা বয়স পর যখন মানুষ আত্মনির্ভরশীল হতে থাকে, তখন সে তার নিজের গণ্ডি নিজে তৈরি করে নেয়, তখন সে সকলকেই তার অপছন্দের কাজগুলোতে মুখের উপর ‘না’ বলতে শেখে কিংবা প্রতিবাদ করে ওঠে। তখন শত চেষ্টা করেও তার উপর বাইরের কারও নিয়ন্ত্রণ আর চলে না। তখন সেই মানুষটির কাছের মানুষগুলো হঠাৎ তার এরূপ পরিবর্তন দেখে কিছুটা হোঁচট খায়, কিন্তু কিছু দিন পরেই তারা এ-ও বুঝে যায়, সেই মানুষটি এখন আর তাদের কোনও কথারই পরোয়া করে না। দিনশেষে, সেই মানুষটি এখন তা-ই করে, যা-কিছু তার হিসেবে ঠিক মনে হয়। তখন সে চাইলে মানসিক কিংবা শারীরিকভাবেও দূরে সরে যেতে পারে, নিজেকে সবসময় অন্যদের থেকে একটা দূরত্বে রেখে দিতে পারে, যদিও তাদের অনেকেই তার কাছের মানুষ, তা সত্ত্বেও, তার কাছের হয়েও খুব সাধারণ, খুব স্বাভাবিক দুটো কথা বলতেও তাদের মনে হাজারো সংকোচ তৈরি হয়ে যেতে পারে। তখন আর খুব কাছের মানুষ হয়েও কাছে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না, মন তখন ভেতর থেকে বার বার একটা কথাই বলতে থাকে…বড্ড ভুল হয়ে গেছে, বড্ড ভুল হয়ে গেছে! তাই এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হবার আগেই নিজের সীমানা বুঝতে চেষ্টা করুন। বুঝুন, তার স্বকীয়তা নিয়েই তাকে বেড়ে উঠতে হবে। মহাকাল তাকে নিজ দায়িত্বে সেভাবেই গড়ে তুলবে, যেভাবে গড়ে ওঠা তার প্রয়োজন। মাঝখান থেকে আপনি নিজের ভুলের কারণেই মানুষটির মন থেকে দূরে সরে যাবেন। যোজন যোজন পথের দূরত্বও মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু মানসিক দূরত্ব একবার তৈরি হয়ে গেলে সে দূরত্ব কিছুতেই আর ঘোচে না।