যখন সে আর থাকতে চায় না

 নিজের জীবনে আপনাকে রেখে দেবার জন্য যদি সে কিছুই না করে, তবে হয়তোবা সে আর চাইছে না, আপনি থেকে যান। সে আপনার চলে যাবার অপেক্ষায় আছে। আপনাদের দু-জনের মধ্যে যে মনোমালিন্যটা চলছে, সেটার শুরু থেকেই আপনি এই সম্পর্কের ইতি অবচেতন মনে যতটা চেয়েছেন, সে তার চাইতেও অনেক বেশি সচেতন মনেই চেয়েছে।
  
 মুখে বলতে পারেনি, এখন নিশ্চেষ্ট থেকে কাজে দেখিয়ে দিচ্ছে। 'চলে যাও!' কথাটা সবাই তো আর মুখে বলতে পারে না, তাই না? অনেকে আবার এটাও ভাবে, দোষটা আমার ঘাড়ে কেন চাপবে? সে-ই বলুক, আমি কেন আগে বলব?
  
 সে-ও হয়তো ওদেরই দলে। সে চায় না, সবাই তাকে আঙুল উঁচিয়ে বলুক, 'এই বিচ্ছেদের জন্য তুমিই দায়ী! তুমিই তো চেয়েছ!' সে বরং এই অভিনয়টা করবে---সে শত কষ্ট সহ্য করেও, শত ত্যাগস্বীকার করেও থেকে যেতে চেয়েছিল! আপনিই দায়ী সব কিছুর জন্য! অথচ দেখুন, প্রকৃত ঘটনা ঠিক উলটো! আপনিই এত কিছুর পরও সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চাইছেন, সে-ই বরং চাইছে না যে সম্পর্কটা থাকুক।
  
 সে মুখে মুখে আপনাকে বলবে, সে আপনাকে ভালোবাসে। এমনকী প্রতিদিনই সে এটা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে! কিন্তু আপনিই ভাবুন, সেই ভালোবাসার কী দাম, যে-ভালোবাসা কেবলই মুখে মুখে? ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির আচরণে, নানান ঘটনায়। আরও ভালো হয়, যদি ভালোবাসাটা ধরা পড়ে নীরবতায়। আপনি ঠিকই ধরতে পারবেন।
  
 অথচ এদিকে আপনি নিজে কী করছেন? প্রতিদিনই নিজেকে মিথ্যে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। বোঝাচ্ছেন, সে আসলে আপনাকে ভালোবাসে, তার ভালোবাসার প্রকাশটাই ওরকম! আপনি তার ভালোবাসাহীন চোখেও ভালোবাসা আবিষ্কার করার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন, কেননা আপনি তাকে ভালোবাসেন, আপনি তার সঙ্গে থাকতে চাইছেন।
  
 এই পুরো ব্যাপারটা খুব ক্লান্তিকর, জানেন? দু-জন মানুষকে একসঙ্গে রাখার জন্য আপনি একা যুদ্ধ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। আপনি যেখানে এক-পা সামনে দেন, সেখানে সে কিনা দুই-পা পেছনে দেয়! দেখলে মনে হয় যেন আপনি কী একটা দায়ে পড়ে গেছেন! এখন আপনার একারই দায়িত্ব সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে যাওয়া!
  
 আপনি কেন করছেন এমন? কেননা আপনি ভাবছেন, পুরনো একটা সম্পর্ককে শেষ করে দিলে আপনাকে নানান ভোগান্তিতে পড়তে হবে। লোকে কী বলবে! এই সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেলে আপনি তো অথই সমুদ্রের মাঝখানে পড়ে যাবেন! তখন কী হবে!
  
 আপনি সম্পর্কের যত্ন নিতে জানেন, শেষ করে দিতে নয়। আপনি সবসময়ই চেষ্টা করে এসেছেন তাকে বুঝতে, সম্পর্কটাকে সুন্দর ও স্বাভাবিক রাখতে। আপনি তাকে বিশ্বাস করেছেন, সম্মান করেছেন। দু-জনের মধ্যে প্রথম ছাড়টা যিনি দিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন আপনি। কখনও কিছুর দরকার হলেও তাকে বলেননি। এমন নয় যে, বলতে আপনি ভয় পেতেন। আপনার মনে হয়েছে, যদি এটা তার জন্য চাপ হয়ে যায়! ওদিকে সে জেনে-বুঝেও আপনার কোনও চাহিদার দিকে কখনও খেয়ালই রাখেনি, কেননা আপনি মুখ ফুটে তাকে কিছু বলেননি।
  
 আচ্ছা, আপনি কি ভালো আছেন? আপনার কি সত্যিই ভালো থাকতে ইচ্ছে করে না? কেন এটা জোর করে মেনে নিতে চাইছেন না যে তাকে ছেড়েই আপনি ভালো থাকবেন? নিজের মনকে বার বার থামিয়ে দিয়ে নিজেকে ক্রমেই এমন শেষ করে দিয়ে আপনার কী লাভ হচ্ছে? সে-ও বিরক্ত হচ্ছে, আপনার নিজের মনের অশান্তিও বাড়ছে।
  
 দেখুন, মাঝে মাঝে এ পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই ঘটে, যা মেনে নিতে মন চায় না। কী? ঘটে না? আমরা যেরকম করে চাই, ঠিক সেরকম করেই কি সব কিছু শেষ হয়? প্রায়ই দেখা যায়, নিজেকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে বিচ্ছেদটা আমাদের খুব দরকার, সেই বিচ্ছেদটাই শুরুতে আমরা মানতে পারি না। মানা তো দূরস্থ, তা নিয়ে ভাবতে পর্যন্ত পারি না! অচেনা রাস্তার ভয়ে আমরা চেনা রাস্তায় কুকুরের মতো দাঁত দিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকি!
  
 কোনও মানে হয়? সম্পর্ক তো দু-জনের জন্যই জরুরি। তো একজন যদি জরুরি না ভাবে, তা-ও তাকে জোর করে আটকে রাখতে হবে বিভিন্ন অজুহাত মাথায় এনে এনে? তার চেয়ে বরং নিজেও বাঁচুন, তাকেও বাঁচতে দিন। অচেনা রাস্তা মানেই চেনা রাস্তার চাইতে খারাপ কিছু, তা তো না-ও হতে পারে! অচেনা রাস্তা চেনার কষ্টটা নিঃসন্দেহে আপনার বর্তমান চেনা রাস্তায় থেকে যাবার কষ্টের চাইতে অনেক কম! এরকমই হয়।
  
 মনে রাখবেন, যে যুদ্ধে দু-জনেরই স্বার্থ জড়িত, সে যুদ্ধ একলা লড়াটা প্রকৃতপক্ষে হেরে যাবারই নামান্তর।