৪০তম বিসিএস-এ সুপারিশপ্রাপ্তদের প্রতি

১. দুইটা জিনিস মন থেকে একেবারেই ঝেড়ে ফেলবেন:
ইগো
সার্টিফিকেট




এর কোনোটাই সিভিল সার্ভিসে কোনও কাজে লাগে না। আপনি কোথায় পড়েছেন, কী রেজাল্ট করেছেন, এসব মাথায় যত কম রাখবেন, তত ভালো থাকবেন। এখানে কেউ কারও চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সবাই সমান, ভালো ক্যারিয়ার গঠন করার সুযোগ এখানে সবার‌ই সমান। আপনি পাবলিক, প্রাইভেট, না কি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, তা দিয়ে কার‌ও কিছুই এসে যায় না।




২. যখন কোনও সেবাগ্রহীতা আপনার কাছে আসবে, তখন তাকে বেশি সময় অপেক্ষা করিয়ে না রেখে তার কথাগুলি শোনার চেষ্টা করবেন। তার কাজটা করে দিতে পারুন বা না পারুন, তার কথাগুলি ধৈর্য ধরে শুনবেন।




৩. সহজে রাগ করা যাবে না। তবে কখনও কখনও রাগের অভিনয় করতে হয় কাজের প্রয়োজনে। রাগ-অনুরাগ যত কম রাখা যায়, সিভিল সার্ভিসে তত‌ই ভালো। একজন সরকারি কর্মচারীর রাগ ও অনুরাগ দুই-ই হবে কপট, যা অনেকসময় কাজের স্বার্থে দেখাতে হয়।




৪. আপনার সঙ্গে আপনার অধস্তনদের কোয়ালিটির পার্থক্য কেবলই কিছু নম্বর, আর কিছু নয়। বিসিএস পরীক্ষায় মাত্র কয়েক নম্বরের পার্থক্য‌ই চেয়ারের পার্থক্য গড়ে দেয়। হয়তো ভাগ্য আপনার প্রতি একটু বেশি প্রসন্ন ছিল। তাই হামবড়া ভাব রাখা যাবে না।




৫. সবসময়ই লো প্রোফাইলে চলা ভালো। নিজেকে যত বেশি অপদার্থ করে দেখাতে পারবেন, তত‌ই ভালো থাকবেন; বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসের বাইরে। লোকজন সরকারি কর্মচারীদের গাধা ভাবতে পছন্দ করে। ওদের তা-ই ভাবতে দিন। এমনকী আপনার দপ্তরের মধ্যেও নিজেকে লুকিয়ে রাখলেই ভালো থাকতে পারবেন। ফোকাসে আসার চেষ্টা করলেই মরবেন। চুপচাপ কাজ করে যান।




৬. অসীম ধৈর্য থাকতে হবে। কোনোভাবেই কোনও কিছু নিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা যাবে না। দরকারি বিষয়গুলো নিয়ে লেগে থাকতে হবে। ধৈর্য যার যত কম, সে তত বাজে কর্মী।




৭. দাপ্তরিক সীমাবদ্ধতা ও দাপ্তরিক পরিধি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। আপনি কী করতে পারেন ও কী করতে পারেন না, কতটুকু করতে পারেন ও কতটুকু করতে পারেন না, এসব নিয়ে খুব ভালো করে জানতে হবে।




৮. নির্দিষ্ট কোড অব কনডাক্ট মেইনটেইন করতে হবে। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক ও আচরণ খুব ভালো করে বুঝতে হবে। সিনিয়ররা সবসময়ই জুনিয়রদের সাপোর্ট দেন। তবে সেটা আদায় করে নিতে হবে নিজের কাজ ও আচরণের মাধ্যমে।




৯. সিভিল সার্ভিসে "ডিজার্ভ করা" বলতে কিছু নেই। আপনি যা অর্জন করবেন, তা-ই আপনার ক্যারিয়ারের ঝুলিতে জমা হবে। আপনার জন্য কেউ পথ ছাড়বে না, আপনিও কার‌ও জন্য পথ ছাড়বেন না। সিভিল সার্ভিস নিজেকে প্রমাণ করার জায়গা। এখানে কাজ করাই সব কিছু নয়, কালচার ও সিচ্যুয়েশন বুঝে কাজ করাই সব কিছু।




১০. ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ বছর ইমেজ তৈরি করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। অফিসার হিসেবে শুরুতেই ভালো ইমেজ তৈরি করতে না পারলে পরবর্তীতে সাফার করতেই হবে। উদাসীন অফিসারকে কেউই পছন্দ করে না। অফিসের বাইরে লোকে আপনাকে অপদার্থ ভাবুক আর যা-ই ভাবুক, অফিসে যেন সবাই আপনাকে কাজের ভাবে। যারা কাজের নয়, তারা ক্রমেই হারিয়ে যায়।




১১. সিনিয়রদের নির্দেশনা ও মোটিভ খুব খেয়াল করে অনুসরণ করতে হবে। তাঁদের আইনানুগ নির্দেশনাই সরকারের নির্দেশনা। তাই সেগুলো ফলো না করলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারি কাজগুলো ঠিকভাবে হবে না এবং আপনি নির্ভরযোগ্যতা হারাবেন।




১২. যে ট্রেনিংগুলো আপনাকে করানো হবে, সেগুলো মন দিয়ে করার চেষ্টা করবেন। কেননা ট্রেনিংগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যেটা আপনার কাজে লাগবে। তাই এখান থেকে অর্জিত জ্ঞান আপনি দাপ্তরিক কাজে লাগাতে পারবেন।




১৩. পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। আপনার সামাজিক আচরণ, মেলামেশা, চলাফেরা সব কিছুই দায়িত্বপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত হবে। আপনি এখন চাইলেই যে-কোন‌ও কিছু বলতে পারবেন না, চাইলেই যে-কোন‌ও কিছু করতে পারবেন না। এমন কিছু করবেন না বা বলবেন না, যার জবাব দিতে আপনার কষ্ট হয়।




১৪. আপনি চাইলেই মনের সব ভাব প্রকাশ করতে পারবেন না। চাইলেই যে-কোন‌ও জায়গায় যেতে পারবেন না। ওখানে এমন কেউ থাকতে পারে, যে আপনার গোপনীয়তা ফাঁস করে দিয়ে আপনার ক্ষতি করবে। অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস না করলেই ভালো হয়।




১৫. বস যা করতে বলেন, একটু সময় দিয়ে হলেও কাজটা করতে হবে। অফিসকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। বস যদি এমন কিছু চান, যেটা আইনানুগ নয়, তবে সেটা নথিতে আইনবিধি অনুযায়ী গুছিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। প্রয়োজনে বসের সঙ্গে আলাপ করে নিতে হবে। এক্সপ্রেশনটা হবে: এরকম করাটা ভালো, তবে ওরকম করলে আরও ভালো হয় বোধ হয়; খুব বিনয়ের সাথে, আইন ও পরিস্থিতি বুঝে। বসের সঙ্গে তর্কে জড়াবেন না। এতে সাময়িক ক্ষতি হলেও ভবিষ্যতে লাভ হবে।




১৬. নেগেটিভ কথাকে পজিটিভ ওয়েতে বলা শিখতে হবে। বস কী চান না, তা বুঝতে হবে। দ্রুততম সময়ে দরকারি কাজটা শেষ করতে হবে। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অবশ্য‌ই অবশ্যই ফিডব্যাক দিতে হবে। যথাসময়ে ফিডব্যাক না দিলে কাজের গুরুত্ব কমে যায়।




১৭. বসের ইন্সট্রাকশনকে যে আপনি প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, এটা বসকে বোঝাতে হবে। আপনাকে যাতে বস খুব ডিপেন্ডেবল মনে করে। মনে রাখতে হবে, বস ইজ অল‌ওয়েজ রাইট, এবং আপনি যে এটা মাথায় রাখেন, ব্যাপারটা বসকে ফিল করাতে হবে।




১৮. অফিস টাইমে পরিবারের সব কিছুই মাথা থেকে দূরে রাখতে হবে এবং ফ্যামিলি টাইমে অফিসের সব কিছু মাথা থেকে দূরে রাখতে হবে। তবে এটা সবসময় অনুসরণ করা যায় না ব্যস্ততার কারণে। সেক্ষেত্রে মনে রাখবেন, পারিবারিক সুখ, শান্তি, এমনকী গ্রহণযোগ্যতাও আপনার ক্যারিয়ারের উপর অনেকটা নির্ভর করে। এটাকে ঠিক রাখতেই হবে যদি ভালো থাকতে চান।




১৯. আপনি কোন‌ও দপ্তরের জন্য অপরিহার্য কেউ নন। আপনার আগেও এ দপ্তর ভালো চলেছে, আপনি না থাকলেও ভালো চলবে। নিজেকে সুপারম্যান ভাবার কোনও সুযোগ সিভিল সার্ভিসে নেই। ওরকম ভাবলে অবশ্যই সাফার করতে হবে। আশেপাশে তাকান, এর সত্যতা পাবেন। এখানে সবাই সমান। আপনি নিজে নিজেকে হিরো ভাবতেই পারেন, তবে আপনার বস বা আপনার দপ্তর যদি আপনাকে জিরো ভাবে, তাহলে আপনি জিরোই।




২০. আপনি কাউকে সাহায্য করতে পারুন আর না-ই পারুন, তার কথা মন দিয়ে শুনুন। তাকে গুরুত্ব দিন। তিনি যেন অনুভব করতে পারেন, আপনি তাঁর প্রতি আন্তরিক। আমি তো সব সমস্যার সমাধান দিতে পারব না, তবে তার কথাগুলি তো শুনতে পারি। যদি তাকে "না" বলতে হয়, তবে এমনভাবে বলি, যেন না-টাও হ্যাঁ-র মতো শোনায়। এতেও অনেকে খুশি হয়। ভাবে, তার নিশ্চয়ই সীমাবদ্ধতা আছে, তাই করতে পারল না। করার ইচ্ছা না থাকলে তো এতক্ষণ আমার কথা শুনত না।




২১. নিজের মনে কী চলছে, তা কাউকে সহজে বুঝতে দেবেন না। বরং তিনি কী চাইছেন, তা বোঝার চেষ্টা করুন। কাউকে কোন‌ও কাজ করার জন্য অনুরোধ করার চাইতে বরং কাজটা করলে তার কী লাভ হবে, সেটা বোঝালেই ভালো।




২২. এখনকার সময়ে লোকে ফেইসবুকে অনেক ছোটো জিনিসকেও বড়ো করে দেখায়। দেখা যায়, যে কাজটা নিতান্তই রুটিন-ওয়ার্ক, সেটাও অনেক ফলাও করে প্রচার করে, যা বিরক্তির উদ্রেক করে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ও বিধিবিধান অনুসরণ করা খুব জরুরি।




২৩. দাপ্তরিক বিষয়ে ফেইসবুকে অহেতুক আত্মপ্রচার নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার। আমার কাছে এটাকে আত্মপ্রতারণা মনে হয়। ফেইসবুকের লাইক-কমেন্ট-শেয়ার গুনে কাজের প্রকৃত মান বোঝা যায় না। ছোটো ছোটো কাজগুলিকে অনেক বড়ো করে দেখালে মানুষ ধীরে ধীরে বড়ো কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। লোকের প্রশংসা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আসল কাজগুলোই ঠিকভাবে করা যায় না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সিভিল সার্ভিসে মাঠের নায়কদের ফেইসবুকে তেমন কেউই চেনে না।




২৪. চাকরিজীবনের শুরুতে সকল কলিগ আপনার বন্ধুর মতো হলেও ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যাটা কমে যাবে। অতএব আচরণে খুব সতর্ক থাকুন। তবে আপনি খুব ভাগ্যবান হলে কলিগদের মধ্য থেকে দুই-একজন বন্ধু পেয়ে যাবেন। ওরা আপনাকে বিপদ ও সম্ভাব্য বিপদ থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঁচিয়ে দেবে। তাদের সাথে সবসময়ই ভালো যোগাযোগ রক্ষা করুন।




২৫. চাকরির আগে আপনার যত বন্ধু ছিল, সেই সংখ্যাটাও ক্রমান্বয়ে কমে যাবে। অতএব নিজেকে আলাদা করে ফেলবেন না। দুঃসময়ে ভালো বন্ধুর গুরুত্ব অনেক। ভালো চাকরি পেলে যে লোক বন্ধুকে ভুলে যায়, তার কপালে দুঃখ অনিবার্য।




২৬. যতই হাই অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকুক না কেন, ডাউন-টু-আর্থ থাকা খুব দরকার। আপনি হার্ভার্ডে পড়েছেন কি অক্সফোর্ডে পড়েছেন, এটা দিয়ে কার‌ও কিছুই এসে যায় না, কেননা এমন নয় যে, বড়ো প্রতিষ্ঠান ভালো অফিসার তৈরি করে। বরং বড়ো বড়ো জায়গায় পড়াশোনা-করা অফিসারেরা বেশিরভাগ সময়ই কর্মক্ষেত্রে তেমন কাজের নন। মেধাবী মানুষ আর মেধাবী অফিসার এককথা নয়।




২৭. মানুষ আপনাকে সম্মান দেয় না, আপনার চেয়ারকে সম্মান দেয়। অতএব বিনয়ী থাকা খুব জরুরি। আজ আপনি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে থাকলেও দু-দিন পরেই অগুরুত্বপূর্ণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে পদস্থ হতে পারেন। মানুষ মানুষকে মনে রাখে, অফিসারকে নয়।




২৮. সরকারি চাকরিতে নায়ক হবার সুযোগ নেই, এটি নিতান্তই প্রটোকল মেনে এগিয়ে নেবার জিনিস। কাজেই উচ্চমার্গীয় চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করাই ভালো। এখানে নায়ক হবার চেষ্টা যে করেছে, সে-ই মরেছে।




২৯. নির্দিষ্ট কোনও কিছুর পিছনে না ছুটে অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে যান। দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাবেন। দায়িত্ববান না হলে অচিরেই হারিয়ে যাবেন, হতাশা এসে জড়ো হবে। তখন সিস্টেমকে বৃথা দোষারোপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।




৩০. বিপদে পড়লে কাউকে কাছে পাবেন না; কাজেই বিপদে যাতে না পড়তে হয়, সেটা খেয়াল রাখুন। আপনার চাকরির সুবিধাভোগী অনেকেই হলেও আপনার কষ্টের ভাগ কিন্তু আপনার একার। মার খেয়ে খেয়ে বাঁচা সত্যিই খুব কষ্টের।




৩১. আপনি যত বিলাসবহুল জীবনযাপন করবেন, আপনার শত্রু সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পাবে। কাজেই সতর্ক থাকুন। সহজ জীবনযাপন আপনাকে শান্তিতে রাখবে।




৩২. সেবা দেবার মনমানসিকতা রাখুন। আপনার চাকরি সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ, এটি মেনে চলুন। সেবাদানের মানসিকতা না থাকলে সিভিল সার্ভিসে টিকে থাকা অসম্ভব।




৩৩. যার উপকার করতে পারবেন না, তার সাথে যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করুন। বিনয়ের প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হবার চেষ্টা করুন, তাহলে সরকারি চাকরি করা অনেক সহজ হবে।




৩৪. ব‌ই পড়ার অভ্যেসটা ধরে রাখুন। মুভি দেখতে পারেন, অবসর চমৎকার কাটবে। বাজে আড্ডা, গীবত, অন্যের পেছনে লাগা ইত্যাদির চাইতে ব‌ই পড়া অনেক অনেক ভালো। আপনার অফিসরুমে ছোটোখাটো একটা লাইব্রেরি তৈরি করতে পারেন। এতে মনের ও অফিসের উচ্চতা বাড়বে। নিশ্চয়ই শোপিসের চাইতে ব‌ইয়ের আর্থিক মূল্য কম, আত্মিক মূল্য বেশি। অফিসের কাজশেষে ব‌ই-মুভি-লেখালেখি'র সমুদ্রে ডুবতে জানলে দেখবেন, অবসর‌ই পাচ্ছেন না! এই অবসরটা একান্তই নিজের। (নিজের নিবিড় অভিজ্ঞতা থেকে বললাম।) মনের অনুভূতি লিখে রাখার চর্চা করতে পারেন। এই চর্চার সময় বানান ও প্রয়োগবিধি খুব ভালো করে শিখে রাখলে নিজের ও লোকের কাছে আপনার সম্মান বাড়বে। কাজে লাগবে ও ভালো লাগবে। মনে রাখবেন, আমরা যা জানি, যা বুঝি এবং যা ভাবি, তার বাইরে সত্য ও সুন্দর অনেক কিছু আছে।




৩৫. আপনার ফেইসবুক পোস্টে আপনার জুনিয়র কলিগদের মধ্যে কে লাইক দিলেন কে দিলেন না, কে শেয়ার করলেন কে করলেন না, এসব নিয়ে একদমই ভাববেন না। জুনিয়র কলিগেরা, আপনার কাছ থেকে সুবিধাপ্রত্যাশীরা সাধারণত কখনও আপনার পোস্টে তাঁদের মনের প্রকৃত কথাটা প্রকাশ করবেন না। বরং এসব নিয়ে ভাবলে ওঁদের বিরক্তির কারণ হবেন, যদিও চোখে-মুখে ওঁরা এটা দেখাবেন না। সবচাইতে ভালো হয়, ফেইসবুকবাসীদের প্রশংসা ও নিন্দার প্রতি ক্রমেই নির্লিপ্ত হয়ে যেতে পারলে। ফেইসবুকের অফিসার এবং অফিসের অফিসার এক জিনিস নয়। আপনার মন জুগিয়ে চললে যার লাভ আছে, তার প্রশংসার দুইপয়সাও কি দাম আছে?




৩৬. অফিসে যাঁরা আসেন, তাঁদের যথাসম্ভব আপ্যায়ন করুন। জিভের স্বস্তির কথা মানুষ মনে রাখে। সেবাগ্রহীতাকে খুব বিনয়ের সাথে অফিসকক্ষে ঢুকতে বলে অবশ্যই অবশ্যই বসতে বলবেন এবং সুযোগ- ও সাধ্যমতো আপ্যায়ন করবেন। দেখবেন, এতে আপনার অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে। কাজের প্রয়োজনে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার রুমে গিয়ে বিদেশি দামি ভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী সেই স্যারকে টেবিলের বেলটা টিপে বলতে দেখেছি, 'ওকে এক কাপ কফি খাওয়ায়ে দিয়ো তো!' এর মানে, তাঁর রুমে নয়, তাঁর রুমের পাশের রুমে আমার জন্য কফির ব্যবস্থা করতে বললেন, তা-ও অমন তাচ্ছিল্যের সুরে! আমি স্যারের রুমে সত্যিই কফি খেতে যাইনি, দাপ্তরিক প্রয়োজনেই গিয়েছিলাম। সেই ঘটনার পর অনেক দিন কেটে গেছে, কিন্তু কষ্টটা বুকে রয়ে গেছে। অবশ্য এক‌ই এবং তাঁর উপরের পদমর্যাদার অনেক কর্মকর্তা তাঁদের চমৎকার আচরণের মাধ্যমে আমাকে সেই দুঃখ ভুলতে সাহায্য করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই!




৩৭. আপনার সহকর্মীদের মধ্যে যাকে আপনি পছন্দ করেন না বা কম পছন্দ করেন, তাকে কখনও ব্যাপারটা বুঝতে দেবেন না। বরং তার সাথে আরও বেশি আন্তরিকতা দিয়ে কথা বলুন। সবসময়ই মাথায় রাখবেন, কলিগেরা আপনার পেছনে লাগলে জীবনটা নরক হয়ে যাবে! আমার অভিজ্ঞতা বলে, যিনি আমাকে একসময় অপছন্দ করতেন কিংবা যাকে আমি একসময় অপছন্দ করতাম, পরবর্তীতে তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আপনার জীবনের সিংহভাগ সময়‌ই কলিগদের সাথে কাটবে। কী দরকার তাদের সাথে দূরত্ব বাড়ানোর?




৩৮. সরকারি কর্মচারীর অন্যতম বড়ো দায়িত্ব হচ্ছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ও দিতে পারা। আপনার সিদ্ধান্তের উপর অনেকের মূল্যবান সময় নির্ভর করে। কোনোভাবেই টেবিলে ফাইল রেখে দেওয়া যাবে না। কাজে দেরি করলে অবশ্যই আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমবে। দরকার হলে আইনবিধি দেখুন, অভিজ্ঞ সহকর্মী এবং সিনিয়রদের সাথে কথা বলুন। সিদ্ধান্ত দিতে কালক্ষেপণ করলে সেবাগ্রহীতাদের রোষানলে পড়ে যেতে পারেন। তবে আর যা-ই করুন, ভালোভাবে না পড়ে ও না বুঝে কখনোই কোথাও সাইন করবেন না। ওরকম করলে বিপদে পড়ে যেতে পারেন।




৩৯. আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুক না কেন, যেভাবেই ব্রেইনওয়াশ করার চেষ্টা করুক না কেন, কখনোই ভুল করেও এটা মাথায় আনবেন না, আপনি বা আপনার ক্যাডারটাই সেরা কিংবা এ ধরনের কিছু। যুগ বদলেছে। এখন এসব হামবড়া ভাবের তোয়াক্কা কেউই করে না। বরং এইসব নাকউঁচু লোকদের নিয়ে আড়ালে সবাই হাসাহাসি করে। যে যার রিজিক নিয়ে আছে, আপনার এইসব আলগা ভাবের পরোয়া করার দরকার‌ই-বা কী ওদের? আমরা সরকারি কর্মচারীরা কাজের প্রয়োজনেই একধরনের বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি। সেখানেও যদি আমরা আরও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আসি, মানসিক দূরত্ব তৈরি করি, তাহলে আমরা বোকা ন‌ই তো কী? আন্তঃক্যাডার সুসম্পর্ক খুব জরুরি। প্রতিটি ক্যাডারের‌ই নিজস্ব কিছু সৌন্দর্য আছে। ওসব ভাব-টাব না নিয়ে বিনয়ের মাধ্যমে ভালো সম্পর্ক রেখে আপনি চাইলেই সেসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। আমরা মূলত জনগণের চাকর। চাকরদের মধ্যে আবার কীসের শ্রেণী?




৪০. সাধারণত আমরা যা-ই করি, তা মূলত পরিবারের জন্যই। তাই পরিবারের বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয়‌ও খুব সচেতনভাবে মাথায় রাখবেন, যাতে পারিবারিক শান্তি বজায় থাকে। পুরোনো বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, ওদের আন্তরিকভাবে সময় দিন, প্রয়োজনের সময় পাশে থাকুন। এতে মানসিক অবসাদের মুহূর্তগুলিতে অনেক স্বস্তি পাবেন। মানসিক স্বস্তি ছাড়া ভালো কর্মী হ‌ওয়া অনেকটাই অসম্ভব। আপনার কলিগদের পরিবারের খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করুন। আপনার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের হেল্প করুন। এতে আন্তরিকতা বাড়ে, সম্পর্ক ভালো হয়। লোকে অফিশিয়াল হেল্পের চাইতে পার্সোনাল হেল্পকে মনে রাখে বেশি। তবে এটা করতে গিয়ে কখনোই কাউকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গায়ে পড়ে তার ব্যক্তিগত বিষয় জিজ্ঞেস করবেন না, তা নিয়ে কথা বলবেন না।