৩৬তম বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতিকৌশল: ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন (কালের কণ্ঠ)

ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অংশের জন্য অন্তত ৩-৪টা গাইড বই এবং ৯ম-১০ম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বই থেকে সংশ্লিষ্ট অধ্যায় থেকে প্রস্তুতি নিতে পারেন। ৩৫তম বিসিএস প্রিলির প্রশ্ন দেখলে খেয়াল করবেন, বেশিরভাগ প্রশ্নই এসেছে ৯ম-১০ম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান বই থেকে। ওটা দাগিয়ে দাগিয়ে পড়ুন।

নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন অংশটি ৩-৪টা গাইড বই থেকে পড়ুন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘নাগরিকদের জানা ভালো’ বইটিও দেখতে পারেন। এ অংশের উত্তর করার জন্য সবচাইতে বেশি দরকার কমনসেন্স। একেকভাবে ভাবলে একেকরকম আনসার হয়, এমন প্রশ্ন এ অংশে কিছু আসার কথা। পিএসসি ইচ্ছে করেই এই গেমটা খেলে যাতে কেউ সেগুলো আনসার না করে সেজন্য। লোভে পাপ, পাপে নেগেটিভ মার্কস।

উপরের দুই অংশের বেশকিছু প্রশ্ন ইন্টারনেটে পেয়ে যাবেন। গুগলে বিষয়ের নাম লিখে সার্চ করে সেগুলিও পড়ে নিতে পারেন।

এখন বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি নিয়ে মোটা দাগে কিছু কথা বলছি:

1. একটা ফ্যাক্ট শেয়ার করি৷ কিছু কঠিন প্রশ্ন থাকে যেগুলো বারবার পড়লেও মনে থাকে না৷ সেগুলো মনে রাখার চেষ্টা বাদ দিন৷ কারণ এই ধরনের একটি প্রশ্ন আরও কয়েকটি সহজ প্রশ্নকে মাথা থেকে বের করে দেয়৷ প্রিলিমিনারি হাইয়েস্ট মার্কস্ পাওয়ার পরীক্ষা নয়, স্রেফ কাট-অফ মার্কস পেয়ে পাস করার পরীক্ষা৷ আপনি ১৯০ পেয়ে প্রিলি পাস করা যে কথা ৯০ পেয়ে প্রিলি পাস করা একই কথা। অপ্রয়োজনীয় মার্কসের বাড়তি শ্রম রিটেনের প্রিপারেশন নেয়ার পেছনে দিন, কাজে লাগবে। মনে রাখবেন, কঠিন প্রশ্নেও ১ নম্বর, সহজ প্রশ্নেও ১ নম্বর।

2. কে কী পারে, সেটা নিয়ে কম ভাবুন। আপনি যা পারেন সেটার চাইতে অন্যরা যা পারে, সেটা শেষ পর্যন্ত বেশি কাজে লাগবে, এরকমটা নাও হতে পারে। যারা বেশি পারে, ওদের সাথে কম মিশুন। যারা কোনও একটা বিষয়ে অনেকবেশি ভাল, তাদের সাথে কখনওই কম্পিটিশনে যাবেন না। কম্পিটিশন হোক নিজের সাথেই। সবসময়ই এই চ্যালেঞ্জটা নিন, গতকালকের ‘আপনি’র চাইতে আজকের ‘আপনি’ এগিয়ে আছেন কিনা।

3. প্রিপারেশন নিচ্ছি-নিচ্ছি—নিজেকে এবং অন্য সবাইকে এটা বোঝানোর চাইতে সত্যি-সত্যি প্রিপারেশন নেয়া ভালো। ‘প্রিপারেশন প্রিপারেশন ভাব, প্রিপারেশনের অভাব।’—কম্পিটিটিভ এক্সামের প্রিপারেশন নেয়ার ক্ষেত্রে এটা হয়। অনেক পরিশ্রম করে ফেল করার চাইতে, বুঝেশুনে পরিশ্রম করে পাস করা ভালো। আপনাকে প্রত্যেকটা সেগমেন্টে খুব ভাল কিংবা মোটামুটি ভাল করতে হবে। কাজেই প্রস্তুতি নেয়ার সময় আপনি যা পারেন, শুধু সেটার উপরেই পুরো এফর্ট দেয়া যাবে না। আমার টেকনিক হল, আমি যা পারি সেটার বেশিবেশি যত্ন নিই, যাতে অন্যদের চাইতে অনেকবেশি সুবিধা আমি সেটাতে নিতে পারি। তবে তার আগে দেখে নিই, যেটা বেশি পারি, সেটা আদৌ সুবিধা নেয়ার মতো কিছু কিনা। ধরুন, ক্লিনটনের ওয়াইফের বান্ধবীর পোষা কুকুরের নামও আপনার মুখস্থ, কিন্তু আমার নানার একটা কালো কুকুর ছিল’কে ইংলিশে লিখেন, My grandfather was a black dog……… কোনও কাজ হবে না।

4. যারা প্রথমবার বিসিএস দিচ্ছেন, তাদেরকে বলছি। প্রথমবারের কাজ ভাল হয় না? কে বলল একথা? আমি প্রথমবারে ক্যাডার হয়েছি। এরকম আরও অসংখ্য নজির আছে। পথের পাঁচালি (বিভূতি ও সত্যজিৎ), নাগরিক, The 400 Blows কিংবা Wuthering Heights, The Catcher in the Rye, To Kill a Mockingbird, The Kite Runner-এ অমর সৃষ্টিগুলি স্রষ্টার প্রথমবারেরই সৃষ্টি। বিসিএস পরীক্ষার মতো বিরক্তিকর পরীক্ষা আরেকবার দিতে হবে, এটা ভাবতে ভয় লাগে না? শুধু এইজন্যেই তো পড়াশোনা করা যায়। সবার মতো আপনাকেও বারবার বিসিএস দিতে হবে কেনো? তবে এখানে luck favour করা না-করার কিছু ব্যাপারও ঘটে। যারা ক্যাডার হয়, তারা একই সাথে যোগ্য ও সৌভাগ্যবান।

5. অনেকেই বলবে, আমার তো অমুক-অমুক প্রশ্ন পড়া শেষ! ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিন৷ আপনার আগে কেউ কাজ শেষ করলেই যে শেষ হাসিটা উনিই হাসবেন—এমন তো কোন কথা নেই৷ আর কেউ আপনার চাইতে বেশি পড়াশোনা করলে সেটা তো আর আপনার দোষ না। আমি বিসিএস পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি শুরু করতে গিয়ে দেখলাম, অনেকের অনেককিছু পড়া শেষ। 3 Idiots তো দেখেছেন। বন্ধুর খারাপ রেজাল্টে যতটা মন খারাপ হয়, বন্ধুর ভাল রেজাল্টে তার চেয়ে বেশি মেজাজ খারাপ হয়। যখন দেখলাম, আমি অন্যদের তুলনায় বলতে গেলে কিছুই পারি না, তখন আমি ২টা কাজ করলাম। এক। বোঝার চেষ্টা করলাম, ওরা যা পারে, সেটা পারাটা আদৌ দরকার কিনা? দুই। ওদের সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করা বন্ধ করে গতকালকের আমি’র সাথে আজকের আমি’কে কম্পেয়ার করা শুরু করলাম।

6. গ্রুপ স্টাডি করা কতটুকু দরকার? এটা আপনার অভ্যেসের উপর নির্ভর করে। আমার নিজের এই অভ্যেস ছিলো না। আমি গ্রুপ স্টাডি করতাম না ২টা কারণে। এক। যখন দেখতাম, সবাই অনেককিছু পারে, যেগুলোর কিছুই আমি পারি না, তখন মনমেজাজ খারাপ হতো। আমি পারি না, এটা ভাবতে ভাল লাগে না। The Pursuit of Happyness এর ডায়লগটা মনে আছে তো? আপনি পারেন না, সবার কাছ থেকে এটা শুনে, বুঝে আপনার কী লাভ? সবাই এটা বললে তো আর আপনি বেশি পারতে শুরু করবেন না, বরং আপনার বেশি পারার ইচ্ছেটা কমে যেতে পারে। দুই। সবার সাথে পড়লে বেশি বেশি গল্প করতে ইচ্ছে করতো, আর মনে হতো, ওরা যেটা করছে সেটা ঠিক, আমার নিজেরটা ভুল। অন্ধ অনুকরণ করতে ভাল লাগে না।

7. আপনি কী জানেন, তার চেয়ে বেশি ইমপর্টেন্ট হল আপনি যা জানেন তা কতটা কাজে লাগাতে পারছেন, সেটা৷ যারা অনেক জানেন, তারা বেশিরভাগ সময়েই যারা অনেক জানেন না, তাদেরকে সহজ টার্গেট ভেবে আনডারএস্টিমেট করেন৷ ভাবনার এই স্বাচ্ছন্দ্যই ওদের ক্রমশ দুর্বল আর ভালনারেবল্ করে দেয়। এটাকে কাজে লাগাতে পারলেই মজা৷ অতিপণ্ডিতদের ফেল করতে দেখার মজাই আলাদা! নিজে পাস করলেও এত মজা লাগে না৷

8. মাঝে-মাঝে পড়তে ইচ্ছে করবে না, স্বাভাবিক। আমারও করত না৷ সারাক্ষণ পড়তে ইচ্ছে করাটা মানসিক সুস্থতার লক্ষণ না৷ Why so serious? Job for Life, not Life for Job. বিসিএস ক্যাডার হতেই হবে, এমন তো নয়! আপনার রিজিক আগে থেকেই ঠিক করা আছে। কত কিছুই তো করার আছে! তাই, ব্রেক নিন, পড়াকে ছুটি দিন৷ মাঝেমধ্যেই৷ রুমের দরোজাজানালা বন্ধ করে ফুল ভলিয়্যুমে মিউজিক ছেড়ে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নাচুন! ইচ্ছেমতো গলা ফাটান! কী আছে আর জীবনে! দুদিন পড়া হল না বলে মন খারাপ করে আরও দুদিন নষ্ট করার তো কোনও মানে হয়না৷ ভুল না করে শিখেছে কে কোথায় কবে? অনুশোচনা করার সময় কোথায়? আপনি তো আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভুলটি করে বসেননি! আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটিও নন!

9. গাইড বইয়ের প্রশ্নগুলি যত বেশি সম্ভব, সলভ করে ফেলুন। যত বেশি প্রশ্ন সলভ করবেন, প্রস্তুতি ততই ভাল হবে। মডেল টেস্টের ৩-৪ বই কিনে প্রতিদিন অন্তত ২-৩টি মডেল টেস্ট দিন। ভাল কথা, মডেল টেস্টগুলোতে একটু কম marks পেলেও মন খারাপ করার দরকার নেই৷ আপনি কী জানেন, তার চেয়ে বেশি important হল, আপনি যা জানেন তা কতটা কাজে লাগাতে পারছেন৷ ভাল প্রস্তুতি নেয়ার চাইতে ভাল পরীক্ষা দেয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

10. কোচিংয়ে কিংবা এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ি না করে বাসায় বসে অনেক সময় দিয়ে পড়াশোনা করুন। দিনে অন্তত ১৫-১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করুন। সকল ঘুম, বিশ্রাম আর ঘোরাঘুরি হবে চাকরি পাওয়ার পর।

11. সব প্রশ্নের উত্তর করতে যাবেন না ভুলেও৷ প্রিলিমিনারী highest marks পাওয়ার পরীক্ষা নয়, just পাস করার পরীক্ষা৷ কিছু difficult & confusing questions ছেড়ে দেওয়ার উদারতা দেখান, কিপ্টেমিটুকু আপাততঃ জমিয়ে রাখুন written exam এর জন্য৷

12. ব্লাইন্ড গ্যেসিং করে করে সব প্রশ্নের উত্তর করতে যাবেন না ভুলেও, তবে কিছুটা ইন্টেলেকচুয়াল গ্যেসিং করলে কোনও দোষ নেই৷ ৬টা প্রশ্ন ছেড়ে জিরো পাওয়ার চাইতে ৩টা কারেক্ট করে ১.৫ পাওয়া অনেক ভালো৷ ভুল করুন বুদ্ধি খাটিয়ে৷ সফলভাবে ব্যর্থ হওয়াটাও কিন্তু মস্ত বড়ো একটা আর্ট৷

13. Competitive exam গুলোতে ভাল করার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির চাইতে আত্মবিশ্বাস বেশি কাজে লাগে৷ I’m the best এই ভাবটা exam hall এ ধরে রাখুন৷ এটা magic এর মতো কাজ করে! একটি প্রশ্নের উত্তর নিজে ভুল করলে যতটা না মেজাজ খারাপ হয়, তার চাইতে অনেক বেশি মেজাজ খারাপ হয় কারো কাছ থেকে শুনে ভুল করলে৷ (তখন মনে হয়, ইসস্ এটা তো আমি নিজে নিজে পারতাম!)

14. প্রশ্নে দু’-একটা ছোট-খাট ভুল থাকতেই পারে৷ এটা নিয়ে মাথা খারাপ করার কিছু নেই৷ সমস্যা হলে তো সবারই হবে, আপনার একার নয়! Nervousness দূর করার চেষ্টা করুন, কারণ ওতে প্রশ্নগুলো তো আর সহজ হবে না, বরং সহজ প্রশ্ন ভুল answer করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে৷ মনে রাখুন, Que sera, sera.

15. এই সময়টাতে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পড়া শেয়ার করা কমিয়ে দিন৷ বন্ধুদের preparation ভাল না শুনলে মন খারাপ হয়, আর preparation আপনার চেয়েও ভালো, এটা শুনলে কিন্তু মেজাজ খারাপ হয়! কেউ আপনার চাইতে ভাল student হওয়া মানেই এই নয় যে, উনি প্রিলিমিনারী পাস করবেন, আপনি করবেন না৷ শেষ হাসিটা হাসার চেষ্টা করুন৷

সবার প্রস্তুতি ভাল হোক। গুড লাক!!

এ লেখাটি গত ২১ অক্টোবর বুধবার কালের কণ্ঠের ‘চাকরি আছে’ পাতায় ছাপা হয়েছিল। লেখাটির লিংক নিচে দিচ্ছি:

http://www.kalerkantho.com/feature/chakriache/2015/10/21/281378