স্মৃতি


তাকে পেতে আমি চাই-ইনি কখনও! তাকে পেতাম যদি, পেতাম কি এর সিকিভাগও, যতটা এখন পেয়েছি না পেয়েও? যে যাকে পায়, তাকে সে পায় কি আদৌ? কতটা পায়? তবে কাকে বলে এই পাওয়া? লোকে যখন বলে, ‘এ জীবনে তাকে পেলাম না!’, তখন আমার খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, পাওয়া না-পাওয়াটা তবে কি শুধুই উপস্থিতিনির্ভর? যদি তা না হবে, তবে লোকে অমন করে ‘পেলাম না’ কেন বলে? তবে কি ধরে নেব, ওরা ভালোবাসার মানুষের মনটুকুও পায়ই না কখনও? এমনকী নিজেও মনটা ঠিক দেয় না? যদি মনই না পেল, যদি মনই না দিল, তবে সেখানে ভালোবাসাটা আর এল কোত্থেকে? ভালোবাসাই নেই যেখানে, সেখানে ব্রেকআপ হয় কী করে?


মাস দুয়েক আগে আমাদের ব্রেকআপ হয়। ভালো ওকে এখনও বাসি, তবে কথা আর হয় না। ব্রেকআপের পর মানসিক অবস্থা কেমন থাকে, তা আপনারা জানেন। আমার অবস্থাটা ভিন্ন রকমের নয়, তবে অন্যদের মতো খুব কষ্টে একদম নীল হয়ে আছি, এমন কিছু নয়। আমার কষ্ট লাগেনি, একটুও না! ওরা যেমন করে বলে, তেমন দুঃসহ কোনও কষ্ট আমার হচ্ছে না।


কেন, জানেন? আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে, সে তো আমার মধ্যেই আছে! সে কোথাও চলে যায়নি তো! আগেও মানুষটাকে আমার মধ্যে যতটা ধারণ করতাম, এখনও করি, সামনেও করার কথা। পার্থক্যটা কোথায় তাহলে? আমি তো কখনও তাকে বাইরে খুঁজতে যাইনি! তাকে পেতে চাইলে আমি বরাবরই নিজের মধ্যেই পেয়ে যাই। যে আমার বাইরে নেই-ই, সে আমার কাছ থেকে হারায় আবার কী করে? না, সে হারিয়ে যায়নি। সে আছে, সে থাকবে। সে পালাবে কী করে যদি আমি না চাই?


যখন আমি ওর প্রেমে পড়ি, তখন সেই প্রথম থেকেই আমার বিশ্বাস ছিল, প্রেম-ভালোবাসা ব্যাপারটা আসলে পাওয়া না-পাওয়ার উপর নির্ভর করে না। ভালোবাসি যাকে, তাকে পেলেও ভালোবাসি, না পেলেও ভালোবাসি। ভালোবাসা তো একটা মানসিক অবস্থা, কোনও শর্ত তো নয়! বাহ্যিকতার বিষয়গুলি হৃদয়ের সমীকরণ মেলায় যেখানে, সেখানে আদৌ কি ভালোবাসা বলতে কিছু থাকে?


আগে আমি নিজের সঙ্গে গল্প করতাম, প্রেমে পড়ার পর থেকে আমি মানুষটার সঙ্গেও গল্প করি। এ-ই তো! নিজের সঙ্গে গল্প করতে যেমনি বাইরের কোনও কিছুর তোয়াক্কা আমাকে করতে হতো না, ঠিক তেমনিই মানুষটার সঙ্গে গল্প করতে গেলেও আমি যে-কোনও সময়ই, যে-কোনও অবস্থায়ই করতে পারি। মানুষটা আছে তো, এই যে বুকের মধ্যেই আছে! আমাকে ছেড়ে সে কোথাও যায়নি, যেতে আমি দেবোও না! যাবে সে কী করে? আমি যেতে দিলে তো!


তবে হ্যাঁ, কোনও একদিন আমাদের ব্রেকআপ হয়ে যাবে, এটা আমি কখনও ভাবতে পারিনি। হয়ে যাবার আগে কেউ ভাবতে পারেও না বোধ হয়। সে আমার সঙ্গে একদিন আর না-ও থাকতে পারে, এইটুকু সন্দেহ অবশ্য আমার কখনও কখনও হতো। আমার ইচ্ছে ছিল, পাওয়া না-পাওয়ার উপর আমাদের প্রেমটা যেন নির্ভর না করে।


আমি মানুষটাকে চেয়েছি যতটা, তার চাইতে অনেক বেশি করে চেয়েছি তাকে ভালোবাসতে। ওইটুকু তো পেরেছি! আমি আমার নিজের কাছে এ ব্যাপারে স্বচ্ছ যে ভালো আমি আগে যাকে বাসতাম, আজও তাকেই বাসি, আমৃত্যু তাকেই বেসে যাব। ভালোবাসায় আমি অনুভব রাখি, মানুষকে নয়। সেখানে মানুষকে রাখতে পারি যদি, তবে ভালো; আর রাখতে না পারলেও ভালোবাসা অটুটই থাকবে। এখানে আমার কষ্ট তো আর রইলই না!


তার সঙ্গে আমার ব্রেকআপের কারণটা বলি। আমরা দু-জন দু-জনকে অনেক বেশিই ভালোবাসি। সে আমার ভালোর জন্যই এ কাজটা করেছে। আর আমি তাকে অনেক বেশি ভালোবাসি বলেই সে আমার সঙ্গে ব্রেকআপ করেছে যাতে আমি তাকে এত ভালো না বাসি। মানুষটা সত্যিই বড্ড বোকা!


তো এই ধরনেরই ছিল আমাদের প্রেমটা। আমি একেবারেই নিশ্চিত, সে আমাকে আমার চাইতেও অনেক বেশি ভালোবাসে। এটা আমার অন্ধবিশ্বাস নয় মোটেও! বুঝেই বলছি, কোনোভাবেই এটা অন্ধবিশ্বাস নয়। তার ভালোবাসার ব্যাপারে আমি পুরোপুরিই নিশ্চিত। যদি একটু বিশদে বলি, সে বিবাহিত ছিল। তার সঙ্গে আমার এমনিই কথা হতো। সে আমদের পরিচিত ছিল, আত্মীয় ছিল, তাই এমনি কথা হতো। বয়সে সে আমার থেকে যথেষ্ট বড়ো। আমাদের প্রেম হয়েছিল মনের সঙ্গে মনের, বয়সের সঙ্গে বয়সের নয়।


আমাদের সম্পর্কের শুরুটা এরকম ছিল, সে আমার সঙ্গে বাচ্চাদের মতোই আচরণ করত, মানে লোকে যেরকম করে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলে, মেশে, ঠিক ওরকম করে সে আমার সাথে কথা বলত, মিশত। এমন করতে করতে আমাদের দু-জনের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একটা বড়ো মানুষের সঙ্গে ছোটো মানুষের যেমন বন্ধুত্ব হয় আর কি! বয়সের পার্থক্যটা বেশি হলে বন্ধুত্বটা হয়ে যায় একটু আদর আদর টাইপের, পুরোপুরি বাচ্চাদের মতো! আমাদেরও তা-ই হয়েছিল।


তো এরকম করতে করতে হঠাৎ করে কীভাবে যেন কী একটা হয়ে গেছে! কখন যে আমাদের মধ্যে প্রেম হয়ে গেল, আমরা তা জানতেও পারিনি! খুব সুন্দর একটা শুরু ছিল আমাদের। আমাদের প্রায় প্রায়ই দেখা হতো, আত্মীয় হিসেবে আমাদের বাসায় তার অবাধ আসা-যাওয়া ছিল। বলা যায়, আমাদের সবসময়ই দেখা হতো। আমাদের কারও মাথায় ছিল না যে, ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে!


আমাদের কারও মাথায় না থাকলে কী হবে, যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে! হওয়ার পরের পর্যায়গুলি শুরুর চেয়েও খুব সুন্দর ছিল। আমার কাছ থেকে তার কোনও আশা ছিল না, না আমার ছিল তার কাছ থেকে কোনও আশা। পুরোপুরিই প্রত্যাশাবিহীন প্রেম ছিল আমাদের। না চাইতেও আমরা অনেকটুকুই পেয়ে গিয়েছিলাম!


যথেষ্ট শুদ্ধ রকমের পবিত্র প্রেমের সংজ্ঞা যদি কেউ খোঁজে, তবে তাকে আমাদের প্রেমটার দিকে তাকাতে হবে। আজকের তারিখ পর্যন্ত আমার এমন কিছু মন পড়ে না যে তার মধ্যে কোনও চাওয়া-পাওয়ার লেশ পরিমাণও ভাবনা ছিল! আমার মধ্যেও তা ছিল না। আমরা দু-জন দু-জনকে ভালোবাসতাম। এই ব্যাপারটা যে কী অদ্ভুত রকমের সুন্দর, তা লিখে বোঝানো যাবে না। জীবনকে তখন বড়ো সুন্দর মনে হতো!


প্রেমের সেই ধীরলয়ের শুরুটা যে এতটা গভীরে চলে যাবে, তা আমরা কখনও অনুমানও করতে পারিনি। তাকে আমার ভালো লাগে, আমাকেও তার ভালো লাগে, এইটুকু ঠিক আছে। সে ভাবছে, আমি তো বিবাহিত! আমি ভাবছি, আমি তো সবে টিন-এজার! জীবনে আশেপাশে কত কিছু আসবে যাবে, ওসব নিয়ে অত ভেবে কী হবে! সময়কে আমরা দু-জন পুরোপুরি সময়ের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলাম।


আমাদের মনে হতো, এই ভালোলাগার হয়তোবা শেষ আছে। চলছে, চলুক না! কী হবে! কিন্তু আমরা দিনে দিনে বুঝতে পারছিলাম, ব্যাপারটা এক্সট্রিম লেভেলে চলে যাচ্ছে। তবু আমরা থামলাম না, নিজেদের থামালাম না। তারপর যা হয় আর কি…চলতে থাকল, আর চলতেই থাকল…চলতে দিলে প্রেম কি আর থামে নিজ থেকে?


আমি অবশ্য তাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, চিন্তা কোরো না! আমি কখনও তোমার ঘরনি হতে যাব না। আমাদের এই প্রেমটাকে আমি নিঃস্বার্থভাবেই দেখতে চাই, শেষ পর্যন্ত এভাবেই রেখে দিতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে কখনও এই আশা রাখব না যে আমার সঙ্গে থাকলে আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে। তুমিও রেখো না অমন।


আমাদের সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন বন্ধুত্ব ছিল, নিবিড় ভালোবাসা ছিল। আমরা আর চার-পাঁচটা জুটির মতো ছিলাম না, যাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক থাকে, প্রায়ই দেখা হওয়ার ব্যাপারটা থাকে, হাত ধরে হাঁটা থাকে, ঝগড়াবিবাদ থাকে। সত্যিই আমাদের মধ্যে এসবের কিছুই ছিল না।


আমাদের দু-জনের প্রেম ছিল, ভালোবাসা ছিল। সে আমাকে রাধা ডাকত, আমি তাকে কৃষ্ণ ডাকতাম। সত্যিকারের ভালোবাসা যে কী, তা আমি জানি না। আমি শুধুই ভালোবাসা অনুভব করেছি, তার সত্যি মিথ্যে খুঁজতে যাইনি কোনোদিনই। সে-ও ঠিক এরকম করেই ভাবত।


আমার মানুষটা আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো ছিল। আমি যতটা জীবন বুঝতাম, সে নিশ্চয়ই আরও ভালো করে বুঝত। তাই আমি তার সব কথাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছি সবসময়ই। এভাবেই চলছিল…চলতে থাকল…আমরা চলতে দিচ্ছিলাম।


একদিন সে হঠাৎ করেই বুঝে ফেলল, আমি আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছি!


আগে থেকেই আমার কখনও বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না, এটা আমার পরিচিত সবাই জানে। পরিবারকেও জানিয়ে রেখেছিলাম আমার এই সিদ্ধান্ত। এমন নয় যে আমি তার প্রেমে পড়ার পর জীবনে তাকে পাবো না ভেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগে থেকেই আমি সারাজীবন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। তবে হ্যাঁ, প্রেমটা হওয়ার পর থেকে সিদ্ধান্তটা দিনে দিনে আরও শক্ত হয়েছে।


আমি সবসময়ই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। আমার স্বপ্ন, পড়াশোনা করে জীবনে অনেক বড়ো কিছু হতে পারি না পারি, মানুষের জন্য কিছু করবই! আমার লাইফের ফার্স্ট প্রায়োরিটিই হচ্ছে পড়াশোনা! আমার খুব ইচ্ছে, ডাক্তার হব, মানুষের সেবা করব। সারাজীবনই অসহায় মানুষের পাশে থাকব। আমি সত্যিই মানুষকে সাহায্য করতে ভালোবাসি। মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে আমার খুব আনন্দ হয়।


সংসারে ঢুকে অন্য সবার মতো গতানুগতিক একটা জীবন কাটাতে আমি পৃথিবীতে আসিনি। যত ভালো মানুষই হোক না, কারও সঙ্গে তার ও তার পরিবারের ইচ্ছেয় পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে আমি সত্যিই পারব না। আমি ওরকম ধাঁচের মানুষই নই! আমি সবসময়ই সবার মাঝে থাকব। সবার সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেব। আমি বরাবরই চেয়েছি, আমার সুখটা যেন কখনওই এককেন্দ্রিক না হয়। হ্যাঁ, সংসারে থেকেও ওসব হয়। অনেকেই সংসার করেও ওসব করছে। কিন্তু আমার মানসিকতাটা একটু আলাদা ছিল। আমি পণ করেছিলাম, আর যা-ই হোক, সংসারে থেকে আমি কিছু করব না।


সে যখন বুঝতে পারল আমার এইসব ধারণা ও বিশ্বাস, যখন ধীরে ধীরে আমার এই জিনিসগুলো সে স্পষ্টভাবে জানতে পারল, তখন তার কাছে মনে হলো, আমি বোধ হয় তার জন্যই জীবনটাকে এরকম করে দেখতে চাইছি। তার জন্যই আমি আমার জীবনের সমস্ত সুখ বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপর সে নিজেকে ব্লেইম করা শুরু করল।


সে আমাকে নানানভাবে বোঝাতে চাইল। ‘আমি তো সংসার করছি, আমি তো সুখীই আছি। আমি আমার স্ত্রী-সন্তান’কে যথেষ্ট ভালোবাসি। তুমি কেন আমার জন্য এমন কষ্টের জীবন বেছে নেবে?’ এরকম আরও হাজারো কথা!


আমি খুব ভালো করেই জানতাম, তার জীবনে আমার জায়গা আর তার স্ত্রীর জায়গা কখনওই এক ছিল না। সে আমাকে কিছুতেই তার স্ত্রীর জায়গায় বসিয়ে ভালোবাসে না। এখানে এসব তুলনা আসার তো প্রশ্নই ওঠে না! হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটা হয়ে গেছে। এখানে কী আর করা যাবে? আমি তার রাধা ছিলাম, সে ছিল আমার কৃষ্ণ। আমাদের যার যার জায়গা তার তার মতোই ছিল।


আমি কখনও নিজেকে তার স্ত্রীর জায়গায় দেখতে চাইনি। কখনও তার কাছ থেকে স্বীকৃতি চাইনি। আমি শুধুই তাকে ভালোবেসে যেতে চেয়েছি। এর বেশি কিছু নয়। এখানেই আমার স্বর্গ! আমাদের দু-জনের মাঝে অন্যরকম একটা ব্যাপার ছিল। আমি আমার ও তার জায়গা নিয়ে সচেতন ছিলাম, সে-ও ছিল। আমি তাকে যেখানে রাখিনি, সে-ও আমাকে সেখানে রাখেনি। আমাদের মধ্যে গভীর প্রেম ছিল, আমরা দু-জন দু-জনকে কোনও বাধ্যতায় নয়, শুধুই ভালোবাসায় বেঁধেছিলাম।


আমাদের মধ্যে ভালোবাসা শুধুই ছিল না, অবশ্যই আজও আছে, সারাজীবনই থাকবে।


এখন সে যে কাজটা করেছে, তা হলো, সে আমাকে ভীষণ রকমের ইগনোর করছে। আমাকে অনেক বকাঝকা করেছে, যখন আমি তাকে নিয়মিত ফোন করতাম। আমার বাসার সব নম্বর সে ব্লক করে রেখেছে। কোনও একটা নম্বর থেকে ফোন করে যদি আমি একটু হ্যালো বলি, কণ্ঠস্বর শুনে সে সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে ফেলে যে আমি ফোন করেছি। আর অমনিই সেই নম্বরটা তার ফোনের ব্লকলিস্টে চলে যায়।


এসব করার একমাত্র কারণ হলো, আমি যাতে তাকে অপছন্দ করি, আর তার কাছ থেকে সরে যাই। সে ভাবে, এখানে আমি তো কিছু পাবো না। সে তো আমাকে কিছুই দিতে পারবে না। এখানে যেন আমি আর না থাকি। সে আমার ভালো চায়!


আমি জানি, এটা করাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে যতই আমাকে যা-কিছুই বিশ্বাস করাতে চাক না কেন, আমি কীভাবে ওসব বিশ্বাস করব! আমি তো জানিই, সে আমাকে ভালোবাসে, আমি তাকে ভালোবাসি! এতদিন পর এসে আমি কী করে আমার মধ্য থেকে ভালোবাসাটা সরিয়ে দেবো?


আগে ভাবতাম, আমি ছেলেমানুষ। আজ বুঝি, সে আমার চেয়েও বেশি ছেলেমানুষ!


আমাদের মধ্যে যোগাযোগের কোনও মাধ্যম নেই। একটাও রাস্তা নেই যে রাস্তায় আমি তার সাথে একটু যোগাযোগ করতে পারি। জীবনে আর কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলতে পারব কি না, তা-ও জানি না। হয়তো দেখা হবে। হ্যাঁ, দেখা হবেই! অনেক বারই আমাদের দেখা হবে। কিন্তু সামনাসামনি দু-জনের কেউ কাউকে কিছু বলতে পারব না। আমাদের ভেতরটা খুব পুড়তে থাকবে, তবু আমাদের দু-জনের কথা হবে না। এমনও নয় যে আমরা দূরে কোথাও দেখা করতে পারি! কখনওই নয়!


আর কোনোদিনও আমাদের কথা হবে কি না আমি জানি না। এখন সমস্যাটা হলো, আমি চাইছি, যা আছে, ঠিকই আছে, এই সহজ সত্যটা মেনে নিতে! আমি জানি, আমি তাকে আর ফিরে পাবো না। আমার জীবনে সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে না। আমি চাই, সে যা চাইছে, তা-ই হোক। সে নিজ থেকেই আমার জীবনে এসেছিল, নিজ থেকে আবার চলে গেছে। ইটস ওকে! আই অ্যাম হ্যাপি!


সে আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, জীবন নিয়ে সুন্দর করে ভাবতে শিখিয়েছে। এই সত্য আমি অস্বীকার করি কী করে?


আমি সত্যিই আমার সাথে ঘটে-যাওয়া সবকিছু নিয়ে ভালোই আছি। কিন্তু স্মৃতি? তার সঙ্গে আমার স্মৃতিগুলো তো আমাকে প্রতি মুহূর্তেই কষ্ট দিচ্ছে! এই স্মৃতির ঝড় থেকে আমি কীভাবে বের হব? স্মৃতিকে ম্যানেজ করা যায় কীভাবে? কেন স্মৃতিরা আমাকে প্রতিনিয়তই এমন তাড়া করে ফিরছে? কেন মানুষ চলে যাবার সময় তার সমস্ত স্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে যায় না? আমি খুব যন্ত্রণার মধ্যে আছি!


প্রেমটা নিঃস্বার্থ ছিল, দু-জনের কোনও চাওয়া-পাওয়া ছিল না। ঠিক আছে, আমি সবকিছু মানলাম। তাহলে এখানে স্মৃতির আঘাতটা এত আসছে কেন? আমি তাকে ভালোবেসেছি, সে এখন আমার সঙ্গে নেই, আমরা দু-জন মিলে কত ভালো ছিলাম…এসব নিয়ে যা-কিছু স্মৃতি, তা কিন্তু আমাকে মোটেও কাঁদাচ্ছে না!


সে আমার সঙ্গে নেই, সমস্যাটা তা নয়। সে আমার সঙ্গে থেকে গেছে, সমস্যাটা এখানেই! আমি ভাবতে থাকি, প্রতিটি বিকেলে আমাদের কথা হতো, আমার এখনকার বিকেলগুলো তার সঙ্গে কথা বলে আর কাটে না। ঠিক আছে, কাটে না। কাটে না, এটা কোনও সমস্যা নয়। কিন্তু আমি কষ্টটা পাচ্ছি এ কারণে যে, আমি সারাক্ষণই ভাবি, কেন কাটে না? কেন আমি তার সঙ্গে কথা বলতে আর পারি না? কেন আমার বিকেলগুলো আজ এমন একলা কাটে?


মানে, এখন আমি চাইছি, সে ফিরে আসুক! আমি এখন তার কাছ থেকে কিছু পেতে চাইছি। আমি চাইছি, আমাদের সুন্দর দিনগুলো আবার ফিরে আসুক! কেন চাইছি? চাইবার কথা ছিল কি? এমন চাওয়া-পাওয়ার প্রেম আমি কবে শিখলাম? আমি কি তবে বদলে যাচ্ছি?


আমি চাই, কোনও স্মৃতি আমাকে কষ্ট না দিক। কোনও কিছুই আমাকে কষ্ট না দিক। সে তো আমার সঙ্গেই আছে, দূরে সরে যেতে পারেনি তো! অবশ্যই সে আমার সঙ্গেই আছে। প্রতিটি মুহূর্তেই সে আমার সঙ্গে থাকে! তাহলে কেন আমি কষ্ট পাবো?


আমি কষ্ট পাই এই ভেবে যে আমার জীবনের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে আছে আমাদের দু-জনের স্মৃতি। আমার ঘরের প্রত্যেকটা আনাচে-কানাচে তার সঙ্গে আমার স্মৃতিরা খেলছে। আমরা দু-জন এইভাবে কথা বলেছি, ওইভাবে কথা বলেছি। আমার জীবনের প্রতিটি টপিকের সঙ্গে তার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। খাবার থেকে শুরু করে, রান্না থেকে শুরু করে…সবকিছুর সঙ্গেই তার স্মৃতি। তার ব্যক্তিগত জীবন, আমার ব্যক্তিগত জীবন, দু-জনের ব্যক্তিগত জীবন, দু-জনের সকল পছন্দ-অপছন্দ দু-জনের কাছে একদম খুঁটিনাটিসহ জানা।


আমি এই স্মৃতিগুলো থেকে বের হতে চাই। এই স্মৃতি যেন আমাকে কষ্ট আর না দেয়। যা ছিল তা ছিল, যা আছে তা আছে। এখন শুধু সে-ই থেকে গেছে আমার কাছে। আমি চাই, আমার জীবনে যাতে তার উপস্থিতি অনুপস্থিতি নিয়ে কোনও কষ্ট না থাকে। সে নেই, কষ্ট নেই। তার স্মৃতি রয়ে গেছে, কষ্ট শুধু এটাই! সে আমার প্রাক্তন হয়েছে, দুঃখ নেই। তার স্মৃতিরা আজও প্রাক্তন হতে পারল না, দুঃখ কেবল এটুকই! স্মৃতিরা বড্ড হন্তারক!


ইদানীং আমার মনে বেশ কিছু প্রশ্ন এসে ভিড় করে। সে আমার লাইফে কেন এভাবে নেই? কেন ওভাবে ছিল? এটা করতে কেন এখন আমরা আর পারছি না? ওটা করতে কেন তখন আমরা পারতাম? এরকম প্রশ্নের পর প্রশ্ন, অবিরত! আমি সত্যিই এই কষ্ট থেকে বের হতে চাই। আমি কষ্ট পেতে চাই না, আমি শুধুই তাকে আমার মতো করে ভালোবাসতে চাই। আমি চাই, তাকে ভালোবাসার জন্য আমার যেন তাকেই দরকার না পড়ে! তার সঙ্গে এরকম কিছু হোক, ওরকম কিছু হোক…এইসব কোনও আশা যেন আমার জীবনে আর না থাকে। আমি আজ বাঁচতে চাই!