বড়ো হয়ে যাওয়া

 বড়ো হয়ে যাওয়ার একটা বড়ো অসুবিধে হলো, আমরা যত বড়ো হই, আমাদের অসুখগুলোও আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে তত বড়ো হতে থাকে। বয়স বাড়লে মনের অসুখও বাড়ে।
 একসময় দশ টাকা দামের ছোট্ট একটা খেলনাগাড়ি আমাদের যতটা সুখী করত, বড়ো হওয়ার পর দশ কোটি টাকার একটা বড়ো গাড়িও আমাদের তার ছিটেফোঁটাও সুখী করতে পারে না। খুব ছোটোবেলায় মাস্টার মাস্টার খেলা, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিংবা পুলিশ পুলিশ সাজার খেলাগুলোও যতটা আনন্দিত করে, বড়ো হয়ে সেই পেশাগুলোতে সত্যি সত্যি ঢুকে যাওয়ার পরও কেমন জানি ছোটোবেলার সেই অসীম আনন্দের সিকেভাগও পাই না। মনে হয়, নাহ্‌, আমি বোধ হয় অন্য কিছু হতে চেয়েছিলাম। প্রাপ্তি যত বাড়ে, প্রাপ্তির সুখ তত কমে।
  
 ছোটোবেলার ইদ কিংবা পুজোয় একটা নতুন জামার মাতাল ঘ্রাণে খুশির চোটে রাতে ঘুমোতেই পারতাম না, অথচ বড়ো হয়ে যাওয়ার পর মাসে দশ বার নতুন জামা কিনেও, সেই ছোট্টবেলার জামার পরমকাঙ্ক্ষিত ঘ্রাণে যেমনি ঘুমহারা হয়ে পড়তাম, তেমনি আর হই না। প্রতিমাসে কেনা ডজনখানেক জামা আলমারিতে এককোণে ছুড়ে রেখে একপাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সংগতি বাড়ার সাথে সাথে ছোটো ছোটো সুখ কমতে থাকে। ছোটো কিছুতে সুখী হওয়ার ক্ষমতা যত কমে, জীবনে অপ্রাপ্তি ও দুঃখ তত বাড়ে।
  
 একটা পুরনো ছেঁড়া দু-টাকার নোট হাতে পেয়ে একসময় খুশিতে আটখানা হয়ে চেঁচিয়ে উঠতাম যে আমরা, সেই আমরাই বড়ো হয়ে নতুন হাজার টাকার নোট মানিব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি নিরাবেগ নির্বিকার হাতে কিংবা লাখ টাকার বান্ডিল ব্যাংকে জমা দিয়ে আসি চুপচাপ। সচ্ছলতার সাথে তৃপ্তির সম্পর্কটা বরাবরই বিপরীতমুখী। যার আর্থিক সংগতি যত বেশি, তার মানসিক তৃপ্তি তত অল্প। চাইলেই কিনতে না পারার দিনগুলিই আমাদের সবচাইতে সুন্দর দিন।
  
 আমরা যত বড়ো হই, সেই অনুপাতে আমাদের সুখ ও আনন্দগুলো তত ছোটো হয়। একসময় পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলেও আমাদের মনে হয়, কিছুই তো পাইনি এ জীবনে! আসলে বড়ো হয়ে যাওয়ার মতো বড়ো অসুখ পৃথিবীতে আর নেই। ছোটো ছোটো স্বস্তি যখন বড়ো বড়ো সুখের কাছে হেরে ও হারিয়ে যায়, তখন থেকেই আমাদের বিষাদের সূচনা হয়। ছোটোবেলায় আমরা বাঁচি সুখী হতে, বড়োবেলায় আমরা বাঁচি জয়ী হতে। বাঁচতে বাঁচতে একসময় জয় হয়তো আসে, কিন্তু জীবন থেকে সুখগুলি এক এক করে হারিয়ে যায়। আমরা সুখী হতে চাই যতটা, জয়ী হতে চাই তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই আমাদের সমস্ত ভাবনা ও কাজ জয়কে উপলক্ষ্য করেই, সুখের স্থান জয়ের এই পৃথিবীতে খুব সামান্যই।
  
 অনুভূতির চাইতে দামি বিত্ত আর কী হয়! সেই অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় প্রাণওয়ালা আস্ত একটা রোবট। অথচ আমরা যতই বড়ো হই, অনুভূতি নামের এই দামি জিনিসটা ততই আমরা দিন দিন হারিয়ে ফেলতে থাকি। একসময় সুখ কি দুঃখ, আনন্দ কি বিষাদ, প্রাপ্তি কি অপ্রাপ্তি, সাফল্য কি ব্যর্থতা এসবের কোনওটাই আমাদের আর ছোঁয় না। যেন সবাই-ই আমরা নিতান্ত বাধ্য হয়েই বাঁচি। বড়ো হওয়ার যে যাত্রা, সে যাত্রায় আমরা স্পষ্ট করেই বুঝতে পারি, আমাদের প্রিয় অনুভূতিগুলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
  
 হ্যাঁ, বাধ্য হয়েই আমাদের বাঁচতে হয়। কারও কাঁধে ভূরি ভূরি দায়িত্বের ভার, তাই বাঁচতে হয়। কারও কাঁধে মা-বাবা’র দায়িত্ব, কেউ-বা নিজেই মা-বাবা; কারওবা স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন কিংবা তার উপর নির্ভরশীল কেউ থাকে; এমন নানান কারণে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় বাঁচতে আমরা বাধ্য হই। এই যে বেঁচে থাকা, এটা একধরনের অভ্যস্ততা। আমরা গতকাল বেঁচে ছিলাম, আজ বেঁচে আছি, আগামীকালও বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা মনে রাখি। এর বাইরে আমরা কখনও যাইনি বলেই এর বাইরে যেতে মন আমাদের ঠিক সায় দেয় না। মানুষ তার অভ্যস্ততার বাইরে কমই যেতে পারে। জীবনটাকে প্রতিদিনই গালিগালাজ করতে করতে বেঁচে থাকি। আমরা বিশ্বাস করতে শিখে গেছি, জীবন এরকমই।
  
 আমার ধারণা, দায়িত্বের এই ভার ও তা বহনের বাধ্যতা না থাকলে পৃথিবীর আশিভাগ মানুষ স্বেচ্ছায় মরে যেত। আমরা বেশিরভাগ মানুষই আদতে বাধ্য হই বলেই বাঁচি, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় বাহ্যিক চাপবিহীন সিদ্ধান্তে বেঁচে থাকে, এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। যারা পারে ওরকম করে বাঁচতে, ওরাই এ পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবান মানুষ। সব কিছু মেনে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রতিটি দুঃসহ গ্লানি ঘাড়ে চাপিয়ে বাঁচতে বড্ড কষ্ট হয়। সেধে সেধে সেই কষ্ট নেওয়ার মানুষ খুব বেশি নেই। দুঃখের সমস্ত আয়োজন করে মানুষ সুখ খুঁজে চলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। এই জায়গায় পৃথিবীর সব মানুষই কপট।
  
 খোঁজ নিলে জানা যাবে, আমরা তেমন কেউই সত্যি সত্যি বাঁচতে চাই না, বাঁচতে আমরা বাধ্য হই। এজন্যই অনুভূতিহীন একটা জীবন নিয়ে রোবটের মতন করে আমরা হাঁটি চলি, হাসি কাঁদি, কথা বলি। নিজের মতো করে বাঁচতে না পারার অক্ষমতাকে মেনে নিয়ে আমরা নানা ধরনের সংকোচ ও আফসোসে প্রতিনিয়ত কুঁকড়ে থাকি। প্রায় প্রতিটি সফল মানুষই মানসিকভাবে চরম ব্যর্থ একজন মানুষ। আমরা বাহ্যিক জয়ের সরব উদ্‌যাপন করি আত্মিক পরাজয়ের নীরব অন্তঃক্ষরণে। কখনওবা মনে মনে নিজেই নিজের মৃত্যুকামনা করতে করতে লোকজনকে শুনিয়ে চিৎকার করে বলি, 'আমি এ পৃথিবীতে হাজার বছর বাঁচতে চাই!' আসলে শোনাই আমরা কাকে? লোকজনকে? না কি নিজেকেই? এমন আত্মপ্রতারণার পোশাকি নামটা ওরা দিয়েছে: সেলফ-মোটিভেশন বা স্বপ্রেরণা!