কোভিড-আইসিইউ’র বেড থেকে



এবার ফিরতে পারলে পাহাড়ে যাব। অনেক উঁচুতে উঠে সূর্যোদয় দেখব। সূর্যের দিকে দু-হাত বাড়িয়ে থাকব পাহাড়ে উঠতে উঠতে। দু-চোখ গোধূলির ফিকে-আলোয় ভরিয়ে দেবো। প্রিয় মানুষটির হাত ধরে পাহাড়ের কোলে কাটিয়ে দেবো অন্তত একটি পুরো বিকেল। সময় দিতে পারি না বলে প্রেমিকা অভিমান করে আছে। কতদিন ওর সাথে কথা হয় না! যদি বেঁচে উঠতে পারি, ওর অভিমান সত্যিই ভেঙে দেবো। আর মরে যদি যাই, তবে ওর অভিমান আপনিই ভেঙে যাবে। আচ্ছা, যদি তখনও না ভাঙে? কাচের চুড়ি কিনে দিতে ভুলে গিয়েছিল বলে কি বাবার উপর মা আজও অভিমান করে আছে? আর কিছু না হোক, শুধুই প্রেমিকার অভিমান ভাঙাতে হলেও আজ বাঁচতে বড়ো ইচ্ছে করছে! বার বারই মনে হচ্ছে, প্রেমিকার অভিমান ভাঙানোর চেয়ে সুন্দর কিছু আর হয় না! ও নিচের ঠোঁটটা উলটে কীভাবে যেন কাঁদে! দেখতে বড়ো মায়া মায়া লাগে! আমার বাবুইটাকে দেখতে পাবো না আর?


গলির কুকুর তিনটা কেমন আছে, জানা হয়নি অনেক দিন। সেরে উঠলে ওদের দেখতে যাব, চিকেন-ফ্রাই খাওয়াব। ওরা অনেক দিন আমার গা ঘেঁষেনি। ওদেরও মন খারাপ হয়, আমি বুঝতে পারি। আচ্ছা, ওরা কি মনের মধ্যে কোনও অভিমান পুষে রাখে? রাখে না বোধ হয়। রাখতই যদি, তবে অনেক দিন পরেও আমাকে দেখলে অমন করে দৌড়ে আসে কেন? কই, আমার প্রেমিকা তো কখনও ওভাবে এল না! না কি ওদের ভালোবাসার বোধটি অভিমানের চাইতেও বড়ো? অমন বোকা বোকা মন নিয়ে ওরা বাঁচে কী করে? অতটা ভালোবাসতে ওদের কষ্ট হয় না? আচ্ছা, কুকুরেরা ভুলে যেতে শেখেনি কেন? কয়েক প্যাকেট সস্তা বিস্কিট ছাড়া আমার কাছ থেকে আর কিছু তো কখনও ওরা পায়নি! আর আমি তো ওদের ভালোবেসে কখনও কিছু খাওয়াইনি! আনন্দ পেতাম, তাই খাওয়াতাম। ওরা আমার আনন্দকেই ভালোবাসা ভেবে আমাকে এতটা ভালোবেসে ফেলল! এত সহজ মন নিয়ে বাঁচে ওরা! মানুষ কেন পারে না ওরকম? কুকুরেরা আজও মানুষ হতে পারল না!


মাকে শেষ কবে জড়িয়ে ধরেছি? মনে তো পড়ে না! সারাক্ষণই যে মায়ের কথা ভাবি, মা কি বুঝতে পারে? মায়েরা কি সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে সব কথা ধরে ফেলতে পারে? মা শেষ কবে আমার চোখের দিকে তাকিয়েছে? মাকে কি সত্যি সত্যিই ভালোবাসি বলে ফেলা যায় না? কী অদ্ভুত একটা পৃথিবী! যাকে ভালোবাসি কি না নিজেই জানি না, তাকেও বলা যায় ভালোবাসি; অথচ যাকে ভালোবাসিই, তাকে কিছুই বলা যায় না! মাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে খুব ইচ্ছে করছে! মায়ের সাথে আবার দেখা হবে তো? মায়ের সাথে যে আমার অনেক গল্প জমে আছে! আচ্ছা, আমি কি কখনও মাকে দুঃখ দিয়েছি? বাড়ি ফেরার সময় সঙ্গে করে এমন কিছু কি আনতে ভুলে গিয়েছি যা মা খেতে চেয়েছিল? অর্ডার করে হাতে-আঁকানো ময়ূরপেখমের শাড়ি কিনে আলমারিতে রেখেছি। মাত্র দু-দিন পরই মায়ের জন্মদিন। দুঃখ থেকে গেল, শাড়িটা মায়ের হাতে দিতে আর পারলাম না!


আজ মনে হচ্ছে, এ জীবনে কাউকে কাউকে দেওয়া কিছু কথা রাখতে পারিনি। আগে কখনও মনে হয়নি এমন। হয়তো আমার দিক থেকে এই কথা না-রাখাটা খুব বড়ো কিছু নয়। ওদের দিক থেকেও কি ব্যাপারটা এমনই ছোটো? যাদের কথা দিয়েছি, রাখতে পারিনি কিংবা রাখতে পারতাম ঠিকই, তবে ভুলে গিয়েছি রাখতে, ওতে তাদের কোনও ক্ষতি হয়নি যদিও, তবু দুঃখ তো নিশ্চয়ই পেয়েছে…একটু হলেও? যদি বেঁচে ফিরতে পারি ওদের কাছে, তবে হাঁটু গেড়ে বসে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব। অমন করে চাইলে পাবো না ক্ষমা? ওদের কি মনে আছে এই ওসব তুচ্ছ ভুলের কথা? কথা যে রাখে না, সে ভুলে গেলেও, সে কথা যাকে দিয়েছে, সে কখনও ভুলে যায় না। এই সহজ সত্যটা আগে কখনও বুঝিনি কেন? যখন আমার সমস্ত কথা ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ, তখনই কিনা কথা না-রাখার ব্যর্থতা এভাবে ভাবাচ্ছে!


আজ খুব হাসতে ইচ্ছে করছে। কতদিন শব্দ করে হাসি না! ছোটো ছোটো সুখে কতদিন হয়ে গেল আর কাঁদি না! নানান ব্যস্ততায় অনুভূতিশূন্য জীবন কাটিয়েছি কত কতদিন! কতদিন নিজের সাথে গল্প করা হয়নি! নদীর সামনে চুপচাপ গোটা একটা সন্ধ্যা কাটিয়েছি শেষ কবে, আজ মনেও পড়ে না! কত কত বার সমুদ্রের কাছে গিয়ে শুধুই পা ভিজিয়ে চলে এসেছি, মন ভেজাতে মনেই ছিল না! জানালার সামনেই যে নির্জন রাস্তাটি চলে গেছে, দুপুরের পর একসময় সেখানে ধীরপায়ে হেঁটে যেতাম। সেখানে আর হাঁটা হয় না। আজ আমার খুব পৃথিবীর রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছে করছে! রাস্তা ফুরিয়ে এলেই কি তবে মানুষ এমনি করে রাস্তার জন্য কাঁদে?


এতদিন পর কেন এসব মনে পড়ছে? এখন মনে পড়েও-বা কী হবে? মানুষের মনটা এমন কেন? কেন আমাদের বুঝতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের ভালোবাসতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের কাঁদতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের ফিরতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের হাসতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের সরি বলতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের মানুষকে মানুষ ভাবতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের মানুষ চিনতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? কেন আমাদের বাঁচতে শুধুই দেরি হয়ে যায়? এ জীবনে কোনোদিনই সময় নষ্ট করবার সময়ই পেলাম না! কী ব্যর্থ একটা জীবন!


আজ অলস সময় কাটাতে বড্ড ইচ্ছে করছে! একটি অখণ্ড অবসর পেতে আমিও পারতাম! নিজের কষ্টগুলির সঙ্গে নিভৃত আড্ডায় মেতে উঠতে আমিও পারতাম! জীবনের কাছে বসে না-বলা কথাগুলি বলতে আমিও পারতাম! আমার যে অনেক কথা বলার ছিল! সত্যিই কি সময় পাবো না আর? আজ কার কাছে ক্ষমা চাইলে সময় নষ্ট করার মতো একটু করে আয়ু পাবো? আমি বোধ হয় ক্ষমা চাইবার সমস্ত অধিকার আজ ফুরিয়ে ফেলেছি! আমার এমন কেন হলো? আমার সারাটি জীবন কাটল জীবনের ব্যস্ততায়, আজ জীবনশেষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে মৃত্যুর ব্যস্ততায়। জীবন নয়, ব্যস্ততাই সত্য হয়ে রইল এই অথর্ব জীবনে! আমি বেঁচে ছিলাম ব্যস্ততা নিয়ে, মরেও যাচ্ছি ব্যস্ততা নিয়ে। আমি তবে বাঁচলাম আর কোথায়!


আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মা! চারিদিকে এত বাতাস, তবু নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো একমুঠো বাতাসও কোথাও নেই। আমি চলে যাচ্ছি। ওরা কোভিড-আইসিইউ’র বেডের পাশে কাউকে আসতে দেয় না। ওদের নিয়ম, আমার একাকিত্ব! অসুস্থতা ও মৃত্যু, এই দুইয়েরই যাপন বড্ড একাকী! তবু কীভাবে যেন ওদের সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাবা এখানে ঢুকে পড়েছে! ছোটোবেলার মতো করে বাবা আমার চুল সরিয়ে সরিয়ে মাথায় হাত বোলাচ্ছে। বড়ো আরাম পাচ্ছি! মা, তোমার সঙ্গে দেখা আর হলো না। তোমাকে শেষবারের মতো ভালোবাসি বলা আর হলো না। তোমার সঙ্গে আমার অনেক অনেক গল্প করার ছিল, মা! তোমরা সবাই ভালো থেকো। বাবা আমাকে নিতে এসেছে, আমি বাবার সঙ্গে যাচ্ছি।


আহা, কতদিন পর আজ বাবার হাত ধরে অনেকক্ষণ হাঁটব! বাবা নিশ্চয়ই আমাকে একঠোঙা বাদাম কিনে দেবে! বাবা চলে যাবার পর আমি আর কোনোদিন বাদাম খাইনি। তোমার মনে আছে, মা? আজ অনেক অনেক দিন পর আয়েশ করে বাদাম খাব। বেঁচে থাকতে বাবাকে কখনও কিছু দিতে পারিনি, মরে যাবার পরেও দিতে পারছি না। সারাজীবন এত পয়সা উপার্জন করে আমার কী লাভ হলো, মা?


জানো, মা, তুমি বুড়ো হয়ে গেলেও বাবা এখনও বুড়ো হয়নি। বাড়ি থেকে শেষ বেরোবার সময় বাবার যে বয়সটা, তা আর বাড়েনি, মা! বাবার চুল এখনও কালো, হাতদুটো আজও বলিষ্ঠ! আমার বাকি জীবনের পুরো দায়িত্বটা বাবাকে নিতে হবে বলেই হয়তো ঈশ্বর বাবাকে এমন শক্তসমর্থই রেখে দিয়েছেন। ঈশ্বর বড়ো ভালো গো, মা!


মা, আজ তোমার একটা পুরনো অভিমান ভেঙে দিই, কেমন? অ্যাক্সিডেন্টের সময় বাবার ব্যাগে তোমার জন্য কেনা তিন গোছা লাল-নীল-সবুজ চুড়ি ছিল। ওরা তোমার কাছে আমার লাশটা পৌঁছে দিলে এই খুশিতে একটু হেসো, মা?