স্মৃতির ঘা

 

 এখন যে মুহূর্তটি আনন্দ দিচ্ছে, তা-ই হয়তো একসময় কষ্টের স্মৃতি হয়ে যাবে। স্মৃতি হয়ে যাবার পর, যে মুহূর্ত যত বেশি কষ্ট দেয়, সে মুহূর্ত তত বেশি সুখের।
  
 মানুষ কষ্ট পায় বিগত সময়গুলোর জন্য নয়, বরং সেইসব সময় যে স্মৃতির জন্ম দেয়, তার জন্যই। চলে গিয়েছে যা, তা কষ্ট দেয় না, তার স্মৃতিই শুধু কষ্ট দেয়। স্মৃতিরা সবাই এসে আমাদের মাথায় ভিড় করতে থাকে, ক্রমাগত হাতুড়িপেটা করতে থাকে, আর বলতেই থাকে, আমিও একসময় বেঁচে ছিলাম! আমার দিকে তাকাও, আমাকে দেখো! আমি একদিন তোমার সঙ্গেই ছিলাম, তোমার জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে আজও আমিই আছি! আমাকে বাদ রেখে তোমার কোনও অস্তিত্বই নেই!
  
 প্রিয় মানুষটি যখন ছেড়ে চলে যায়, তখন মানুষটির কথা ভেবে যতটা খারাপ লাগে, তার চাইতে অনেক বেশি খারাপ লাগে, যখন, মানুষটির সঙ্গে আমার যা যা স্মৃতি, সেগুলি এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। মানুষ কাঁদায় না, মানুষের স্মৃতিই কাঁদায়।
  
 স্মৃতিদের আপনি যত ভুলতে চেষ্টা করবেন, ওরা তত বেশি করে মনের মধ্যে এসে ভিড় করবে। ওদের সরিয়ে রাখতে চাইলেই বরং আরও বেশি করে বুকের কাছে চলে আসে। বেঁচে থাকবার সমস্ত আয়োজনকে অর্থহীন করে দিতে স্মৃতির চাইতে বড়ো হন্তারক আর কে আছে!
  
 আমাদের পুরো জীবনটাই স্মৃতির অ্যালবাম। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই এক-একটি রিল, যা ছবি হয়ে সেই অ্যালবামের পাতায় পাতায় থেকে যায় খুব স্পষ্ট অবয়বে। ঠিক এই মুহূর্তটিই কালকের কিংবা দূরের কোনও একটি সময়ের স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। আজ যা কাঁদাচ্ছে, হয়তো তখন তা-ই হাসাবে। আজ যা হাসাচ্ছে, হয়তো তখন তা-ই কাঁদাবে। হাসি বা কান্না কোনোটিই চিরস্থায়ী নয়, ওরা কেউ থাকে না, কেবল জীবনই থেকে যায়। আমাদের এ জীবনটা এরকমই!
  
 যখনই আমরা বলি, খুব করে চেয়েও তাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না, তখন আসলে আমরা যা ভুলতে পারছি না, তা হচ্ছে তার সঙ্গে তৈরি আমাদের স্মৃতিগুলো। মানুষ যখন স্মৃতি হয়ে যায়, তখনই বোঝা যায়, মানুষটি আমাদের জীবনে কী ছিল! হারিয়ে ফেলবার আগ পর্যন্ত মানুষকে চেনা ও মূল্যায়ন করা সহজ নয়। আমরা স্মৃতির দামে মানুষ কিনি।
  
 সে আমায় ছেড়ে গিয়েছে, এটা মেনে নেওয়া যতটা কষ্টের, তার চাইতে অনেক বেশি কষ্টের, প্রতিনিয়তই এই স্মৃতিটা অনুভব করতে হওয়া, আমাকে ছেড়ে যাবার কথা উঠলে সে কীভাবে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠত! আমরা দু-জনই তখন কাঁদতাম, এর নাম মুহূর্ত। আমি একলাই এখন কাঁদি, এর নাম স্মৃতি।
  
 মৃত্যু যে বিচ্ছেদ ঘটায়, সে বিচ্ছেদে মৃত্যু যতটা বিহ্বল করে দেয়, তার চাইতে অনেক বেশি বিহ্বল করে, সে একদিন আমার জন্যই বেঁচে ছিল, এই সত্যটা। এমন কারও জন্য মরে যাওয়াও সহজ, কিন্তু এমন কারও কথা ভেবে বেঁচে থাকাটা মোটেও সহজ কিছু নয়।
  
 স্মৃতিকে বাড়ানোর অনেক ওষুধ পাওয়া যায়, অথচ স্মৃতিকে হত্যা করার জন্য এক বিষ বাদে আর কিছুই পাওয়া যায় না। স্মৃতিশক্তি দুর্বল বলে কাঁদে যারা, ওরাও কিন্তু তীব্র অনিচ্ছাতে কিছু কিছু দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়ায় বছরের পর বছর। মানুষ ভীষণ স্মৃতিকাতর প্রাণী। স্মৃতিকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে যে যত কম, তার বুকে যন্ত্রণার ছোপ ছোপ দাগ তত বেশি গাঢ়।
  
 মধুর সময়ের স্মৃতিগুলোই সবচাইতে বেশি ধারালো হয়। আমরা বর্তমানের আনন্দে ভাসি, আর ভবিষ্যতের বিষাদ বুনি। একদিন হঠাৎ কোনও এক ঝুমবৃষ্টির রাতে, বিষণ্ণ গোধূলিতে, আগুনফোটা ভোরে, রৌদ্রমাখা ক্লান্ত দুপুরে, ঘোরলাগা আঁধারে প্রিয় মানুষটির মুখ, হাসি, অশ্রু, স্পর্শ স্মৃতি হয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। তার কোনও প্রিয় কথা, প্রিয় গান, প্রিয় মুহূর্ত, প্রিয় খাবার, প্রিয় কাজ, প্রিয় সিনেমা, প্রিয় জায়গা, প্রিয় কবিতা, সেই মানুষটির প্রিয় যা-কিছু, তার সবই স্মৃতির প্রকট শরীর হয়ে এসে ধারালো ছুরির মতো কলিজার প্রতিটি ইঞ্চি খুব নিখুঁতভাবে কেটে কেটে আমাদের একেবারে ছারখার করে দেয়।
  
 আমরা তার পাঠানো সব চিঠি পুড়িয়ে ফেলতে পারি, তার দেওয়া সব উপহার ধ্বংস করে ফেলতে পারি, তার সঙ্গের সব ছবি ছিঁড়ে ফেলতে পারি, তবু তাকে কিছুতেই ভুলে ভালো থাকতে পারি না। সম্পর্কের উষ্ণতা যত স্বস্তির, স্মৃতির দহন ততোধিক কষ্টের।
  
 মানুষ বড়ো অদ্ভুত প্রাণী। মানুষ প্রতারকের জন্যও কাঁদে; এমন নয় যে না চিনে কাঁদে, চিনেও সে খুব কাঁদে। কখনও শোধরাবে না জেনেও মানুষ প্রতারককে বার বার ক্ষমা করে দেয়, আর সব মেনে নিয়ে বুকের মধ্যে যত্ন করে রাখে। একসময় সেই প্রতারক যখন চরম আঘাতটা করে চলে যায়, তখনও মানুষ তার স্মৃতিগুলো হাতড়ে হাতড়ে কাঁদে, তার জন্য প্রার্থনা করে। মানুষ যতটা-না রক্তমাংসে গড়া, তার চাইতে অনেক বেশি স্মৃতিতে গড়া। মানুষ, যতটা মানুষ, ততোধিক স্মৃতির পুতুল। এই পুতুলেরা মায়ায় বাঁচে, মায়ায় মরে।