স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-এ বলছেন, “পঞ্চভূত লয়ে যে দেহ, সেইটি স্থূলদেহ। মন, বুদ্ধি, অহংকার আর চিত্ত, এই লয়ে সূক্ষ্মশরীর। যে শরীরে ভগবানের আনন্দলাভ হয়, আর সম্ভোগ হয়, সেইটি কারণশরীর। তন্ত্রে বলে, ‘ভগবতী তনু।’ সকলের অতীত ‘মহাকারণ’ (তুরীয়) মুখে বলা যায় না।” পঞ্চভূত: পৃথিবী বা মাটি (মাংস, হাড় ও অঙ্গ গঠন করে), জল (রক্ত-সহ সকল জলীয় অংশ গঠন করে), বায়ু (বাতাস গঠন করে), অগ্নি (দেহের তাপ গঠন করে), আকাশ (স্থূলদেহের উপাদানসমূহের ভারসাম্যের উপর ভিত্তি করে মন এবং তার ধরন গঠন করে)।




স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণদেহের যা পূর্ণ অখণ্ড রূপ, তার নাম মানবদেহ। এই সমগ্র পৃথিবীতে যা-কিছু দৃশ্যমান বা অদৃশ্য-রূপে জড়, জ্যোতির্ময় ও চেতনরূপে বিদ্যমান আছে, তা-ই মানবদেহে ও মানবমনে প্রকটিত রূপে বিদ্যমান আছে। এর কিছুটা পরিচয় না পেলে হয়তো সাধন বা যোগ জীবনের প্রথমেই মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ থাকতে পারে।




আকার, আকৃতি, প্রকৃতি, অস্থি, চর্ম, মেদমজ্জা, মাংস, রক্ত, রস ইত্যাদি স্থূল শরীরের পূর্ণ রূপ। বোধ, বায়ু (মেজাজ) বিভিন্ন জ্যোতিরূপ ইত্যাদি পূর্ণ সূক্ষ্ম শরীর, চৈতন্য ও চিৎশক্তি তথা প্রাণ নিয়ে কারণ শরীর।




এই মানবশরীরের পূর্ণ বিকাশ সাধন করলে মানুষ দেখতে পায় যে, সমগ্র বিশ্ব‌ই শরীরের তিনটি রূপের কোনো একটিতে ধারণযোগ্য এবং বিশ্বের সমগ্র রূপ ওই তিন শরীরের মাধ্যমেই পূর্ণ প্রকট হয়ে উঠছে। যতক্ষণ সময় মানুষ তার নিজের মধ্যে এমন বিশ্ববিকাশ দেখতে না পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই মানবদেহের বৈশিষ্ট্যরূপ যে-বিশ্বাস, তার ভিত্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না এবং বিশ্ব, মানব ও ঈশ্বর যে মূলত এক, তারও কোনো প্রমাণ দেওয়া চলে না। মৃত্যুশীল শরীরের মধ্য দিয়ে অমরত্ব প্রমাণ করা কোনো দিনই সম্ভব নয়।




মানবদেহে বিশ্বাসই হচ্ছে প্রকৃত স্বাভাবিক ভিত্তি ও ভাব হচ্ছে পরিচালক।




এই দুইয়ের উপর নির্ভর করেই মানুষকে চলতে হয়—উপাসনা, তপস্যা, সাধনা, যোগ ইত্যাদি পথে; পথের পাথেয়: গুরুকৃপা এবং গুরুপ্রদর্শিত পন্থা বা কৌশল। কারণ দেহের অমরত্বই প্রকৃত অমরত্ব, কাজের মাধ্যমে মানুষ তা-ও করতে সক্ষম। আজ হোক, কাল হোক, এ আশা মানুষের পূর্ণ হবেই, যদি সে চেষ্টা করতে থাকে।




স্থূল দেহের প্রয়োজন কী? স্থূল দেহই কর্মময় দেহ। কারণ ও সূক্ষ্মদেহের যা পূর্ণ বিকাশ, তা আমরা স্থূলদেহের বোধের মাধ্যমে উপলব্ধি করে থাকি। স্থূলদেহ যেখানে নেই, সেখানে উপলব্ধিগত বোধের বিকাশ কোথায়? তাই কর্মের মাধ্যমে কারণ এবং সূক্ষ্মকে পূর্ণরূপে প্রকাশিত দেখতে চাইলে স্থূলদেহ ছাড়া আর কোনো দেহ বা বাহ্যিক প্রকাশ নেই, কেননা স্থূলদেহকে অবলম্বন করেই আমরা সূক্ষ্ম ও কারণ দেহকে জানতে, বুঝতে বা দেখতে পারি। স্থূলদেহ না থাকলে তা কোনোমতেই সম্ভব হতো না। রূপ, আকার, আকৃতি, প্রকার-প্রকৃতি ও বোধের মাধ্যমেই আমরা অরূপ-স্বরূপ ও পূর্ণ চৈতন্যের মূলটি কর্ম বা ক্রিয়ার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে বা ধরতে পারি।




সূক্ষ্ম বা বোধময় দেহের মাধ্যমে আমরা সকল প্রকারের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য আকার-আকৃতির বোধ অনুভব ও উপলব্ধি করে থাকি। এটাই অনুভূতি বা বোধ-সম্পন্ন দেহ। বুদ্ধি ও জ্ঞানের পূর্ণ প্রসারতার কাজটি মানুষ এই সূক্ষ্মদেহের মাধ্যমেই করে। এই বোধময় দেহের মধ্যেই কর্মময় দেহের পূর্ণ প্রকাশ বা বিকাশ স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়, তিন দেহের এটিই মধ্যদেহ—এখান থেকেই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কাজ চলছে এবং এই দেহই যেন অপর দুই দেহের সামঞ্জস্য বা সমতা রক্ষা করে মানুষের শরীরে চিরশাশ্বত স্বভাবে বিদ্যমান রয়েছে।




স্থূলদেহ যেমন কর্মপ্রধান, সূক্ষ্মদেহ তেমনি বোধ বা মন-প্রধান। অবশ্য বলতে গেলে স্বভাবত কর্মই হচ্ছে সব কিছুর নিয়ামক। এর প্রাধান্য সব দেহেই সমভাবে বিদ্যমান।




কারণ দেহ বা প্রাণই অপর দুই দেহকে ধারণ করে রেখেছে। মূলত এখান হতেই স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহের পূর্ণ বিকাশ। কারণ-দেহ চৈতন্য-প্রধান বিধায় এটাকেই সৃষ্টির প্রকৃত মূল বলা যেতে পারে। কারণ-দেহ না থাকলে কার্য-দেহ বা কর্ম-দেহের প্রকাশই হতে পারে না। আর কর্ম যদি বোধশূন্য হয়, তাহলে জ্ঞানময় দেহেরও উদ্‌ভব হতে পারে না; আর জ্ঞানময় দেহের (বুদ্ধিমত্তার আবরণের) বিকাশ না হলে চিন্ময় দেহ বা চৈতন্যময় দেহকে ধরা কোনোমতেই সম্ভব নয়।




তাই বলা যায়, সমগ্র সৃষ্টির মূলই হচ্ছে এই কারণদেহ বা চৈতন্যময় দেহ। এখান থেকেই মানুষ ব্রহ্মের তথা ঈশ্বরের দিকে, ভক্তির তথা প্রেমের দিকে যাবার পথ পেয়ে থাকে। এখানে না পৌঁছা পর্যন্ত মানুষ কিছুতেই ওই সকল পন্থার মূল খুঁজে পায় না।




তাই কারণ হতে যেমন স্থূল ও সূক্ষ্মের পূর্ণ প্রকাশ, তেমনি অপর দিকে ঈশ্বর, ব্রহ্ম ও প্রেমের পূর্ণ বিকাশ।




এখন দেখা যায়, যা কারণ-দেহে পরমাণুরূপে বিদ্যমান, তা-ই সূক্ষ্মে অণুরূপে বিদ্যমান, আবার তা-ই স্থূলে আকার-আকৃতি-প্রকৃতিরূপে বিদ্যমান। অতএব, এই তিনের অভিন্ন সংযোগ দ্বারাই সম্ভব হয় মানুষের মধ্যে পূর্ণ-স্বরূপের বিকাশ। একটিকে বাদ দিয়ে অপর দুইটি যে অপূর্ণ, তা বুঝতে কোনো অসুবিধে বা সন্দেহ হয় না।