গীতার শ্লোকার্থ: ৯/১৪

সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।
(গীতা, ৯/১৪)




অনুবাদ: তারা সবসময় আমার গুণকীর্তন করে, আমাকে পাবার জন্য যথাসাধ্য যত্ন (চেষ্টা) করে, নিশ্চিত (নিঃসংশয় চিত্তে) নিয়মানুষ্ঠানপূর্বক (আচারঅনুষ্ঠান পালন করার মধ্য দিয়ে) যম (সংযম বা সঠিক জীবনযাপন) নিয়মাদির অনুশীলন করে, আমাকে ভক্তির সাথে প্রণাম করে, এভাবে (আমার সাথে) নিত্যযুক্ত থেকে উপাসনা করে।




পদ্যানুবাদ:
সর্বদা কীর্তনে তারা আমাকেই পূজা করে আর
একনিষ্ঠ নমস্কারে নিত্যযুক্ত উপাসনা করে।
(মহাপয়ারামৃত গীতা, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় অনূদিত)




তাৎপর্য: মানুষ বহু পুণ্য কাজের মাধ্যমে যখন দৈবী প্রকৃতির (মোক্ষলাভে সহায়ক সাত্ত্বিকী প্রকৃতির) অঙ্কস্থ (অবস্থালাভের অধিকারী) এবং মহাত্মা হয়, তখন তারা যেভাবে আমার উপাসনা করে, তা নিয়েই বলা হচ্ছে। সবসময় আমার কীর্তন করে, কেননা জগতে যদি কখনো কারও গুণ বা মহত্ত্ব কীর্তন করতে হয়, তবে জ্ঞানে (নির্বিকল্প বা নিরাকার সাধনায়) বা অজ্ঞানে (সবিকল্প বা সাকার সাধনায়) ব্রহ্মকে তথা চৈতন্যকে তথা আমাকেই কীর্তন বা প্রার্থনা করা হয়। তবে যারা মহাত্মা, তারা জানে বোঝে প্রত্যক্ষ করে যে, আমিই সব, সুতরাং গুণ বা মহত্ব কীর্তন করার সময়, আমাকেই পরিকীর্তিত বা প্রশংসিত করে।




বর্তমানকালে যে নামকীর্তনাদির বহুল প্রচার দেখা যায়, তা এই ‘মাং কীর্তয়ন্তঃ’ কথারই দূরাগত অনুশীলন, কেননা চৈতন্যের জাগরণে ব্যবহৃত সকল পন্থাই মূলত ভগবানের‌ই উপাসনা। নামরূপে যে নামী নিজেই বিরাজ করেন—”যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি।/নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি।।" (শ্রী নরোত্তম দাস বিরচিত 'শ্রীশ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম’) . . . এই পঙ্‌ক্তিদুটির সার্থকতা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেন, তাঁদেরই নাম-কীর্তন সার্থক হয়, তা-ই এই গীতোক্ত কীর্তন। এর অর্থ হলো, ব্রহ্মবিদ্যা ও ব্রহ্ম মূলত এক‌ই সত্তা, (যেমনি রাহুর মস্তক ও রাহু এক‌ই সত্তা) তাই ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করা হলে মূলত ব্রহ্মকেই লাভ করা হয়—তবে এই তুলনায় কেবল তখন‌ই পৌঁছনো যায়, যখন নাম তথা উপাসনা আর উপাসক এক হয়ে উপাস্যে বিলীন হয়ে যায়।




আমাকে বাদ দিয়ে প্রাণের সগুণ দেবতার দিকে লক্ষ্যহীন হয়ে, অর্থাৎ নির্গুণ ব্রহ্মকে লাভ করার প্রাথমিক ধাপটিই অনুসরণ না করে যে-নামকীর্তন, তা কীর্তনের পূর্ববর্তী সাধনা তথা প্রস্তুতি মাত্র। মন্ত্রজপও এই কীর্তনের মধ্যে পরিগণিত হতে পারে। জপের সময় যদি মন্ত্র চৈতন্যময়-চৈতন্যযুক্ত-চৈতন্যস্পর্শী না হয়, তবে তেমন জপ যথার্থ জপ পদবাচ্য হয় না—তা যথার্থ জপ করার ঠিক আগের সাধনা বা প্রস্তুতি মাত্র, যেমনি লোকে সত্যিকারের ধ্যানের জগতে প্রবেশ করার আগে অসংখ্য বার চোখ বুজে বসে থাকে। (তুলনীয়: পড়াশোনার মধ্যে ঢোকার আগে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও টেবিলে ব‌ই-খাতা নিয়ে বসে থাকার ক্রমাগত চর্চা করতে হয়।)




আমাকে পাবার জন্য লোকে তীব্র যত্নের প্রয়োগ করে। যার যত্ন যেমন তীব্র, তার ‘আমি’ তথা ‘জীবাত্মা’ তত সমাসন্ন বা নিকটবর্তী। যাঁরা মনে করেন, বিনা যত্নে বা চেষ্টায় শুধু ভগবানের কৃপাতেই সব হয়, যখন উপযুক্ত সময় হয়, তখন তিনিই ডেকে নেন আর নিজেই সব করে দেন—তাঁদের সেই সর্বময় ভগবদ্‌করুণার উপলব্ধির জন্যই যত্ন বা চেষ্টা করতে হয়। উপযুক্ত সময়ে ভগবান ডেকে নেবেন, এভাবে সেই সময়ের প্রতীক্ষা ও যতদিন সে সময় না আসে, ততদিন সংসারের ঘাত-প্রতিঘাত নীরবে সহ্য করার জন্য যত্ন বা চেষ্টা করতে হয়—এই যত্ন বা চেষ্টাই আসল জিনিস। স্থূল বা দৃশ্যমান যত্ন ছাড়া জগতে কিছুই পাওয়া যায় না; বিনা মূল্যে কিছুই লাভ হয় না। আমরা যেন কিছুতেই ভুলে না যাই যে, কৃপাও মূল্যলভ্য। ভগবানের কৃপা আপনাআপনি বর্ষিত হয় না, তা পাবার জন্য চেষ্টা করতে হয়, চরম মূল্য দিতে হয়। “ভগবান দিল না বলে পেলাম না”, এমন বলার আগে তা পাবার জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে হয়।




এই কথাগুলি শুনতে ভালো লাগলেও সত্য, না লাগলেও সত্য। যেখানে দেখা যাবে, যত্ন বা চেষ্টা ছাড়া কিছু পাওয়া গেছে, সেখানে বুঝে নিতে হবে, দৃষ্টির অগোচরে যত্ন বা চেষ্টা লুকিয়ে ছিল। সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আর পরীক্ষায় ভালো করে যে ছাত্র, তার ঘুরে বেড়ানোটাই আমরা দেখি, পড়াশোনাটা তত দেখি না। তবে কথা হচ্ছে, যখন দেখা যায়, একটু একটু করে যত্ন আসছে, তখনই বোঝা যায়, ভগবদ্‌-কৃপাই যত্নের আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। যত্নই কাজের শুরু, চেষ্টাই ভগবানের কৃপার প্রথম পর্যায়। আন্তরিক যত্ন কখনও ব্যর্থ হয় না। যাঁরা মহাত্মা, যাঁরা দৈবী বা সাত্ত্বিক বা ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য বা কামনাশূন্য প্রকৃতির আশ্রিত, তাঁদের ভেতর দিয়ে এ লক্ষণ প্রকাশ পাবেই পাবে। ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হয়ে কাজ করা যায় কীভাবে? ডাক্তার যখন রোগী দেখছেন, তখন তিনি প্রাপ্য-অর্থের কথা না ভেবে কেবলই কাজের দিকে মনোনিবেশ করবেন—এতে যশ ও সমৃদ্ধি আপনাআপনিই বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে আসবে। শিক্ষক ছাত্র পড়ানোর সময় যদি সারাক্ষণই বেতনের দিকে মন না রেখে শিক্ষাদানের মানের দিকে মন দেন, তাহলে সুনাম ও অর্থলাভ দুই-ই হয় খুব স্বাভাবিকভাবেই।




‘দৃঢ়ব্রতাঃ’ অর্থ: যে নিশ্চিত বা সংশয়হীন হয়ে নিয়ম অবলম্বন করে; ভগবানকে পাবার জন্য দৃঢ়নিশ্চয় হয়ে কোনো ধরনের বিশিষ্ট নিয়ম অবলম্বন করে। বিশিষ্ট নিয়মকেই ব্রত বা কঠোর সাধনা বলে। কেউ নামকীর্তন করে, কেউ তপস্যা করে, কেউ ধ্যান করে, কেউ যোগ করে, কেউ পূজা করে—এ সবই এখানে ‘ব্রত’ শব্দের একেকটা উপায় বা পথ। এ সকল কাজ বা ব্রতানুষ্ঠানে দৃঢ়তা থাকা চাই, অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমি এটা দ্বারা ভগবানকে লাভ করব, এ বিষয়ে কোনো ধরনের সংশয় নেই”—এমন নিশ্চয় বা নিঃসংশয় জ্ঞানই ভগবদ্‌পদ লাভের একমাত্র উপায়।




যে যা-ই করুক না কেন—উপাসনার প্রকারভেদে কোনো সমস্যা নেই—যে যা করে, তাতে তার দৃঢ় নিশ্চয়জ্ঞান থাকা আবশ্যক। যার যা কাজ, তা পুরোপুরি ঠিকভাবে করাই ধর্ম। যদি প্রতিদিন‌ই কোদাল দিয়ে মাটি কেটে কেটে সেই কাজে দৃঢ়নিশ্চয় বা সংশয়শূন্য জ্ঞান হয়, তবে তার সাহায্যেও ভগবানলাভ তথা চৈতন্যের জাগরণ হতে পারে। অনেকে আছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যা-পূজা-জপ-তপ সব কিছুই নিয়মমতো করেন, কিন্তু কাজে দৃঢ়তা ও ঐকান্তিক ভাব নেই, অর্থাৎ এসব কাজ করার সাথে সাথেই যে ভগবদ্-সঙ্গ লাভ হচ্ছে, এ বিশ্বাস থেকে তাঁরা বিচ্যুত। তাঁরা ভাবেন, কাজ কোনোমতে করলেই হবে, কাজ করতে করতেই একসময় ভগবানের দয়া অনুভব করা যাবে। এভাবে হয় না। এভাবে হলে মোটামুটি সবারই ভগবানলাভ হয়ে যেত।




অবশ্য তাঁদের অমন ভাবনার কোনো দোষ নেই, যে যেমন আর কি—তবে এমন কাজ করার সময়ই যে ভগবদ্-সঙ্গ লাভ করা যায়—এখনও তারা সে আনন্দ পাননি, এটা বলতে হয়। কখনোই কারও নিজস্ব সাধনাপ্রণালীর পরিবর্তন করার কোনো দরকার নেই। শাক্ত শাক্তই থাকুন, বৈষ্ণব বৈষ্ণবই থাকুন, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান তাঁর নিজের ধর্মমতেই থাকুন—যিনি যা-ই করুন না কেন—সাধনা তখনই শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে, যখন সাধনায় কোনো ফাঁক থাকে না, এবং যখন সাধনার মধ্য দিয়ে এই ভাবটি লক্ষ করা যায় যে—সাধনার মধ্যেই সাধক নিমজ্জিত রয়েছেন। এরকম হলে তবেই সেই সাধক দৃঢ় নিশ্চয়বান বা সংশয়হীন হতে পারেন। এমন বোধে বা ভাবে বা জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হবার আগে যদি কেউ মনে করেন যে, আমি দৃঢ়ব্রত হয়েছি, তবে তাঁর অমন কথা কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।




যারা মহাত্মা, যাদের দৈবীপ্রকৃতি লাভ হয়েছে, তারাই ভগবানকে পাবার জন্য দৃঢ় ও বিশেষভাবে যত্নশীল হয়, তারাই ভগবানের সর্বব্যাপক স্বরূপ উপলব্ধি করার জন্য দৃঢ়ব্রত বা সংকল্পবদ্ধ হয়। যারা তাঁকে চায়, তাদের চরিত্রে ওই দুইটি লক্ষণ (দৃঢ়তা ও যত্নশীলতা) আপনাআপনিই প্রকাশ পায়। বাকিরা তাঁকে চাইলেও পায় না, কেননা তাদের সেই চাওয়ার পথটিই ভ্রান্ত। চাইতে না জানলে ব্যাকুল হয়ে চেয়েও কিছু হয় না। নির্বোধের বা অজ্ঞানের ব্যাকুলতায় কিছু হয় না।




নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা—ভক্তির সাথে আমাকে প্রণাম করে। আমরা ‘ভক্তি’ শব্দ দিয়ে সোজা কথায় ‘ভালোবাসা’-ই বুঝে নিই; আমাদের সহজবুদ্ধিতে এটাই আসে। এমন অর্থে কেউ কোনো আপত্তি করে না। ভালোবাসা যে কী, তা কাউকে বুঝিয়ে দিতে হয় না, কারণ সকল জীবেই ভালোবাসা অল্পবিস্তর আছে, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে। ভগবানকে ভালোবাসার নাম ভক্তি, আর তা বাদে অন্য কোনো ভালোবাসা ভক্তি নয়। ভগবানে ভালোবাসা বা ভক্তি কীভাবে লাভ করা যায়? ভক্তি কিন্তু নিত্যবস্তু, অর্থাৎ এমন কোনো হেতু বা উপায় নেই, যার সাহায্যে ভক্তি জন্মাবে।




জগতের অন্য সকল ভালোবাসা অনুকূল বস্তু বা ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠতায় জন্মে থাকে, কিন্তু ভগবানের প্রতি ভালোবাসা অর্থাৎ ভক্তি তেমন কিছু নয়। সেটা অহৈতুক বা স্বার্থসিদ্ধির আকাঙ্ক্ষাশূন্য এবং সম্পূর্ণ অপার্থিব বস্তু। ভক্তি জীবের অন্তরে নিত্যপ্রবৃত্ত বা সিদ্ধই আছে। কোনো নির্দিষ্ট কাজ করলে ভক্তির উদয় হয়, অথবা সেই কাজ না করলে ভক্তি বিলুপ্ত হয়—ভক্তি এমন কিছু নয়; ভক্তি স্বয়ংসিদ্ধ। মানুষ যথার্থই যাকে ভালোবাসে, তিনিই যে ভগবান, এ কথাটা অনেকেই স্বীকার করতে পারে না, তাই নিত্যসিদ্ধ ভক্তি হতে বঞ্চিত হয়। পরকে কখনও ভালোবাসা যায় না; যতক্ষণ ভেদজ্ঞান তথা আমি-তুমি পার্থক্যবোধ থাকে, ততক্ষণ ঠিক ঠিক ভালোবাসা হতেই পারে না; তা ভালোবাসার অনুশীলন মাত্র। আমরা সবচাইতে বেশি ভালোবাসি নিজেকেই—এতে কোনো সংশয় নেই। আর এই যে ভালোবাসি, এর কিন্তু বিশেষ কোনো কারণও নেই। আমি আমার আমিকে একমুহূর্তের জন্যও বিদায় দিতে পারি না, বিদায় দিতে চাইও না। বিদায় দেওয়া সম্ভব‌ও নয়, কেননা সেক্ষেত্রে আমাকেই আমার মধ্য থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, যা কখনোই হয় না। সুখে-দুঃখে-স্বর্গে-নরকে সবখানে আমাকেই আমি ধরে আছি।




এই যে নিজের প্রতি আমার অতিপ্রিয়ভাব, এটা কি কোনো সাধনা দ্বারা লাভ করতে হয়, না কি স্বতঃসিদ্ধ? ওই আমিটাকে যদি ভগবান তথা পরব্রহ্ম তথা চৈতন্য বলে বুঝে নিতে পারা যায়, তবে ভক্তি তো ভক্তের স্বয়ংসিদ্ধরূপেই লব্ধবস্তু হয়ে পড়ে, কেননা ভক্ত তো তার ভেতরকার ‘আমি’-টাকে নিয়েই ছিল, শুধু স্পষ্ট করে চিনতে পারেনি। গণ্ডগোলটা বাধে এখানেই—আমরা ভাবি, যাকে ভালোবাসি, সে তো আর ভগবান নয়। সে যে নিছকই আমি তথা জীব—আর এখানেই সকল অবিদ্যা, সকল অজ্ঞান অবস্থিত। ‘আমি’-কে ভালোবাসতে পারি, অথচ ভগবান বলে বিশ্বাস করতে পারি না, তাই তো আমরা ভক্তি-সমুদ্রে ডুবে থেকেও ভক্তিহীন দীন-কাঙাল, তাই তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন—’আমি’-র স্বরূপ, ’আমি’-র মহত্ত্ব, ’আমি’-র গৌরব—এর সব‌ই যখন হৃদয়ঙ্গম হবে, যখন ‘আমি’ কী বস্তু, তা চিনতে পারব, তখন আর ভক্তির জন্য দরজায় দরজায় ছুটতে হবে না। ভক্তির ঘর ‘আমি’-তেই।




জ্ঞান ও ভক্তি আসলে অভিন্ন বস্তু। আত্মজ্ঞান এবং আত্মপ্রেম, এই দুটির বেলায় শব্দেই কেবল ভেদ, বস্তু কিন্তু অভিন্ন—ভগবান পৃথক একজন, যতক্ষণ এমন জ্ঞানের অস্তিত্ব থাকবে, ততক্ষণ সঠিক ভক্তি হতেই পারে না। যিনি আমার আমি, যাঁর পর আর কিছু নেই, যিনি পরম গন্তব্য তথা সব কিছুর দ্রষ্টা, তিনিই তো ভগবান বা চৈতন্য বা পরব্রহ্ম। ভগবানে যতক্ষণ আত্মদান করা না যায়, ততক্ষণ ভগবান পরই থাকেন, আর পরকে কখনো ভালোবাসা যায় কি? যিনি আমার আমি, তিনি স্বরূপত আমি হয়েও পররূপে অবস্থিত। ‘আমি’ বলতে আমরা বড়োজোর বুদ্ধি পর্যন্ত বুঝতে পারি। এ বুদ্ধিরও পরপারে যিনি অবস্থিত, তিনিই আমি, তিনিই পররূপে আপন, তিনিই পুরুষ তথা ব্রহ্ম, তিনিই পুরুষোত্তম। তাঁর সাথে যে-প্রেম, তার নামই পরকীয়প্রেমরূপী আত্মপ্রেম। বৈষ্ণব-শাস্ত্রে বলা হয়, তাঁকে প্রেম করতে হয় না, প্রেমই তাঁর স্বরূপ, প্রেমই সেখানে স্বতঃসিদ্ধ বস্তু, সেই প্রেমস্বরূপে উপনীত হবার নামই পরকীয় প্রেমলাভের অবয়বে আত্মপ্রেমলাভ। এই দশায় উপনীত হবার পথে অনেক রকমের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পায়, যথা পুলক, অশ্রু, কম্প, স্বেদ, রোমাঞ্চ, নৃত্য, গীত ইত্যাদি। এ সকলই প্রেমময়ের সামীপ্যে অবস্থিত।




আত্মপ্রেমের মধ্য দিয়ে পরমপ্রেম-স্বরূপে উপনীত হলে সেখানে যে কী হয়, তা বলা যায় না; সে যে মূকাস্বাদনবৎ—যেখানে যুক্তি তর্ক সব চুপ হয়ে যায়—যা নিজে বুঝি, পরকে নিজের মতন করিয়া বোঝাতে পারি না, যাহা অনেকটা বোবার মিষ্টান্ন আস্বাদনের মতন—নিজে যা বুঝল, তা প্রকাশ করতে পারে না। তখন বাক্যে ও মনে কোনো ভেদ নেই, বুকে বুকে এক হয়ে গেছে! আমি নেই, অথচ কেবল আমিই আছে—সেখানে প্রেম আর প্রেমিকে ভেদ নেই। অপূর্ব সে তত্ত্ব, অনির্বচনীয় সে প্রেম—সেটাই লাভ করতে হবে, সেটাই বুঝতে হবে।




প্রেমের জন্য লালায়িত হতে হবে না। যাতে আমাদের স্বাভাবিক প্রেম আছে, তাকে ঈশ্বর বলে স্বীকার করা আরম্ভ করতে হবে—ঈশ্বরকে আলাদা হিসেবে কল্পনা করা যাবে না। তিনি স্বতঃসিদ্ধ, অর্থাৎ সবসময়ই আত্মারূপে সকলের অন্তরে আছেন। তাঁর অন্য কোনো লক্ষণ যদি ধরতে না পারি, যিনি না থাকলে আমার আমিই থাকে না, সেই যে ‘আমি’-র আমি, তিনিই তো ঈশ্বর বা চৈতন্য বা ব্রহ্ম বা জীবাত্মা।




যাঁর সত্তায় আমার সত্তা, যিনি আমার ‘আমি’-রও আমি, তিনি যে আমার কত প্রিয়তম আত্মার বস্তু, সে কথা কি আর বলে বোঝাতে হয়! বুঝতে পারলে আপনাআপনিই মাথা নত হয়ে পড়ে। আপনা থেকেই ভক্তিপূর্বক প্রণাম এসে উপস্থিত হয়। ভগবানের এই রূপ অনুভবে তাঁর সাথে নিত্যযুক্ত হয়ে উপাসনা করতে হয়। মহাত্মাগণ এভাবেই উপাসনা করেন।




ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, (১) সততং কীর্তয়ন্তঃ, (২) যতন্তশ্চ, (৩) দৃঢ়ব্রতাঃ, (৪) নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা—এই চার প্রকারে আমার উপাসনা হয়ে থাকে। গীতায় ৭/১৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে 'চতুর্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনঃ অর্জুন' অর্থাৎ, (১) আর্ত বা পীড়িত (২) জিজ্ঞাসু (৩) অর্থার্থী  (৪) জ্ঞানী—এই চার প্রকার পুণ্যকর্মা ব্যক্তি আমার উপাসনা করেন। যতক্ষণ মানুষ আর্তি দূর করার জন্য ভগবানকে ডাকে, ততক্ষণ সে 'কীর্তয়ন্তঃ' (chanting)। যখন জিজ্ঞাসু হয়, তখন 'যতন্তঃ' (fully endeavoring)। যখন অর্থার্থী হয়, তখন 'দৃঢ়ব্রতাঃ' (with determination)। আর যখন জ্ঞানী হয়, ঠিক তখনই 'ভক্ত্যা নমস্যন্তশ্চ' (in devotion, offering obeisances)।




এটা দ্বারা বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় যে, জ্ঞান তথা ব্রহ্মজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত ভক্তিপূর্বক প্রণামের অধিকার‌ই হয় না। আর এরকম প্রণাম যদি জীবনে এক বার‌ও মাত্র করা যায়, তাহলেও জীবন সার্থক হয়ে যায়। আমরা তা পারি না, তাই বার বার ভক্তির বা প্রণামের অভিনয় করি—এই আশায় যে, এমন অভিনয় করতে করতে একদিন ভক্তির সাথে প্রণাম করতে পারব, অর্থাৎ সেদিন কেবল জ্ঞানময় স্বরূপের সন্ধান পেয়ে সব ধরনের ভেদজ্ঞানের ঊর্দ্ধে উঠে গিয়ে পরমানন্দে একমেবাদ্বিতীয়ম পরমানন্দ-ধামে উপনীত হব।




তাই জ্ঞান বড়ো কি ভক্তি বড়ো, জ্ঞান ভালো কি ভক্তি ভালো, জ্ঞানের পথ সহজ কি ভক্তির পথ সহজ, এ ধরনের প্রশ্ন এবং এগুলির উত্তর নিয়ে বৃথা কালক্ষেপণ না করে যিনি নিজেই জ্ঞানস্বরূপ, যিনি নিজেই প্রেমস্বরূপ, তাঁর শরণাগত হতে হলে সকল সংশয় আপনা থেকেই মিটে যাবে, জীবন ধন্য হবে। নিশ্চয়ই প্রশ্নের চেয়ে প্রার্থনা জরুরি।




নিত্যযুক্তা—এর অর্থ: নিত্যস্বরূপ বস্তু, যা আত্মা তথা ভগবান, তাঁতে যুক্ত হওয়া অথবা সবসময় যুক্ত থাকা…সকল অবস্থার ভেতর দিয়ে তাঁতেই যুক্ত থাকতে হবে। কীভাবে যুক্ত থাকতে হবে, তা 'সততং কীর্তয়ন্ত' ইত্যাদি কথা দিয়ে বোঝানো হয়েছে। ‘উপাসনা’ শব্দের অর্থ সমীপে আসন নেওয়া—কীর্তনাদির সাহায্যে তাঁর সমীপস্থ বা নিকটস্থ হওয়াই উপাসনা। যেমন সাধনাই হোক, দৈনন্দিন সাধন-ভজনকালে যদি ভগবানের সন্নিহিত না হওয়া যায়, অর্থাৎ আমি যে তাঁর একান্ত সন্নিহিত (চৈতন্যরূপে), এটা যদি প্রতিদিন‌ই উপলব্ধ না হয়, তবে তা উপাসনা-বাচ্যই হয় না। তাই তো সারাজীবন ধর্ম ও কর্মের আচার-অনুষ্ঠান করেও প্রকৃত উপাসনাহীন হয়ে জীবন বৃথা গেল ভেবে ভেবে অনুতাপ করতে হয়। প্রত্যেক কর্তব্যকাজ‌ই ঐকান্তিক উপাসনার আন্তরিকতা দিয়ে করতে হয়। এভাবে প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়েই যে আমরা তাঁর সমীপস্থ হচ্ছি, তা অনুভব করার সামর্থ্য জন্মালেই ঠিক উপাসনা হয়, নতুবা উপাসনার কিছুই হয় না, বরং সবটাই সাধারণ কাজের মতনই হয়ে থাকে। ভগবানে যুক্ত থাকলে প্রতিটি অস্তিত্ব‌ই ভগবান তথা চৈতন্য তথা ব্রহ্ম তথা পুরুষ তথা পরাপ্রকৃতির ‘আমি’ হয়ে ওঠে।