মাথা থেকে মাথাব্যথা

আকাশ, বাতাস, জল, মাটি, শূন্য, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, অনন্ত কোটি দেবতা-গুরু-মহাত্মা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ঈশ্বর, পরমেশ্বর, ভগবান প্রভৃতি সগুণ সত্তা সকলেই নিজ নিজ কর্তব্যে রত। কারও জন্যই কারও মাথাব্যথা নেই। কারও তত্ত্ব বা খোঁজ নেবার‌ও কারও প্রয়োজন নেই।




অথচ দেখুন, যত চিন্তা, যত মাথাব্যথা কেবল মানুষেরই। মানুষের মধ্যে বোধের উন্মেষের সাথে সাথেই বোধে প্রশ্ন জাগে—এই আকাশ, বাতাস, জল, মাটি, শূন্য, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ইত্যাদি কী কী উপাদানে সৃষ্ট, কেই-বা এদের স্রষ্টা? এর পরে প্রশ্ন জাগে—’আমি’ কে? কোথা হতেই-বা এসেছি? আমার শুরু ও শেষ কোথায়?




মানুষ বাদে আর কারও মধ্যেই এ প্রশ্ন জাগে না। তারপর মানুষ যখন শাস্ত্র থেকে বা গুরুমুখে ঈশ্বর, পরমেশ্বর, ভগবান, দেব-দেবী ইত্যাদির কথা শুনতে পায়, তখন মানুষ ভাবে—তা-ই তো, যদি এঁরা এই পৃথিবীতে থেকে থাকেন বা আমাদের মধ্যেই থেকে থাকেন, তবে তাঁরা আমাদের খোঁজ নেন না কেন? আমাদেরই-বা তাঁদের খোঁজ নিতে এত ইচ্ছে করে কেন?




এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে? তাঁরা আছেন বা নেই, কীসের জন্য আছেন, কোথায় আছেন, কেনই-বা মানুষের প্রশ্নের জবাব দেন না—এসবের জবাবও কিন্তু মানুষই দিয়ে থাকে, আর কেউই দেয় না। জাগ্রত মানুষের মধ্যেই সকল প্রশ্নের জবাব নিহিত। যে যেমন অভাব বা প্রয়োজন বোধ করে প্রশ্ন করবে, তেমন জবাবই সে নিজের বা অন্যের কাছ থেকে পাবে। আর কোথাও জবাব পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই।




মানুষ এখানে একা হয়েও অনন্ত। কেননা অনন্ত প্রশ্নও তার মধ্যেই জাগছে, আবার উত্তরও সে নিজের ভেতর থেকেই পাচ্ছে।




মানুষের স্বভাব দেখলে মনে হয়, মানুষই যেন সকলের সমস্ত কিছু—অভাব, অভিযোগ এবং তা থেকে উৎপন্ন চাহিদা বা প্রয়োজন মেটাবার জন্য দায়ী। বাকি সকলেই যেন মানুষের অপেক্ষায় অপেক্ষমান। ঈশ্বর, ভগবান, দেবতা ইত্যাদি সকলেই যেন মানুষের বোধের মধ্য দিয়ে প্রকট হবার জন্যই অপেক্ষমান। মানবেতর জীবজন্তু, বৃক্ষ-লতা-গুল্ম ইত্যাদির জীবন-মরণ, সুখ-দুঃখ দেখার দায়িত্বও যেন মানুষেরই উপর ন্যস্ত। তবে কি মানুষের জন্য ভাবার এক সে নিজে বাদে আর কেউই নেই? . . . না, নেই।




থাকবে কীভাবে? যাদের নিজের কোনো কিছুরই অভাব নেই বা থাকলেও ওই অভাব অনুভব করার বোধই নেই, তারা কীভাবে নিজের অভাব বা অন্যের অভাব বোধ করতে ও মেটাতে পারে? সকল কিছুই—অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ—এইসব বোধ মানুষই করে থাকে—তা নিজের জন্যই হোক বা পরের জন্যই হোক।




এই মহাবিশ্বের সকল সৃষ্টি, জীবজন্তু, দেবতা-ঈশ্বর ইত্যাদির প্রয়োজন একমাত্র মানুষই উপলব্ধি বা বোধ করতে সক্ষম। এত বিরাট দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা মানুষের, অথচ সেই মানুষ যদি পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, তবে সে কি আর কোনো দিন মানুষ হতে পারবে? সকল শক্তি ও প্রাপ্তি যার কর্মোদ্যমের মধ্যে, সে আজ ভিক্ষুকের মতো ‘শক্তি’ ও ‘প্রাপ্তি’ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে ফিরছে। এর চাইতে বেশি দুঃখময় ও বেদনাজনক আর কী হতে পারে?




মানুষ মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে কেবল গুণসমূহের অধিকারী হয়ে জীবনপথে সকল প্রকারের কাজ ও জীবনযাত্রা নির্বাহ করে আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে যে, মানুষের ওসব কৃতকর্মের বিষময় ফল আজ মানুষকেই সর্বতোভাবে বিব্রত করে তুলেছে—এখনও মানুষ এটা বুঝতে পারেনি যে, এ তারই অতীতের কৃতকর্মের ফল। এখনও মানুষ অন্যের উপরে দোষ চাপিয়ে মুক্তির বৃথা আশায় সচেষ্ট।




মানবজীবনে সংঘাত না এলে মানুষের মধ্যে সঠিক কর্তব্যবোধ জেগে ওঠে না। আজ সেই সংঘাত পূর্ণরূপ নিয়ে মানুষের সামনে সমুপস্থিত। এখন মানুষ দেখবে যে, মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে এতদূর পথ চলে আদৌ সে সুবিবেচকের পরিচয় দেয়নি। এই সংঘাত হতে শিখতে হলে, আর ওই শিক্ষার দ্বারা মুক্তি পেতে চাইলে একমাত্র পূর্ণ মনুষ্যত্বের পথই মানুষকে বেছে নিতে হবে—এটা বাদে অন্য কোনো পথ বা উপায় খোলা নেই।




এই যুগ যেমন অমনুষ্যত্বের ও অমানুষোচিত কর্মফলের চরম বিকাশ ও প্রকাশের যুগ, ঠিক তেমনি অন্যদিকে মনুষ্যত্বলাভের সোপানে আরোহণের স্বর্ণযুগ।




এতদিন মানুষ আশাবাদী হয়ে কাজের উদ্‌যাপন করেছে—কল্পনাকে পাথেয় করে আর গুণকে ভিত্তি করে, এখন মানুষকে হতে হবে সম্যক্ বাস্তববাদী। ভাবে, কাজে এবং ফলে এক দেখতে হবে—চরিত্রকে পাথেয় করে এবং মনুষ্যত্বকে ভিত্তি করে।




আজ সমগ্র মানবসমাজের, সমগ্র রাষ্ট্রের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য হচ্ছে: মানুষের মধ্য থেকে সকল প্রকারের পশুত্বকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পূর্ণ মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা করার জন্য সম্ভাব্য সকল পথে চেষ্টা করা। কেননা, মানুষ যদি পূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে না পারে, তাহলে তার মধ্যে প্রকৃত কর্তব্যবোধ জাগতেই পারে না—কি নিজের জন্য, কি সমষ্টিগত মানবসমাজের জন্য।




মানুষ অতিরিক্ত কিছুই চাইছে না। মানুষের জন্য মনুষ্যত্বই স্বাভাবিক চাহিদা, তাই তাকে সাধনার মাধ্যমে, যোগের মাধ্যমে কড়ায়-গণ্ডায় হিসেব করে পেতে হবে—পূর্ণ মনুষ্যত্ব এবং দেশ ও দশের সামনে দিতে হবে প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয়। মানুষের মনুষ্যত্বই তার স্বাভাবিক অধিকার। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে যদি আমরা দেবত্ব, ঈশ্বরত্ব, ব্রহ্মত্ব ইত্যাদি খুঁজি, তাহলে অস্বাভাবিকতাই খোঁজা হবে। আগে তো বাল্যশিক্ষা পড়া শেষ হোক, তার পরে নাহয় ভারী ভারী ব‌ই পড়া যাবে।




আমরা যদি মনুষ্যত্বে পূর্ণতা লাভ করতে পারি, তাহলে দেখব, ওই মনুষ্যত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেবত্ব, ঈশ্বরত্ব, পরমেশ্বরত্ব, পরমাত্মতত্ত্ব ইত্যাদি। ইতর ও ভদ্র উভয় প্রকারের কোটি কোটি সৃষ্ট জীবের অভাব, অভিযোগ, ভাব বুঝে প্রতিপালন করার পূর্ণ ক্ষমতা ও ভার একমাত্র মানুষেই নিহিত ও ন্যস্ত। এত বড়ো দায়িত্বশীল মানুষ…সে যদি অমানুষ ও পশু পর্যায়ে থেকে গিয়ে ওই সমষ্টির গুরুভার নিয়ে কর্তব্যপালনে রত হয়, তাহলে আজ যে বিষময় ফল মানবসমাজের অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলিয়ে দিতে বসেছে, তা হ‌ওয়া কি আমরা অস্বাভাবিক মনে করতে পারি?




ফল দেখলেই কাজ সম্পর্কে ধারণা করতে বোধ হয় কোনো যুগেই সাধারণ সুধীসমাজের একটুও অসুবিধে হয় না। যখন মানুষ পূর্ণ মনুষ্যত্ব অর্জন করবে, তখন সে কোনো দল বা সম্প্রদায়ের নামে কলঙ্কিত হতে চাইবে না। যে একলাই পথ চলতে শিখেছে, বিতর্কিত হবার ঝুঁকি নিয়েও তার দলভুক্ত হবার কী প্রয়োজন?




মানুষ জনহিতকর বা ভালো কাজ করে অমরত্বের খাতায় কখনোই নাম লেখাতে পারে না। ভালো কাজ করে ভালো নামই পাওয়া যায়, যদিও মানবসমাজ হতে অনেকসময় ভালো কাজকে অমর নাম দেওয়া হয়। কিন্তু তা কোনো দিক দিয়েই অমরত্বের অর্থ বহন করে না। কাজ দ্বারা মানুষ যেদিন ভালো-মন্দের অতীত স্বতন্ত্র কোনো কাজ (যা আর কেউ কখনও করেনি, তেমন কাজ) করতে পারবে, সেদিনই শুধু তার অমর কোনো কাজ করা হবে।




মানবদেহের অমরত্বকে কেন্দ্র করেই শুধু অমর কথাটি প্রয়োগ করা যেতে পারে, কেননা মানবদেহ অমর না হলে মানুষের দ্বারা অমর কাজ করা কীভাবে সম্ভব? অমর হবার জন্য কাজ আর অমর কাজ এক‌ই কথা নয়। উদাহরণস্বরূপ, বীজ অমর, কিন্তু বীজ হতে যে বৃক্ষ হচ্ছে, তা মৃত্যুশীল। এখানে বিচার করলে দেখা যায়, বৃক্ষের আদিস্বরূপ বীজ অমর, আর বীজের পূর্ণরূপ বা দেহ বৃক্ষ মৃত্যুশীল। কোথায় মৌলিক ভেদ বা পার্থক্য থাকার জন্য এমন অমর বীজ হতে মৃত্যুশীল বৃক্ষের উদ্‌ভব হচ্ছে?




এই মৌলিক ভেদটিকে ধরতে পারলেই অমর পরমাত্মা হতে আগত এই মানবদেহ ওই পরমাত্ম-স্বরূপের সাথে সর্বতোভাবে একত্ব লাভ করে বা অভেদ হয়ে চির-অমরত্ব প্রাপ্ত হতে পারে। বীজ বেঁচে আছে বৃক্ষের মধ্য দিয়ে, বীজের থেকে বৃক্ষের জন্ম—তাহলে বীজ মৃত্যুকে জয় করে এভাবে অমর হলো; মানুষকেও বীজের মতো হয়ে উঠতে হবে। মানুষের মাঝে ঠিক এই মৌলিক ভেদটির উৎপত্তিই তাকে অমর-বীজের মতো করে তোলে তথা অমরত্ব পাইয়ে দেয়।




এটাই প্রকৃত স্বাভাবিক অমরত্ব নামে খ্যাত এবং এটা সকল শাস্ত্রে অনুমোদিত।