সে যখন হারিয়ে গেল

 এবং, অবশেষে সে হারিয়ে গেল।
  
 তার অনুভূতিই আর কাজ করছিল না যেন। ওই মুহূর্তে সে কেমন অনুভব করছে, তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না।
  
 সুখের এবং দুঃখের অনুভূতি তার মধ্যে একইসঙ্গে কাজ করছিল। সে কাউকে বলতে পারছিল না, তার ঠিক কেমন লাগছে।
  
 সে চুপ হয়ে রইল। কাউকেই কিছু বলছিল না। নিজের সমস্ত কথা নিজের মধ্যেই জমা করে রাখছিল।
  
 তার জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছিল। তার বিনিময়ে সে যা পেয়েছিল, তা না পেলেই বরং সে আজ ভালো থাকত। সে ভাবছিল, এই কষ্টটা বোধ হয় বাকি জীবনে আর যাবে না। তার জীবনটাই আজ শেষ।
  
 সময়ের নিয়মে সময় গড়াল। এখন সে হাসতে পারে এবং হাসে। কখনও শব্দ করে হাসে, কখনওবা নিঃশব্দে হাসে। তাকে বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, সব ঠিক আছে। তার কিছু হয়নি।...আসলে কিছুই ঠিক নেই। সে একেবারেই ভেঙেচুরে গেছে। বাঁচতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।
 সে জানে, সে সারাক্ষণই মিথ্যে হাসির উপর আশ্রয় করে বেঁচে আছে। এর বেশি আর কিছুই তার করার নেই। তার হৃদয় আজও ভাঙা। তবে এতে কার কী এসে যায়? কী হবে মানুষকে দুঃখ দেখিয়ে? ভাঙা-হৃদয় নিয়ে হাসতে বড্ড কষ্ট হয়। যাদের অমন করে হাসতে হয় না, তারা এটা বুঝবে না।
  
 তার ভুল ছিল একটাই। সব জেনে-বুঝেও সে বার বার মানুষটাকে ক্ষমা করে দিচ্ছিল। তার ভয় ছিল, যদি মানুষটা তাকে ছেড়ে চলে যায়? তখন সে বাঁচবে কী করে? যে মানুষ কখনও তাকে দাম দেয়নি, তাকে হারানোর ভয়ে সে অস্থির হয়ে ছিল। যতটুকু দাম মানুষটার প্রাপ্য ছিল, তার চাইতে অনেক বেশি দাম সে তাকে দিয়ে ফেলেছিল। তাই মানুষটা তাকে মূল্যহীন করে রাখার সুযোগটা পেয়েছে। মানুষকে খুব বেশি দাম দিতে নেই। বেশি দাম পেলে মানুষ বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
  
 যাকে যেতে দিতেই হবে, কিংবা যে আমাকে রাখবেই না, তার হাতটা প্রথম দিকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। সময় যত কাটে, দুঃখ তত বাড়ে। এটাই নিয়ম। জীবন নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। যাকে সে ভালোবাসে, যে-কোনও কিছুর বিনিময়ে হলেও তাকে সে তার জীবনে রেখে দিতে চাইত। সে ভাবত এক, জীবন তাকে দেখাল আরেক।
  
 মানুষটার জীবনের সঙ্গে সে জড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। খুব তাড়াতাড়িই সে তার নিজের জীবনটাকে মানুষটার জীবনের সমীকরণে বেঁধে ফেলেছিল। সে কখনও বুঝতে চাইত না, মানুষটা তাকে নিয়ে ঠিক এরকম করেই ভাবে কি না। তার বিশ্বাস ছিল, তার ভালোবাসার মানুষটা কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।
  
 পৃথিবীতে তার মতন বোকা মানুষ অনেক আছে। এতটা সারল্য দিয়ে জীবন চলে না। এতটা সহজ হয়ে বাঁচলে দুঃখ পেতে হয়। সে-ও পেয়েছে। মানুষটা যখন চলে গেল, তার অস্তিত্বের প্রায় সমস্তটাই যেন মানুষটার সঙ্গে চলে গেল। একবুক শূন্যতা নিয়ে সে একা পড়ে রইল।
  
 যা যা প্রতিশ্রুতি সে নিজের আত্মাকে দিয়েছিল, তার সবই যেন হাওয়ায় উড়ে গেল। তবু সে অপেক্ষা করতে থাকল। তার বিশ্বাস, তার ভালোবাসা যদি সত্য হয়, তবে মানুষটা নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ফিরতে তাকে হবেই!
  
 বেচারি সত্যিই সরল, সহজ, বোকা। এমন মানুষ এ পৃথিবীতে খুব বেমানান। এমন মানুষকে কষ্ট দেওয়া খুব সোজা। এমন মানুষকে সবাই ছেড়ে চলে যায়। এমন মানুষ সারাজীবনই অপেক্ষা করতে থাকে। কীসের জন্য এ অপেক্ষা, তা সে নিজেই জানে না।
  
 একদিন এমন মানুষ কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারে না, কাউকেই আর ভালোবাসতে পারে না, কাউকেই আর হৃদয়ে জায়গা দিতে পারে না। সেদিন ওরা জেনে যায়, কারও সঙ্গে যন্ত্রণায় বাঁচার চাইতে একা একা যন্ত্রণায় বাঁচা অনেক ভালো।