তোমারে দেহনের লাইগ্যা যে জ্বালা-যন্ত্রণা আমি মাথা পাইত্যা, বুক পাইত্যা বইয়া বেড়াইছি, তুমি হেগুলান জানো না। জানো না বইলাই, “তুই খারাপ, তুই আমার বারিত্থে বাইর হ!” কইতে তোমার মুখে বাজে না। তোমার কলিজা পুড়ে না আমারে না দেখলে। তাই কতায় কতায় কইয়া ফালাও, “তোর মুখ দেখলেই আমার দিন খারাপ যায়!”
আমি হাসি, খিলখিল কইরা হাসি। অথচ এই হাসির লাইগ্যাই কিনা বিয়ার পর নতুন আমারে কোথাও যাইতে দিতা না। কইতা, “তোর হাসিমুখ না দেখলে আমার কামে জোস আহে না, বউ! তুই আমারে ফালাইয়া যাইস না।” তোমার এই কথা হুইন্যাই হেই যে বিয়ার পর বাপের ভিটা ছাড়ছি, আর এক দিনও বাপ-মারে দেখবার লিগাও যাই নাই।
সময় পালটাইয়া যায়... অভাবও একদিন দূর হইয়া যায়... কিন্তু ভালোবাসা মইরা গেলে কি আর বাঁইচা থাকন যায়! মানুষ সব কষ্ট সইতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা না থাকনের কষ্টে টুক কইরা মইরা যায়।
তোমার মনে আছে, আমাগো পুরাইন্যা সংসারের কথা? ওই যে দুই-তিনটা থালাবাটি, একটা পাতিল আর খুনতি নিয়া আমরা যে সংসার পাতছিলাম? ছোটোকালে যেমনে সইয়ের সাথে ঘরঘর খেলতাম, তেমনি ছোটোছোটো ঘটিবাটি নিয়া পুতুলের সংসার শুরু করছিলাম তুমি আর আমি মিল্যা। তুমি খালি চিন্তা করতা, অহন কী অইব, রাইতে কী খামু, বিষ্টি নামলে কই গিয়া খারামু!
আমি তোমার চিন্তা করা দেখতাম আর হাসতাম। ভাবতাম, লোকটা এত কিছু নিয়া ক্যান ভাবে? এত ভাবলে কি আর সংসার করন যাইব? তোমারে কিছু জিগাইলেই কইতা, “যত চিন্তা তোরে নিয়া, বউ। আমারে নিয়া আমি বিয়ার আগেও ভাবি নাই, এহনো ভাবি না। তোরে অযত্নে রাখলে আমি শান্তি পামু না।” আর আমি খালি ভাবতাম তোমার কেমনে যত্ন করা যায়, তাই নিয়া।
তুমি আমার কথা ভাবতা, আর আমি তোমার কথা। নতুন সংসারে আমাগো জানি আর কুনু কাম আছিলো না। সারাদিনে একবার চাইরডা ভাত ফুটাইয়া খাইতাম ডাইল মাইখ্যা, আর ডাইল না থাকলে শুকনা মরিচ দিয়া মাইখ্যা দুইজনে খাইয়া নিতাম একথালে। খাইয়া নিয়া খেতার তলে গিয়া শুইয়া পড়তাম।
তহন ছিল আষাঢ় মাস। তুমি দাওয়ায় বইয়্যা বিষ্টি দেখতা আর কইতা, “কাইল কী খামু? মহাজন কিছু টাকা না দিলে আমি কই যামু, ক ত?” আমি কিচ্ছু কইতাম না, ভুল কইরাও চাইয়্যা দেখতাম না তোমার মুখ। আমার মনে লাগত, তুমি বুঝি এই কাইন্দা সারছো! তোমার কান্দন সইতে পারতাম না, তোমারে কানতে দেকলে মইরা যাইতে মন চাইত।
আমার সারাডা শইল ব্যথা; তার চাইতেও বড়ো যেই ব্যথা, সেইডা অইলো মনে। আমি কইতে পারি না কাউরে মনের বিষের কতা। আমার মন পুইড়া ছাই অইতাছে দিনদিন। এহন তো মনে হয়, ছাইগুলাও উইড়া যাইব, ওইগুলারেও আর নিজের বইলা দাবি করবার পারুম না। হায়রে, আমার শইলের ছাইও আমার পর!
আইচ্ছা, মনের অসুখ মাইনষে সরাইয়া রাহে ক্যান? ক্যান কাউরে জানতে দেয় না তার মনের কতা? কী অইব জানলে? মাইনষে মুখ কালা করব? হাসাহাসি করব? সব গোপন কতা জাইন্না ফালাইব? এইগুলাই তো ডর, নাকি? আইচ্ছা, সেই ডরের থিকা আমি যে মনে মনে ছটফটাইয়া মইরা যাইতাছি, হেইডা বেশি ডরের কতা না? আমি যে চিল্লায়পাল্লায় একটু কানতে চাই, হেইডা কি আমার অপরাধ?
হইলে হউক গা! সবাই শুনো, আমার মনে অসুখ, খুব বড়ো অসুখ। তোমরা কে কুনহানে আছ, আমার মনের মানুষটারে একটা খবর দেও, আমি আর বাঁচমু না। যাওয়ার আগে মানুষটারে এক বার পরান ভইরা দেখবার চাই। কই, হুনতাছো, আমার পাড়াপড়শি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন?
কই, তোমরা না কতা দিছিলা পাশে থাকবা? এহন তোমরা কই? নাকি কতা দেওয়াডা তুমগো কাছে এহন কতার কতা হইয়া গেছে? খালি কইয়াই খালাস…অ্যাঁ!?
আমার কতা মনে কইরা তুমি মাঝরাইত্তে উইঠা উইঠা আর কাইন্দো না। তুমি কানলে আমি টের পাই, তুমি হাসলেও টের পাই। একসাথে খালি ঘরই তো করি নাই, একসাথে বাইড়াও তো উঠছি, চিনাও তো নিছি দুইজন দুইজনের মন দুইডা। তাইলে কও, ক্যামনে ভালা থাকমু আমি, যদি তুমি কান্দাকাটি করো? কাইন্দো না গো, সোনা!
আরে এত কান্দে নাকি মানুষ? আমাগো দেহই তো আলাদা হইছে, মন কি কেউ আলাদা করবার পারছে? পারব কুনুদিন? এত ঘাবড়াইয়ো না। বিয়ার রাইতে আমি তুমার মাতা ছুঁইয়া কতা দিছিলাম, যা-ই হইয়া যাইক, যতই কাইজ্জা লাগুক, যতই ঘরে অভাব থাকুক, আমি তুমারে ফালাইয়া কুনুখানে যামু না। মনে আছে?
আর তুমিও কতা দিছিলা, যত যা-ই হইক, তুমি কহনো নেশাপানি করবা না, কুনুদিন আমি ছাড়া অন্য আর কুনু মাইয়্যালোকরে মনে জায়গা দিবা না। তুমি আর আমি, আমরা দুইজনেই এতগুলা বছর আমাগো কতা রাকছি। আমরা একজন আরেকজনরে এতই ভালোবাসছি যে গেরামের অন্য মাইনষেরা আমাগো দেইখা হিংসায় জ্বইলা যাইত, উঠতে-বইতে আমাগো খোঁচা মাইরা মাইরা কতা কইত।
তুমি মাঝেমইধ্যে চেইত্যা গেলেও, আমি অগো কতায় খালি হাসতাম। অরা নিজেরা জীবনে কাউরে ভালোবাসে নাই, কারও ভালোবাসা পাইতে কেমন লাগে, তা-ও অরা জানে না, কুনুদিন জানবও না। অগো কতায় রাগ করলে অইব? যারা ভালোবাসাই পায় নাই, অরা জ্বলব না তো কে জ্বলব?
মনে আছে, তুমি যে চানরাইতে আমারে রানতে দেখলে দাঁত কিড়িমিড়ি কইরা কইতা, “মেন্দি দিবার পারস না? শুকনা হাতেই ইদ করবি?” আমি হাসতাম আর কইতাম, “আমি তো কুনুখানে যামু না, তাইলে মেন্দি দিয়া কী হইব?” তুমি আরও চেইত্তা গিয়া কইতা, “চুপ থাক! তুই রান্দা বাদ দে; আয়, মেন্দি পরায় দিই। আমি দেখমু তরে। আর কাইল বিহানে নামাজ শেষে গঞ্জে থিকা আলতা আইন্না দিমু।” এক্কেবারে পোলাপাইন আছিলা তুমি!
আমি ফিক কইরা হাইসা দিতাম। জলদি জলদি কামকাজ গুছাইয়া পাটি পাইত্তা বইতাম দুইজনে। তুমি কাঁপা কাঁপা হাত দিয়া মেন্দি এলাইয়া মেলাইয়া দিতা, আর নিজেই নিজেরে গাইল দিতা। আমি খিলখিল কইরা হাসতাম। তুমি কইতা, “যা বউ, শিগ্গির হাত ধুইয়া আয়। এই আউলাঝাউলা রঙ হইয়া গেলে সর্বনাশ হইব!” আমি কইতাম, “উঁহু, একটুও যামু না আমি। এমনেই থাকমু। এই মেন্দি লাল হইলে পাড়ার সব বউগো দেহামু। ওরা জানতে চায়, আমার চাষাভুষা বেকার জামাই আমারে কী দেয়! কী সুখে আমি তোমার ঘর করি! দুই হাত উপরে তুইলা এই মেন্দি দেহাইয়া আমি কমু, “সবাই দ্যাখ্, এই যে আমার সুখ! এই সুখে আমি ঘর করি, বুঝলি? তগো ঘরে এই সুখ আছে? হা হা... জানি, এই সুখ নাই তগো, আসলে তগো কপালে সুখই নাই। ভালোবাসা পাইতে কপাল লাগে, এই কপালডা আল্লায় আমারে দিছে, তাই তগো অত জ্বালা। জ্বলতে থাক, জ্বইলা-পুইড়া খাক হইয়া যা সব! হা হা হা…”"