শেষ লেখা

কয়েকদিন থেকেই শীতের তীব্র ঘ্রাণ পাচ্ছি। একা একা এই আনন্দ ভোগ না করে যেই মালতী পিসির কাছে বললাম, “শীত এসে গেছে, দেখলে!”, অমনিই সে বলল, “'ছাই! একনো পাকা চালিয়ে সেই গরমকালের হেসেবেই বিল জমা করে যাচ্চি; আর এ বলচে, ঠাণ্ডা পড়ে গেচে!”




আমি আর কথা বাড়াতে গেলাম না। যে মানুষ শীতের হিসেব পাখা ঘোরার বিলের সাথে মিলিয়ে ফেলেছে, তার সাথে শীতবিলাস নিয়ে আড্ডা দেওয়াটাই অহেতুক। সবার সামনে প্রকৃতির শাড়ি-ছায়া পালটে পাটভাঙা জংলা পাড়ের কাপড় গায়ে জড়িয়ে নতুন করে পরিপাটি হবার দৃশ্য যাদের চোখেই পড়ে না, তাদের নিয়ে আমি আর কী-ইবা বলতে পারি?




এই রাত দুটোয় লিখতে বসলাম। কেন বসলাম? শব্দেরা জাতপাত মিলে আমার মাথার মধ্যে যন্ত্রণা করছে, সেজন্য। যখন-তখন লেখা পেয়ে গেলে যে যন্ত্রণা হয়, তা কি লেখারা বোঝে? ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছিল, তাই একটু চা করলাম। চা না খেলে কিচ্ছুটি লিখতে পারতাম না। আমার হয়েছে যত জ্বালা! কী লিখতে বসেছি মনেই করতে পারছি না; যা লিখছি, তাতেও স্বস্তি মিলছে না। এমন দুইমন নিয়ে কোথায় যে পালাই, কেউ ঠিকানা দেবেন?




কাল সকাল সকাল চান সেরে, চুল শুকিয়ে রানি-গোলাপি জর্জেটটা পরব, অনেক দিন তুলে রেখেছি, আর না। শাড়ির সাথে ইয়া বড়ো কালো গোল টিপ কপালে সেঁটিয়ে দেবো, আর খোঁপায় রজনীগন্ধার গাজরা, ব্যস্। কাল আমার ছুটি। ঘুরে বেড়াব ইচ্ছেমতো।




ও, ভালো কথা, আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ বইটা আনিয়ে রাখতে বলেছিলাম সঞ্চিতা লাইব্রেরিতে, সেইটে আনার ছুতো করেই নাহয় বেরুলাম! এখন শেষ করলাম সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘হায় প্রেম’। বার বারই মনে হচ্ছে, দিনশেষে সব‌ই প্রেমই... হায় প্রেম!




বহুদিন ধরে ফোনে টাইপ করতে করতে কাগজে-কলমে লেখার ব্যাপারটা আমি ভুলেই যাচ্ছি। আচ্ছা, আজ লিখলে কেমন হয়? সবাই তো ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে এখন। কাগজে-কলমে লেখার যে বুনো অভ্যেস, ঘুসঘুসে একটা শব্দ, অক্ষরগুলোর আঁকাবাঁকা সৌন্দর্য... ওসব আমি বহুদিন চেখে দেখিনি।




আজ লিখতে বেশ লাগছে। মনে হচ্ছে, গোটা দুনিয়াই এই একলেখায় সেঁটে দিই। এত রাজকীয় নিস্তব্ধতা, পবিত্র একাকিত্ব, তামসিক মৌনতা, জামবাটিতে খাবার তুলে রাখার মতন আমার তুলে-রাখা সব রহস্য আজ এই একলেখায় উগড়ে দিতে ইচ্ছে করছে।




আমার মনে হচ্ছে, কে যেন পায়ের উপর পা তুলে বসে আমার লিখে যাওয়া খেয়াল করছে। ফ্লাস্ক থেকে কড়া লিকার দেওয়া চা ঢেলে ঢেলে খাচ্ছে একটু পর পর, আর আমার উদ্দেশ্যে কিছু-একটা বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।




গলা খাঁকারি দিয়ে সেই খর্বাকার মানুষটি ভরাট গলায় বলছে, “এদিকে কী দেখছ, নীল? তোমার কাজ হচ্ছে লেখা, তুমি লিখে যাও তোমার মতন করে। যা পারো, যত পারো, লিখে যাও। তোমার অনুপস্থিতিতে এই অক্ষরগুলোই তোমার উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে থাকবে। তাই লিখো... চালাও কলম... থেমো না... নীলিমা দাস, তুমি লেখো। হতেও তো পারে, এই ঘোর কাটলেই তুমি অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করবে! হতেই তো পারে, এই সাদামাটা ম্যাড়ম্যাড়ে লেখাই নীলিমা দাসের শেষ লেখা!"