সহজ হিসেব

 
রক্তের সম্পর্কের মানেই কিন্তু আপনজনের সম্পর্ক নয়। এ জগত বড়ই বিচিত্র। এখানে পরের ছেলেও আপনের চেয়ে আপনজন হতে পারে, অথচ নিজের ছেলে সারাজীবনই পর, এমনকি শত্রু হয়েই থেকে যায়। রক্তের বাঁধন মানেই মনের বাঁধন নয়।


আপনাকে এ কথাগুলো বলছি, কারণ আপনাকে আমার এমন একজন আপনজন মনে হচ্ছে। আমার কথাগুলো কেউই শুনতে চায় না। আমার ইচ্ছে খুব একটা পূরণ হয় না, কিন্তু আমি চাই, আপনি আমার কথাগুলো পড়বেন। আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ হোক। আপনি আমার কথাগুলো পড়বেন, এ আমার সৌভাগ্য।


ছোটবেলা থেকেই ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম। মা-বাবার ভীষণ বাধ্য ছেলে হয়েই বড় হয়েছি। বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকতাম। বই পড়তে খুব ভালো লাগত। মনে হতো, পৃথিবী-ই বই, বই-ই পৃথিবী। এর বাইরে আর কোনও জীবন নেই। আমার এমন ডেডিকেশন দেখে মা-বাবা আমাকে নিয়ে স্বপ্নদেখা শুরু করে। আমিও যেন রংতুলির আঁচড়ে ওদের স্বপ্নগুলিকে আরও জ্যান্ত করে তুলতাম। চোখ বন্ধ করেই ভাবতাম, একদিন আমি বড় হব, আকাশ ছোঁব, লেখাপড়া করে অনেক বড় মানুষ হব। মা-বাবাও আমাকে বড় বড় স্বপ্ন দেখাত।


স্কুলে প্রথমশ্রেণী থেকেই প্রথম হতাম। এর ধারাবাহিকতাও বজায় থাকল। এমন হতে লাগল যেন ‘প্রথম’ স্থানটা একমাত্র আমার জন্যই বরাদ্দ। ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় নিজের কনফিডেন্স লেভেল ছিল অনেক হাই। এভাবে আমার শিক্ষাজীবন সাফল্যের সাথে বন্ধুত্ব রেখেই এগিয়ে চলছিল।


পিএসসি আর জেএসসি-তে এপ্লাস। দুটোতেই আমাদের জেলায় প্রথম হলাম। সবাই ধরেই নিল, আমাকে ওই প্রথম স্থানটা থেকে সরানো একদমই সম্ভব নয়। আমিও মনে মনে তা-ই ভাবতাম।


নবমশ্রেণী থেকে দশমশ্রেণীতে উঠতেই আমি প্রথম থেকে দ্বিতীয় হয়ে গেলাম। এবার আমার সকল অহংকার ধূলিসাৎ হয়ে গেল। জীবনে এই প্রথম আমি দ্বিতীয় হলাম। মেনে নিতে পারছিলাম না। আমার আগে আর একজন আছে, আমার চেয়ে মেধাবী একজন আমার ক্লাসে আছে, এটা মানতেই পারছিলাম না। যে কখনও কাউকেই তার আগে যেতে দেখেনি, একজনের পেছনে দাঁড়াতেও তার কষ্ট হয়।


ওদিকে মনে মনে যারা আমাকে ঈর্ষা করত, ওরা তো খুশিতে আত্মহারা! ওদের চোখেমুখে ছড়ানো খুশিতে আমি প্রায় অন্ধকারেই তলিয়ে যাচ্ছিলাম। ওদের খুশি আমার সহ্যই হচ্ছিল না। আমার মনে হতে শুরু হলো, এবার আমার সব শেষ! আমার মধ্যে ডিপ্রেশন তৈরি হতে লাগল। পরিবারের সবাই হতবাক, আত্মীয়স্বজনরা কিছুই বুঝতে পারছে না। সবার মুখেই এক কথা, আমার মতো ছাত্র প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হতেই পারে না!


ছোটবেলা থেকেই ভালো ছাত্র হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে যাওয়াটা একটা বিশ্রী জিনিস, নিজেকে কিছুতেই আর ছোট ভাবা যায় না। নিচ থেকে উপরে উঠা যায়, কিন্তু উপর থেকে নিচে নামাটা যন্ত্রণার, ভয়ংকর যন্ত্রণার। পৃথিবীর সবাই কেবল উপরেই উঠতে চায়। উপরে উঠতে উঠতে আকাশ ফেড়ে তারও উপরে উঠে যাবার পরও মানুষ আরও উপরে উঠতে চায়, নিচের দিকে তাকানোর কথা মানুষ ভাবতেই পারে না, নামা তো অনেক দূরের কথা! যা-ই হোক, আমাকে একধাপ নিচে নামতে হলো। এটা মেনেনেওয়া আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ ব্যাপারটা তেমন কিছুই না, রোলনাম্বারে একটা ডিজিটের ব্যবধান মাত্র!


আমি জীবন আর সময়ের গুরুত্ব হারাতে শুরু করলাম। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করলাম। দিন দিন উদাসীনতা বাড়ছিল। বন্ধুদের সাথে আড্ডামারা শুরু করি। তাদের সাথে মিশে মিশে আমি আস্তে আস্তে সিগারেট ধরি। এভাবে একদিন দুইদিন স্মোক করতে করতে ব্যাপারটায় আমি ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে যাই। একটাসময় স্মোক না করলে কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগতে শুরু হয়। আমি অস্থিরতা কমাতে আবার সেই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় গিয়ে নিয়মিত লুকিয়ে লুকিয়ে স্মোক করি। বাবা-মাকে মিথ্যা বলে বলে নানা অজুহাত বানিয়ে বাসা থেকে বের হতাম। ওরা জিজ্ঞেস করলে বলতাম, বন্ধুদের সাথে পড়তে যাচ্ছি। আমি তো কখনও অবিশ্বাসের কাজ করতাম না, তাই আমার সব কথাই বাবা-মা বিশ্বাস করত।


খুব দ্রুতই ফ্রাস্ট্রেশন কমাতে ধূমপানে আসক্ত হয়ে চেইনস্মোকার হয়ে গেলাম। এসব ব্যাপারে বাবা-মা আন্দাজই করতে পারেনি। বাবা-মাকে নানা কারণ আর অজুহাত দেখিয়ে দেখিয়ে আমি সব সময়ই টাকা নিতাম স্মোকিংয়ের খরচ যোগাতে। কখনও বলতাম, স্কুলে এটা লাগবে, ওটা লাগবে। প্রাইভেটে পড়তে যেতাম, সেখানকার টাকা মেরে দিয়ে উড়িয়ে ফেলতাম। আবার কখনও কখনও প্রয়োজনের বাইরে বাড়িয়ে বলেটলে দ্বিগুণ টাকা হাতিয়ে নিতাম।


যেহেতু আমি ভীষণ বাধ্য ছেলে ছিলাম, বাবা-মা তেমন অবিশ্বাস করত না আমার কথা। আমিও ওদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে আমার সব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলাম।


বন্ধু, আড্ডা, স্মোকিংয়ের মাঝে এত বেশি ডুবে গিয়েছিলাম যে আমার পড়াশোনায় তেমন মন বসে না। সারাদিন বইতে মুখ গুঁজে-থাকা এই আমি সারাদিন আড্ডাবাজি আর স্মোকিংয়ে জড়িয়ে পড়লাম খুব অল্প বয়সেই। ভেবেছিলাম, একসময় ফ্রাস্ট্রেশন কাটিয়ে আমি আবার স্বাভাবিক হব এবং পড়াশোনায় মন বসাব, কিন্তু হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা। আমার আর আগের মতো পড়তে ভালো লাগে না।


এভাবে দিন গড়িয়ে আমার টেস্টপরীক্ষা এল। আমি যথেষ্ট রকমের খারাপ রেজাল্ট করলাম। বাবা-মা পুরোপুরি হতভম্ব। নিজেকে জোর করে চেপে ধরে আমি এসএসসি’র জন্য প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুতেই যেন মন বসে না। এদিকে এসএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে এল। আমি আমার স্মোকিংজোনটা থেকেও বের হতে পারছি না, আবার পড়ায়ও পুরোপুরি মন বসাতে পারছি না। কেমন একটা অবস্থা! টেস্ট পরীক্ষার খারাপ রেজাল্টে আমি আরও হতাশ হতে শুরু করলাম। বাবা-মা আমাকে পড়ায় মন বসাতে নানাভাবে বোঝাল। আমি ওদের আশ্বস্ত করলেও নিজেকে আশ্বস্ত করতে পারছিলাম না। বারবারই ভাবতে শুরু করি, যদি আমার এসএসসি’র রেজাল্ট খারাপ হয়, বাবা-মা খুব কষ্ট পাবে। তবু আমার পড়ায় কিছুতেই মন বসে না। এমন দোদুল্যমান অবস্থায় আমি স্মোকিং এবং পড়াশোনা দুইই চালিয়ে গেলাম।


এভাবে আমি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা হলো কোনও রকম। আমি পড়াশোনা তেমন না করলেও আমার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর ছিল, একবার কিছু পড়লে মাথায় ঢুকে যেত। কেবল তার উপর ভিত্তি করে আমি পরীক্ষাটা দিলাম। পরীক্ষাশেষে দেখলাম, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সবাই আমার ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। কিন্তু আমার মনে বারবারই অন্য ডাক দিচ্ছে।


রেজাল্ট দিল। রেজাল্ট এল ৪.৮৪। এপ্লাস মিস হওয়ায় বাবা-মা ভেঙে পড়ল। আমিও নিজের প্রতি সম্মান হারাতে শুরু করলাম। হতাশায় ডুবে গেলাম। নিজের মুখ দেখাতে ইচ্ছে করছিল না বাবা-মাকে। আমার মনখারাপ দেখে বাবা-মা প্রতিনিয়তই আমাকে উৎসাহ যোগাতে শুরু করল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি এসব কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।


জেলাশহরের সরকারি কোনও কলেজেই চান্স পেলাম না। ভর্তি হলাম একটা বেসরকারি কলেজে। আমার মনে আরও কষ্ট জমতে শুরু করল। আমি আগের চেয়ে বেশি স্মোকিং করতে শুরু করি। ভালো করে পড়াশুনা করব বলে বলে বাবা-মা’র কাছ থেকে বেশি করে টাকা নিতাম। কয়েকটা কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। বিভিন্ন সাবজেক্টের জন্য বিভিন্ন স্যারের কাছে পড়তে শুরু করলাম। যেখানে যখন যে স্যারের কাছেই পড়ব বলেছি, বাবা-মা কখনও ‘না’ করেনি। যত টাকাই চাইতাম, দিয়ে দিত। আমি সব কোচিং আর স্যারদের কাছে ভর্তি হলেও ক্লাস করতে যেতাম না। কোচিং আর স্যারদের টাকা নিজের আড্ডাবাজি আর স্মোকিংয়ের পেছনে খরচ করতাম। একসময় এই নেশার টাকা জোগাড় করতে কোচিং ছেড়ে দিই। কিন্তু বাবা-মা সেটা জানত না। ওদের কিছুই বলিনি। কিন্তু ঠিকই মোটাঅংকের টাকা নিতাম কোচিং আর স্যারদের বেতন নিচ্ছি বলে বলে।


বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতাম, কখনও কখনও স্যারদের দিতাম, খুবই অনিয়মিতভাবে কোচিং-এ যেতাম, কিন্তু বাসায় এসে আর কিছু পড়তাম না। বইয়ের সাথে কোনও সম্পর্কই ছিল না। আমি স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতাম, বন্ধুদের সাথে মিশতাম। কিন্তু আমার মাথার ভেতর কী চলত, আমি জানি। আমি একটি রাতও শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না। ঘুমাতে গেলে রাত গভীর হলে আমার বুক কাঁপতে শুরু করে। আমি অস্থির হয়ে এপাশ ওপাশ করতাম। ঘুমাতে খুব চেষ্টা করলেও আমার কিছুতেই ঘুম আসত না। অদ্ভুত একধরনের অপরাধবোধে আমি ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।


এভাবে ফাঁকি দিতে দিতে দেখি, এইচএসসি পরীক্ষা এসে হাজির। মা-বাবার টাকা নষ্ট করার জন্য আর নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমি প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগেছি তখন।


একদিন। বিকেলে পড়তে বসেছি। মা রুমে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে, চোখে-মুখে চুমু এঁকে দিয়ে আদর করে চলে গেল। মায়ের সারামুখে আমাকে নিয়ে অনেক বড় বড় স্বপ্নের ছায়া যেন ঝুলে আছে। চোখদুটো যতটা না মমতায় ভরা, তার শতগুণ আমাকে নিয়ে স্বপ্নে ভরা।


এদিকে বই সামনে নিয়ে বসে থাকলেও আমার মন বইয়ে নেই। টেবিলে বসে আছি, বইয়ে মুখগুঁজে আছি, কিন্তু মনটা ঠিক বইয়ে নেই। মনটা যেন মরা কোনও নদী।


মা আমাকে আদর করে চলে যাবার পর দেখলাম, তীব্র যন্ত্রণায় আমার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমি মায়ের আদর ভালোবাসা কিছুই ডিজার্ভ করি না। আমার বেঁচেথাকারই কোনও অধিকার নেই। আমি খোলাবইয়ের বুকে মাথা চেপে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। মা যাতে শুনতে না পায়, তেমন করে বালিশে মুখটা চেপে ধরে হাউমাউ করে ইচ্ছামতো কাঁদলাম। আমার কেন জানি পুরো পৃথিবীটাকে ওলটপালট লাগতে শুরু করল। নিজেকে সাতখুনের খুনির চেয়েও ভয়ংকর অপরাধী মনে হতে লাগল। ভাবতে লাগলাম, আমি এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাই। এতদিনের করা পাপের অনুশোচনা থেকে মুক্তি পেতে আমি আমার সামনে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। বাকি সবকিছু শুধুই অন্ধকার। আমার কাছে জীবনের কোনও পিছুটান নেই।


সেদিন প্রচণ্ড মনঃকষ্ট আর অনুশোচনা থেকে বাঁচতে আমি ভয়ংকর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আমি সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। এক, ভালো রেজাল্ট। দুই, সুইসাইড।


আমার কাছে দ্বিতীয়টিই সহজ মনে হলো। কারণ আমি পড়তে বসতে পারি না। বই নিয়ে বসলেই মনে হয়, এতগুলো বই, এত পড়া, কিছুই যে পড়িনি! আমি আসলেই কিছুই পড়িনি। কিন্তু বেঁচে থাকতে বাবা-মাকে আবার আর একটা খারাপ রেজাল্ট দেখাতে পারব না। ওরা আমার জন্য কী না করেছে! দিনের পর দিন আমাকে বিশ্বাস করে গেছে, আমি যা-ই চেয়েছি, তা-ই দিয়েছে। আমাকে কখনওই কোনও সমস্যা বা ঝামেলা বিন্দুমাত্রও বুঝতে দেয়নি ওরা। যারা আমাকে এতটা ভালোবাসে, আমি ওদের সাথে এ কী করলাম!


আমার মধ্যে সুইসাইডাল ডিপ্রেশন কাজ করছে। আমার আর কিছুই হয়তো করার নেই। আমার মনে হচ্ছে, সুইসাইড করাটাই যেন পাপের একমাত্র প্রায়চিত্ত। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করলাম। আমি সুইসাইডই করব।


একদিন বিকেলে বাবা-মা কী একটা জানি দরকারে বাইরে গেছে। আমি ঘরে একা। আমি ঘরে একা থাকলে তখন বাবা-মা বাইরে গেলে বাইরে থেকে তালা দিয়েই বেরোয়। ওরা চলে যাবার পর আমি ঘরের খুঁটিনাটি আনাচকানাচ সব ভালো করে ঘেঁটে দেখলাম। জানলা খুলে আকাশটাও দেখে নিলাম। বইগুলোর পাতায় পাতায় শেষবার চুমু খেলাম। বাবা-মার রুমে গিয়ে ওদের শোবার খাটে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম।


আমি আমার দুচোখের উপর হাত দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি। অনেক অনেক কথা মনে পড়তে শুরু করল। সেই ছোটবেলা, বাবার শাসন, মায়ের আদর। আমাকে ঘিরে ওদের কতশত স্বপ্ন। আমায় ঘিরে ওদের কত জল্পনাকল্পনা, আমার অতীতের গৌরবোজ্জ্বল রেজাল্টে বাবা-মার মুখের সেই স্বর্গীয় হাসি। এক এক করে চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে।


পরক্ষণেই মনে পড়তে লাগল ধীরে ধীরে আমার নষ্ট হয়ে যাওয়া, স্মোকার হওয়া, পড়ালেখায় রেজাল্ট খারাপ হওয়া, বাবা-মায়ের সাথে অসংখ্য অন্যায় করা, ওদের টাকা নষ্ট করা। এবার আমার ভাবনার তীব্রতা বাড়তে লাগল। চোখের কোনা বেয়ে দরদর করে জল বেরোতে লাগল।


শোয়া থেকে উঠে আমি আমার রুমে গিয়ে কাপড় শুকতে দেবার দড়ি খুলে ফ্যানের সাথে বাঁধলাম। ফ্যানের নিচ বরাবর টুলে দাঁড়িয়ে ফ্যানের সাথে শক্ত করে বাঁধা দড়ির বাকি প্রান্ত নিজের গলায় ফাঁসের মতো করে বেঁধে নিলাম। যখনই পায়ের নিচের টুলটা ঠেলে ফেলে দিতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই দেখি, মেইন দরজায় বাবা-মা কী জানি কথা নিয়ে হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকছে। আমি থরথর কাঁপতে শুরু করি। আমার কাঁপুনিতে পায়ের তলার টুলটা হঠাৎ পায়ের নিচ থেকে সরে গেল! আমার গলায় দড়িটা আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গেল। শ্বাস আটকে আসছে, জিভ বেরিয়ে যেতে চাইছে, কাশি পাচ্ছে, চোখ উল্টে গেছে। প্রচণ্ড কষ্টে আমি কথা বলতে পারছিলাম না। দড়ির তীব্র টান আমার গলাটাকে ধড় থেকে আলাদা করে দিতে চাইছে যেন! সে টান গলার মাংস গলে হাড় ধরল। গলা দিয়ে নিঃশ্বাস বের হতে চাইছে না। মনে হচ্ছে, আমার গলাটা কেউ দুই হাত দিয়ে টেনে টেনে মাংস ছিঁড়ে গলার হাড় ভেঙে ধড় থেকে মাথাটাকে আলাদা করে দিচ্ছে। বুকের ভেতরের হৃৎপিণ্ডটা শতগুণ, হাজারগুণ, লক্ষকোটিগুণ দ্রুতগতিতে কাঁপতে লাগল। সারাশরীরের ভয়ংকর যন্ত্রণায় আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে কী ভয়ংকর যন্ত্রণা! জিহ্বায় সামান্য একটু দাঁতের আঁচও লাগলে যে আমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠি, সে-ই আমিই জিহ্বাটাকে বিপরীত দুইপাটির দাঁত দিয়ে এতটাই জোরে কামড়ে ধরে আছি, যেন এই মুহূর্তেই জিভটা কেটে দুই টুকরো হয়ে ফ্লোরের উপর খসে পড়বে। পুরো শরীর কাঁপছে অসহনীয় যন্ত্রণায়, নিঃশ্বাস নিতে না পারার কষ্টে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে দিয়ে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করছি।


গলার রগগুলো থেকে শুরু করে সমস্ত শরীরের প্রতিটি রগে রগে এক ভয়ংকর যন্ত্রণা পৌঁছে যাচ্ছে। দেহের প্রতিটি রন্ধ্র কষ্টে নিথর হয়ে যাচ্ছে। এই তীব্র যন্ত্রণার কাছে পড়ালেখা, স্বপ্ন, অপরাধবোধ কিংবা অনুশোচনা একেবারে কিছুই না। আমার মনে হচ্ছে, ঠিক এই মুহূর্তে আমি এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পারলেই আমার আর কিছুরই দরকার নেই। ভালো রেজাল্ট তো দূরে থাক, আমার পড়াশোনারই দরকার নেই। আমার কেবল বেঁচে থাকাটাই দরকার। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তিটাই দরকার। আর কিছু না, সত্যিই আর কিছুই না। বেঁচেথাকাটাই বড় কথা, আসলে ঠিক বড় নয়, একমাত্র কথা, পৃথিবীর আর বাকি সবকিছুই চুলার ছাইভস্ম!


আমি শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে চাইছি, ‘মা’ বলে জোরে ডাক দিতে চাইছি, কিন্তু কিছুতেই কথা বলতে পারছি না, গলা থেকে একটা শব্দও বের করতে পারছি না। এভাবে প্রায় এক মিনিট ধরে ঝুলে আছি। আমার ধ্যান বাবা-মার দিকে। হাত দিয়ে শক্ত করে দড়ি ধরে রেখে দড়ির সাথে বাঁধা মাথাটা ফিরিয়ে রুমের দরজা দিয়ে বাবা-মার দিকে তাকাতে চাইছি বারবার, কিন্তু এদিকে আমার শরীরের ভারে ফ্যানটা ভীষণ দুলছে আর ঘুরছে। আমি কিছুতেই ওদিকে তাকাতে পারছি না। অস্থির হয়ে পা ছুড়তে ছুড়তে ছটফট করে পায়ের তলায় কোনও ঠাঁই খুঁজছি, কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না। কী এক অসহ্য যন্ত্রণায় আমার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে লাগল।


পৃথিবীটাকে ঘোর অন্ধকার লাগতে শুরু করল। এই মুহূর্তে আমি কেন গলায় দড়ি লাগিয়েছি, সেটাই ভুলে গেছি। পুরো পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়ে হলেও, জীবনের যা-কিছু আছে, সবকিছু উৎসর্গের বিনিময়ে হলেও আমি শুধু এই তীব্র যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে চাই, একেবারেই শূন্যহাতে হলেও বেঁচে থাকতে চাই। শুধুই বাঁচতে চাই। কিছুই লাগবে না আমার, আমি কিছুই চাই না। শুধু এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই। যেকোনও কিছুর বিনিময়ে এখান থেকে মুক্তি চাই।


আমি খুব করে চাইছি, বাবা-মা খুব দ্রুত আমার রুমে এসে আমাকে বাঁচাক। স্রষ্টার কাছে ভীষণ ভীষণ প্রার্থনা করছি, আমার সব ভুলের জন্য মাফ চাইছি, তাঁর সাহায্যকামনা করছি।


দেখলাম, বাবা-মা কী একটা জানি হাতে নিয়ে আমার রুমের দরজা খুলে হাসতে হাসতে ঢুকে পড়ল। আমাকে ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখে ওরা ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে দুজনেই আমার পা-দুটোকে জড়ো করে আমার শরীরটাকে উপরের দিকে ঠেলে ধরে দড়ি থেকে আমার গলাকে উপরের দিকে আলগা করে ধরে রাখতে চাইছে। বাবা তার শরীরের সবটা শক্তি দিয়ে আমার শরীরটাকে যতটুক জড়ানো যায়, ততটুকু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উপরের দিকে করে ঠেলে ধরে আছে যাতে রশির টান আমার গলায় না পড়ে। মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ও কাঁপতে কাঁপতে একদৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে বটি নিয়ে এল। মা আমার পায়ের তলায় টুল এনে আমাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি দাঁড়ানোর সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। এবার মা আমাকে আলগিয়ে ধরে রাখল, আর বাবা দ্রুত কাঁপতে কাঁপতে টুলে দাঁড়িয়ে ফ্যান থেকে ঝুলতেথাকা আমার গলার দড়িটা অনেক কষ্টে কেটে দিল। আমি জানি না, আমার দুর্বল মা কী করে আমার শরীরটা বহন করে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল!


যা-ই হোক, আমাকে নামিয়ে শোয়ানো হলো। এতক্ষণ পর আমার যন্ত্রণা কমল যেন! আমি একটু একটু নিঃশ্বাস নিতে পারছি। গলা থেকে কেমন একটা গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে। আমি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে আছি। মনে হচ্ছে, বেঁচেথাকটাই এ জগতের একমাত্র সত্য, বাকি সবই মিথ্যে!


দড়িটি অনেক শক্ত করে ধরে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে হাতের তালুতে দড়ির গাঢ় দাগ পড়ে নীল নীল হয়ে গেছে। বাবা-মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেই চলছে, আর আমার গলায় গভীরভাবে বসে-যাওয়া দড়ির দাগে দাগে ছিঁড়ে-যাওয়া চামড়ায়, মাংসে মলম লাগাচ্ছে।


আমি দেখছি, বাবা-মা অস্থির হয়ে আমার সারাগায়ে হাত বোলাচ্ছে। খানিক বাদে আমাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ভাগ্যক্রমে সে যাত্রায় আমি বেঁচে গেলাম। নিশ্চিতমৃত্যু থেকে ফেরার চাইতে বড় সৌভাগ্য আর একটাও নেই।


আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। বাবা-মা জানার চেষ্টা করছে, আমি ঠিক কী কারণে সুইসাইডের চেষ্টা করেছিলাম। বাবা-মা দুজনেই কাঁদোকাঁদো গলায় খুব অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার মাথায়, চোখে, মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বারবার জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছিল। এবার ব্যথায় নয়, লজ্জায় আমি তেমন একটা ওদের দিকে ঠিক তাকাতে পারছিলাম না। বাবা কীভাবে জানি বুঝতে পেরেছিল যে আমি আসলে পড়াশোনা নিয়ে খুব ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। বাবা আমার কপালে চুমু খেতে খেতে বলল, বাবা রে, তুই শুধু বেঁচে থাকলেই চলবে। ওসব পড়াশুনা, রেজাল্ট ওসব কিছুই আমাদের কারও লাগবে না। শুধু তুই বেঁচে থাক। তোকে আর কিছুই করতে হবে না। তুই যদি না চাস তো তোর পড়াশোনা করতে হবে না। করিস না পড়াশোনা, তার পরও তুই বেঁচে থাক। আমাদের কাছে তুই-ই সবকিছু। পড়াশোনা আমাদের কাছে কিছুই না। তুই না থাকলে বাবা আমরা পড়াশোনা দিয়ে কী করব?...বলেই বাবা-মা দুজনেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমিও তাদের সাথে কাঁদছি, চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করছি, আর ভাবছি, এতটা স্বার্থপর হলাম আমি! কেবলই নিজের ইগোর কথা ভেবে মরতে গিয়েছিলাম!


আমি ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছেটা আরও তীব্র হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার জীবনটাতে শুধুই আমার একার নয়, আমার মা-বাবারও অধিকার আছে। আমি আমার এ জীবনটা চাইলেই নষ্ট করে দিতে পারি না। সে অধিকারই আমার নেই। ওটা পাপ, ওটা অন্যায়, ওটা স্বার্থপরতা।


তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আবার পড়াশোনা করব। আমি নিজেকে ভালো রাখব। যতদিন বাঁচব, বাবা-মাকে কখনওই কষ্ট দেবো না। ওদের কথার বাইরে এক পা-ও দেবো না। আমি অনেক পড়াশোনা করব, সব নিয়মশৃঙ্খলা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব। আমি আমার জন্য নয়, আমার মা-বাবার জন্য বেঁচে থাকব। শুধুই পড়াশোনা করব, ভালো রেজাল্ট করব। রেজাল্ট ভালো হোক বা না হোক, যেটাই হয়, আমি সেটাতে সন্তুষ্ট হব। ভালো রেজাল্ট না হলে মানুষ শেষ হয়ে যায় না। ভালো রেজাল্ট ব্যাপারটাই একধরনের আই-ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই না। জীবনে কিছু করতে হলে ভালো রেজাল্ট লাগবেই, এমন কিছুতেই নয়। ভালো রেজাল্ট করে পৃথিবীতে কয়টা মানুষ অনেকদূর যেতে পেরেছে? এক বেঁচেথাকাটাই বড় কথা, বাকি সবই মিথ্যে, ফক্কিকার, ভুয়া।


কিছুক্ষণ পর চোখ মুছতে মুছতে মা আমার হাতে পিৎজা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোর জন্য এনেছিলাম, বাবা। তুই তো পিৎজা খুব ভালোবাসিস। খেয়ে নে, বাবা। কতক্ষণ হয়ে গেল, কিছু খাসনি! আর ওরকম কিছু চিন্তা করবি না, আমাদের তোর রেজাল্ট লাগবে না, আমাদের তোকেই লাগবে। তোর যা ইচ্ছা তা করিস। পড়াশোনা করতে ইচ্ছে না করলে করিস না। আমরা কেউ তোকে কিছু বলব না।


মা-বাবা দুজনকে জড়িয়ে ধরে আমি এবার বলে উঠলাম, আমি ভুল করেছি। আমাকে মাফ করে দাও। তোমাদের টাকা নষ্ট করে আমি সিগারেট খেয়েছি, পড়াশোনা না করে সময়টা বিভিন্ন জায়গায় নষ্ট করেছি। আমি এজন্যই ডিপ্রেশনে চলে গেছি। আমি তোমাদের সাথে দিনের পর দিন অন্যায় করেছি। সব মিলিয়ে আমি একধরনের ভয়াবহ অনুশোচনায় ভুগছিলাম। ভেবেছিলাম, বেঁচে থেকে কী হবে! আমি তো তোমাদের অথর্ব ছেলে! জীবনে কিছুই করতে পারব না, তোমাদের কেবল ঠকিয়েই যাচ্ছি। তাই ওরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।


বাবা-মা দুজনেই আমাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে বোঝাতে লাগল, সময় একদিন ঠিক হয়ে যাবে। ওদের সবই তো আমারই জন্য। আমি ছাড়া যে ওদের আর কেউ নেই! আমার বেঁচেথাকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি, রেজাল্ট নয়।


হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বাবা-মা আমাকে গ্রামে নিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে আমরা দাদা-দাদির কবর জিয়ারত করলাম, আত্মীয়স্বজনদের সাথে চার দিন সময় কাটালাম। এই কয়দিন বাবা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, এই দুইটি মানুষের জন্য জীবনও দিয়ে দেওয়া যায়! আর আমি কিনা তাদের কত কত মিথ্যে বললাম, স্বার্থপরের মতো নিজের ইগোকে জিতিয়ে দিতে চাইলাম! যদি কখনও জীবন দিতে হয় তো অন্য কিছুরই জন্য নয়, কেবল বাবা-মায়ের খুশির জন্যই জীবন দেবো।


হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এখনও আমি আবার ডিপ্রেশনে ভুগি। তখন চোখ বন্ধ করে আমি সেই আগের কথাগুলো ভাবি, বাবা-মায়ের মুখ কল্পনা করি। দুচোখ বন্ধ করে ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবতে থাকি, আমি চলে গেলে মানুষ দুইটা বাঁচবেই না আর! সামান্য পড়াশোনা করিনি, এটার জন্য জীবন দিয়ে দেওয়ার সত্যিই কোনও মানে নেই।


হাতে সময় খুবই কম। সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা। এই সময়ের মধ্যে আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি। আমার শরীরটা একটু দুর্বল। আমাকে বেশ কিছু ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে দেওয়া হয়েছে। আমি দ্রুতই সেরে উঠছি। আমি পড়াশোনা করছি কোনও বাড়তি চাপ মাথায় না রেখে। যা হওয়ার হবে। যদি ফেইলও করি, আবার পরীক্ষা দেবো। কী আর হবে? বাবা-মা আমার পাশে আছে, আমার কীসের ভয়? সামান্য সময়ের মধ্যে ঠিক যতটুকু প্রস্তুতি নেওয়া যায়, ততটুকুর উপর ভিত্তি করে যে রেজাল্টটা হয়, সে রেজাল্টই আমি মেনে নেব। আমি স্মোকিং ছেড়ে দিয়েছি। হাসপাতাল থেকে বের হবার পর আজ পর্যন্ত আমি একটাও সিগারেট খাইনি। বেঁচে থাকতে আর কখনও সিগারেট ছুঁয়েও দেখব না।


আমি ধীরে ধীরে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরছি। যখনই ডিপ্রেশন আমাকে গিলে ফেলতে চায়, আমি মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরি, বাবার পাশে গিয়ে বসে থাকি, বাবা-মায়ের সাথে গল্প করি। আহা, কখনও এই দুইটা চমৎকার মানুষের সাথে গল্প করাই হলো না! কী যে ভালো লাগে ওদের সাথে গল্প করতে! মনের শক্তি অনেক বেড়ে যায়! ওদের মুখ দেখলে আমার ডিপ্রেশন চলে যায়। মনে হতে থাকে, আমিও পারব। হেরে যাবার জন্য আমি পৃথিবীতে আসিনি। চলেই তো যেতে চেয়েছিলাম, জিতে যাব বলেই তো থেকে গেলাম! ভাবি, এই দুইজন মানুষ আমাকে বড় ভালোবাসে! ওরা আমাকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেড়ায়, অথচ আমিই কিনা নিজেকেই ভালোবাসছি না! এ কেমন কথা!


জীবনে লেখাপড়াই সবকিছু নয়। একটা পরীক্ষায় খারাপ করলে জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। আরও অনেক সুযোগ আছে। সুস্থ শরীরে বেঁচেথাকাটাই অনেক কিছু। বেঁচে থাকলে জীবনে কত চমৎকার চমৎকার সুযোগ আসবে। চলে গেলে তো সব শেষই হয়ে গেল! জীবন আমাকে কখন, কোথায়, কীভাবে সারপ্রাইজ দিয়ে দেবে, তা দেখার জন্য হলেও বেঁচেথাকা যায়!


যখন খুব অসহায় লাগে, নিজের মাইন্ডসেট চেঞ্জ হয়ে যায়, নিজেকে ফিরিয়ে আনার জন্য গুগলে সার্চ করি। খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন মোটিভেশনাল ব্লগ পড়ি, ইউটিউব - টেডটকস থেকেও বেঁচেথাকার বিভিন্ন রসদ জোগাড় করি। সেলফহেল্পের উপর লেখা কিছু বই পড়ি। ভালো লাগে, বাঁচতে ইচ্ছে করে, নিজেকে বদলে ফেলতে মন চায়। জীবনের প্রতি আমার এখন অনেক মায়া! সত্যিই তো, একটা ভালো রেজাল্ট কখনওই একটা জীবনের চেয়ে বেশি দামি, বেশি জরুরি হতে পারে না। কখনওই না, কিছুতেই না! পৃথিবীর বড় বড় মানুষগুলি যে দারুণ সব রেজাল্ট করেছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁদের জীবনে দুঃখ ছিল, ব্যর্থতা ছিল, অপ্রাপ্তি ছিল। তাঁরা তবু হাল ছেড়ে দেননি। পুরো পৃথিবীসুদ্ধ মানুষও যখন তাঁদের বলেছে, ‘তুমি শেষ হয়ে গেছ!’, তখনও তাঁরা নিজেকে বলে গেছেন, ‘হ্যাঁ, আজ থেকেই আমার যাত্রা শুরু!’


আমি হয়তো তাঁদের মতো অত বড় কেউ হয়ে যাব না কখনওই। আর কিছু হতে পারি আর না পারি, আমার বাবা-মায়ের ছেলে হয়ে তো থাকতে পারব! সত্যি বলছি, মৃত্যু থেকে ফিরে আসার পর আমার এর বেশি কিছু চাওয়ার নেই। লাইফ ইজ মোর বিউটিফুল দ্যান অ্যা গুড রেজাল্ট!


আমার সিগারেট-খাওয়ার ‘বন্ধুরা’ আমার কোনও খোঁজ নেয় না। আমি সিগারেট ছাড়লাম, আর ওরা আমায় ছেড়ে দিল। জীবনের অনেক কঠিন সমীকরণও আমি এখন বুঝি, আর এ তো খুবই সহজ হিসেব!