সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন বিবাহ

ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের কেমিস্ট্রি বইতে সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন নামে একটা বন্ধন আছে। এটা কী? সহজ করে বলি। কেমিস্ট্রিতে বন্ধন হল, অন্তত ২টি পরমাণু কিংবা রাসায়নিক ‘অন্য কিছুর’ মধ্যে একসাথে থাকার একটা বোঝাপড়া। ‘অন্য কিছু’ মানে, সেটি আয়ন হতে পারে, যৌগমূলক হতে পারে। এই বাক্যটি যাঁরা বোঝেননি, তাঁদের এটা বোঝার চেষ্টা করারও দরকার নেই। যা-ই হোক, এই বোঝাপড়ায় ইলেকট্রন নামে একটা জিনিস লাগে, যেমন মানবিক বন্ধনে ভালোবাসা লাগে, ওরকম। আর সমযোজী বন্ধন হল, সমবায় সমিতি টাইপের একটা ব্যাপার। মানে, ওই বন্ধনে যারা থাকবে, তারা তাদের বন্ধন গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান ইলেকট্রন সমান সংখ্যক শেয়ার করবে। এটাই বন্ধন গঠনের শর্ত। এ বন্ধনে সবাই সমান, কারণ সবার কন্ট্রিবিউশন সমান সমান। কেউই কারও উপর কোনও খবরদারি করতে পারবে না, এটাই নিয়ম। কিন্তু আয়নিক বন্ধনের বেলায়, ইলেকট্রন দেবে একজন, গ্রহণ করবে আরেকজন। একজন প্রভু, অন্যজন দাস। যে প্রভু, সে প্রভুত্ব করবে, দাস সেটা চুপচাপ মেনে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ দাসের যে ইলেকট্রন নেই, ও কীভাবে উঁচুগলায় কথা বলবে? যে কখনওই রেস্টুরেন্টে বিল দেয় না, সে আবার নিজের ইচ্ছেমতো মেন্যু অর্ডার করে কোন আক্কেলে? এরকম আরকি!

 সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধনটা একটু অন্য রকমের। এখানে, দুজন ইলেকট্রন শেয়ার করে বন্ধন গঠন করে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে, ওদের এই সহাবস্থানে দুজনেরই সমান সমান অধিকার, ওরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে দিব্যিই আছে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এ বন্ধনটা কিছুটা আয়নিক টাইপের। আয়নিক বন্ধনের মতো এখানে ইলেকট্রন কেউ দেয় না, নেয়ও না, এইটুকু ঠিক আছে। সমস্যাটা অন্য জায়গায়। যে ইলেকট্রনগুলি শেয়ার-করা অবস্থায় থাকে, সেগুলি আসে শুধু একজনের কাছ থেকে। যার কাছ থেকে আসে, বন্ধনে থাকার সময়ে সে ইলেকট্রনগুলি ব্যবহার করে। আবার যার ইলেকট্রন দেবার ক্ষমতা নেই, সে-ও ওই ইলেকট্রনগুলি সমান অধিকারে ব্যবহার করে। এখন কথা হল, এই যে একজন ইলেকট্রন দিল, আরেকজন কিছুই দিল না, আবার দুজনই ইলেকট্রনগুলি শেয়ার করছে সমান অধিকারে, এখানে দুজনেরই স্ট্যাটাস পুরোপুরি একই হবে, এটা তো আর হতে পারে না, তাই না? হয়ও না।

 ধরা যাক, কোনও ছেলে কোনও মেয়ের বাবার কাছ থেকে টাকাপয়সা কিংবা উপহার নিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করল। বিয়ের পর ছেলেটা, মেয়েটা কিংবা মেয়েটার বাপের বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে সরবে কিংবা নীরবে খোঁটা শুনবে না, এটা কি হয়? ও ঘরজামাই হয়ে থাকুক আর না-ইবা থাকুক, ও কিন্তু আত্মসম্মান কিছুটা হলেও বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে। তাই ওর দায়িত্ব, চুপচাপ অনেক বড়ো বড়ো হক কিংবা না-হক কথা সহ্য করা। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে, আহা! সুখের পরিবার! সুখের, ঠিক আছে। কিন্তু সে পরিবারের কর্তাটির পৌরুষ আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। বিয়ের পর মেয়েটি প্রায়ই ছেলেটিকে আঙুল উঁচিয়ে বলবে কিংবা অ্যাটিচিউডে প্রকাশ করে দেবে, “তুই তো আমার বাপের টাকায় খাস!” সে ওঁচানো-আঙুলটা কিন্তু সারাজীবনের জন্য। এক্ষেত্রে ছেলেটি সবসময়ই মেয়েটির এবং মেয়েটির বাপের ফ্যামিলির কাছে ‘ইয়েস স্যার! ইয়েস স্যার!!’ অ্যাটিচিউডে থাকতে বাধ্য। শ্বশুরবাড়ির আদর হয়তো থাকবে, কিন্তু সম্মানটুকু নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। প্রকৃত পুরুষ সম্মানহীন আদর দীর্ঘদিন সহ্য করতে পারে না। মেয়ের ভাইও নিজের বোনের জামাইকে কখনওই মন থেকে সম্মান করতে পারবে না। বলতে পারেন, না না, এমন হয় না! আমি বলি, আরে ভাই, শোনেন! মেয়ের ভাই এত ভালো হলে তো আর লোকে মেয়ের ভাইকে ‘শালা’ বলত না!!

 তো, যে প্রসঙ্গে ছিলাম। সন্নিবেশ সমযোজী বন্ধন। এ বন্ধনেও যার কাছ থেকে ইলেকট্রনগুলি আসে, সে আরেকজনের দিকে সবসময়ই স্বাভাবিকভাবেই একটা আঙুল উঁচিয়ে রাখে। মানে, যেহেতু শেয়ার-করা ইলেকট্রনগুলি আসলে ওর, তাই সে একটা অ্যারো সাইন দিয়ে ওকে বারবারই মনে করিয়ে দেয়, “তুই তো আমার বাপের টাকায় খাস!” বাকিজনের কিচ্ছুটি বলার থাকে না, কারণ ঘটনা তো সত্যি। এই ওঁচানো-আঙুল, মানে অ্যারো সাইনটির ‘তাৎপর্য’ আশেপাশের সবাইই বোঝে, কিন্তু এমন ভাব দেখায় যে, এতে কোনওকিছু মনে করার কিছুই নেই। মেয়ের বাবা তো মেয়ের জামাইয়েরও বাবা। আমিও বলি, অবশ্যই বাবা। কিন্তু পিতৃত্বের দাবি যেন পিতৃত্বের দায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে না থাকে। ওরকম কিছু হলে সহজ সম্পর্ক আর সহজ না-ও থাকতে পারে।

 আমি দেখেছি, মেয়ের বাবা ধনী হলে উনি পৃথিবীর সব ছেলেকেই দরিদ্র প্রেমিকের মতো ভাবেন, যে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেই শ্বশুরবাড়ির বাজারটাজার করে দেবার জন্য। ওরা বিয়ের পর বিনা নিমন্ত্রণেই যখন তখন শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে বলবে, “মা, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে! ঘরে যা আছে, তা-ই দিয়ে ভাত দ্যান।” উনি ধরেই নেন, পৃথিবীর সব ছেলেরই একমাত্র ধান্দা, বিয়ের পর ওঁর সম্পত্তির কিছু অংশ হলেও বগলদাবা করা। শ্বশুরবাড়ির কাজটাজ করে দেয়া কোনওভাবেই অশোভন কিছু নয় যদি সেটা ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ থেকে হয়, দায় থেকে নয়। এ ধরনের মেয়ের বাবারা ছেলে কিংবা ছেলেপক্ষকে নিজে কিংবা কারও মাধ্যমে নিজের অ্যাসেটের হিসেব দিতে বসেন। ওঁদের ধারণা, সব ছেলেরই বুকের উপরে একটা অদৃশ্য ট্যাগ লাগানো আছে: ফর সেল!

 বিয়ের এই বাণিজ্যিক রূপটির জন্য কিন্তু কোনওভাবেই মেয়ের বাবা এককভাবে দায়ী নন। আমাদের সামাজিক চালচলনই ওঁদেরকে ওরকম করে ভাবতে বাধ্য করে। অনেক ছেলেকেই দেখেছি, নিজেকে বিক্রির জন্য সদাপ্রস্তুত। ভাববেন না, এটা শুধু অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত ছেলেরাই করে। আমি আমার ম্যাট্রিক-ইন্টারে ‘ডবল স্ট্যান্ড-করা’ ডাক্তার বন্ধুকে দেখেছি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বিয়ের সময় শ্বশুরের কাছ থেকে একটা ফ্ল্যাট, একটা গাড়ি, আর নিজের চেম্বারের জন্য নগদ ৪০ লক্ষ টাকা নিয়েছে ‘আপন ভেবে’। আইবিএ’তে এমবিএ করার সময় অনেকেই পেয়েছি, যারা বলত, “বিয়ের সময় টাকা নেবো না কেন? আমার কি কোনও দাম নেই?” এ কথা শুনতাম আর কোরবানির হাটের নাদুসনুদুস তেলতেলে গরুটির কথা মনে পড়ে যেত। কত যত্নআত্তি করে গরুগুলিকে কোরবানির জন্য রেডি করা হয়! লোকে বেশি দাম দিয়ে গরু কিনবে, আর জবাই করার সময় গরুটি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলেও কিচ্ছুটি না বলে ‘ওরে আমার লক্ষ্মীসোনা, যাদুর কণা’ বলে বলে আহ্লাদ করে চুম্মা খাবে, এরকম তো হওয়ার কথা নয়। অনেক ছেলেকে দেখেছি, ওরা অপেক্ষা করে থাকে শ্বশুরের টাকায় সেটেল্ড হওয়ার জন্য। খুব হিসাবনিকাশ করে প্রেমে ফেলে বড়োলোকের বোকাসোকা আবেগি কোনও মেয়েকে। এসব স্বাধীনতা আর আত্মসম্মান বিকিয়ে দেওয়া ছেলেরাই মেয়ের বাবাদের মনের মধ্যে একটা স্টেরিয়োটিপিক্যাল চিন্তাভাবনা তৈরি করে দেয়। একটা সময়ে ওঁরা বিশ্বাস করে ফেলেন, সব ছেলেই বোধ হয় মেরুদণ্ডহীন।

 নিজেকে, নিজের পরিবারকে আর স্ত্রীকে চালানোর মতো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনও ছেলেরই বিয়ের কথা মাথায় আনাও ঠিক নয়। যে এখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, সে আরেকজনকে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা দেবে কীভাবে? জীবনটা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতো নয়। প্রেম করলাম, আর ছেলেমানুষের মতো কাজী অফিসে গিয়ে দুম্‌ করে বিয়ে করে ফেললাম! এসব কাজী অফিসের বিয়েটিয়ে কিংবা কোর্ট-ম্যারেজ কয়টা টেকে শেষপর্যন্ত? আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন। এসব বিয়ে তো সাধারণত গোপন থাকে, তাই হয় ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মেয়েটার আরেক জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়, কিংবা এর আগেই নিজেদের মধ্যে ঝামেলাটামেলা বাধিয়ে ছেলেটা কিংবা মেয়েটা সম্পর্কটা আর রাখতে চায় না। জীবনের প্রত্যেকটা খামখেয়ালি বড়ো সিদ্ধান্তের জন্য আপনাকে চরম মূল্য দিতে হবে, এটাই নিয়ম। বিয়ের কাগজপত্র দেখিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেটা কিংবা কখনও কখনও মেয়েটা ব্ল্যাকমেইল করেছে, এমন ঘটনাও তো কম ঘটে না। স্রেফ ভালোবাসার জোরে বিয়ে টিকেছে কয়টা? যেগুলি টিকেছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেগুলিতে মেয়েটা কিংবা ছেলেটা ঘর ছেড়েছে। পরিবার আর সমাজ থেকে পালিয়ে পালিয়ে জীবন কাটানো তো আর বীরপুরুষের কাজ নয়, তাই না?

 ওপরের কথাগুলির ভূরি ভূরি ব্যতিক্রমও আছে। প্রেমে পড়ার পর পুরোপুরি বদলে গেছে, এমন ছেলেও কম নয়। একেবারে বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো ‘চৌধুরি সাহেব’কে দেখিয়ে দিতে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছে, এরকম আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ছেলেরা নিঃসন্দেহে স্যালুট ডিজার্ভ করে। প্রেম পুরুষমানুষকে যেমনি দুর্বল করে দেয়, তেমনি সবল হতেও শেখায়। তবে দ্বিতীয়টির জন্য রিকশাভাড়া আর ফুচকার বিলটা দিতে জানতে হবে। সাধারণত প্রেমিকার টাকায় প্রেম-করা ছেলেরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে কম। ‘বিয়ের সময় শ্বশুরের কাছ থেকে হাতঘড়িটাও নেবো না!’ এমন আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে নিজেকে পুরোপুরি বিয়ের যোগ্য করে তোলার আগেই বিয়ে? নৈব চ, নৈব চ!!