যত মত, তত পথ

(লেখাটি ২০১২ সালের শেষের দিকে লেখা।)

ফেসবুকে আমার রিলিজিয়াস ভিউস-এ লেখা আছে: . . . . . . (Fill in the blank with any Religion as you wish!) এটা নিয়ে কেউ-কেউ জিজ্ঞেস করেন। আমি খুব মার্জিতভাবে সঠিক উচ্চারণে আসসালামুয়ালাইকুম বলি। ব্যাচের প্রথম হিসেবে চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে আমাকেই অনেক জায়গায় প্রতিনিধিত্ব করতে হয়েছে, সবার পক্ষ থেকে কিছু বলতে হয়েছে (এখনও বলি অনেক জায়গায়)। আমি অডিয়েন্স বুঝে কথা বলি, তাই সালাম-ই দিয়েছি। আমার অনেক শ্রদ্ধেয় সিনিয়র বলেছেন, সুশান্ত খুব সুন্দরভাবে সালাম দেয়, যেটা অনেক মুসলিম ছেলেও পারে না। এটা নিয়েও কথা ওঠে, সবসময়ই আদাব কিংবা নমস্কার বলি না কেনো? শুধু মাঝেমাঝে কেনো বলি? আসসালামুয়ালাইকুম অর্থ কী? আপনার উপর সৃষ্টিকর্তার শান্তি বর্ষিত হোক। নমস্কার অর্থ কী? আমি আপনার ভেতরের ঈশ্বরকে প্রণাম করি। এ দুইয়ের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব তো দেখি না! একজন মানুষকে যেকোনওটি দিয়েই অভিবাদন জানানো যায়। উনি কোনটা শুনতে চাইছেন, সেটা বুঝে বললে ক্ষতি কী? আমার খাওয়াদাওয়ায় অতোটা বাছবিচার নেই। আমি খাই, খাবারটা স্বাস্থ্যসম্মত কি না সেটা ভেবে, হজম হবে কি না সেটা ভেবে। নেই কেনো? এটা নিয়েও প্রশ্ন। আমি কারওর সাথে দেখা হওয়ার পর কীভাবে সম্বোধন করবো, এটাকে কোনও ধর্মীয় কালচার দিয়ে বেঁধে ফেলতে চাই না। যাকে সম্বোধন করছি তার ব্যক্তিগত অভিরুচি অনুযায়ী আমি সম্বোধন করে থাকি, এখানে ধর্মের বাধানিষেধ আনার কথা কখনও আমার মাথায়ই আসে না। ধর্ম নিয়ে আমার অল্পবিস্তর পড়াশোনা আছে—বিনয়ের সাথে বলছি, যাঁরা ধর্মকে মানেন বেশি, জানেন কম, অন্তত তাঁদের অনেকের চাইতে বেশি। আমার কাছে কখনওই ধর্মকে এতোটা ঠুনকো মনে হয়নি যে, কিছু সম্বোধনের ধরন কিংবা ফুড হ্যাবিট-য়েই এটা চেনা কিংবা অচেনা হয়ে যাবে। আমরা ধর্মকে যতটা না হৃদয়ে স্থান দিয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি স্থান দিয়েছি বাকচাতুর্যে, ডায়নিং টেবিলে। ধর্মের এসেন্স কতোটুকু বুঝি আমরা? ভেবে দেখুন তো, আমরা ধর্মটাকে পেয়েছি অনেকটা পৈতৃক সম্পত্তির মতো; জন্মসূত্রে। আপনি যে ধর্মেরই হোন না কেনো, এতে কিন্তু আপনার কোনও কৃতিত্ব কিংবা অকৃতিত্ব নেই। আমাদের অনুমতি নিয়ে ধর্ম পছন্দ করতে দিলে আমরা অনেকেই অন্য কোনও ধর্ম পছন্দ করে নিতাম। বেশিরভাগই হয়তো জন লেননের মতো নো রিলিজিওন-এর পক্ষে থাকতো। খেয়াল করেছেন কী, ইস্কনের আদর্শ বুঝেশুনে অনেক বিদেশি, যারা ধর্মের প্রধান যে সুর, অর্থাৎ মানবপ্রেম, সেটার দীক্ষা নিয়েছেন, ওদের ডিভোশন দেখুন; দেখবেন, ওরা কিন্তু আমাদের চাইতেও অনেকবেশি ধর্মের মূল কাজগুলো করছেন। ওদের তো আর এটা চাপিয়ে দেয়া হয়নি, ওরাই স্বেচ্ছায়, জেনে-বুঝে আনন্দের সাথে এটা বয়ে চলেছেন। Unlike us, they are Hindus by choice, not by born. আমি কমপক্ষে গত চৌদ্দ বছর ধরে প্রার্থনা করি না। এর জন্যে আমাকে কখনওই কোনও ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। মহান ঈশ্বরকে আমার আজ পর্যন্ত কখনওই এতোটা ভিনডিক্টিভ মনে হয়নি যে উনার কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যান না করলে উনি আমার কোনও ক্ষতি করে ফেলবেন। অতি তেলবাজি আর দেখানেপনা তুচ্ছ মানুষের দরকার হয়, ঈশ্বরের না। ঈশ্বর আমার কাছে যতোটা না প্রভু, ততোধিক বন্ধু। আমাদের সম্পর্কটা বেশ ভাল। আমি তাঁর সাথে কোনও ঝামেলায় যাই না, উনিও কখনওই আমার সাথে এখনও পর্যন্ত কোনও ঝামেলায় যাননি। বরং, আমি উনার প্রতি কৃতজ্ঞ এই জন্য যে, উনি আমার প্রথম জীবনের অনেক প্রার্থনা কবুল না করে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। সব কথা উনি শোনেন না বলেই উনি অন্তর্যামী। আমার জন্যে কী ভাল, কী মন্দ একমাত্র উনিই ঠিকঠিক জানেন। আমরা কতোটুকুই বা ভবিষ্যৎ বুঝতে পারি! এটার জন্যে উনাকে এতো বেশি পেইন দেয়ার কোনও মানেই হয় না। আমার কাছে, ধর্মের মূল কথা হলো, নিজে বাঁচো, অন্যকেও বাঁচতে দাও। (Live & let live.) আমরা এটা কম করি। আমরা ধর্মের বাহ্যিকতায় বেশি ব্যস্ত। সব ধর্মেই স্পষ্টভাবেই বলা আছে, কর্মই ধর্ম। সরস্বতী পুজো করলে পরীক্ষায় পাস হয় না, পরীক্ষায় পাসের জন্যে পড়াশোনা করতে হয়। তাই দেখবেন, পাড়ার যে ছেলেরা পুজোর আগেআগে চাঁদার জন্যে বেশি পেইন দেয়, তাদের বেশিরভাগই পড়াশোনার ধারেকাছেও নাই। কারণ, পড়াশোনা করাটা তো কঠিন, পুজো করাটা সোজা। ওরা পুজো করে আর পরীক্ষায় ফেল করে।

তবে, সরস্বতী কাদের উপর তুষ্ট?

প্রশ্নটা বেশ! উত্তরটাকে দিই ঘুরিয়ে, নিয়ো বুঝে।

পুজোর নামে বাড়াবাড়ি,

বইয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি,

ফাঁকিবাজিতে কাড়াকাড়ি—

যে ভক্তরা এসব করে উৎসাহ পাও তাড়াতাড়ি,

ঠিক জেনে নাও, বিদ্যাদেবী বরাবরই ছাগলছানার এমন নাচে রুষ্ট!

পুজোটুজো করে পরীক্ষায় পাস করা গেলে অন্তত আমি পড়াশোনা করতাম না; পড়াশোনা করাটা অনেকবেশি কষ্টের কাজ। আমি কাজটাজ ফেলে ঈশ্বরকে ডাকবো, আবার দারিদ্র্যের জন্যও উনাকে দুষবো, এটা তো হয় না। ঈশ্বর থালায়-থালায় স্বর্ণমুদ্রা আর সন্দেশ দিয়ে যান শুধুই নাটক-সিনেমায়। ওতে পেট ভরে না, প্রোডিউসার-ডিরেক্টরের পকেট ভরে। বেশিরভাগ মানুষই শুধুই ধার্মিক হতে চায় কেনো? ভালমানুষ হতে চায় না কেনো? দু’টো কারণে। এক। ধার্মিক হওয়াটা ভালমানুষ হওয়ার চাইতে অনেক সহজ। দুই। মানুষ ধার্মিক হয় স্রেফ নিজের প্রয়োজনে। একটু ভেবে দেখুন তো, আমরা ধার্মিক হই নিজের প্রশান্তির জন্য। যা করে সুখী থাকা যায়, ভাল বোধ করা যায়, আমার সাধারণত তা-ই করি। এতে অন্যের কী ভাল হয়? যদি হয়ও বা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা তার নিজ কর্মের গুণে, আমাদের গুণে নয়। অনেকে নিজ ধর্ম পালন করতে গিয়ে আরও বড়ো একটা অধর্ম পালন করেন, সেটা হলো, অন্যের ক্ষতি কিংবা অসুবিধে করে ধর্ম পালন করা। আমি ধার্মিক, এটা সম্পূর্ণ আমার নিজের পছন্দে, নিজের জন্যে, এটার জন্যে আমি কিছুতেই কোনও বাড়তি সুবিধা কিংবা সম্মান দাবি করতে পারি না। এরকম দাবি করাটা নেহায়েত সেইসব স্কুলগোয়িং বালকবালিকার ছেলেমানুষি, যাদের কাছে ধর্ম ব্যাপারটাই ধর্মশিক্ষা বইয়ের পাতায়, পরীক্ষার খাতায়, আর মার্কশিটে। আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ধর্ম আর দেশ নিয়ে বড় বড় বুলি কপচানো সবচেয়ে নিরাপদ আর লাভজনক। স্বার্থের প্রয়োজনে সবাই ধর্ম আর দেশকে রেপ ক’রতে পছন্দ করে। এবং করে। এটা অনেক রিস্ক-ফ্রি। ইমোশন মিশিয়ে কৌশলে এটা ক’রতে পারলে শাস্তি তো হয়ই না, বরং বাড়তি পুরস্কারও জুটে যেতে পারে। যারা ঠিকভাবে ধর্ম পালন করেন, তারা কখনওই এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন না, অন্যকে অসুবিধেয় ফেলে এটা করেন না, এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করতে জানেন। আপনার পরকালের সুন্দর জীবনের জন্য ইনভেস্টমেন্টের দায় (liability) অন্যের ঘাড়ে চাপাবেন না যেনো! ধর্ম অনুভবের ব্যাপার; কেউ কী অনুভব করবেন, কী অনুভব করবেন না, সেটা ঠিক করে দেয়ার আমি কে? সবাই তো আর ঠিক একইরকম করে ভাবেন না, একইভাবে বাঁচেন না। যত মত, তত পথ। ধর্ম আমাদের যতোটা ধারণ করে আছে, এর সিকিভাগও যদি আমরা ধর্মকে ধারণ করতে পারতাম, তাহলে পৃথিবীতে আজ এতো দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকতো না। আস্তিক্য-নাস্তিক্য নিয়ে হইচই করার মতো ইচ্ছে কিংবা সময় কোনওটাই আমার কোনওকালেই ছিল না, এখনও নেই। পৃথিবীটিতে অন্য আরও অনেককিছু আছে ভাববার। আমি অমুক ধর্মের, এটা যেমন আমার কোনও গুণ নয়; তেমনি অন্যকেউ অমুক ধর্মের নয়, এটা উনার কোনও দোষ নয়। ধর্ম দিয়ে কারও গ্রহণযোগ্যতা বিচার করা আর জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি দিয়ে কারও চেহারা বিচার করা একই ধরনের মূর্খতা। কেননা দুটোতেই ব্যক্তির কোনও হাত থাকে না। যে কৃতিত্ব কিংবা অকৃতিত্ব ব্যক্তির নয়, সেটার জন্য ব্যক্তি কোনও আনুকুল্যের দাবিদার কিংবা বৈষম্যের শিকার হতে পারেন না। কোনওকিছুর ভালগুলো গ্রহণ করার সময় যতোটা স্বার্থপর হতে হয়, খারাপগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার সময় ঠিক ততোটাই বুদ্ধিমান হতে হয়। তাই, কোনও ধর্মকে হেয় করে কেউ কিছু বললে আমার খুব কষ্ট হয়। কারওর বিশ্বাসকে অশ্রদ্ধা করে কখনওই নিজের বিশ্বাসকে বড়ো করা যায় না। এটা ধার্মিকতা নয়, এটা ধর্মান্ধতা। আর একটা কথা, আমি যা কিছু ভাবি, করি (যেগুলো নিয়ে আমার বন্ধুরা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন), সেগুলোর ক্ষেত্রে আমি যে ইউনিক, তা কিন্তু নয়। আসল ব্যাপার হল, আমি কিছুতেই হিপোক্রিট হতে পারি না, হিপোক্রিসি সহ্যও করতে পারি না। আমি যা বলার খুব সরাসরি বলি। হিপোক্রিট হওয়ার চাইতে স্কাউন্ড্রেল হওয়া অনেক ভাল। অনেকেই কতোকিছু করে, চুপচাপ থাকে, সবার চোখে ভাল-ভাল সেজে থাকে; পেছনের মেরুদণ্ডটা কতো আগেই ক্ষয়ে গেছে বোধ হয়। আমার ব্যর্থতা, আমি এটা করতে পারি না। প্রত্যেকটা ধর্ম আমার কাছে একেকটা দর্শনের মতো, আমি খুব স্বার্থপরভাবে সব ধর্মের এসেন্সগুলো হৃদয়ে ধারণ করি। এতো ঝগড়া করার সময় কোথায়? আমার কাছে ধর্ম পালন করা খুব সোজা। কারও ক্ষতি না করা, কাউকে ধোঁকা না দেয়া, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের সেবা করা, সম্ভব হলে কারওর উপকার করা, সুন্দরভাবে বাঁচা এবং অন্যকে সুন্দরভাবে বাঁচতে দেয়া, ধর্মের আর্ট-ট্রেডিশন-কালচার-স্থাপত্য-দর্শন-উৎসব এইরকম আরও অনেককিছু নিয়ে জানা-বোঝা-শেখা, অন্য ধর্ম আর ধর্মের মানুষকে যথাযথভাবে সম্মান করা —- এইসবকিছু। ধর্ম পুঁথির পাতায় নয়, ধর্ম মানুষের মধ্যে। পুণ্য বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেটা নিজের জীবনটাকে বদলে দেয়ায়, অন্যের জীবনকে বদলাতে সাহায্য করায়, কাউকে মাছ দিয়ে নয়, মাছ কীভাবে ধরতে হয় সেটা শেখানোয়, অনেকের না হোক অন্তত কিছু লোকের জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়ায়, নিজে যা পেয়েছি সেটা পাওয়ার রাস্তা অন্তত কিছু লোককে দেখানোয়। একটু ভাবুন তো, যদি কেউ নিষ্প্রাণ পাথরের শিবলিঙ্গের গায়ে পুরোটা দুধ না ঢেলে কিছুটা দুধ কোনও অনাথ শিশুর মুখে দিতো, তাহলে পৃথিবীটা কি আরও সুন্দর হতো না? কিংবা ঈদের পাঞ্জাবিটা ১৫ হাজার টাকায় না কিনে ৫ হাজার টাকায় কিনে বাকি ১০ হাজার টাকায় রাস্তার অসহায় কিছু টোকাইকে জামাকাপড় কিনে দিলে ঈদের আনন্দটা কি আরেকটু বাড়তো না? যে ধর্ম পৃথিবীকে অসুন্দর আর আনন্দহীন করে দেয়, আমি সেই ধর্ম পালন করতে চাই না। আরেকটা ভাবনা শেয়ার করি। আমার মনে হয়, আগে মা-বাবা, পরে ঈশ্বর। দৃষ্টিগ্রাহ্য কিংবা অনুভব করা যায় এমনকিছু কি আছে যা ঐশ্বরিক, অথচ আমরা বাবা-মা’র কাছ থেকে পাইনি কিংবা পাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাইনি? আমি এখনও পর্যন্ত এর কোনও সদুত্তর পাইনি। আপনি পেলে আমাকে জানান। বৃদ্ধ মা-বাবা’কে ওল্ডহোমে কষ্টে রেখে মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে কিংবা গির্জায়-মন্দিরে-প্যাগোডায় সারাদিন প্রার্থনা করলে কী ফল হবে? আমরা অনেকেই ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাবা-মা’কে অনেক যুক্তি দিয়ে ধর্ম পালনে বাধা দিই। আমাদের সাথে যুক্তিতে উনারা পারবেন না। এটাই স্বাভাবিক। একসময় চুপ হয়ে যাবেন, মনেমনে কষ্ট পাবেন। উনারা আমাদের বড়ো করেছেন বলেই কিন্তু আমরা উনাদের চাইতেও আধুনিকমনস্ক হতে পেরেছি। ওরকম হয়ে উনাদেরকেই আহত করা কি ঠিক? আমরা আমাদের মায়েদের উনারা ইন্ডিয়ান হিন্দি-বাংলা সিরিয়াল কিংবা রিয়েলিটি শো দেখেন বলে অনেকসময়েই তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গ করে কতোকিছু বলি। কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছি, উনারা গল্প করার জন্যে তো কাউকে কাছে পান না, বুড়ো বয়সে কথা বলতেও তো কাউকে লাগে, আমরা নিজেরাও তো সময় দিতে পারি না ব্যস্ততার জন্যে; একটু খেয়াল করলেই দেখবো, অন্তত টিভি দেখার সময়টাতে উনারা কীরকম হাসিখুশি থাকেন! মা-বাবা’কে সুখী রাখাটাই সবচেয়ে বড় কথা। তাই ওরা খুশি থাকার সময়টাতে উনাদের মন খারাপ করে দিয়ে কী লাভ? উনারাই বাঁচবেনই বা আর কতোদিন? বাবা-মা’কে সেবা করার সৌভাগ্য তো সবার হয় না। বেশিরভাগ বাবা-মা’ই তো ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজেরা ফুরোতে-ফুরোতে একসময় একেবারেই ফুরিয়ে যান। যাঁদের জীবনের সকল সুখআহ্লাদের বিসর্জনে আমাদের সমস্ত অর্জন, তাঁদের সুখী করার সৌভাগ্য আমাদের কয়জনের ভাগ্যে জোটে? তাই, উনারা যতদিন আমাদের মাথার উপরে ছায়াতরু হয়ে আছেন, উনাদের উনাদের মতো করে সুখেশান্তিতে থাকতে দেয়াটাই ধর্ম।

(সেদিন লক্ষ্মীপুজো ছিল। আমাদের বাসায় মা-ই পুজো করেন। সব উপাচার সাজিয়ে সন্ধেয় পুজো হয়। তাই মাকে সারাদিন উপোস থাকতে হয়। পুজো শেষে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করার বিধান আছে। মাকে দেখলাম, অনেক ক্লান্ত আর দুর্বল অনুভব করছেন। আমি যদিও ধর্মের বাহ্যিকতাগুলি অতটা মেনে চলি না, তবু মায়ের কষ্ট একটু হলেও কমানোর জন্য সন্ধ্যায় স্নান সেরে লক্ষ্মীর পাঁচালিটা পড়ে দিলাম। দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ, মন্দ-মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস……………… আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পাঁচালি পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, প্রায় আঠারো বছর পরও প্রায় পুরো পাঁচালিটাই আমার মুখস্ত আছে এখনও, যদিও এই আঠারো বছরে কখনওই লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করা হয়নি! বুঝলাম, ছোটবেলায় শেখা ছড়া কেন বড়বেলায়ও মনে থাকে! যা প্রসঙ্গে বলছিলাম। ওই যে আমি যা পালন করি না, মানে ধর্মীয় বাহ্যিকতা, তা পালন করার মাধ্যমে মায়ের কষ্টটা একটু হলেও কমাতে পেরেছি, সেটাই আমার কাছে হৃদয়ের শান্তি, স্বস্তি, আনন্দ, অতএব—ধর্ম। যা আমাকে শান্তি দেয়, তা আমার ধর্ম; যা অন্যকে শান্তি দেয়, তা অন্যের ধর্ম। তাই কোনও ধর্মই বড়ও নয়, ছোটও নয়। সব ধর্মেরই প্রয়োজনীয়তা সমান, কারণ সব ধর্মই কোনও না কোনও জনগোষ্ঠীকে প্রশান্তি এনে দেয়।)