শেষ নিয়ে ভাবনা

এই বিচিত্র প্রকৃতির এবং প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের পরিণাম কী? বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতেরা বলেন, সকলই অবিনশ্বর—অবস্থার পরিবর্তনে প্রকৃতির উন্নতি হচ্ছে, তার সাথে সাথে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষের দেহ-মনের বিভিন্ন উন্নতি ঘটছে। দার্শনিকেরা আত্মার অমরত্ব স্বীকার করে বলেন, মানুষ ক্রমেই পূর্ণত্বের দিকে চলছে; অসভ্য মানুষ সুসভ্য হচ্ছে—একদিন সুসভ্য মানুষ দেবত্বে উন্নীত হবে।




আমরা জরা-মৃত্যুর অধীন, শোকে-দুঃখে ও পাপে-তাপে মুহ্যমান, আমরা বড়ো কথা জানি না, বড়ো কথা বুঝিও না। সরল চোখে দেখছি, সবই যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, সবই যেন পতন ও ধ্বংসের দিকে ছুটছে। আমার অস্তিত্বেই আমার কাছে জগতের এবং প্রকৃতির পুরো অস্তিত্ব প্রতিপন্ন। আমিই যদি চললাম, আমার সমাজের লোক সবই যদি ডুবতে চলল, তবে সমষ্টির উপর পৃথিবীর আর কার কী উন্নতি সম্ভব, কীই-বা অসম্ভব, তা ভেবে আমার কাজ কী? আমি যাকে প্রকৃতির প্রকৃতিত্ব বলি, আমি যাকে মানুষের মনুষ্যত্ব বলি, তা যেন পতন এবং মরণের পথেই চলছে। চাঁদ ছেঁকে অমৃত, ফুল নিঙড়ে সুষমা, জল জমিয়ে শৈত্য, আগুন জ্বেলে উষ্ণতা, জল-আগুন মিলিয়ে বাষ্প যে পাওয়া যায়, তার মূলে কী? তার মূলে এক অবিনাশী কার্যকরী চৈতন্য-শক্তির প্রকাশ। সেই শক্তি প্রত্যক্ষবাদ বা জড়বাদের তর্কে দিনদিন প্রচ্ছন্ন, কুয়াশাবৃত হচ্ছে কি?




এক শ্রেণীর পণ্ডিতেরা এখন কেবল জড়ই স্বীকার করেন; আর এক শ্রেণীর পণ্ডিত জড়কে নাকচ করে কেবল মায়াই স্বীকার করেন। শঙ্করের মায়াবাদ বা চৈতন্যবাদই ঠিক হোক বা চার্বাকের প্রত্যক্ষবাদ বা জড়বাদই ঠিক হোক—আমরা বিচার চাই না, বিচার করি না; বলি কেবলই এই কথা, উভয় মতবাদের ভেতরেই যে সত্য লুকিয়ে আছে, উভয় মতই যে আংশিক সত্য, এ কথা কোনো পক্ষই কোনোদিন মানল না; কোনোদিনই উভয় দলের মিলন সংঘটিত হলো না। মানল না যে, এই সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামলা প্রকৃতি প্রত্যক্ষ-জড় এবং প্রত্যক্ষ-চৈতন্য সংমিশ্রিত। সুতরাং পূর্ণ প্রকৃতির পূর্ণ জ্ঞান কোথায় পেল মানুষ?




চিরবৈপরীত্য ও চিরবৈষম্যময় প্রকৃতি পূর্ণরূপে আবিষ্কৃত হলেন আর কোথায়? যিনি পূর্ণরূপে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃতই হলেন না, তাঁর পরিণামই-বা বলতে কে সক্ষম? বিজ্ঞান বলেন, চাঁদ-সূর্য একসময় নিভে যাবে; কিন্তু তার পরিণতিতে কী হবে, কেউ কি তা বলতে পারেন? কল্পনা এবং থিওরি মিশ্রিত কথা ছেড়ে বিচার করলে, সকলকেই স্বীকার করতে হবে, প্রকৃতির পরিণাম বা পরিণতি সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য। এই প্রকৃতির বিবর্তনে কী বিকৃতি ঘটবে, তা কোনো জড়বাদী বা কোনো অধ্যাত্ম-শাস্ত্রবাদী ঠিক করে বলতে পারেন না। উভয়ের যখন সম্মিলন হবে, তখন হয়তো কিছুটা সম্ভব হতে পারে। তবে এখন সে-কথা আকাশকুসুমের মতোই কল্পনাময়।




প্রকৃতির পরিণাম যদি এমন, মানুষের পরিণাম তবে কী? মানুষ বিশ্বব্যাপী প্রকৃতিরই ছায়া; সুতরাং এককথায় বলতে গেলে, তার পরিণামও তেমন। সৃষ্টির মধ্যে, পরিষ্কার করে, জড় ও চৈতন্যের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় কেবল মানুষের মধ্যে। মানুষে জড়ের লীলা আছে, চৈতন্যের খেলাও আছে। এখানে জড়-চৈতন্য মিশ্রিত আকারে পরিশোভিত। এখানে চৈতন্যের কাজ, চিরভৃত্যের মতো, জড়দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পন্ন করছে। মস্তিষ্ক হুকুম করে, হাত-পা কাজ করে। মন আজ্ঞা করে, ইন্দ্রিয়সমূহ তা পালন করে। কাম-ক্রোধ ষড়রিপুর অধীন মানুষ—সে প্রতিনিয়তই ইন্দ্রিয়ের অধীনতা অবনতভাবে স্বীকার করছে। এখানেই যেন পূর্ণ জ্ঞানের আবির্ভাব। এখানে আসক্তি-বৈরাগ্য, সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধার, ইহকাল-পরকাল সব যেন প্রতিভাত।




মানুষ যদি সম্যক প্রকারের জ্ঞানে জ্ঞানী হতো, তবে বোধ হয় প্রকৃতির পরিণাম-সমস্যার সদুত্তর দিতে পারত। দুঃখের বিষয়, সব দেখে-শুনেও মানুষ নিরেট বোকা, অত অত পড়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করেও মানুষ মহামূর্খ—যেন কখনও কিছু দেখেনি, যেন কেউ কিছু শোনেনি। কে না অভিজ্ঞতায় দেখেছে যে, ইন্দ্রিয়ের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে শরীরের ক্ষতি হয়—কিন্তু কে তা হতে বিরত থাকে? কে না শুনেছে যে, রিপুর অহেতুক প্রশ্রয়ে মনুষ্যত্বের বিঘ্ন ঘটে—কিন্তু কে তা মেনে চলে বা নিবৃত্তিসাধন করে? রিপুর সেবা আর ইন্দ্রিয়ের দাসত্বে মানুষ সবসময় আত্মহারা, সেজন্য‌ই পরিণাম বোঝে না।




আত্মজয়ী, বিবিধ জ্ঞানে জ্ঞানী, মনীষাসম্পন্ন মহাত্মাগণ নিশ্চিত করে কি বলতে পারেন, মানুষ কে কোন পথে গিয়ে কোন কূলে পৌঁছবে? আমরা ইন্দ্রিয়ের দাস, রিপুর অধীন, বারোমাস আমরা জরা-মৃত্যু দেখে বিকম্পিত, সশঙ্কিত, সংসারচিন্তায় বিজড়িত—তাই আমরা বলি, মৃত্যুই মানুষের পরিণাম। আত্মার অমরত্বে কাল্পনিক বিশ্বাসের কথা ছেড়ে দিলে, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পরিণাম জানি না। যদি জানতাম, তবে এমন করে মনুষ্যত্বের পথে কাঁটা ছড়াতাম না।




ভালো-মন্দ যদি মানুষ বুঝতে না পারত, তবে কোনো কথা ছিল না। মানুষের মধ্যে সৎ ও অসৎ, উভয় বুদ্ধিই বিদ্যমান। দেবাসুরের সংগ্রাম প্রতিনিয়ত মানুষের হৃদয়ে চলছে। বিবেক বা বিধাতার আদেশ যাঁরা স্বীকার করেন না, তাঁরাও, প্রেয়ঃ ও শ্রেয়ঃ, এ দুই জ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। দেখা যায়, দেবাসুর সংগ্রামে এখন আসুর বুদ্ধিরই জয় হচ্ছে। দেখছি, মানুষ শ্রেয়ঃর পথ ছেড়ে প্রেয়ঃর পথেই ধাবিত।




বোঝে না কে? মদ খেলে শরীর নষ্ট হয়, এটা কে না জানে? ব্যভিচার করিলে শারীরিক ও মানসিক শক্তি কমে যায়, নানা ব্যাধি আক্রমণ করে, এটা কে না বোঝে? তবুও মানুষ ওসবে মজে কেন? ধনঐশ্বর্য, বিষয়বৈভব সবই ক্ষণস্থায়ী, এটা কে না জানে! অথচ মানুষ অহংকারে কেন মত্ত হয়? দু-দিনের যে-সুখসম্পদ, তার জন্য মানুষ আত্মহারা হয়ে গর্বে অন্ধ হয় কেন? অন্যের মহত্ত্ব স্মরণে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, এটা কে না জানে, অথচ নিজের হাজারো দোষ উপেক্ষা করেও, অন্যের দোষ আলোচনায় মানুষ কেন সারাক্ষণই ব্যস্ত?




এর কারণ আর কিছুই নয়—কারণ এই, দেবাসুর সংগ্রামে অসুরেরই প্রতিনিয়ত জয় হচ্ছে। এটাই প্রত্যক্ষবাদের বিশেষত্ব। "ঋণ করে ঘি খাও।"—এমন মতের জন্ম হলেই, মানুষ ভেতরটা ভুলে বাইরেরটা নিয়ে মজে। বৃত্তিমুখী শিক্ষা আমাদের অনেক উপকার করার পাশাপাশি এই এক মহাক্ষতিসাধন করছে যে, বহুদর্শী, যোগনিরত ঋষিদের সন্তানদেরকে ভেতর হতে বাইরে, সূক্ষ্ণ জ্ঞান হতে স্থূল জ্ঞানে, অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান-ভক্তির রাজ্য হইতে প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য সুখ-সম্ভোগে উপস্থিত করছে। আগে ছিল সাধনভজন, এখন পাশ্চাত্য শিক্ষা কাজকর্ম-জগতে আমাদেরকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে! কেবল সাধনভজন ভালো নয়, কেবল কাজকর্মও ভালো নয়—উভয়ের সংযোগ চাই। কিন্তু কোনোদিনও কোনো দেশে তা হলো না। কেউ সাধনভজন করে পৃথিবী খোয়াল, পৃথিবীর শিক্ষা হারাল; কেউবা সুখ সুখ, কর্ম কর্ম করে ধর্ম, স্বর্গ, পুণ্য, নীতি ভুলে কেবলই পাপের পথে চলল!




মানুষ সব বুঝেও আত্মরক্ষা করতে পারল না। মানুষ সব বুঝেও বিষকে সুধা ভেবে পান করে মরল! এ এমনই আশ্চর্য ব্যাপার যে, মরতে হবে জেনেও মানুষ তা ভুলে, পাপে মজছে—যেন মরণের পথ ছাড়া মানুষ আর কিছুই জানে না!




জড়বিজ্ঞান মরণের কথা বলতে পারে, মরণের পরপারের কথা ঠিক বলতে পারে না। মানুষ মরবে, ঠিক—কিন্তু তার পরে? এখানেই কি শেষ? এই জ্ঞানের অতীত আর কোনো জ্ঞান কি নেই? জড়বিজ্ঞান এখানে নিরুত্তর। মানুষ সেজন্যই আত্মহারা, এজন্যই অনেকের কথা এই যে, জীবন পেয়েছি, এখন সুখসম্ভোগ করে মরি। দিনশেষে মানুষ পতঙ্গ‌ই—আসক্তি-পিপাসা-আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরছে। যেদিকে তাকাই, সবই যেন এই দশাগ্রস্ত। ক্ষণিক সুখের জন্য সবাই ব্যস্ত। উন্নতি বা পরিণামের চিন্তা নেই বললেই চলে। চার্বাকের (চার্বাকবাদীরা যেহেতু ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার বিরোধিতা করেন, তাই সম্ভবত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ধ্বংসের সংকেত—চিবিয়ে খাবার পিষে ফেলার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে—হিসেবে এই নামটি ব্যবহার করা হয়েছে।) মতোই ষোলোআনা আধিপত্য করছে।




সর্বনাশের আর বাকি কী! মানুষ যদি কেবল জড়দেহধারী হতো, তবে আমরা শরীরক্ষয়ের ফলে ব্যথা পেতাম না। দেহের ভেতর যে-চৈতন্যশক্তি—আত্মাই বলো বা মনই বলো—আছে, তার উৎকর্ষের জন্য আমরা কিছুই করছি না। তার উৎকর্ষ, তার অনুশীলন ছাড়া জীবের উদ্ধার নেই। তার উৎকর্ষের জন্যই রিপু, ইন্দ্রিয়, শরীর; তার জন্যই সুজলা-সুফলা প্রকৃতিময় এই বিশ্ববিদ্যালয়। আত্মিক জগতে যাবার আয়োজন এই জড়দেহে রয়েছে, কিন্তু সে সম্বন্ধে আমরা নির্বিকার, উদাসীন। কাজেই আমরা মরণকে দেহীর পরিণাম মনে করি।




কাল্পনিক বিশ্বাসের বলে কেউ কেউ আত্মার অমরত্ব স্বীকার করেন বটে, কিন্তু তা প্রকৃত আত্মজ বিশ্বাস নয়—সন্দেশ না খেয়ে, শোনাকথায় সন্দেশের মিষ্টত্ব স্বীকার করার মতোই ওই স্বীকৃতি। ওতে কোনো উপকার নেই। শোনাকথায় যে-জ্ঞান জন্মে, তা আত্মিক জগতের পূর্ণজ্ঞান নয়। মানুষ প্রত্যক্ষ জ্ঞান না পেলে, প্রকৃত আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস লাভ করতে পারে না। আত্মিক শক্তির উৎকর্ষসাধনহীনতাই এই অবিশ্বাসের মূল। এই অবিশ্বাস মানুষকে গ্রাস করে ফেলছে। সুতরাং মৃত্যুর অতীত জগতের কথা এখন কল্পনা-কুয়াশায় আচ্ছন্ন।




মানুষ, মৃত্যু উপস্থিত হলে এজন্য হাহাকার করে, অস্থির হয়, আবার কোনোমতে বেঁচে গেলে, দু-দিন পর তা ভুলে আনন্দোৎসবে যোগ দিয়ে রিপু-তাড়নায় মাতে। মানুষ দিনদিন এত অসার হয়ে যাচ্ছে যে, আত্মিক জগতের কথা, চিন্ময় রাজ্যের কথা—এখন কল্পনা বলেই মনে হচ্ছে। পুনর্জন্ম সম্ভব কি না, পরকালে আত্মা কেমন অবস্থায় থাকবে, এসব এখন মত-সঙ্কীর্ণতায় জড়িত হয়ে রয়েছে; যা যার অন্ধবিশ্বাস, তা সে কিছুতেই ছাড়ে না। নূতন কথা শুনলেই ক্রোধ বা বিরক্তিতে আত্মহারা হয়। প্রকৃত জ্ঞান না থাকাই এমন হবার কারণ। প্রকৃত চিন্ময়শক্তির জ্ঞান যতদিন না উদিত হবে, ইন্দ্রিয়াতীত রাজ্যের কথা কিছুতেই মানুষ ধারণা করতে পারবে না। ততদিনই মানুষ মৃত্যুকেই জীবনের শেষ মনে করবে এবং মৃত্যুতে হাহাকার করবে।




মানুষ যখন জড় ও চেতনের জ্ঞানে সম্যক ব্যুৎপত্তি লাভ করবে, তখন জড়াতীত চৈতন্য এবং চৈত্যাতীত জড়ের পরিণাম তার কাছে উজ্জ্বল প্রভায় প্রদীপ্ত হবে; মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যাবে, কী করবে, তখন বুঝবে। একবার বুঝলে পৃথিবীকে সর্বস্ব জ্ঞানে পাপে-তাপে জড়িয়ে গিয়ে আর মরবে না। সেদিন কবে আসবে, কে জানে!