অনন্তের সিঁড়ি

একদিন সন্ধেবেলায় সাগরতীরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির বিচিত্র লীলা দেখছি আর ভাবছি। অনন্তে প্রসারিত সাগরের উত্তাল তরঙ্গের গর্জন অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে এক অপরূপ সাত্ত্বিক জগতে নিয়ে উপনীত করল। দেখলাম, ভাবলাম এবং মুগ্ধ হলাম! দেখলাম, প্রকৃতি সীমাবিশিষ্ট হয়েও, স্বচ্ছ দর্পণের মতো অনন্তের আভাস দিচ্ছে; অথবা যা অনন্ত, তা-ই সীমাবদ্ধ হয়ে, এই বিশাল বিস্তৃত সাগরেও যেমন সীমা দেখা যায়, ঠিক তেমনি, আমার চোখকে ধাঁধাচ্ছে। অনন্ত আকাশের মতোই, সাগর বিশাল বিস্তৃত হলেও, আমি তার অল্প অংশ‌ই দেখতে পাচ্ছিলাম। ভাবলাম, ওই সাগরের গা, আমার ক্ষুদ্র চেতনাশক্তি—দুই-ই এক মহাচৈতন্যের পরিচয় দিচ্ছে।




বিস্মিত হলাম—জড় এবং চৈতন্য, এই উভয়ের সংমিশ্রণে বিধাতার যে অনন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতি রচিত, এই প্রকৃতি খুব ক্ষুদ্র হলেও তা মহান অপার অগম্য আদিশক্তি ব্রহ্মেরই সত্তামাত্র। সেদিন জীবনের একটা বিশেষ দিন গেছে; কিন্তু যা দেখেছিলাম এবং ভেবেছিলাম, পৃথিবীর কাছে তা পুরোপুরিভাবে ব্যক্ত করতে পারি, অত শক্তি আমার নেই।




পণ্ডিতেরা বলেন, এই বিচিত্র প্রকৃতি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম—এই পঞ্চভূতাত্মিকা এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই ত্রিগুণান্বিতা। বিভিন্ন পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা রূপান্তরে এবং ভাষান্তরে প্রকৃতিকে, নানাকথায়, নানাব্যাখ্যায় ওই সকল ভূত এবং গুণের সমন্বিতা বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য, প্রাচীন এবং নবীন—এই উভয় যুগের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে—জড় এবং মায়া, আত্মা এবং কায়া, সেশ্বর এবং নিরীশ্বরবাদের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে বলি, প্রকৃতির মধ্যে যা-কিছুর অস্তিত্ব মানুষের জ্ঞানায়ত্ত হয়েছে, তার সকলই এক মহান অপার অনন্ত শক্তির আভাস দিচ্ছে। যা অনন্ত, তা-ই মানুষের ধারণাশক্তির আয়ত্তাধীন হবার জন্য সীমাবদ্ধভাবে উপস্থিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র যা, সীমাবিশিষ্ট যা দেখি, মনে হয়, তার সবই অনন্তের ছায়ামাত্র।




স্থূল দৃষ্টিতে দেখলে, এই প্রকৃতির সকল বস্তুই সীমাবিশিষ্ট বলে মনে হয়। 'সৃষ্টি' শব্দটা মাথায় এলেই তাকে সান্ত বলে মনে হয়। সীমাবিশিষ্ট মানুষের দর্শন ও ধারণাশক্তি অতি সামান্য, কিছুদূর যায়, তারপর আর দৃষ্টি ও ধারণাশক্তি যায় না। যেমন সাগরের কিছু অংশের পর দৃষ্টি আর চলে না, ঠিক তেমনি, বোধ হয়, মানুষ অনন্তের ভাব ধারণা করতে পারে না বলেই প্রকৃতিকে সীমাবিশিষ্ট মনে করে; সীমা নিয়ে, ক্ষুদ্ৰতা নিয়ে থাকতেই ভালবাসে। আমরা দেখতে চেষ্টা করব, ক্ষুদ্র ও সীমাবিশিষ্ট প্রকৃতির মধ্যে অনন্তের আভাস পাওয়া যায় কি না।




জড়ের কথাই প্রথমে আলোচনা করি। জড় কী? পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতেরা আবিষ্কার করেছেন, জড় অবিনশ্বর পরমাণুর সমষ্টি। জড় বিশ্লেষণ করলে পরমাণুই পাওয়া যায়। এই পরমাণু কী?—এটি জড়ের এমন ক্ষুদ্রতম অংশ, যা আর ভাগ করা যায় না, অর্থাৎ জড়ের যে-অংশ মানুষ কখন দেখেনি, অথবা যে-অংশ কল্পনার সাহায্য নিয়ে ভাবতে হয়। পরমাণু মানুষ কখনও দেখেনি, দেখতে পারেনি, অর্থাৎ এটি এমন কিছু, যার মূলে দৃষ্টি যায় না, অর্থাৎ যা অনন্ত। পরমাণুর সমষ্টিতে পর্বতের উৎপত্তি, রাজ্য ও জনপদের উৎপত্তি, এই সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা প্রকৃতির উৎপত্তি। পরমাণু জমে জমে যখন বিশাল পর্বত বা মাটির স্তর হয়েছে, সেই পর্বত ও মাটির স্তর সম্পর্কে ধারণা করতেও মানুষ অসমর্থ। পর্বত বা মাটির স্তরের একাংশ দেখে মানুষ অন্য অংশের কথা ভেবে নেয়; পুরো অংশ মানুষ কখনও দেখতে পারে না। যা দেখেনি, পরোক্ষজ্ঞানে তা কল্পনা করে।




পরমাণুর আদিতে কল্পনা, পরমাণুর পরিণতিতে এবং সমষ্টিতেও কল্পনা—মানুষের জ্ঞান ও ধারণাশক্তি এতটাই সীমাবদ্ধ। প্রকৃতির একটা সামান্য পরমাণু কত বড়ো যে, তা ভাবতে ও ধারণা করতে মানুষ হিমশিম খেয়ে কত‌ই-না কাল্পনিক স্বপ্ন দেখছে! প্রকৃতিতে কত পরমাণু আছে, কেউ জানে না; পরমাণুর শেষ কোথায়, তা-ও জানে না; আবার পরমাণুর সমষ্টিতে কত পাহাড়-সাগর হয়েছে, তা-ও মানুষ ঠিক বলতে পারে না। সান্ত ও অনন্তের কেমন আশ্চর্য এক সংযোগ!




বিন্দু বিন্দু জলকণা সূর্যের উত্তাপে বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। এসব বাষ্পকণা জমে মেঘ হচ্ছে। মেঘের দল জমে জমে ভারী হয়ে বৃষ্টিধারায়, ঝরনাপ্রবাহে পৃথিবীকে শীতল করছে। বৃষ্টি-জল এবং ঝরনা-জল মিলে নদী সৃষ্টি করছে। নদীর দল মিলে বড়ো বড়ো সাগরে পরিণত হচ্ছে। ক্ষুদ্র- ক্ষুদ্র জলকণার সমষ্টিতেই বড়ো বড়ো সাগরের উৎপত্তি। পলকহীন চোখে সাগরের দিকে চেয়ে দেখো, সাগরের যে-অংশ দেখতে পবে, তা অতি সামান্য, কিন্তু অনন্ত অংশ তার পশ্চাতে। অনন্তের ঢেউ, অনন্তকাল ধরে বয়ে বয়ে এভাবেই যেন মানুষের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। পৃথিবীর সাগরে কত জল, কত তরঙ্গ, কেউ তা জানে না, কেউ তা বোঝে না। সান্তের মধ্যেই অনন্তের কী চমৎকার আভাস!




সময়ের কথা ভাবো। একটি মুহূর্তের কথা চিন্তা করো। তোমার সামনে একটা মুহূর্ত—এর কোনো পরিসর নেই, ব্যাপ্তি নেই—এ কেবলই তিলমাত্র। এই মুহূর্তই, কত ক্ষুদ্র প্রাণীর পক্ষে আয়ু—জীবন-মরণকাল। এই মুহূর্তে কত মস্তিষ্ক হতে কত অনন্ত চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। এই মুহূর্ত‌ই কারও জন্ম বা কারও মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। মুহূর্ত‌ কত জনকে পথের ভিখারি করছে, কত ভিখারিকে রাজসিংহাসনে বসাচ্ছে। মুহূর্ত‌ ভক্তের প্রাণ হতে একটা বার আরাধ্যের নাম উচ্চারণ করিয়ে স্বর্গ-মর্ত্য কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মুহূর্তের মহিমা চিন্তা করলে মানুষ আত্মহারা হয়ে যায়। অথচ মুহূর্ত অতি সামান্য জিনিস। এই মুহূর্ত জমে জমে ঘণ্টা বা প্রহর, ঘণ্টা বা প্রহর জমে জমে দিনরাত, দিনরাত জমে জমে সপ্তাহ—তারপর মাস, তারপর বছর, তারপর যুগ, তারপর শতাব্দী রচনা করছে। শতাব্দীতে শতাব্দীতে কত দর্শন-বিজ্ঞান, কাব্য-ইতিহাস আবিষ্কৃত হচ্ছে।




পৃথিবীর বয়স কত কে জানে! কোথা হতে সময়ের আরম্ভ, তাই-বা কে বলতে পারে! কোথায়ই-বা সময়ের পরিসমাপ্তি, তাই-বা নির্ণয় কে করতে পারে! ক্ষুদ্র মুহূর্ত— আদিতে-অন্তে অনন্ত শৃঙ্খলে বাঁধা। ক্ষুদ্র মুহূর্ত—অনন্তের ছায়া। সময় যেমন অনন্তজ্ঞাপক যন্ত্র, এমন আর দ্বিতীয়টি নেই। এসব ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।




সৃষ্টির আদি কল্পনা করো; কল্পনা করো, যে-উপায়েই হোক, প্রথমে যেন কেবল একটা গাছের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই গাছে চোখজুড়ানো কত ফুল, কত ফল শোভা পেয়েছে। সেই ফুল একসময় ঝরে পড়েছে, সেই গাছ একসময় মরে গেছে, কিন্তু তার পেছনে কত অঙ্কুর রয়ে গেছে। বীজাঙ্কুর-সহ পরিপক্ব কত ফল মাটিতে পড়েছে, তা হতে সময়ে সময়ে কত গাছের জন্ম হয়েছে। আদি গাছটি কোথায় যেন চলে গেছে, কিন্তু সেই আদি হতে পৃথিবীতে কত বন-জঙ্গল-অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে। সেই অরণ্যের সারি সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধন করে বিলীন হচ্ছে, আবার নুতন অরণ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। আদিতে একটি গাছ কল্পনা না করলেও বোঝা যায়, একটা গাছ বহু গাছের মূল—একটা গাছ হতে পৃথিবী ঘোর অরণ্যে পরিণত হতে পারে। পৃথিবীতে কত গাছ, কত জঙ্গল আছে, কেউ জানে না। সান্তের ভেতরে এখানেও অনন্তের আভাস পাওয়া যায়।




একটু একটু মৃদু হাওয়া ব‌ইছে। আমাদের শরীর জুড়াচ্ছে; আমরা অক্সিজেন টেনে নিয়ে জীবনধারণ করছি। এই একটু একটু শীতল বায়ু যখন প্রবল প্রচণ্ড ঝড়ের আকার ধারণ করে, আমরা ভয়ে জড়সড় হই, আমাদের শৌর্যবীর্য উড়ে যায়। এই ঝড় সাগরে কত তরঙ্গ তোলে, কত জাহাজ ভাঙে, কত বাড়িঘর চূর্ণ করে, কত গাছ-পাহাড় উপড়ে ফেলে। এই হাওয়ার রাশি কোথা হতে আসছে, কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না। কত দিন হলো বাতাসের সৃষ্টি হয়েছে, ভূমণ্ডলে কত বাতাস আছে, কেউ জানতে পারে না। আরও একটু পেছনে গিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, কত বড়ো অনন্ত হাওয়া-সাগর চারিদিকে ছড়িয়ে আছে।




সান্ত তাকে বলি, যার অন্ত পরিমাপ করা যায়। আর অনন্ত তাকেই বলি, যার অন্ত নির্দেশ করা যায় না। বায়ুর আদি-অন্ত কে নির্ণয় করতে পারে? এভাবে যে সীমাবিশিষ্ট পদার্থ ধরি, একটু চিন্তার পরই দেখি, তারই পেছনে সীমারহিত একটা বিরাট অনন্ত সংযুক্ত রয়েছে।




প্রকৃতির এ সকল বিভাগের আলোচনা ছেড়ে চৈতন্যজগতে যাই। মানুষ-সৃষ্টি বিধাতার এক অপরূপ সৃষ্টি। মানবদেহে জড় ও চৈতন্য, উভয়ই আছে। মানবদেহ পঞ্চভূতাত্মক, প্রাণ-মন ত্রিগুণান্বিত। মানুষকে বিশ্লেষণ করলে দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র মানুষের এই ত্রিবিধশক্তির ভেতরেও কি অনন্তের ছায়া পাওয়া যায়? একটু ভাবা যাক।




বিবর্তনবাদ পৃথিবীকে জানিয়েছে, সামান্য বস্তু হতে মহতের উদ্‌ভব এবং জড় হতে চেতনের জন্ম সম্ভব। আদি মানব-মানবী'র এক বিন্দু রক্ত হতে পৃথিবীর অগণিত মানুষের উদ্‌ভব হয়েছে, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও, বিবর্তনবাদ বিশ্বাস করেও এটা মেনে নেওয়া যায় যে, এক স্ত্রী ও এক পুরুষের এক বিন্দু রক্ত হতে অসংখ্য মানুষের উৎপত্তি হতে পারে। এক মানুষ মরছে, দশ-বিশ সন্তান তার পেছনে রয়ে যাচ্ছে; সেই দশ-বিশ লোপ পাচ্ছে; কিন্তু তাহলে শত, সেই শত হতে হাজার, হাজার হতে কোটি কোটি মানুষ জন্মাচ্ছে।




ভূমধ্যসাগরে কড মাছ যদি ধরা না হতো, তবে ১৫ কি ২০ বছরে ভূমধ্যসাগর কড মাছে পূর্ণ হয়ে যেত। জনসংখ্যার বৃদ্ধিও এমন। মনুর সন্তানদের বংশবৃদ্ধি দেখলে বিস্ময় জাগে। এক পিতৃপুরুষ হতে কত জ্ঞাতি হয়েছে, প্রাচীন বংশের সকলের ইতিহাস সংগ্রহ করলে তা জানা যায়। ঋষিদের নামানুসারে বিভিন্ন গোত্র হয়েছে। একেক গোত্রে এখন কত লোক হয়েছে, গোনা যায় না। মানুষের এক বিন্দু শক্তিতে কী এক অত্যাশ্চর্য অনন্ত ব্যাপার দেখা যাচ্ছে।




সমষ্টিতে মানুষের শক্তি কত বিস্তৃত, ধারণা করা যায় না; অন্যদিকে ব্যষ্টিতে সেই শক্তি কত, তারও কি ধারণা হয়! সমষ্টিতে মানুষ দৈহিক বলে সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবী বিকম্পিত করে—এতে কত রাজ্যের উত্থান, কত রাজ্যের পতন হচ্ছে, কত বংশের বিনাশ এবং কত বংশের অভ্যুদয় হচ্ছে। আর ব্যষ্টিতেই কি মানুষ সামান্য? একজন মহাত্মা পৃথিবীকে আমূল বদলে দিতে পারেন। মানুষ কী ভাবে, কী করে, কেউ বলতে পারে না। প্রতিটি ব্যক্তির ভেতরে কত বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তার তরঙ্গ অবিরত খেলছে, কেউ জানে না। কেউ কারও মন আয়ত্ত করতে পারে না। মানুষের শক্তির অন্ত কোথায়? আদি সময় হতে কত মানুষ এবং মানুষের বংশ লোপ পেয়েছে, কত মানুষ এবং বংশ অভ্যুদিত হয়েছে, এখনই-বা পৃথিবীতে কত মানুষ আছে, কে গণনা করতে পারে?




একজন মানুষের শরীরে কত শক্তি নিহিত, তারও কেউ পরিমাণ করতে পারে না। মুহূর্তে মুহূর্তে প্রকৃতি নতুন হচ্ছে, মুহূর্তে মুহূর্তে মানুষ নতুন হচ্ছে। নিতান্তই সামান্য মানুষেরও হৃদয়ে যেন অসামান্য অনন্তের ছায়া—কত বল, কত বীর্য, কত চিন্তা, কত জ্ঞান, কত প্রেম, কত পুণ্য, এর ধারণাও হয় না। মানুষের চিন্তা, জ্ঞান ও বীর্যবলে এই সসাগরা পৃথিবী ধনধান্যে, শোভাসৌন্দর্যে পূর্ণ হয়েছে। দেশের পর দেশ, নগরের পর নগর, রাজ্যের পর রাজ্য—আজ মানুষের অজেয় শক্তি ঘোষণা করছে। মানুষের মস্তিষ্কের সাহায্যে কত কাব্য, কত দর্শন, কত বিজ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে, কে বলতে পারে? যুগান্তব্যাপী, শতাব্দীব্যাপী সাধনার ফলে মানুষ সৃষ্টির রাজত্ব পেয়েছে।




মানুষের প্রতিকথায় অনন্ত জ্ঞান পরিব্যক্ত, প্রতিকাজে অনন্ত শক্তি বিকশিত। সামান্য একটা মানুষের বিষয় ভাবতে গেলেও হৃদয়মন বিস্ময়ে পূর্ণ হয়। মানুষের কত প্রেম, কত চিন্তা, কত কাজ—সকলেরই ভেতরে যেন অনন্ত রূপে প্রতিভাত। বড়ো কাজ, বড়ো কথা, ছোটো কাজ, ছোটো কথা—সবই অবিনশ্বর, সবই প্রয়োজনীয়। একটিরও অভাবে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। যত সামান্য সামান্য বিষয়, যত সামান্য সামান্য কথা-কল্পনা হয়, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ক্ষুদ্র মানুষ যেন বিশাল অনন্তের প্রতিকৃতিমাত্র।




মানুষ ভাবে কী, আর করে কী? যত সামান্য বিষয়‌ই ভাবে বা যত সামান্য কাজই করে, তার সকলেরই লক্ষ্য অনন্ত। ভাবতে আরম্ভ করে কেউ আজ পর্যন্ত ভাবনার কূল পায়নি, কাজ করেও কেউ কাজ শেষ করতে পারেনি। প্রেম, পুণ্য, জ্ঞান ও ধর্ম উপার্জন করে কেউ বাসনাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। প্রেমের আকর্ষণে মানুষ পাগল—বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান হতে তার ভালোবাসা আরম্ভ হয়েছিল, কিন্তু এখন সে আর তাতে তৃপ্তি পায় না—সে আরও চায়, আরও চায়। ভালোবেসে তার বুকের পিপাসা মেটেনি। সে জ্ঞান, পুণ্য, ঐশ্বর্য অর্জন করতে চেয়েছিল, কিন্তু যত ওসব অর্জন করেছে, ততই তার বাসনার আগুন জ্বলেছে।




জ্ঞানপিপাসা, ঐশ্বর্যপিপাসা বা পুণ্যপিপাসা—মানুষের যত পিপাসা কল্পনা করা যায়, মৃত্যু পর্যন্ত কোনো পিপাসারই নিবৃত্তি নেই। তার শরীর চায়, মন চায়, ইন্দ্রির চায়, বৃত্তি চায়, রিপু চায়; সকলই 'দে দে' মহারবে মাতোয়ারা। দিশাহারা মানুষ পাপে ডুবতে ধায় যখন, তখনও অনন্ত পাপে সে ডুববে; যখন ধর্মে উঠতে চায়, তখনও অনন্ত পর্যন্ত ছুটবে। দিনরাত সে ব্যস্ত। দিনরাত সে দারুণ পিপাসায় মাতোয়ারা। তার অভাব কোনোদিনও ঘুচল না। তার পিপাসা কোনোদিনও মিটল না!




মানুষ ঈশ্বরের প্রতিকৃতি। মানুষের সৎপ্রবৃত্তির পিপাসা এবং তার দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক তেজ ও শক্তির কথা যখন ভাবি, তখন বিস্ময়ে নিমগ্ন হই এবং মনে আসে, সত্যিই মানুষ ঈশ্বরের প্রতিকৃতি। মানুষ সৃষ্টির রাজা, এ কথা বললেও মানবত্বের পুরোপুরি প্রকাশ হয় না। অসীম ঈশ্বর মানুষের ক্ষুদ্র শরীরে আবদ্ধ হয়েছেন, এই কথা বললেই যেন অধিক যুক্তিযুক্ত হয়। আবার অন্যদিকে, মানুষের পৈশাচিক প্রক্রিয়ার কথা যখন মনে হয়, তখন আর এভাব মনে থাকে না; মনে হয়, "মানুষ কে যে তার পূজা করি?" আর যা যেমনই হোক, এখানেও মানুষের অনন্তত্ব ভেবে অবাক হতে হয়। সৃষ্টিতে আলোর পাশেই অন্ধকার, পুণ্যের পাশেই পাপ—বিধাতার সৃষ্ট কি না জানি না, কিন্তু এটা জানি, আলো যদি অনন্ত, তবে অন্ধকারও অনন্ত; পুণ্য যদি অনন্ত, তবে পাপও অনন্ত। সকলের মধ্যেই অনন্তের বিশাল বিস্তৃত আভাস পাওয়া যায়।




কোটি কোটি পরমাণু জমে জমে এই সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবী সুসজ্জিত হয়েছে; কোটি কোটি পরমাণু জমে জমে ওই অনন্ত নক্ষত্রজগৎ বিরচিত হয়েছে। সুনির্মল জ্যোৎস্নাময়ী রাতে অনন্ত বালুকাপূর্ণ পুরুষোত্তমের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সবই অনন্ত—সাগরে অনন্ত তরঙ্গরাশি এবং আকাশে চন্দ্র-সূর্য অবিশ্রান্ত দিনরাত কত শতাব্দী ধরে অবিরত ছুটছে। যা ভাবি, সবই অনন্ত। সাগরের কূল নেই, আকাশের কূল নেই, সাগরতীরের অতলস্পর্শী বালুকারাশির কূল নেই, আকাশের নক্ষত্ররাশিরও কূল নেই। ভাবলাম, মানব-পরিবারের কূল নেই, মানব-সম্প্রদায়ের কূল নেই। ভাবলাম, কূল নেই একটাও বৃক্ষের, একটাও নক্ষত্রের, একগাছিও তৃণের, একটাও বালুকণার, একটাও মানুষের। যা ভাবি—সবই যেন অনন্ত। সব সীমাই যেন অসীমে ধাবিত, অথবা অসীমে বিলীন; সান্ত যা ছিল, সব যেন আজ অনন্ত হয়ে গেছে। ভাবলাম, ডুবলাম এবং বিস্ময়ে অনন্তের উদ্দেশে কোটি কোটি প্রণাম করলাম।




তুমি পাঞ্চভৌতিক প্রকৃতির সীমাকে ভালোবাসো, অসীম কিছুই দেখতে পাও না? এত কথার পর, এক বার সীমার বিষয় চিন্তা করো তো দেখি! কীসের কূল আছে, কার অন্ত আছে? যা দেখছ, তার সবই অনন্ত! পৃথিবীর কত বয়স হয়েছে, তুমি জানো না। পৃথিবীতে কত নদ-নদী, কত বৃক্ষ-লতা, কত পাহাড়-পর্বত আছে, তুমি জানো না। পৃথিবীতে কত পরমাণু, কত জীব আছে, কত জীব মরেছে, তা জানো না। সন্ধ্যার আকাশের দিকে চেয়ে দেখো, ওই অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জের বিষয়ে তুমি কিছুই জানো না।




জানো তবে কী বলো তো? তোমার জ্ঞান কতটুকু বলো তো? একটা পরমাণুর বিষয় ভাবো, অকূল বিস্ময়ে ডুবে যাবে। জানো কী যে, এত অহংকার করো? একটা সামান্য মানুষের কথা ভাবো, অবাক হবে। পৃথিবীতে কত বেদ-পুরাণ আবির্ভূত হয়েছেন, কত যোগী-ঋষি বেঁচে ছিলেন বা আছেন, সেসবের কিছুই জানো না। জানো না নিজকে নিজেই—নিজের দেহে, নিজের মনে যা আছে, তা-ও তুমি জানো না। কোথায় ছিলে, জানো না; কোথায় চলেছ, তা-ও জানো না। তোমার লক্ষ্য কী, জানো না; তোমার উদ্দেশ্য কী, জানো না। কীজন্য পৃথিবীতে এসেছ, জানো না; কী করছ, তা-ও জানো না। কাল তোমার পরিণাম কী হবে, তা-ও জানো না।




নিজের কথা স্থিরচিত্তে নিজে ভাবো, অবাক হয়ে যাবে। কোনো চিন্তার সীমা নেই, কোনো কাজের পরিসমাপ্তি নেই। এইটুক ভেবে ফেললেই চিন্তার শেষ হবে, বলতে পারো না; এইটুক করে ফেললেই হাতের কাজ সমাপ্ত হবে, বলতে পারো না; বরং বুঝবে, কোনো কিছুরই শেষ নেই, সব যেন অনন্ত। অনন্ত ছাড়া—আর অন্য কিছু খুঁজে পাবে না। জ্ঞানের অনুসরণ করো, অন্ত পাবে না; প্রেমের পথে চলো, অন্ত পাবে না। সান্ত যা, ওই দেখো, তা মরে গেছে; এ রাজ্যে এখন যেন কেবল অনন্তেরই উদ্‌ভব হয়েছে। সব ভুলে, আত্মাকেও ভুলে একবার অনন্তে ডোবো যদি, তবে ওখানে যে কী সুখ, বুঝবে।




এক 'আমি'র দৌরাত্ম্যে পৃথিবী উচ্ছন্নে গেছে। 'আমার জ্ঞান, আমার ভক্তি, আমার শক্তি, আমার বিত্ত, আমার মুক্তি।' 'আমি করি, আমি বলি।'—চারিদিকে এমন সব রব! 'আমি' সীমায় বন্ধ থাকলে, পৃথিবীর সবই সীমাবিশিষ্ট বলে মনে হয়, কেননা সীমার ভেতরে থেকে অসীমকে দেখা যায় না। যখন 'আমিত্ব' বিসর্জিত হয়, তখন সব সীমা অন্তর্হিত হয়—ক্ষুদ্র দৃষ্টি অনন্তে তখন ধাবিত হয়।




এই 'আমি'টা কে ভাই, বলো তো? মানুষ কে? সান্ত কোথায়? আমিত্ব কোথায়? সবই যখন অনন্তে ডুবল, তখন 'আমিত্ব'ও বিসর্জিত হলো। কার আমিত্ব ডুবল? তোমার? আমার? তা নয়। মহাত্মাগণ যখন অনন্তে নিমগ্ন হলেন, তখন উচ্চকণ্ঠে বললেন, "I and my father are one." ওই চৈতন্য যখন অচৈতন্য হয়ে অনন্তে ডুবলেন, তখন বললেন—আমি সেই, আমি সেই।" শাক্য যখন নির্বাণপ্রাপ্ত হলেন, তখন নিরঞ্জন-তটে অনন্ত জ্ঞান ফুটে উঠল। কিন্তু পৃথিবীর অবস্থা এমনই, এ দৃষ্টান্ত মানুষ দেখে না, মানুষ অহংময় সীমার ভেতরে থাকতেই ভালোবাসে। সে ডুবেও, আবার ঘুরেফিরে, অহং-প্রাচীরময় রাজ্যে উপস্থিত হয়৷ একেক বার সে যায় অনন্তপুরে, কিন্তু আবার ফিরে গণ্ডির ঘরে প্রবেশ করে। এটাই মায়া, এটাই অবিদ্যা, এটাই অন্ধকার, এটাই সান্ত।




এখানেই সম্প্রদায়ের উদ্‌ভব, এখানেই পাপ-প্রলোভন, এখানেই যশ-মানের কুহক, এখানেই বিবাদ-বিসম্বাদ। এখানেই দলাদলি-রক্তারক্তি, এখানেই পাপাসুরের রাজস্ব, এখানেই সঙ্কীর্ণতা, অপ্রেম ও কুজ্ঞান, এখানেই সংসারাসক্তি। অহংকার নামক যে একটা পাপ মানুষকে অনন্তের পথ হতে সান্তের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সেই পাপ এখানেই বসবাস করে। সে মানুষকে বুঝিয়ে দেয়, আর কিছুই নেই, কেবল "তুমিই আছ!" "তোমার সমান নয় কেউই ত্রিভুবনে।"—অহংকারের শিক্ষা এমন। অহংপুরের দাস-দাসী অহংয়ের চরণতলে বসে পাপ-গরলপান করে, ঈশ্বরকে অস্বীকার করে। সান্তেই আরম্ভ, সান্তেই পঞ্চভূতাত্মিক প্রকৃতির পরিণতি—এমন পাপ এটাই মানুষকে বুঝিয়ে দেয়।




এই পাপের হাত হতে যাঁরা মুক্ত হতে পেরেছেন, তাঁরা দেখেন, মায়া ও অবিদ্যার কুয়াশা কেটে গেছে—চারিদিকে বিশাল উদার রাজ্য বিস্তৃত হচ্ছে—সম্প্রদায় নেই, দেশ নেই, রেখা নেই, দিন নেই, সব এক অবিনাশী অনন্ত শক্তিরই বিকাশ। তখন তাঁরা দেখেন, সামান্য অবিনাশী জড় পরমাণুর ভেতরে এক অবিনাশী অনন্ত চিদ্‌ঘন আনন্দ-শক্তি মূর্তিমান। এখানে কেবলই বিশ্বজনীন ভাব, উদারতার পর উদারতা—এক মহাউদারতার রাজ্য বিস্তৃত হচ্ছে। যা দেখা যায়, তা কেবল অনন্তের কথাই প্রকাশ করে। যার দিকে চাওয়া যায়, সে-ই এক অননুমেয় অনন্তের আভাস দেয়। ফুল হাসে, পাখি গায়, নদী চলে, ঝরনা কলকল ধ্বনি করে—সবই সেই অনন্তের কথা প্রকাশ করে।




সান্ত ভৌতিক প্রকৃতি যখন অনন্তের রূপ ধারণ করেছে—ভেদাভেদ যখন চলে গেছে, তখনই অনন্তের পূজা আরম্ভ হয়েছে। তখন মানুষ দেখে, চাঁদ-সূর্য অনন্ত আকাশে অনন্তেরই মহিমা ঘোষণা করছে; অনন্ত নক্ষত্র-জগৎ অনন্তের কীর্তিই প্রচার করছে, আর এই সসাগরা পৃথিবী অনন্তের কথাই ঘোষণা করছে। এই উচ্চভূমিতে মানুষ যখন দাঁড়ায়, তখন মানুষ নিজশক্তির মূলে কেবল অনন্ত শক্তি অনুভব করে দেবত্ব লাভ করে। তখন বিশ্বামিত্রের বাহুবল পরাস্ত হয়েছে, বশিষ্ঠের বুদ্ধিবল হার মেনেছে, বাল্মীকির ধর্ম ও চরিত্রবল স্বৰ্গ-মর্ত্য কাঁপিয়ে এ জগতে ভ্রাতৃত্ব সংস্থাপনে, অনন্ত পরিবার গঠনে সক্ষম হচ্ছে। অথবা খ্ৰিষ্ট তখন পৃথিবীকে উদ্ধারের জন্য 'আমিত্ব' ক্রুশকাঠে বলি দিয়ে অনন্তের পরিবার গঠনে সহায়ক হয়েছেন, অথবা শাক্য কঠোর তপস্যায় নির্বাণ লাভ করে অনন্তের কীর্তি জগতে অক্ষুণ্ণ রাখছেন। তাঁদের লক্ষ্য অনন্তের দিকে ছিল, অনন্তেই তাঁদের সকল কীর্তি। সেই কীর্তি অনন্তকাল থাকবে।




কেউ কেউ বলতে পারেন, শত্রুকেও ভালেবেসো। কিন্তু এর পরেই প্রশ্ন আসে—এই উদার শিক্ষার পরও আবার সমাজে নানান সম্প্রদায়ের উদ্‌ভব হলো কেন? অবিদ্যা, মায়া এবং অহং নামক দস্যুর পরাক্রম এ জগতে অজেয় বলে এখনও আমরা এই রাজ্যে বাস করছি। আমরা বুঝি না, অনন্তের ধারণা করি না। আমরা নিশ্চিন্ত। আমরা উদাসীন। অহংসেবাই আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র। সান্তের কোলে আমরা সবসময়ই শুয়ে আছি। হায়, বাহুবলে আর বুদ্ধিবলে আমরা এ জগতে ভ্রাতৃত্ব সংস্থাপনে বদ্ধপরিকর! আমাদের ভেতরের বশিষ্ঠ মুনি বুদ্ধি, বিদ্যা ও তপস্যার বলে পৃথিবীতে ভ্রাতৃভাব স্থাপন করবেন ভাবছেন, আর আমাদের ভেতরের বিশ্বামিত্র মুনি ভাবছেন—"বাহুবলে প্রায় সবই জয় করেছি, বাকিটুকু শিগ্‌গিরই জয় করে সবাইকে ভাই ভাই করে দেবো।" কিন্তু এই সময় বাল্মীকি মুনি কেঁদে আকুল—দারুণ অনুতাপে অন্তরের সব কিছু ভষ্ম করে ফেলেছেন! জয় কার তবে? বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের যখন দেহত্যাগ হলো, তখন—




"ব্রহ্মা বাল্মিকীকে স্বর্গযাত্রার জন্য অনুরোধ করলে বাল্মীকি মুনি অশ্রুসিক্ত চোখে ব্রহ্মার চরণে লুণ্ঠিত হলেন। বলতে লাগলেন, “দেবাদিদেব! আমি অতি পাপিষ্ঠ, আমি অতি নরাধম, আমি আপনার কথা রাখতে পারলাম না। আমি যে-সকল পাপ করেছি, আজও তার প্রায়শ্চিত্ত হয়নি, প্রভু। এখনও, "আমি ব্রাহ্মণ, আমি ক্ষত্রিয়, আমি পণ্ডিত, আমি মূর্খ, আমি ধনী, আমি দরিদ্র।" বলে অভিমান আছে। এতে মানুষের সুখ হলো আর কোথায়! যখন এই অভিমান যাবে, সমস্ত পৃথিবীসুদ্ধ স্বর্গে যাবে।" এমন ধরনের কথাবার্তা বলে বাল্মীকি কাঁদতে লাগলেন।




ব্রহ্মা বললেন, "নভোমণ্ডলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করো।" বাল্মিকী দেখলেন—সবিতৃমণ্ডলমধ্যবর্তী সরসিজাসন-সন্নিবিষ্ট কেয়ুরবান কনককুণ্ডলধারী কিরীটীহারী হিরন্ময় বপুঃ শঙ্খচক্রধারী মুরারি—বিরাজ করছেন। ভক্তিভাবে গদগদ হয়ে বাল্মিকী দেখতে লাগলেন, দেখতে দেখতে নারায়ণ বিরাটমূর্তি ধারণ করলেন। বাল্মিকী অনেক বাহু, অনেক উদর, অনেক বক্ত্র (মুখ), অনেক নেত্র, দংষ্ট্রাকরাল (বড়ো বড়ো দাঁতবিশিষ্ট) অনন্তরূপ দেখলেন। তাঁর আদি নেই, অন্ত নেই, মধ্য নেই। শশিসূর্য নেত্রে দীপ্তবক্ত্র শরীর প্রভায় দিগন্তপ্রকাশী নারায়ণ পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত মধ্যস্থল পূর্ণ করে র‌ইলেন। দেব, দানব, যক্ষ, রক্ষ, ব্রহ্মাদি সকলে, মানব-জীব-জন্তু সকলেই সেই বিরাটের মুখে প্রবেশ করছে। তাঁর প্রতি লোমকূপে কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড বিলীন রয়েছে। দেখলেন, সে বিরাট মূর্তির সামনে দেবাদিদেবও কীটতুল্য, আর মানুষ তো একেবারেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ! এ দেখে বাল্মীকি স্তব করতে লাগলেন।




তখন ব্রহ্মা বললেন, "বাল্মিকী! তুমি দেখো, সকল মানুষই সমান, সবাই ভাই ভাই, আর সবাই-ই এক। যাও, পৃথিবীময় এই সাম্য, ভ্রাতৃভাব ও একতা গেয়ে বেড়াও। তুমি অমর হলে তোমারই জয়।" বিরাটের মুখ হতে তখন বিরাট স্বরে ধ্বনিত হলো: জয়!”




তাই বলা যায়, সান্ত আর কিছুই নয়—অনন্তের সিঁড়ি—অজ্ঞান মানুষকে অনন্তে নিয়ে যাবার সহজ উপায়মাত্র। অনন্তই সান্তরূপে মানুষকে অনন্তে পৌঁছাচ্ছে—আকারের ভেতর দিয়ে নিরাকারে, ক্ষুদ্রের ভেতর দিয়ে মহতে নিয়ে যাচ্ছে। অনন্তে বিস্তৃত সাগরতীরে দাঁড়ালে কিছুদূর দেখা যায়, তারপর আর দৃষ্টি যায় না। অনন্তে প্রসারিত আকাশের দিকে বা প্রান্তরের দিকে তাকালেও সীমা চোখকে বাধা দেবে, সকল অংশ দেখতে দেবে না। আকাশেও সীমা, প্রান্তরেও আমাদের চোখ সীমাই দেখে! প্রকৃতপক্ষে যেখানে সীমা নেই, সেখানেও সীমা বলে ভ্রম হয়। এভাবে সমস্ত পদার্থই অনন্ত হয়েও সীমাবদ্ধভাবে মানুষের কাছে উপস্থিত হয়। ধীরচিত্তে অনুধাবন করলে বোঝা যাবে, অন্ত কিছুরই নেই, সবই অনন্ত; সান্তত্ব মানুষের দৃষ্টি বা ধারণাশক্তির বাধামাত্র, অথবা মানুষকে অনন্তে পৌঁছে দেবার সিঁড়িমাত্র।




অহংকার, মায়া, অবিদ্যা মানুষকে গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায়; কিন্তু যখন দিব্যজ্ঞান জন্মে, তখন সবই অনন্ত বলে মনে হয়। অনুতাপের আগুনে অহংকে ভস্ম করে পাপমুক্ত বাল্মীকি অনন্ত তত্ত্ব পেয়ে বিধাতার জয় ঘোষণা করে গেছেন। আমরা যতদিন তেমনি করে অহং ভস্ম করতে না পারব, যতদিন মায়া ও অবিদ্যার উপরে উঠতে না পারব, ততদিন অনন্ত বুঝব না—গণ্ডির মধ্যেই মরব ও পচব, অনাবিল অহেতুকী প্রেম ও পুণ্যের আস্বাদন পাবো না। যতদিন মানুষ অহংকারের রাজ্যে বাস করে, ততদিনই সব কিছু সান্ত দেখে, সান্ত ভাবে; আর যখন অহংকে ভস্ম করে, নিজেকে বিসর্জন দেয়, তখনই অনন্তের ছায়া সব জায়গায় বিরাজিত দেখে মোহিত ও স্তম্ভিত হয়। অনন্তের আভাস যখন মানুষ পায়, তখন সে নিজের পাপদেহ ভস্ম করে উদার বিশ্বজনীন ধামে পৌঁছে—তা-ই মায়াতীত বৈকুণ্ঠ, তা-ই অবিদ্যা-বিমুক্ত মুক্তিধাম।