শুভ বিবাহবার্ষিকী

 শুভ বিবাহবার্ষিকী, প্রিয়!
  
 আজকের দিনটিকে আমি সেলিব্রেট করতে চাই কোনও ধরনের সেলিব্রেট না করেই!
  
 আমি গত কয়েক দিন ধরে এই দিনটির কথা বার বার বলে যাচ্ছি। এই দিনটিকে আমি খুব মিস করি। যদিও একদিক থেকে ভাবলে, এই দিনটির কথা আমার ভুলে যাওয়া উচিত ছিল। কত কিছু হারিয়ে গেল আমার, আবার কত কিছু পেলাম, কিছুই তোমাকে আর দেখানো গেল না। অথচ প্রায় প্রায়ই মনে হয়, নিজেকে ভেঙেচুরে সবটাই তোমাকে বলে দিই।
  
 তোমার কি এই দিনটির কথা মনে আছে? জানি না আছে কি না। বিয়ের দিনই আমাদের শেষ দেখা! এত আশ্চর্যজনক ঘটনা পৃথিবীতে নিশ্চয়ই খুব কম আছে। হ্যাঁ, তুমি অবশ্য ওটাকে নিয়মের বিয়ে না-ই বলতে পারো! আমাদের এই পৃথিবীতে খাঁটি জিনিসগুলো কখনওই নিয়ম মেনে হয়নি। শুধু সিঁথিতে সিঁদুর পরলেই যেমন বিয়ে হয় না, তেমন অনেকের ক্ষেত্রে, সব নিয়ম মেনে বিয়ে করার পরেও কিন্তু বিয়েটা হয় না! এখানে পুরো ব্যাপারটিই অনুভূতির, সম্মানের, শ্রদ্ধার, বিশ্বাসের।
  
 অনেক ভারী ভারী শব্দ বলে ফেললাম, চোখে পানি এসে যাচ্ছে। হয়তো এই শব্দগুলো বলার জন্য তিন বছর যথেষ্ট নয়, তবুও সামনে কী হবে, তা না ভেবে, এতদিন কী হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে আমি বড়ো বড়ো শব্দগুলো সাহস নিয়ে বলেই ফেললাম। আজ তো নিজের মতো করে বাঁচি, কাল যা হবার হবে!
  
 কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি, কতটা সময় কেটে গেছে, কত কত অপেক্ষা করে ছিলাম! এসব ভাবলে এখন ভীষণ অবাক লাগে! খুব খুব অবাক লাগে! এটা কি সেই ধৈর্যের অভাবে দাঁত দিয়ে ঘুড়ির সুতো কেটে-ফেলা আমিটা? এটাই কি সেই একগুঁয়ে আমি, যে আমি কখনও কোনও সম্পর্কের ধার ধারিনি! চিন্তায়, কথায় কারুর সাথে না মিললে, জাস্ট ফুলস্টপ দিয়ে বেরিয়ে এসেছি যে আমি? এটাই কি সেই আমি, যে কখনওই এতটা বিশ্বাস করতে জানত না?
  
 আজ আমি নিজেকে চিনতে পারছি না। তবে আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের এবং বলতে পারো আহ্লাদের বিষয় হচ্ছে, আমাদের বিয়েটা। সেদিন আমাদের বিয়েতে শুধু আমরাই ছিলাম। পরিবার, সমাজ, এত রীতিনীতি, অমুকের মন রাখা, তমুকের কথা মেনে নেওয়া, শাড়ি-গয়না, ঢাকঢোল, বন্ধুবান্ধবের ভিড়ে আমাদের দু-জনকে হারিয়ে যেতে হয়নি। আমরা শুধু মনের দিক থেকেই বাঁধা পড়তে চেয়েছিলাম, নিয়মের দিক থেকে নয়! এবং আমাদের চাওয়াটা সত্যি হয়েছে, দ্যাখো!
 খুব সম্ভবত, আমাদের দু-জনের কথা আমরা দু-জন ছাড়া আর কেউই জানে না। আমি কোথাও আটকে যাবার মানুষ নই, এমনকী তুমিও নও। অথচ দ্যাখো, দু-জনেই কেমন ইচ্ছে করেই আটকা পড়ে আছি! এটাকে আমার কাছে জাদু মনে হয়। তা না হলে এ-ও সম্ভব!
  
 সমাজের সব নিয়মকানুন মেনে কাছে এসেও ক-জন আমাদের মতো করে মনের দিক থেকে এতটা কাছাকাছি থাকতে পারে বলো? অনুভূতি যে উপস্থিতিকেও হার মানাতে পারে, আমি তা একটু একটু করে দেখেছি ও দেখছি। এখন আমি সম্পর্ক, প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে ছোটোবেলার মতন বড়ো বড়ো লেকচার আর দিই না, খুব লজ্জা লাগে। এখন বুঝি, এগুলো লেকচার দেবার জিনিস না। যারা লেকচার দেয়, তাদের কথা শুনে মনে মনে হাসি।
  
 আমি একইসঙ্গে বয়সে কতটা বড়ো এবং বুদ্ধিতে কতটা ছোটো, এ জীবনে তুমি না এলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না। এই একটাই জায়গা, যেখানে বড়ো হতে আমার ইচ্ছেই করে না! তোমারও যে করে না, আমি তা-ও জানি। তোমাকে যতই ভাবি, আমি ততই হেরে যেতে শিখি! যার কাছে হেরে যেতেই সমস্ত সুখ, তাকেই আমি বলি প্রিয়! এ আমার ব্যর্থতা নয়, এতেই আমার সকল জিত!
  
 আমি ঠিক করে কিছুই লিখতে পারছি না, আজ খুব কাঁদলাম লিখতে গিয়ে। কেন কাঁদছি, জানি না। কী লিখব এর পরে, তা-ও বুঝতে পারছি না। কিছু লিখেই বোঝাতে পারব না, আসলে কী বোঝাতে চাইছি! আবার না লিখেও শান্তি পাচ্ছি না। কীরকম জানি একটা অনুভূতি! তোমাকে পেয়েছি যত, বোঝা না-বোঝার দায়টা কমেছে ততই।
  
 ভেবেছিলাম, আজকে শাড়ি, চুড়ি, সিঁদুর পরব। কিন্তু আমাকে দিয়ে হলো না। মা আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেবার সময় যদি কেঁদে ফেলি, কিংবা প্রতিবেশী বউদির কাছে একটুখানি সিঁদুর চাইলে যদি জিজ্ঞেস করে, ‘কী করবি রে তুই সিঁদুর দিয়ে?’ সেই ভয়ে কিংবা লজ্জায় আমার কিছুই আর করা হলো না। আমি ভেবেছিলাম, তোমাকে চিঠি লিখব। চিঠিটাও শেষ পর্যন্ত লেখা আর হলো না। কী আর হবে লিখে!
  
 তোমাকে পেয়েছি বলেই না চাইতেও পুরো পৃথিবী পেয়ে বসে আছি! ইদানীং ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য ‘ভালোবাসি’ শব্দটাকেও খুব ছোট্ট মনে হয়। আগে 'ভালোবাসি' বলে ফেলতে কোনও জড়তাই কাজ করত না, কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে ফেলার পর থেকে 'ভালোবাসি' বলতে নিজের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়! কী যে শক্ত একটা কাজ এই 'ভালোবাসি' বলা! তাই ওটা আর বলি না।
  
 শোনো, আজ আর লিখব না। মাত্র তিনটে বছরই তো গেল! এখনই এত কিছু বলে না ফেলাই ভালো। তোমারও কি তা-ই মনে হয় না, বলো?