দাম্পত্যে বন্ধুত্ব

 মানুষটা কখনও শোধরাবে না জেনেও তার সঙ্গে থেকে যাবার নামই দাম্পত্যসম্পর্ক।
 শোধরানোর মানে কী? আপনি যেমন চাইছেন, তেমন হওয়া। কেউ কি কারও মনের মতো হয়ে উঠতে পারে শেষপর্যন্ত? পারে না বোধ হয়, তবে যে যেমন আছে, তেমন করেই পরস্পরকে মেনে নিয়ে ওরা দু-জন পাশাপাশি থেকে যেতে পারে।
  
 এর জন্য ভালোবাসার দরকার নেই, বন্ধুত্বের দরকার। আমার বন্ধু আমার মনের মতো না-ও হতে পারে, তবে আমি তাকে তার মতো করেই মেনে নিতে রাজি আছি, কেননা সে-ও আমাকে আমার মতো করেই মেনে নিচ্ছে। এর নামই বন্ধুত্ব।
  
 দাম্পত্যে এমন বন্ধুত্ব থাকলে ভালো, না থাকলে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। সমস্যা হলো, প্রায় সময়ই, মানুষ যখন বিয়ে করে, তখন সে মুখে মুখে একজন বন্ধু চাইলেও মনে মনে চায় একজন স্বামী বা স্ত্রী। সেই চাওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বলেই নিজের অজান্তেই এমন কিছু কাজ করে বসে যা বন্ধু কখনও বন্ধুর সাথে করে না।
  
 ভালোবাসায় বিশ্বাস নষ্ট হলেও ভালোবাসা টিকে থাকে কখনও কখনও, কিন্তু বন্ধুত্বে বিশ্বাস একবার নষ্ট হয়ে গেলে বন্ধুত্বটা আর কখনওই ফিরে আসে না। ব্যাপারটা এমন নয় যে আপনি আপনার সেই বন্ধুটাকে আর ক্ষমা করতে পারবেন না, বরং নিজেকেই আপনার বোকা মনে হবে সেই মানুষটাকে বিশ্বাস করার জন্য। তখন আবারও বন্ধুত্ব করতে চাইলে তার সঙ্গে হিসেব করে চলতে হবে। সত্যিটা হলো, এই হিসেবটার নাম আসলে দাম্পত্য, বন্ধুত্ব নয়।
  
 এতদিন প্রেম করল, কখনও তেমন সমস্যা হয়নি; হলেও সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দু-জন। অথচ যেই বিয়ে করল, অমনিই দু-জন দু-জনকে স্বামী-স্ত্রী ভাবতে শুরু করে দিল, সেখান থেকে বন্ধুত্বটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল! সবাই-ই নিজের মতো, কেউই সাধারণত অন্য কারও মতো হয় না। হ্যাঁ, মানুষ কখনও কখনও তার ভালোবাসার মানুষের মনের মতো হয়ে উঠতে পারে। কেন হয়? ওরকম হতে ভালো লাগে বলেই হয়। ভালো না লাগলে তো আর হতো না নিশ্চয়ই! এই হয়ে ওঠার ব্যাপারটা দু-দিক থেকে না-ও হতে পারে, এটা মাথায় রেখেই দাম্পত্যযাপন করতে হয়। আমার যা ভালো লাগে, তা আরেকজনের ভালো লাগবেই কেন? বলতে পারেন, নিজের স্বামী বা স্ত্রী আরেকজন হয় কী করে? আমি বলব, ভুল ভাবছেন! ঠান্ডামাথায় একটু ভাবুন! বস্তুত, এক নিজে বাদে এই দুনিয়ার সবাই-ই আরেকজন!
  
 মানুষ অবচেতন মনে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অপরকে ভালোবাসি কেন? ভালোবাসতে ভালো লাগে বলেই ভালোবাসি। নিজের সন্তানকে ভালোবাসি কেন? সন্তানটা নিজের বলেই ভালোবাসি। কই, পরের সন্তানের বেলায় তো এই ভালোবাসা ততটা আসে না! যদি পরের সন্তানকে ভালোবাসিও, তবে আমার সন্তান যদি এমন হতো, কিংবা ও যে আমার সন্তানেরই মতো---এইসব ভেবেই ওকে ভালোবাসি। অন্য সব কিছু বাদ দিই। এই যে মানুষ আত্মহত্যা করে, কেন করে? যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে না বলেই তো করে, তাই না? সেখানেও কিন্তু মূলত নিজেকে ভালো রাখতে পারার ব্যর্থতাটাই কাজ করে, আর কিছু নয়।
  
 এই যে সন্তান আঘাত দিলেও মানুষ তবু তাকে ভালোবাসে, এর নাম মোহ বা মায়া। শুরুতে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেছে, আর সেখান থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এই মায়া জিনিসটা আসে অভ্যস্ততা থেকে, একধরনের টান থেকে। এখানে যে ভালোবাসা, তার নাম বন্ধুত্ব---আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন। এর কারণেই মানুষ অন্যকে যত-না নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ঘোরায় নিজেকেই! মানুষ আসলে নিজেরই দাসত্ব করে, এই দাসত্বের নাম নিজের ভালোলাগার কিংবা অভ্যস্ততার প্রতি দাসত্ব, যদিও নিজেকে ক্ষমা করে দেবার জন্য মুখে বলে, আমি মায়ায় পড়ে অমুকের দাসত্ব সহ্য করছি!
  
 বন্ধুকে সব বলা যায়, তবে বলে দেবার পর কেউ কেউ আর বন্ধু থাকে না। তখন মনে হয়, হায়, আমি কাকে বন্ধু ভেবেছিলাম! আসলে সবাই বন্ধু হবার যোগ্যতা রাখে না। কেউ কেউ কেবলই স্বামী বা স্ত্রী হতেই জন্মায়। মানুষ এরকম নানান ভুলের মধ্য দিয়েই একদিন সত্যে পৌঁছোয়। কেউ কেউ দড়ি দেখে সাপ ভাবে, কেউ কেউ আবার সাপ দেখেও দড়ি ভাবে। শেষমেশ কিন্তু সত্যটা মানুষের কাছে ঠিকই ধরা পড়ে যায়---সাপের কামড় খেয়ে কিংবা দড়ির কামড় না খেয়ে!
  
 এই আধুনিক সময়ে দাম্পত্যজীবন সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখতে গেলে ভালোবাসার চাইতে বন্ধুত্বের দরকারই বেশি।