শুদ্ধতম আত্মজীবনী

মানুষ বেঁচে থাকার সময়ে অনেক অনেক কিছুই কাউকে বলতে পারে না, খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও।

আপনার জীবনে এমনও অনেক কথা আছে, যা আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ জানে না, আপনার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউ জানবেও না; এমনকী মৃত্যুর পর‌ও সেসব কথার তেমন কিছুই কার‌ও কোনোদিনই জানা হবে না, অথচ কিছু কথা জানানো খুব দরকার। মানুষ খুব করে বলতে চায়, তবু বলার মানুষ খুঁজে পায় না। কে বলে, পৃথিবীতে অনেক মানুষ?!

অনেক মানুষই চায়, কিছু বিষয় তার জীবিতাবস্থায় কেউই না জানুক। এই ব্যাপারটা চরম সুন্দর। একটা সুন্দর সুইসাইড-নোট কিংবা লুকোনো নোটবুক... দুঃখময় কিছু মৃত্যুর কারণ, খুব গোপন কিছু ব্যথার কথা মানুষের মৃত্যুকে আরও রহস্যময় করে তোলে।

সমাজের চোখে যাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তাদের অনেকেই প্রকৃতপক্ষে নিজের আত্মাকে খুন করে ফেলে দৈহিক মৃত্যুর অনেক আগেই। তাই ওদের নোটবুক বস্তুত সুইসাইড-নোট ছাড়া আর কিছু নয়।

মৃত্যুর পরও অনেক কিছুই আসে যায়---হোক সে মৃত্যু আত্মিক বা দৈহিক।

আমার তো ভীষণ ইচ্ছে করে, আমি বেনামি কিছু চিঠি লিখব; সেসব চিঠির প্রাপক কে, তা কেউ কখনও জানবে না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার অনেক কথাই মানুষ জানবে না, জানতে আমি দেবোই না। সবাইকে সবকিছু জানতে দিতে নেই।

আমি নিজের ইচ্ছেয় একটা মরণ চাই; নিজের ইচ্ছেয়, নিজের সুবিধায় মরণ পাবার একমাত্র পথ সুইসাইড। যারা সুইসাইড করে, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ওদের শেষ লেখাটা বার বার পড়ি। ওরা শেষ কথাটা বলে অন্তত যেতে পারে। এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে? কিন্তু যারা হঠাৎই মরে যায়, তারা তো বুঝতেই পারে না যে তারা মরে গেছে।


সুইসাইড-নোট হচ্ছে একজন মানুষের শুদ্ধতম আত্মজীবনী।

ধরুন, কাল মারা যাবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। আপনি সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে ফোন করে শেষ কথা সেরে নেবেন, প্রিয় খাবারটি খেয়ে নেবেন, প্রিয় মানুষটির সাথে দেখাও করে নেবেন, প্রিয় শেষ কথাটিও বলে যাবার মতন মহাসুযোগ পাবেন। প্রিয় গানটি আরেকবার শুনে নেবেন, প্রিয় বইটায় একবার চুমু খেয়ে নেবেন।

একজন মানুষ অনন্তকালের জন্য চলে যাচ্ছে, সেটা সে বুঝে গেছে এবং সব প্রিয় ব্যাপার সে শেষ বারের মতো করে নিয়েছে। ভাবা যায়?

অ্যাক্সিডেন্ট করে মরে গেলে তো প্রিয় খাবারটাও শেষ বার খাওয়া হয় না। কী যে কষ্টের, ভাবতে পারেন?

এজন্যই তো মৃত্যুর আগে নিজের মতন করে দু-চারটা দিন বাঁচা দরকার, শেষ ইচ্ছাগুলো পূরণ করে নেওয়া দরকার। Death is the end of everything.

এলোমেলো লাগছে? আচ্ছা, একটু সহজ করে বলি। আমাদের কষ্টগুলি আসলে একেকটা সুইসাইড-নোটের জন্ম দেয়। সেগুলির বেশিরভাগই কখনও কোথাও লেখা হয় না, তাই পৃথিবীর কাছে এক সুইসাইড বাদে আর কোনও মৃত্যুই সুইসাইড নয়। কিন্তু ভাবুন তো, যে মানুষটি প্রতিদিন‌ই হাজার বার মরে চলেছে কষ্টে কষ্টে, তার আত্মার এই মৃত্যু কি তবে কিছু নয়? তার মৃত্যু সাইলেন্ট সুইসাইড ছাড়া আর কী?

যে মানুষটা একদিন নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা করতে ভুলে যায় কিংবা মনে থাকলেও ভালো রাখে না, তার বেঁচে থাকায় সুস্থতা বলে আদৌ কি কিছু আছে? অসুস্থ হলে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর কেউবা বাহ্যিক সুস্থতা নিয়েও সারাজীবন‌ই বাঁচে যন্ত্রণার হাসপাতালে।

যন্ত্রণার হাসপাতালে কোনও ডাক্তার থাকে না, শুধুই রোগী থাকে। মানুষ মরে গেলে হাসপাতাল থেকে তার ডেডবডি আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়, আর যন্ত্রণার হাসপাতালে মানুষ নিজেই নিজের ডেডবডি বহন করে বাঁচে... প্রতিমুহূর্তে।


সুইসাইড করে চলে যেতে সাহস লাগে, আর সাইলেন্ট সুইসাইড মেনে নিয়ে বাঁচতে লাগে দুঃসাহস। এই অর্থে, বেশিরভাগ মানুষই ভীষণ রকমের দুঃসাহসী, যা হয়তো সে নিজেও আমৃত্যু বুঝতে পারে না।

সবকিছুর পরও, প্রস্থানের চেয়ে অবস্থান সুন্দর।