শ্রীরামের পদপ্রান্তে (৪র্থ ভাগ)

#রাম_নবমী




সন্তজনের (সাধুদের) লক্ষণ:
১. সন্তন্‌হকে লচ্ছন রঘুবীরা
কহহু নাথ ভঞ্জন ভব ভীরা।।
সুনু মুনি সন্তন্‌হকে গুন কহউ
জিন্‌হ তেঁ মৈঁ উন্‌হকে বস রহউ।।
অর্থ: সকলের নাথ (রক্ষক বা প্রভু), সংসারভয় নাশকারী রঘুবীর (রামের প্রপিতামহ রঘুর বংশের বীর তথা রাম), সজ্জনের লক্ষণ-বল (ভালো মানুষের বৈশিষ্ট্যসূচক শক্তি) রাম বললেন, “হে মুনি, শোনো—আমি সজ্জনের গুণ বলছি—যা দ্বারা আমি তাদের (সজ্জনের) বশীভূত রয়েছি।”




২. ষট্ বিকার জিত অনঘ অকামা 
অচল অকিঞ্চন সুচি সুখ ধামা।।
অমিতবোধ-অনীহ মিত ভোগী
সত্যসন্ধ কবি কোবিদ জোগী।।
সাবধান মানদ মদহীনা
ধীর ভগতিপথ পরম প্রবীনা।।
অর্থ: যে-ব্যক্তি ষড়বিকার জয় করেছেন; যিনি নিষ্পাপ, কামনারহিত, অচঞ্চল, অকিঞ্চন (ধনহীন), পবিত্র, সুখধাম (সুখের আশ্রয়), অপার জ্ঞানসম্পন্ন, তৃষ্ণারহিত (লোভ নেই যাঁর), পরিমিত ভোগী (ভোগ করেন পরিমিত পরিমাণে), সত্যপ্রতিজ্ঞ; যিনি কবি, পণ্ডিত, যোগী (সাধনা করেন তিনি), সাবধান (সংযত), সকলকে মান (প্রাপ্য সম্মান) দেন, কিন্তু নিজে অভিমানশূন্য (কোনো বিষয়ে রাগ বা দম্ভ নেই যাঁর), ধীর এবং ভক্তিপথে অত্যন্ত প্রবীণ (চতুর), তিনিই সজ্জন। (আমাদের দেহ অনিত্য। এই দেহের নাশ আছে, এই দেহের আছে ষড়বিকার—অর্থাৎ এই দেহের জন্ম আছে, স্থিতি আছে, বৃদ্ধি আছে, পরিণাম আছে, ক্ষয় আছে; আর সবশেষে দেহের নাশ আছে।)




৩. (দোঁহা) গুনাগার সংসার-দুখ
রহিত বিগত সন্দেহ।
তজি মম চরন সরোজ প্রিয়
জিন্‌হকহঁ দেহ ন গেহ।।
অর্থ: যে-ব্যক্তি গুণের ভাণ্ডার, সংসারের দুঃখরহিত এবং (আমার কৃপার বিষয়ে) সংশয়শূন্য, আমার চরণকোমল ছেড়ে যার নিজের দেহটিও প্রিয় নয়, ঘরও প্রিয় নয়,




৪. নিজগুন স্রবন সুনত সকুচাহি
পরগুন সুনত অধিক হরষাহীঁ।।
সম সীতল নহিঁ ত্যাগহিঁ নীতী
সরল সুভাউ সবহিঁ মনপ্রীতি।।
অর্থ: নিজের গুণ কানে শুনলে যে সংকুচিত হয় (নিজের প্রশংসা শুনে যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে), অপরের গুণ (প্রশংসা) শুনলে যে অধিকতর আনন্দিত হয়, যে (সকল জীব, বস্তু ও ঘটনার প্রতি) সমদৃষ্টিসম্পন্ন ও শীতল, এবং যে-ব্যক্তি নীতি কখনও (এমনকী বিপদের সময়‌ও) ত্যাগ করে না, যার স্বভাব সরল এবং যে সকলের সাথে আন্তরিক প্রীতিসম্পন্ন,




৫. জপ তপ ব্রত দম সংজম নেমা
গুরু-গোবিন্দ-বিপ্র-পদ প্রেমা।।
স্রদ্ধা ছমা মইত্রী দায়া
মুদিতা মম পদপ্রীতি অমায়ী।।
অর্থ: যে জপ (মন্ত্র বা ঐশ্বরিক নামের ধ্যানমূলক পুনরাবৃত্তি), তপ (স্বর্গাদি লাভের জন্য বা সংকল্পসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কঠিন সাধনা), ব্রত (পুণ্যলাভ ইষ্টলাভ বা পাপনাশের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত ধর্মকার্য), দম (ইন্দ্রিয়সংযম), (শম: মানসিক শান্তি) সংযম (সংযম প্রজ্ঞার তথা বুদ্ধিমত্তা ও বোধের সর্বোচ্চ ও বিশুদ্ধতম রূপের জন্ম দেয়) ও নিয়ম (সদর্থক বা ভালো বা উপযুক্ত কর্তব্য বা প্রক্রিয়া)—সমস্তই (পালন) করে এবং গুরু, গোবিন্দ (ভগবান) ও ব্রাহ্মণের চরণে যার প্রেম হয়েছে, যার শ্রদ্ধা, ক্ষমা, মৈত্রী (দানশীলতা, প্রেমময়-দয়া, বন্ধুত্ব, সৌহার্দ্য, ভালো ইচ্ছা এবং অন্যদের প্রতি সক্রিয় আগ্রহ), দয়া, প্রসন্নতা, মায়াহীনতা (অকৃত্রিমতা) ও (আমার চরণে) প্রেম হয়েছে,
(শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ।/জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্।। অর্থাৎ, শম (বাসনার নিবৃত্তি), দম (আত্মসংযম), তপ (তপস্যা), শৌচ (বিশুদ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা ও স্পষ্টতা), ক্ষান্তি (ক্ষমা, সহিষ্ণুতা), সরলতা, জ্ঞান, বিজ্ঞান (ব্রহ্ম সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান) ও আস্তিক্য (পরমাত্মায় বিশ্বাস)—এগুলি ব্রাহ্মণদের স্বভাবজাত কর্ম। ~~ গীতা, ১৮/৪২; ফলে এই কর্মসমূহ সম্পাদন করলে যে কেউই ব্রাহ্মণ বলে অভিহিত হন—তাঁর জন্ম যেখানেই হোক না কেন। ‘ব্রাহ্মণ’ শব্দটি এই কর্মবৈশিষ্ট্যসমূহের সমাহারযুক্ত যে-কোনো ব্যক্তির (তিনি ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য যা-ই হন না কেন) অভিধাতেই প্রযোজ্য।)




৬. বিরতি বিবেক বিনয় বিগ্যানা
বোধ জথারথ বেদপুরানা।।
দম্ভ মান মদ করহিঁন কাউ
ভুলি ন দেহিঁ কুমারগ পাউঁ।।
অর্থ: যার বৈরাগ্য, বিবেক, বিনয়, বিজ্ঞান ও বেদপুরাণের যথার্থ বোধ জন্মেছে (তত্ত্ব অনুভূতি হয়েছে—’অপরাবিদ্যা’ অর্থে), যে দম্ভ (কপট ধার্মিকতা), অভিমান ও মদ (অহংকার) কখনও করে না এবং ভুলেও কুপথে পা ফেলে না,
(শ্রীভগবান বললেন:
হে বীর, চঞ্চল মন রোধ করা অতি সুকঠিন—
সত্য। তবু অভ্যাস আর বৈরাগ্যে সে-ও হয় বশ।
গীতা, ৬/৩৫ (মহাপয়ারমৃত গীতা, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় অনূদিত)
অর্থাৎ, কোনো একটি কাজ করতে ভালো লাগছে কি লাগছে না, তা বিবেচনা না করে কাজটি করা দরকার হলে করে যেতে (প্রবৃত্ত হতে) হবে, করা দরকার না হলে করা থামিয়ে দিতে (নিবৃত্ত হতে) হবে। এটি বস্তু, ঘটনা বা অন্য যে-কোনো কিছুর বেলাতেও সত্য। মনের কথা না শুনে মনকে প্রয়োজনানুসারে ক্রমাগত অভ্যাসের মাধ্যমে প্রবৃত্ত বা নিবৃত্ত করতে হবে। এর নাম‌ই বৈরাগ্য।)




৭. গাবহিঁ সুনহিঁ সদা মম লীলা
হেতু রহিত পর হিত রত সীলা।।
সুনু মুনি সাধুন কে গুন জেতে
কহি ন সকহিঁ সারদস্রুতিতেতে।।
অর্থ: যে সবসময় আমার লীলাগান (আমার বিভিন্ন আখ্যানবর্ণনা) করে ও শোনে, স্বার্থশূন্য হ‌ওয়া এবং পরহিতে লেগে থাকাই যার স্বভাব, হে মুনি, শোনো, সাধুজনের যে-গুণ আছে, তা সম্পূর্ণভাবে বেদ ও সরস্বতীও বর্ণনা করতে সমর্থ হয় না। (অর্থাৎ সাধুগণের মাহাত্ম্য যেহেতু মহান পরাবিদ্যাপ্রসূত, সেহেতু সাধারণ অপরাবিদ্যার সাহায্যে সেটি বর্ণনা করা যায় না।)




৮. (দোঁহা) রাবনারি জসু পাবন
গাবহিঁ সুনহিঁ জে লোগু।
রাম ভগতি দৃঢ় পাবহিঁ
বিনু বিরাগু জপু জোগু।।
অর্থ: রাবণের শত্রু রামচন্দ্রের পবিত্র যশ (প্রসিদ্ধি বা গুণকীর্তন) যে-ব্যক্তি গান করে ও শোনে, সে বৈরাগ্য, জপ ও যোগ (বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, অধ্যবসায় ও উপায়) ব্যতীতই রামপদে দৃঢ় ভক্তি লাভ করে থাকে।




৯. দীপশিখা সম জুবতিতনু
মন জনি হোসি পতঙ্গ।
ভজহি রাম তজি কামু মদু
করহি সদা সতসঙ্গ।।
অর্থ: যুবতীর শরীর (আকর্ষণকারী) দীপশিখার মতো; রে মন, তুমি এতে পতঙ্গ কখনও হয়ো না; কাম (ইন্দ্রিয়সুখ, কামেচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা) ও মদ (মানসিক অস্থিরতা) ত্যাগ করে রামের ভজনা করো (প্রার্থনা করে করে স্থির হ‌ও) এবং সবসময়ই সৎসঙ্গ করো। (ভালো লোকের সাথে মেশো।)




১০. সন্ত অসন্তন্‌হ কৈ অসি করনী
জিমি কুঠার চন্দন আচরনী।।
কাটই পরসু মলয় সুনুভাই
নিজগুন দেই সুগন্ধ বসাই।।
অর্থ: সজ্জন ও দুষ্টের কাজ চন্দন ও কুঠারের আচরণের মতো। হে ভাই, শোনো, কুঠার যেমন চন্দন কাটে, কিন্তু চন্দন নিজের গুণ—সুগন্ধ তার মধ্যে লাগিয়ে দেয়। (ঠিক তেমনি দুষ্ট লোক ভালো লোককে কষ্ট দিলেও ভালো লোকের কিছু ভালো দিক দুষ্ট লোকটির মধ্যে আবেশিত বা সঞ্চারিত হয়।)




১১. (দোঁহা) তা তে সুর সীসন্‌হ চঢ়ত জগবল্লভ শ্রীখণ্ড।
অনল দাহি পীটত ঘনহিঁ পরসু বদন যহ দণ্ড।।
অর্থ: এর জন্য চন্দন সংসারের প্রিয় এবং দেবতাদের মাথার উপরে থাকে, কিন্তু কুঠারের এই দণ্ড যে, লোকে তা অগ্নিতে দগ্ধ করে এবং ঘন ঘন তার মুখ পিটিয়ে থাকে। (কর্মফল বোঝাতে এবং তার মাধ্যমে মানুষকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করতে এই দোঁহার অবতারণা।)




১২. বিষয় অলংপট সীল গুনাকর
পরদুখ দুখ সুখ সুখ দেখেঁ পর।।
সম অভূতরিপু-বিমদ বিরাগী
লোভামরষ হরষ ভয় ত্যাগী।।
অর্থ: সজ্জন বিষয়ে লম্পট হয় না (অর্থাৎ সম্পত্তি বা সম্পদ ভোগের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার করে না), শীল (চরিত্র) ও গুণের ভাণ্ডার, পর-দুঃখে দুঃখী ও পরসুখে সুখী হয়ে থাকে, সকলের প্রতি সমান (পক্ষপাতদুষ্ট নয়, এমন) ব্যবহার করে, তার কোনো শত্রু হয় না, সে অভিমানশূন্য ও বৈরাগ্যবান হয় এবং লোভ, ক্রোধ, হর্ষ ও ভয় ত্যাগ করে থাকে। (অর্থাৎ কি লোভ, কি রাগ, কি আনন্দ, (কি শোক,) কি ভয়—কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারে না।)
(অভিমান কী? শিবাবতার শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’-র ১০৪ নং শ্লোক বলছেন, আমাদের অহংকার কোনটা? ‘আমি বুদ্ধি’, ‘আমি কর্তা’, ‘আমি ভোক্তা’—এই ভাব। আমরা দেহে ‘আমি’ বুদ্ধি করি। তাই চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জগতের সঙ্গে যে-সংযোগ, সেই অনুভব ‘আমার’ হচ্ছে বলে মনে করি। কর্মেন্দ্রিয়গুলোর সাহায্যে যা-কিছু করি, মনে করি, ‘আমি’ করছি। এমনি করে আমাদের অহংকার দেহ ও ইন্দ্রিয়গুলির সঙ্গে একাকার হয়ে থাকে। এই অহংকার বা ‘আমি’-বুদ্ধির উপর চিদাত্মার (চৈতন্যরূপ আত্মার) ছায়া পড়ে। তাই এই ‘আমি’-বুদ্ধি যা-কিছুতেই আরোপিত হয়, তা-ই চেতন বলে মনে হয়। এই কারণেই শরীর-মন-বুদ্ধি-জড় হলেও চেতন বলে মনে হয়। এই শ্লোক বলছেন, ‘অহঙ্কারঃ সঃ বিজ্ঞেয়ঃ কর্তা ভোক্তাভিমানী’—এটা জানতে হবে যে, সেই অহংকার হচ্ছে ‘আমি কর্তা’, ‘আমি ভোক্তা’—এই অভিমানযুক্ত।)




১৩. কোমলচিত দীনন্‌হপর দায়া
মনবচ ক্রম মম ভগতি অমায়া।।
সবহিঁ মানপ্রদ আপু অমানী
ভরতপ্রানসম মম তেঁ প্রানী।।
অর্থ: যার চিত্ত কোমল; দীনজনের প্রতি দয়া আছে; মন, বাক্য ও কর্মে আমার প্রতি (ভগবানের প্রতি) মায়াহীন (কৃত্রিমতাবর্জিত বা শুদ্ধ) ভক্তি স্পষ্ট; সকলকে সম্মান দান করে এবং নিজে অভিমানশূন্য—হে ভরত, এমন ব্যক্তি আমার প্রাণের সমান প্রিয়।




১৪. বিগতকাম মম নাম পরায়ন
সান্তি বিরতি বিনতী মুদিতায়ন।।
সীতলতা সরলতা মইত্রী
দ্বিজ-পদ-প্রীতি-ধরমজনয়িত্রী।।
অর্থ: সে (ব্যক্তি) কামনারহিত ও আমার নামপরায়ণ (আমার নাম উচ্চারণে ও শ্রবণে শান্তি পায়); সে (ব্যক্তি) শান্তি, (বিষয়ে বা ভোগেচ্ছায়) বিরক্তি, নম্রতা ও প্রসন্নতার আধারস্বরূপ; এবং শীতলতা, সরলতা, মৈত্রী ও ধর্মের ভাবোৎপাদক (যে-কোনো) ব্রাহ্মণের চরণে প্রীতিসম্পন্ন। (অর্থাৎ একজন প্রকৃত ব্রাহ্মণ সেই ব্যক্তির গুণসমূহকে প্রীতির সাথে দেখেন।)
১৫. যে সব লচ্ছন বসহিঁ জাসু উর
জানহু তাত সন্ত সন্তত ফুর।।
সম দম নিয়ম নীতি নহিঁ ডোলহিঁ
পুরুষবচন কবহুঁ নহিঁ বোলহিঁ।।
অর্থ: হে তাত (পুত্রতুল্য ব্যক্তিকে স্নেহসম্বোধন), এসব লক্ষণ যার হৃদয়ে প্রকাশিত হয়েছে, তাকে সবসময় সাধু পুরুষ বলে জানবে। যে শম (অন্তরিন্দ্রিয়ের নিগ্রহ বা বাসনার নিবৃত্তি), দম (বহিরিন্দ্রিয়ের নিগ্রহ বা আত্মসংযম) নিয়ম ও নীতি কখনও লঙ্ঘন করে না, কখনও কঠোর বাক্য বলে না,




১৬. (দোঁহা) নিন্দা অস্তুতি উভয় সম মমতা মম পদকঞ্জ।
তে সজ্জন মম প্রাণপ্রিয় গুণমন্দির সুখপুঞ্জ।।
অর্থ: নিন্দা ও স্তুতি দুই-ই যার পক্ষে সমান (প্রশংসা ও নিন্দা যাকে বিচলিত করে না) এবং আমার চরণকমলে যার মমতা—সেই গুণধাম ও সুখস্বরূপ (গুণের আশ্রয় এবং যাকে দেখলেও সুখের অনুভূতি জন্মে) সজ্জন আমার প্রাণের মতো প্রিয়।




১৭. সন্ত সহহিঁ দুখ পরহিত লাগি
পর-দুখ হেতু অসন্ত অভাগী।।
ভূরজ তরু সম সন্ত কৃপালা
পরহিত নিত সহ বিপতি বিসালা।।
অর্থ: সজ্জন অপরের হিতের জন্য দুঃখ সহ্য করেন আর হতভাগ্য দুষ্ট লোক অপরের দুঃখের কারণ হয়ে থাকে। দয়ালু সাধুপুরুষ পৃথিবীর ধূলি ও বৃক্ষের মতো প্রতিদিন অপরের হিতের জন্য দারুণ বিপত্তি সহ্য করেন। (বিনম্র ধূলির উপর দিয়ে কত ঝড় বয়ে যায়, গাছ নীরবে কেমন সকল আঘাত সহ্য করেও অবিচল থাকে—ঠিক তেমনি।)




১৮. বড়ে ভাগ পাইয় সতসঙ্গা
বিনহিঁ-প্রয়াস হোই ভবভঙ্গা।।
সন্তপন্থ অপবর্গকর কামী ভব কর পন্থ
কহহিঁ সন্ত কবি-কোবিদ শ্রুতি পুরাণ সদ্‌গ্রন্থ।।
অর্থ: বড়ো ভাগ্যবশতই সৎসঙ্গ মেলে এবং এতে বিনা প্রয়াসেই সংসারবন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। (মানুষ মানসিকভাবে মুক্তি বা মোক্ষলাভ করে নিজেকে নির্ভার অনুভব করে।) সন্তজন, কবি ও পণ্ডিতগণ বলেন, বেদ-পুরাণ আদি উত্তম গ্রন্থে কথিত আছে যে, সৎসঙ্গ মোক্ষদায়ক (ঈশ্বরের প্রতি অনন্য ভক্তি উৎপাদক) ও কামী-জনের সঙ্গ-সংসার যন্ত্রণাদায়ক। (যার ভেতরে ভোগেচ্ছা ও কামনা-বাসনা বেশি, তার সঙ্গ মানুষকে সারাক্ষণই যন্ত্রণার মধ্যে রাখে।)




সৎসঙ্গ (ভালো মানুষের সাহচর্য বা সাধুসঙ্গ) নিয়ে দু-একটি কথা:
১. তব হি হোই সব সংশয় ভঙ্গা
জব বহুকাল করিয় সত সঙ্গা।।
সুনিয় তহাঁ হরিকথা সুহাঈ
নানা ভান্তি মুনিন্‌হ জো গাঈ।।
জেহি মহুঁ আদি মধ্য অবসানা
প্রভু প্রতিপাদ্য রামু ভগবানা।।
অর্থ: যখন তুমি বহুকাল পর্যন্ত সৎসঙ্গ করবে, তখনই তোমার সমস্ত সন্দেহ দূর হবে। (ভালো সঙ্গে মিশলে তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে ভালো গুণের কথা জানা যায়, এবং সে অনুযায়ী কাজ করলে মন থেকে অনেক সংশয় কেটে যায়।) সেই সৎসঙ্গে ভগবানের মধুর কথা শুনতে হবে, মুনিগণ নানা প্রকারে তা গেয়েছেন এবং তার আদি, মধ্য ও অন্তে প্রতিপাদ্য একমাত্র প্রভু ভগবান রামচন্দ্রই। (ভগবানের গুণ বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার মধ্য দিয়ে ভগবানের তথা চৈতন্যের কাছাকাছি পৌঁছনোর রাস্তা চেনা যায়। সেই রাস্তার শুরুতে, মাঝে, শেষে এক ভগবান বা ব্রহ্ম‌ই অবস্থান করেন। উপনিষদেও ব্রহ্মজ্ঞানলাভের উপায় হিসেবে বিভিন্ন আগমশাস্ত্র অধ্যয়নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।)




২. নিত হরিকথা হোতি জহঁ ভাই
পঠবউ তহাঁ সুনহু তুমহ্ জাই।
জাইহি সুনত সকল সন্দেহা
রাম চরন হোইহি অতিনেহা।।
অর্থ: হে ভাই, যেখানে নিত্য হরিকথার প্রসঙ্গ হয়, সেখানে তোমাকে পাঠাই; তুমি সেখানে গিয়ে শোনো, শুনলেই সকল সন্দেহ দূর হবে এবং রাম-চরণে অত্যন্ত ভক্তি হবে। (ভালো থাকার জন্য ভালো সঙ্গে মিশতে হয়। ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা পাবার জন্য ভালো কাজ করেন, এমন লোকের সাথে মিশতে হয়। ঈশ্বরের দর্শন লাভ করার জন্য তাঁর পথের পথিকদের সাথে মিশতে হয়।)




৩. (দোঁহা) বিনু সৎসঙ্গ ন হরিকথা তেহি বিনু মোহ ন ভাগ।
মোহ গয়ে বিনু রামপদ হোই ন দৃঢ় অনুরাগ।।
অর্থ: সৎসঙ্গ ব্যতীত হরিকথা-প্রসঙ্গ মেলে না এবং ভগবানের কথা না শুনলে মোহ দূর হয় না; এবং মোহ দূর না হলে রামপদে দৃঢ় অনুরাগও হয় না। (নিজের ভেতর থেকে কালিমা, ভ্রান্তি, সংশয় দূর করতে চাইলে ব্রহ্মজ্ঞান লাগে। সেই জ্ঞানের পথিকদের কাছ থেকে বিজ্ঞান তথা ব্রহ্মত্বের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করতে হবে এবং সেই পথে চললে ধীরে ধীরে মনের সমস্ত দ্বিধা ও জড়তা কেটে যাবে। মোহ ও ভ্রান্তি দূর হলেই জ্ঞানের উৎপত্তি হয় এবং তার পরে ভক্তি ক্রমশ দৃঢ় হয়ে ওঠে।)