শ্রীরামের পদপ্রান্তে (৫ম ভাগ)

#রাম_নবমী
অসন্ত বা অসাধুর লক্ষণ:




১. খলন্‌হ হৃদয় অতি তাপ বিসেখী
জরহিঁ সদা পরসম্পতি দেখী।।
জহ কহুঁ নিন্দা সুনহিঁ পরাঈ
হরষহিঁ মনহু পরীনিধি পাঈ।।
অর্থ: দুষ্টের হৃদয় অনন্ত তাপের আধার—সে পরের সম্পত্তি (সমৃদ্ধি) দেখে সারাক্ষণই জ্বলে; যদি কখনো পরের নিন্দা শোনে, অমনিই তখন তার মনে এমন হর্ষ হয় যেন (হঠাৎ) কিছু ধন মিলে গেল!




২. সন ইব খল পরবন্ধন করঈ
খাল কঢ়াই বিপতি সহি মরঈ।।
খল বিনু স্বারথ পর অপকারী
অহি মূষক ইব সুনু ঊরগারি।।
অর্থ: দুষ্ট লোক শনপাটের মতো অপরকে বেঁধে ফেলে এবং নিজের চামড়া টেনে-ছিঁড়ে (হলেও) বিপদ সহ্য করে মরে যায়। হে গরুড় (পৌরাণিক বৃহৎ পাখি—ভগবান বিষ্ণুর বাহন), শোনো, সাপ ও ইঁদুরের মতো, দুষ্টলোক নিজের কোনো স্বার্থ না থাকলেও অন্যের অপকার করে। (অন্যের বিপদেই তার সকল আনন্দ।)




৩. পরসম্পদা বিনাসি নসাহীঁ
জিমি সসি হতি হিম উপল বিলাহী।।
দুষ্ট হৃদয় জগত আরত হেতু
জথা প্রসিদ্ধ অধম গ্রহ কেতু।।
অর্থ: দুষ্টলোক অপরের সম্পত্তি বিনাশ করে (ক্ষতিসাধন করে) নিজেও ধ্বংস হয়ে যায়—যেমন ক্ষেতের শস্য নষ্ট করে শিলা (বৃষ্টিরূপে পতিত বরফখণ্ড) নিজেও গলে যায়। দুষ্টের হৃদয় সংসারে দুঃখের (আর্তির বা পীড়ার) কারণ—যেমন নীচ গ্রহ কেতুর কথা বিখ্যাত।
(হিন্দুপুরাণ অনুসারে, সমুদ্রমন্থনের সময় রাহু (স্বরভানু) নামক এক অসুর লুকিয়ে দিব্যঅমৃতের কয়েক ফোঁটা পান করে। সূর্য ও চন্দ্রদেব তাকে চিনতে পেরে মোহিনী অবতাররূপী ভগবান বিষ্ণুকে জানায়। তৎক্ষণাৎ, অমৃত গলাধঃকরণের পূর্বেই ভগবান বিষ্ণু নিজের সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে রাহুর ধড় থেকে মুণ্ডু ছিন্ন করে দেন। অমৃত পানের জন্য মুণ্ডুটি অমরত্ব লাভ করে এবং এভাবেই রাহু গ্রহটির উৎপত্তি হয়; বাকি মুণ্ডুহীন দেহটির নাম হয় কেতু। সূর্য ও চন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষের কারণে বছরের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাহু এদেরকে গ্রাস (গ্রহণ) করে ফেলে। কিন্তু এই গ্রহণের পর সূর্য ও চন্দ্র রাহুর কাটা গ্রীবা থেকে আবার বেরিয়ে আসে।)




৪. কাম ক্রোধ মদ লোভ পরায়ন
নির্দয় কপটী কুটিল মলায়ন।।
বয়রূ অকারন সব কাহুসোঁ
জোকর হিত অনহিত তাহূ সো।।
অর্থ: সে (অসাধু ব্যক্তিটি) কাম, ক্রোধ, মদ ও লোভে আসক্ত, নির্দয়, কপট, কুটিল ও পাপের আধারস্বরূপ, কারণ ছাড়াই সকলের প্রতি বৈরভাব (শত্রুতা) করে এবং যে (ব্যক্তি) (অন্যের) হিত (উপকার) করে, তারও অহিত (ক্ষতি) সাধন করে থাকে।




৫. ঝুটই লেনা ঝুটই দেনা
ঝুটই ভোজন ঝুট চবেনা।।
বোলহিঁ মধুরবচন জিমি মোরা
খাহিঁ মহাঅহি হৃদয় কঠোরা।।
অর্থ: বৃথা তার গ্রহণ, বৃথা তার দান, বৃথা তার ভোজন, বৃথাই চাবান (চিবোনো তথা খাদ্যগ্রহণ)—সে (অসাধু ব্যক্তি) মধুর বাক্য বলে থাকে—যেমন ময়ূর; কিন্তু সে বড়ো বড়ো সাপ খায় এবং তার হৃদয় বড়োই কঠোর।




৬. (দোঁহা) পরদ্রোহী পর দার রত পরধন পর অপবাদ।
তে নর পাঁবর পাপময় দেহ ধরে মনুজাদ।।
অর্থ: সে পরদ্রোহী (পরের অনিষ্টকারী), পরস্ত্রীতে আসক্ত, পরধন অভিলাষী এবং পরের নিন্দাতেই লেগে থাকে; সেই নীচ লোক বস্তুত রাক্ষসই এবং পাপময় দেহ ধারণ করে থাকে।




৭. লোভই ওঢ়ন লোভই ডাসন
সিস্নোদর পর জম পুর ত্রাস ন।।
কাহু কৈ জৌঁ সুনহিঁ বড়াঈ
শ্বাস লেহি জনু জূড়ী আঈ।।
অর্থ: লোভই তার চাদর, লোভই তার বিছানা; ইন্দ্রিয়সুখ ও পেটের জন্যই সে ব্যস্ত থাকে, তার যমপুরীর ভয় নেই। কারও কোনো প্রশংসা শুনলে সে এমনভাবে শ্বাস নেবে যেন জ্বর আসছে।




৮. জব কাহু কৈ দেখহি বিপত
সুখী ভয়ে মানহুঁ জগন্‌পতী।।
স্বারথরত পরিবার বিরোধী
লম্পট কাম লোভ অতিক্রোধী।।
অর্থ: সে (অসাধু ব্যক্তি) যখন কারও বিপদ দেখে, তখন সুখী হয় এবং মনে করে যেন সে জগতের রাজা হয়ে গেছে। সে স্বার্থপরায়ণ, পরিবারের বিরোধী, লম্পট, কামী, লোভী ও অত্যন্ত ক্রুদ্ধ স্বভাবের।




৯. মাতু পিতা গুরু বিপ্র ন মানহিঁ
আপু গয়ে অরু ঘালহিঁ আনহি।।
করহিঁ মোহবস দ্রোহ পরাবা
সন্ত সঙ্গ হরিকথা ন ভাবা।।
অর্থ: মাতা, পিতা, গুরু, ব্রাহ্মণ কাউকেই সে মানে না, নিজে তো (বিনষ্ট হয়ে) গেছেই, অপরকেও নাশ করে, মোহবশত (ভ্রান্ত ধারণায় বা খেয়ালের বশে) অপরের দ্রোহ (ক্ষতি) করে এবং সাধুসঙ্গ ও ভগবানের কথা সে ভাবে না।




১০. অবগুনসিন্ধু মন্দমতি কামী
বেদবিদূষক পরধন স্বামী।।
বিপ্রদ্রোহ সুরদ্রোহ বিসেষা
দম্ভ কপট জিয় ধরে সুবেষা।।
অর্থ: সে অবগুণের (দোষের) সাগর—মন্দবুদ্ধি, কামী (লোভী); সে বেদের (ধর্মের) কথায় উপহাস করে এবং পরধন অধিকার করে। তার মধ্যে বিশেষ মাত্রায় (গীতার দর্শন অনুযায়ী) ব্রাহ্মণ ও দেবতা (একটি প্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত শক্তি, যা স্বর্গীয় বা পবিত্র বলে বিবেচিত) দ্রোহ (ক্ষতি করার চেষ্টা) দেখা যায় এবং তার হৃদয়ে দাম্ভিকতা ও কপটতা, কিন্তু সে বাইরে সুন্দর বেশ (ছদ্মবেশ) পরিধান করে থাকে।




১১. (দোঁহা) ঐ সে অধম মনুজ খল কৃতজুগ ত্রেতা নাহিঁ।
দ্বাপর কছুক বৃন্দ বহু হোইহহিঁ কলিজুগ মাহিঁ।।
অর্থ: ওই প্রকার নীচ এবং দুষ্ট লোক সত্য ও ত্রেতা যুগে দেখা যায় না। কিছু দ্বাপর যুগে দেখা যায়, কিন্তু কলিযুগে ওইরকম লোক দলে দলে অসংখ্য হবে।




১২. পরহিত সরিস ধরমু নহিঁ ভাঈ
পরপীরা সম নহিঁ অধমাঈ।।
নিরনয় সকল পুরান বেদকর
কহেউঁ তাত জানহিঁ কোবিদ নর।।
অর্থ: হে ভাই, পরোপকারের মতো ধর্ম নেই, আর অন্যকে পীড়া (কষ্ট) দেবার মতো নীচতাও আর নেই। হে তাত, আমি এ সমস্ত‌ই বেদ ও পুরাণের সিদ্ধান্ত বলেছি, এটা বুদ্ধিমান লোকই জানতে পারে।




১৩. নর সরীর ধরি জে পরপীরা
করহিঁ তে সহহিঁ মহাভবভীরা।।
করহিঁ মোহবস নর অঘ নানা
স্বারথরত পরলোক নসানা।।
অর্থ: মানুষের শরীর ধারণ করে যে পরপীড়া দেয়, তাকে সংসারে ভয়ানক বন্ধনজনিত দুঃখ সহ্য করতে হয় (সে মোক্ষলাভ করতে পারে না)। যে মোহবশে স্বার্থপর হয়ে নানা প্রকারের পাপ করে থাকে, তার পরলোক তো নষ্ট হয়ই (সে নরকগামী হবেই হবে)।




১৪. (দোঁহা) জীবনমুক্ত ব্রহ্মপর চরিত সুনহিঁ তজি ধ্যান।
জে হরি কথা ন করহি রতি তিনহ্‌কে হিয় পাষান।।
অর্থ: জীবন্মুক্ত (জীবদ্দশাতেই মায়ার বন্ধন মুক্ত, অর্থাৎ আত্মতত্ত্বজ্ঞ—যে-ব্যক্তি সম্পূর্ণ আত্মজ্ঞান ও আত্ম-উপলব্ধি লাভ করেছেন এবং কৈবল্য বা মোক্ষ (মুক্তি) অর্জন করেছেন) ও ব্রহ্মপরায়ণ ব্যক্তি নিজের ধ্যানাদি ত্যাগ করেও সেই চরিত্র শুনে থাকেন (এবং তাকে ভালো পথে ফেরানোর জন্য সদুপদেশ প্রদান করে থাকেন)—সেই হরিকথায় যার প্রীতি হয় না, তার হৃদয় পাথরের মতো কঠিন।




(যাঁদের বুদ্ধি ব্রহ্মনিষ্ঠ, ব্রহ্মে যাঁদের আত্মভাব, ব্রহ্মে যাঁদের স্থিতি, যাঁরা ব্রহ্মপরায়ণ, ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা যাঁদের সমস্ত পাপ ও পুণ্য বিধৌত হয়েছে, তাঁরা মোক্ষ লাভ করেন, তাঁদের আর পুনর্জন্ম হয় না।~~গীতা, ৫/১৭)




এখন দেখা যাক, রাম কে।




যাজ্ঞবল্ক্যের প্রতি ভরদ্বাজের প্রশ্ন:




১. এক রাম অবধেসকুমারা
তিহ্ন কর চরিত বিদিত সংসারা।।
নারি বিরহ দুখ লহেউ অপারা
ভয়উ রোষ রন রাবন মারা।।
অর্থ: এক রাম তো অযোধ্যার রাজার পুত্র, তাঁর চরিত্র সংসারে প্রসিদ্ধ। তিনি স্ত্রীর বিরহে অপার দুঃখ পেয়েছিলেন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে রাবণকে মেরেছিলেন।




২. (দোঁহা) প্রভু সোই রাম কি অপর কোউ
জাহি জপত ত্রিপুরারি।
সত্যধাম সরবগ্য তুম্‌হ
কহহু বিবেক বিচারি।।
অর্থ: হে প্রভো, আপনি সত্যধাম (সত্যের ঠিকানা বা আশ্রয়) এবং সর্বজ্ঞ, আপনার জ্ঞানে বিচার করে বলুন, শিব যাঁর নাম জপ করেন, তিনিই কি সেই রাম, না কি অন্য কেউ?




৩. (দোঁহা) অতি বিচিত্র রঘুপতিচরিত জানহি পরম সুজান।
জে মতিমন্দ বিমোহবস হৃদয় ধরহি কছু আন।।
অর্থ: রামচন্দ্রের চরিত্র অত্যন্ত বিচিত্র, পরম চতুর (জ্ঞানী, বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান) লোকই তা জানতে পারে। যে হীনবুদ্ধি এবং মোহের বশীভূত, সে হৃদয়ে এটা (প্রকৃত চরিত্র) হতে অন্য কিছু বলে ধারণা করে।




৪. (দোঁহা) ব্রহ্ম জো ব্যাপক বিরজ অজ অকল অনীহ অভেদ
সো কি দেহ ধরি হোই নর জাহি ন জানত বেদ।।
অর্থ: যে-ব্রহ্ম সর্বব্যাপী (সর্বত্র বিদ্যমান), জন্মরহিত, মায়াহীন (নিত্য ও বিকারশূন্য), কলারহিত (অখণ্ড), (কর্মফলে) ইচ্ছাশূন্য এবং ভেদরহিত এবং যাঁকে বেদও (কোনো আগমশাস্ত্র‌ও) জানতে পারে না, তিনি কি দেহ ধারণ করে মানুষ হতে পারেন?
(আমি জন্ম বিরহিত, অনশ্বর (অবিনাশী, অক্ষয়), সর্বভূতের ঈশ্বর হয়েও আত্মমায়া (নিজের মায়া বা যোগমায়া) বশে আবির্ভূত হই।~~গীতা, ৪/৬)
(ব্রহ্মের স্বজাতীয়, বিজাতীয় কিংবা স্বগত ভেদ নেই। সমজাতীয় দুটি বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে যে-ভেদ, তা স্বজাতীয় ভেদ; যেমন একটি বৃক্ষের সঙ্গে অন্য এক বৃক্ষের ভেদ। দুটি ভিন্নজাতীয় বস্তু বা ব্যক্তির মধ্যে যে-ভেদ, তা বিজাতীয় ভেদ; যেমন একটি বৃক্ষের সঙ্গে পর্বতের ভেদ। একই বস্তু বা ব্যক্তির অন্তর্গত বিভিন্ন অংশের মধ্যে যে-ভেদ, তা স্বগত ভেদ; যেমন একটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা এবং পত্র-পুষ্পের মধ্যে ভেদ। ব্রহ্ম এই তিনপ্রকার ভেদরহিত।)




৫. বিষ্ণু জো সুরহিত নরতনুধারী
সোউ সর্বগ্য জথা ত্রিপুরারী।।
খোজই সো কি অগ্য ইব নারী
গ্যানধাম শ্রীপতি অসুরারী।।
অর্থ: ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের কল্যাণের জন্য নরদেহ ধারণ করেছেন (রামচন্দ্র ভগবান বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম), শিবের মতোই তিনি সর্বজ্ঞ মহাজ্ঞানী, লক্ষ্মীপতি এবং অসুরের শত্রু—তিনি কি অজ্ঞানীর মতো স্ত্রীকে খুঁজবেন?




৬. মুনিধীর জোগী সিদ্ধ সন্তত বিমল মন জেহি ধ্যাবহী।
কহি নেতি নিগম পুরাণ আগম জাসু কীরতি গাবহীঁ।
সোই রাম ব্যাপক ব্রহ্ম ভুবন নিকায় পতি মায়াধনী।
অবতরেউ অপনে ভগতহিত নিজতন্ত্র নিত রঘুকুলমণি।।
অর্থ: ধীর মুনি, যোগী এবং সিদ্ধগণ সর্বদা নির্মল মনে যাঁর কীর্তি ও যশ গান করে থাকেন, সেই ব্যাপক (বিরাট) ব্রহ্ম সমস্ত ভুবনের পতি এবং মায়াধীশ (সকল মায়ার নিয়ন্ত্রণকারী) রাম নিজের ভক্তগণের কল্যাণের জন্য নিজেই রঘুকুলমণিস্বরূপ (রঘু হচ্ছেন রামের প্রপিতামহ) অবতার গ্রহণ করিয়েছেন। (এ তাঁর বিচিত্র লীলার‌ই অংশমাত্র; তিনি ইচ্ছে করেই, অবতাররূপে অবতীর্ণ হবার জন্য‌ই রঘুবংশে জন্ম নিয়েছেন।)




৭. ভয়ে প্রগট কৃপালা পরমদয়ালা কৌশল্যা হিতকারী।
হরষিত মহতারি মুনি মন হারী অদভূতরূপ বিচারি।।
লোচন অভিরামং তনুঘন স্যামং নিজ আয়ূধভুজ চারী।
ভূষণ বনমালা নয়ন বিসালা সোভাসিন্ধু খরারী।।
অর্থ: কৌশল্যার হিতকারী অত্যন্ত দয়ালু কৃপালু ভগবান প্রকটিত হলেন। মুনিগণের মনহরণকারী অদ্ভুত রূপ (যে-রূপে ধ্যানী মুনিগণের‌ও ধ্যান ভেঙে যায়) দেখে মাতা হর্ষিত (পুলকিত) হলেন। সুন্দর চোখ, মেঘের মতো শ্যাম (ঘননীল, মেঘবর্ণ) শরীর এবং চারিবাহুতে (চতুর্ভুজ মূর্তি—চারটি হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মধারী মূর্তিরূপ) নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র ছিল। তিনি অলংকার ও বনমালা (বিবিধ ফুলের আজানুলম্বিত—দেহের উপরদিক থেকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বা প্রসারিত—মালা) ধারণ করেছিলেন। তাঁর চোখ বিশাল ছিল এবং খর (তীব্র বা প্রবল বা নিষ্ঠুর) অসুরের শত্রু রাম শোভার (সৌন্দর্যের) সাগর ছিলেন।




৮. কহ দুই কর জোরী অস্তুতি তোরী কেহি বিধি করউঁ অনন্তা।
মায়া-গুন-জ্ঞানাতীত অমানা বেদ পুরান ভনন্তা।।
করুনা-সুখ-সাগর সব-গুন-আগর জহি গাবহি স্রুতি সন্তা।
সো মম হিত লাগী জন অনুরাগী ভয়উ প্রগট শ্রীকন্তা।।
অর্থ: জোড়হাতে মা (কৌশল্যা) বললেন, হে অনন্ত, তোমার স্তুতি কীভাবে করব? তুমি মায়া, গুণ, জ্ঞান ও পরিমাণের অতীত (পুরুষ বা ব্রহ্ম)—বেদ (জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদ) ও পুরাণ এই কথাই বলে। তুমি করুণা-সুখের সাগর, সমস্ত গুণের ভাণ্ডার—এটা বেদ (শাস্ত্র) ও সন্তজন গেয়ে থাকেন। তুমি সেই (সকল) ভক্তজনের প্রিয়কারী লক্ষ্মীপতি, তুমি আমার কল্যাণের জন্য আবির্ভূত হয়েছ।




৯. ব্রহ্মাণ্ড নিকায়া নির্মিত মায়া রোম রোম প্রতি বেদ কহৈ।
মম উর সো বাসী যহ উপহাসী সুনত ধীরমতি থির ন রহৈ।।
উপজা জব জ্ঞানা প্রভু মুসুকানা চরিত বহুত বিধি কীহ্ন চহৈ।
কহি কথা সুহাই মাতু বুঝাই জেহি প্রকার সুত প্রেম লহৈ।।
অর্থ: বেদ (উপনিষদ ভাগ) বলছেন—তোমার মায়ায় রচিত সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তোমার প্রত্যেক রোমে রয়েছে। সেই তুমি আমার গর্ভে রয়েছিলে—এই হাসির (অবিশ্বাস্য) কথা শুনে ধীর ব্যক্তিরও বুদ্ধি স্থির থাকে না। মায়ের (কৌশল্যার) যখন জ্ঞান হলো, তখন প্রভু ঈষৎ (অল্প) হাসলেন, কেননা তিনি অনেক প্রকারে (নিজের) চরিত্র বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। প্রভু রামচন্দ্র সুন্দর সুন্দর কথা বলে মাকে এমন করে বোঝালেন যাতে মায়ের হৃদয়ে পুত্র-প্রেম জন্মে।




১০. মাতা পুনি বোলী সো মতি ডোলী তজহু তাত যহ রূপা।
কীজিয় সিসু লীলা অতি প্রিয় সীলা যহ সুখ পরম অনূপা।।
সুনি বচন সুজানা রোদন ঠানা হোই বালক সুর-ভূপা।
যহ চরিত জে গাবহিঁ হরিপদ পাবহিঁ তে ন পরহি ভবকূপা।।
অর্থ: মায়ের সেই (তখন) বুদ্ধি বিচলিত হলো, তিনি আবার বললেন, হে তাত (পুত্রতুল্য ব্যক্তিকে স্নেহ-সম্বোধন), এই রূপ ত্যাগ করো এবং অত্যন্ত আনন্দ-বৃদ্ধিকর শিশুলীলা করো—এই সুখ অত্যন্ত অনুপম। এই কথা শুনে দেবতাদের রাজা সুজান (জ্ঞানী) ভগবান বালক হয়ে রোদন (কান্না) করতে লাগলেন। এই চরিত্র যে গান করবে (এই চরিত্রের মাহাত্ম্য যে বর্ণনা করবে), সে হরিপদ (ভগবানের কৃপা) লাভ করবে এবং সংসাররূপ কূপে কখনও পড়বে না। (সংসারের মায়াজালে কখনও বিভ্রান্ত হবে না, সমদর্শী হয়ে জীবন কাটাতে পারবে।)




১১. (দোঁহা) বিপ্র-ধেনু-সুর-সন্ত হিত
লীহ্ন মনুজ অবতার।
নিজ-ইচ্ছা-নির্মিত-তনু
মায়া-গুন-গো-পার।।
অর্থ: মায়া, গুণ (সত্ত্বসমূহ—ধার্মিকতা, ইতিবাচকতা, সত্য, শান্ততা, ভারসাম্য, শান্তিপূর্ণতা ও মহত্ত্ব) ও ইন্দ্রিয়াদির অতীত ভগবান আপন ইচ্ছায় শরীর ধারণ করে ব্রাহ্মণ, গো, দেবতা ও সজ্জনগণের হিতের জন্য (রামরূপে) মনুষ্য অবতার গ্রহণ করলেন।




১২. (দোঁহা) ব্যাপক ব্রহ্ম নিরঞ্জন
নির্গুন বিগত বিনোদ।
সো অজ প্রেম-ভগতিবস
কৌসল্যা কে গোদ।।
অর্থ: যিনি ব্যাপক (বিরাট) ব্রহ্ম, নিরঞ্জন (কৃষ্ণ ও শিবের উপাধি, যার অর্থ দাগহীন বা যিনি নিষ্কলঙ্ক ও বিশুদ্ধ), নির্গুণ (ত্রিগুণাতীত, অর্থাৎ সত্ত্ব (ভালোত্ব, শান্তভাব, বৈরিতামুক্তি), রজঃ বা রজস (গভীর আসক্তি, সক্রিয়তা, গতিশীলতা), তমঃ বা তমস (অজ্ঞতা, জড়তা, আলস্য)—এই তিন বৈশিষ্ট্য বা গুণের প্রভাব বা মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত) এবং হর্ষশোকরহিত (যাঁর আনন্দ বা দুঃখের অনুভূতি নেই) সেই জন্মরহিত (পুরুষ) ঈশ্বর (ব্রহ্ম) প্রেম-ভক্তির বশীভূত হয়ে কৌশল্যার কোলে র‌ইলেন।




১৩. রামু ব্রহ্ম-পরমারথরূপা
অবিগত অলখ অনাদি অনূপা।
সকল বিকার-রহিত গত-ভেদা
কহি নিত নেতি নিরূপহি বেদা।।
অর্থ: রাম—ইনি পরমপুরুষ তথা চৈতন্য তথা পরমাত্মা তথা পরমদ্রষ্টা তথা ব্রহ্ম, পরমপদার্থস্বরূপ, ব্যাপক, অলক্ষ্য (অদৃশ্য, অরূপ), অনাদি (স্বয়ম্ভু), অনুপম (তুলনা বা উপমাহীন), সমস্ত বিকারশূন্য এবং ভেদরহিত। বেদ (উপনিষদ) ‘নিত্য’ ও ‘নেতি’ (বৃহদারণ্যকোপনিষদোক্ত বৈদিক বিশ্লেষণের ‘নেতি নেতি’ পদ্ধতি, যা অনন্তের পথনির্দেশক) বলে তাঁর স্বরূপ নির্ণয় করে থাকে।