শ্রীরামের পদপ্রান্তে (৩য় ভাগ)

#রাম_নবমী
গোস্বামী তুলসীদাসজির রামচরিতমানস সরোবরে অসংখ্য মণিমাণিক্য ছড়িয়ে রয়েছে। যাঁরা ডুব দিতে পেরেছেন, তাঁরা রত্নের সন্ধান পেয়েছেন। আমি এ লেখায় কিছু মণি সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র, তাতে যথেষ্ট ত্রুটি থাকলেও মণিসমূহ নিজের দীপ্তিতেই উজ্জ্বল। যদি এর গায়ে শৈবাল কিংবা আবর্জনার মতো কিছু দেখাও যায়, তবে তা অবান্তর এবং মণির সাথে সম্পর্কহীন জেনে সরিয়ে নিতে হবে।




তুলসীদাসজি তাঁর লেখায় গ্রামের প্রচলিত ভাষার প্রয়োগ করেছেন, গ্রন্থের ভাষা সব জায়গায় শুদ্ধ হিন্দি নয়, “কা ভাষা কা সংস্কৃত, প্রেম চাহিয়ে সাঁচ” (দোঁহাবলী)। এর মধ্যে গ্রামের ভাষা বেশি হলেও সংস্কৃত, ভোজপুরী, অযোধ্যা অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা, ব্রজভাষা ইত্যাদি মিশ্রিত রয়েছে; তবে প্রধানত এটা অযোধ্যারই ভাষা—”গিরা গ্রাম সিয়রাম জস, গাবহিঁ সুনহিঁ সুজান।”




গোস্বামীজির ভাষায় ‘শ্রী’ শব্দটি বাদে ‘শ’-এর প্রয়োগ নেই। ‘ষ’ সবখানে ‘খ’-এর জায়গায় লেখা হয়েছে। ‘অমৃত’ শব্দ ‘অমিঅ’, এমন দেখা যায়। ‘জ্ঞ’ শব্দের স্থানে ‘গ্য’ এবং ‘ক্ষ’-এর জায়গায় ছ, চ্ছ বা ষ লেখা দেখা যায়। সংযুক্তাক্ষরের প্রয়োগ তাঁর ভাষায় কম, যথা ধরম, পরতীতি, সহসসীসু ইত্যাদি। ‘ণ’-এর প্রযোগ নেই—’ন’ দ্বারা তার কাজ চালিয়ে নিয়েছেন। ‘লক্ষ্মণ’ শব্দটি অধিকাংশ স্থানেই ‘লষন’, এমন লিখেছেন। একবচনান্ত অ-কারান্ত শব্দ কর্মকারকে তার শেষে অযোধ্যায় প্রায়ই উকারের আদেশ (প্রয়োগ) হয়, যেমন সমাজু, রাজু, বিচারু করমু, ধরমু, সুজসু ইত্যাদি; রামচরিতমানসেও সেরূপ প্রয়োগ দেখা যায়।




অন্ত্যস্থ ব-এর উচ্চারণ ‘ওয়’-এর মতো। ব স্থানে উ-এর ব্যবহারও আছে, যেমন প্রভাউ, সুতন্ত্র। স-এর উচ্চারণ ইংরেজি ‘s’-এর মতো। ‘জ’-এর উচ্চারণ করতে হলে ‘য’ না হয়ে ‘জ’ ব্যবহৃত আছে, যেমন জম = যম, জুগ = যুগ। ‘য’-এর উচ্চারণ ‘ইয়’, এমন হয়ে থাকে; য়হ = ইহা (এটা)। য়-এর স্থানে ই ব্যবহৃত হতেও দেখা যায়, যেমন সহাই = সহায়। র ও ল সময়ে সময়ে অভেদ রূপে ব্যবহৃত হয়। ম স্থানে বঁ-এর ব্যবহার আছে, যেমন পাবঁর। ই, ঈ এবং উ, ঊ (মূল বর্ণ ও -কার দুই ধরনের) প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেকসময় প্রকৃত বানানের বিপরীত ব্যবহার দেখা যায়।




দোঁহা-চৌপাঈ ছন্দে পুরো ‘রামচরিতমানস’ লিখিত হয়েছে। তুলসীদাসজির ব্যবহৃত ভাষায় শব্দরূপ ও ধাতুরূপ লিখিত হিন্দি হতে কিছুটা পৃথক্ বলে বোঝার সুবিধার জন্য তার একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপরে উপস্থাপন করা হলো। এখন শ্লোক, দোঁহা ও চৌপাঈ নিয়ে বলছি:




শ্লোক দুই পঙ্‌ক্তিতে রচিত, প্রতিটি পঙ্‌ক্তি ‘পদ’ নামে পরিচিত। শ্লোক অনুষ্টুপ বা ত্রিষ্টুপ ছন্দে লেখা হয়। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা প্রভৃতি গ্রন্থে শ্লোকের ব্যবহার দেখা যায়। শ্লোকসমূহে গভীর দার্শনিক, নৈতিক, জ্ঞানমূলক বার্তা খুবই অল্প কথায় পরিপূর্ণরূপে নির্দিষ্ট গঠনে প্রকাশিত হয়।




গঠনগতভাবে দোঁহা একটি যুগ্মক বা যুগল, যা দুই পঙ্‌ক্তিতে রচিত; প্রতিটি পঙ্‌ক্তিকে ‘মিশ্র’ বলা হয়। দোঁহার পঙ্‌ক্তিদ্বয় সমান দৈর্ঘ্যের এবং খুবই সহজ ছন্দের। এতে দোঁহা মুখস্থ ও আবৃত্তি করা সহজ হয়। দোঁহাসমূহ সাধারণত হিন্দি, অযোধ্যার ভাষা, ব্রজভাষা, অপভ্রংশ ইত্যাদি কথ্যভাষায় লেখা হয়, যেখানে ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে। প্রাত্যাহিক জীবনের দার্শনিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, ধর্মীয় বিভিন্ন সূক্ষ্মদর্শি পরিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা, দোঁহাসমূহের প্রাণবন্ত চিত্র এবং রূপকের মধ্য দিয়ে খুবই সহজ-সাবলীল আঙ্গিকে প্রকাশ পায়। মধ্যযুগের কবীর, রহীম, তুলসীদাস প্রমুখ সন্তকবি দোঁহা সাহিত্যের সবচাইতে উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁদের দোঁহা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষকে সাহিত্য ও অধ্যাত্ম জগতে অনুপ্রাণিত করে আসছে।




চৌপাঈ হচ্ছে চার পঙ্‌ক্তির স্তবক, প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতেই নিজস্ব তাল ও লয় লক্ষণীয়। পঙ্‌ক্তি চারটি অভিন্ন দৈর্ঘ্যের না-ও হতে পারে, পদাংশেও হেরফের থাকতে পারে (যা শ্লোকে ও দোঁহাতে হয় না)। কাব্যিক দ্যোতনা সৃষ্টির সুযোগ চৌপাঈয়ে অবারিত। ভাবাবেগের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো আখ্যান বা পৌরাণিক, লোকজ, প্রচলিত কাহিনির নৈতিক আবহে ব্যাখ্যান‌ই চৌপাঈয়ের মূল উপজীব্য বিষয়। ভারতীয় মহাকাব্য, ভক্তিমূলক কবিতা ও লোকসংগীত সাহিত্যে চৌপাঈয়ের সার্থক প্রয়োগ সুখকর পঠনের অভিজ্ঞতা দেয়। চৌপাঈয়ে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা এমনভাবে দেওয়া হয় যে, পড়ার বা শোনার সময় মনে হয়, ঘটনাসমূহ যেন চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। কথ্যভাষায় রচিত বলে চৌপাঈয়ের ছন্দ আয়ত্ত করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সে কারণেই যুগের পর যুগ ধরে ভারতের লোক-ঐতিহ্য ও লৌকিক জ্ঞান মুখে মুখে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে ছড়িয়ে গেছে। ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাধনায় শ্লোক ও দোঁহার পাশাপাশি চৌপাঈয়ের স্থান‌ও অনেক উঁচুতে।




দোঁহা ও চৌপাঈয়ের প্রসঙ্গে ‘সুমিরন’ বলতে ঈশ্বরের নাম স্মরণ বা ধ্যান করার অনুশীলনকে বোঝায়। এটি আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি রূপ, যা প্রায়শই ভক্তিনির্ভর এবং সুখ ও দুঃখ উভয় সময়েই সান্ত্বনা খোঁজার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আসুন, ‘রামচরিতমানস’ গ্রন্থ থেকে ‘সুমিরন’ সম্পর্কিত কিছু চৌপাঈয়ের সাথে পরিচিত হ‌ই:




১. জেহি সুমিরত সিধি হোই
গননায়ক করিবর বদন।
করউ অনুগ্রহ সোই
বুদ্ধিরাসি সুভগুন সদন।।
অর্থ: যাঁকে স্মরণ করলে সিদ্ধিলাভ হয়, যিনি গজানন (যাঁর মুখ হাতির মতো), যিনি মহাবুদ্ধিমান এবং সদ্‌গুণধাম (সদ্‌গুণের পরম আশ্রয়), সেই (সিদ্ধিদাতা) গণেশ কৃপা করুন।




২. মূক হোই বাচাল পঙ্গু চঢ়ই গিরিবর গহন।
জাসু কৃপা সো দয়াল দ্রবউ সকল কলিমল দহন।।
অর্থ: যাঁর কৃপায় বোবাও বক্তা হয় এবং পঙ্গুও দুর্গম পাহাড়ে উঠতে পারে, সেই কলিযুগের সমস্ত পাপ নাশকারী দয়ালু (ভগবান) কৃপা করুন।




৩. কুন্দ-ইন্দু সম দেহ
উমারমন করুনা অয়ন।
জাহি দীন পর নেহ
করউ কৃপা মর্দন ময়ন।।
অর্থ: কুন্দ (জুঁই) ফুল ও (শারদীয় স্বচ্ছ) চাঁদের মতো যাঁর দেহ, যিনি পার্বতীর সাথে বিহার করেন, যিনি দয়ার আধার, দীনজনের প্রতি যাঁর স্নেহ এবং যিনি কামদেবকে (হিন্দুশাস্ত্রানুযায়ী প্রেমের দেবতা) ভস্ম করেছিলেন, তিনি (সেই শিব) দয়া করুন।




৪. বন্দ‌উঁ গুরুপদ কঞ্জ
কৃপাসিন্ধু নররূপ হরি।।
মহামোহ তমপুঞ্জ
জাসু বচন রবিকর নিকর।।
অর্থ: মহামোহ (অজ্ঞান বা অবিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞানের অভাব) রূপ অন্ধকারের নিকট যাঁর বাক্য সূর্যকিরণমালার (চৈতন্যের জাগরণ ঘটায় যা) মতো, যিনি দয়ার সাগর এবং যিনি মানুষ রূপধারী ভগবান, সেই গুরুর (ব্রহ্মজ্ঞানী তথা ব্রহ্ম) চরণকমল আমি বন্দনা করছি।




৫. বন্দ‌উঁ গুরুপদ পদুম পরগা
সুরুচি সুবাস সরস অনুরাগা।
অমিয় মূরিময় চূরন চারূ
সমন সকল-ভব-রুজ-পরিবারূ।।
অর্থ: গুরুর চরণকমলের (পাদপদ্মের) সুন্দর, সুগন্ধবহ, রসময় ও ভক্তিপূর্ণ রজের (ধূলির) বন্দনা করছি। সেই পদধূলি অমৃতের মূলময় (মূলস্বরূপ, অর্থাৎ অমৃতের উৎস) সুন্দর চূর্ণ; এটা দ্বারা (এটা প্রাপ্ত হলে) সংসারের সমস্ত রোগ (কষ্ট, সংশয়, অপ্রাপ্তি) নষ্ট হয়ে যায়।




৬. সুকৃত সম্ভুতন বিমল বিভূতী
মঞ্জুল মঙ্গল মোদ প্রসূতী।।
জনমন-মঞ্জু-মুকুর-মল-হরনী
কিয়ে তিলক গুনগন বসকরনী।।
অর্থ: (সেই পদরজ) শিবের শরীরের উজ্জ্বল বিভূতির সমান পবিত্র এবং তা সুন্দর কল্যাণ ও আনন্দ দান করে। এটি লোকের (ভক্তের) মনরূপ সুন্দর দর্পণের ময়লা (কালিমা) দূর করে এবং তার দ্বারা তিলক (চন্দন, মাটি ইত্যাদি দিয়ে কপাল, বাহু ইত্যাদিতে আঁকা চিহ্ন বা ফোঁটা) (ধারণ) করলে সমস্ত গুণ (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) বশীভূত (আয়ত্তাধীন) হয়ে যায়। (বিভূতি বা ভস্ম বা তিরুনিরু হলো পবিত্র ছাই, যা পোড়ানো-গোবর থেকে তৈরি হয় এবং আগমীয় বা শাস্ত্রবিহিত বিবিধ আচারে ব্যবহৃত হয়। [আগম—প্রথা, ‘যা এসেছে’])




৭. শ্রীগুরু পদ-নখমনিগন-জোতী
সুমিরত দিব্য দৃষ্টি হিয় হোতী।
দলন মোহ তম সো সুপ্রকাসূ
বড়ে ভাগ উর আবই জাসূ।।
অর্থ: শ্রীগুরুর পদ-নখরূপ মণি সকলের (হৃদয়ের) জ্যোতি, (যা) স্মরণ করামাত্রই হৃদয়ে দিব্যদৃষ্টির উদয় হয়। সেটি সুপ্রকাশিত হলে মোহ বা অজ্ঞানরূপ অন্ধকার দূর হয়ে যায়। যাঁর হৃদয়ে এটা (এই জ্যোতিস্বরূপ স্বয়ংপ্রকাশ বা ব্রহ্মের আলো তথা জ্ঞান) আসে, তাঁর বড়ো সৌভাগ্য। (তিনিও তখন ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী তথা ব্রহ্ম হয়ে যান।)




৮. উঘরহি বিমল বিলোচন হিয়ে কে
মিটহি দোষ-দুঃখ ভব রজনী কে।।
সূঝহি রাম-চরিত মনি মানিক
গুপুতঃ প্রগট জহঁজো জেহি খানিক।।
অর্থ: (রামচরিত্ররূপ মণিরত্নের প্রকাশে) হৃদয়ের নির্মল চোখ খুলে যায়, সংসাররূপ রাত্রির (যা মোক্ষলাভের পথে বাধা, তা-ই রাত্রি) দোষ ও দুঃখ মিটে (দূর হয়ে) যায়, রামচরিত্ররূপ মণিরত্ন (সব‌ পথই) দেখিয়ে দেয়—তা গুপ্ত থাকুক অথবা প্রকাশিত থাকুক অথবা কোনো খনিতেই (আড়াল) থাকুক।




সজ্জনের (সৎজনের/ভালো মানুষের) মাহাত্ম্যবর্ণনা:
১. সাধু চরিত সুভ সরিস কপাসূ
নিরস বিসদ গুণময় ফল জাসূ।।
জো সহি দুখ পরছিদ্র দুরাবা
বন্দনীয় জেহি জগ জসু পাবা।।
অর্থ: সাধুগণের চরিত্র কাপাসের (ধবধবে সাদা কার্পাস তুলার) মতো কল্যাণকর (শুভ), যার ফল নীরস হলেও উজ্জ্বল গুণযুক্ত। কাপাস যেমন (ধুনুরি (যে তুলো ধোনে এবং ধোনা তুলো দিয়ে বালিশ, লেপ, তোশক তৈরি করে), তাঁতি প্রভৃতি অনেকের কাছ থেকে) নিজে দুঃখ সহ্য করে অন্যের শরীর ঢেকে রাখে (লজ্জা নিবারণ করে, উষ্ণতা-আরাম-স্বস্তি দেয়), তেমনি তিনিও নিজে দুঃখ সহ্য করে অন্যের ছিদ্র (কষ্ট বা সীমাবদ্ধতা) ঢেকে রাখেন (দূর করেন) এবং এই সংসারে বন্দনীয় (স্থায়ী) যশ লাভ করেন।




২. মুদ মঙ্গলময় সন্ত সমাজূ
জো জগ জঙ্গম তীরথরাজূ।।
রামভগতি জহঁ সুরসরিধারা
সরসই ব্রহ্মবিচার প্রচারা।।
অর্থ: সাধুসমাজ আনন্দদায়ী ও মঙ্গলপ্রদ এবং জগতে এ সমাজ চলন্ত তীর্থরাজ (প্রয়াগ: গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী—এই তিন নদীর সঙ্গমস্থল) স্বরূপ। রামভক্তি এখানে গঙ্গার ধারা এবং ব্রহ্মবিচারের (ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার ধাপে উন্নীত হবার বিবিধ উপায়ের) প্রচার (বা পথনির্দেশ) (হচ্ছে) সরস্বতী নদীর (অদৃশ্য) প্রবাহ।




৩. বিধি নিষেধময় কলিমল হরনী
করম কথা রবিনন্দিনি বরনী।।
হরি হর কথা বিরাজত বেনী
সুনত সকল মুদ মঙ্গল দেনী।।
অর্থ: কলিযুগের পাপ-মলহারী (পাপ ও চিত্তের কালিমা দূর করে যা) কর্তব্য ও অকর্তব্য কাজের কথা যমুনা স্বরূপা, ত্রিবেণীসঙ্গম (বা প্রয়াগ) স্বরূপ এই বিষ্ণু ও শিবের (তুলনীয়: যমুনার নিচ দিয়ে প্রবাহিত অন্তঃসলিলা সরস্বতী ও গঙ্গার) কথা অত্যন্ত আনন্দ ও মঙ্গলদান করে।




৪. বট বিস্বাসু অচল নিজ ধর্মা
তীরথরাজ সমাজ সুকর্মা।।
সবহি সুলভ সব দিন সব দেসা
সেবত সাদর-সমন কলেসা।।
অকথ অলৌকিক তীরথরাঊ
দেই সদ্য ফল প্রগট প্রভাঊ।।
অর্থ: নিজের ধর্মে (নিজের কর্তব্যকর্মে) অটল বিশ্বাসই বটবৃক্ষ (যা সুশীতল ছায়া তথা পরম আস্থা প্রদান করে), ভালো কাজগুলি তীর্থরাজ প্রয়াগের মেলা—এই সাধুসমাজ সব দিনে (কালে) এবং সব দেশেই সুলভ (কেননা তাঁরা তো মানুষের কল্যাণের জন্য সব জায়গাতেই গিয়ে থাকেন) এবং তাঁদেরকে সাদরে সেবা করলে ক্লেশ দূর হয়। এই তীর্থরাজ (নিজে ভালো কাজ করা এবং ভালো কাজে অন্যকে তথা সাধুকে তথা যিনি ভালো কাজ করেন, তাঁকে সহায়তা করা) অকথনীয়, অলৌকিক এবং শীঘ্র ফলদান করে—এর প্রভাব তো প্রত্যক্ষ। (কর্মফল নিজের চোখেই দেখা যায়।)




৫. (দোঁহা) সুনি সমুঝহি জন মুদিত মন
মজ্জহি অতি অনুরাগ।।
লহহিঁ চারি ফল অছত তনু
সাধু সমাজু প্রয়াগ।।
অর্থ: এই সাধুসমাজরূপী তীর্থরাজের উপদেশ (সদুপদেশ) আনন্দিত মনে শুনে ও বুঝে (শুধু শুনে গেলেই চলবে না, কাজে লাগাতে চাইলে ভালো করে বুঝতেও হবে) অত্যন্ত অনুরাগের সাথে যিনি তাতে ডুব দেন (কর্মে প্রবৃত্ত হন), তিনি এই শরীরেই চারি ফল (ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) লাভ করেন। (চারটি পুরুষার্থ বা মানবজীবনের চারটি সঠিক লক্ষ্য, যথা ধর্ম (ধার্মিকতা, নৈতিক মূল্যবোধ), অর্থ (সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মূল্যবোধ), কাম (আনন্দ, প্রেম, মনস্তাত্ত্বিক মূল্যবোধ) এবং মোক্ষ (মুক্তি, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ, আত্ম-বাস্তবতা উপলব্ধি))




৬. বাল্মীকি নারদ ঘটজোনী
নিজ-নিজ মুখনি কহী নিজ হোনী।।
জলচর থলচর নভচর নানা
জে জড় চেতন জীব জহনা।।
অর্থ: বাল্মীকি, নারদ এবং অগস্ত্য মুনি নিজ নিজ মুখেই নিজেদের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। জলচর, স্থলচর এবং নভোচর অনেক প্রকারের যত জড় ও চেতন জীব (‘সত্তা’ অর্থে: জড়সত্তা ও চেতনসত্তা) এই সংসারে আছে—




৭. মতি কীরতি গতি ভূতি ভলাই
জব জহি জতন জহাঁ জেহি পাই।।
সো জানব সতসঙ্গ প্রভাঊ
লোকহু বেদ ন আন উপাঊ।।
অর্থ: তারা যখন‌ই কোথাও কোনো উপায়ে—যে বুদ্ধি, কীর্তি, গতি, ঐশ্বর্য এবং ভালো যা-কিছু পেয়েছে, তার সমস্তই পেয়েছে সৎসঙ্গের প্রভাবে। (সঙ্গ ভালো না হলে রঙ্গ বা কীর্তি ভালো হয় না।) এই সংসারে উপায় দুই: লৌকিক (কাণ্ডজ্ঞানোদ্ভূত) ও বৈদিক (শাস্ত্রবিহিত), আর অন্য উপায় নেই।




৮. বিনু সতসঙ্গ বিবেক ন হোঈ
রাম কৃপা বিনু সুলভ ন সোঈ।।
সতসঙ্গতি মুদ মঙ্গল মুলা
সোই ফল সিধি সব সাধন ফুলা।।
অর্থ: সৎসঙ্গ বিনা (সৎসঙ্গ না পেলে) বিবেক হয় না (বোধ জন্মে না) এবং সেই সৎসঙ্গও রামের (ভগবানের) কৃপা (অদ্বৈতমতে, চৈতন্যের জাগরণ) ছাড়া সহজে পাওয়া যায় না। আনন্দ ও মঙ্গল-বৃক্ষের (জীবনপ্রণালির) মূল সৎসঙ্গ, তার ফুল সাধন (চেষ্টা) এবং ফল (যা ফুল থেকে উৎপন্ন) সিদ্ধি (জ্ঞানলাভ)।




৯. সঠ সুধরহি সতসঙ্গতি পাঈ
পারস পরসি কুধাতু সোহাঈ।।
বিধিবস সুজন কুসঙ্গতি পরহী
মনি ফনি সম নিজগুন অনুসরহী।।
অর্থ: সৎসঙ্গ পেয়ে শঠ (দুষ্ট) শুদ্ধ হয়ে যায়, যেমন পরশমণির স্পর্শে লোহা সোনা হয়ে যায়। (ভেড়ার পালে বাস করলে সিংহের শৌর্যবীর্য লাভ করা যায় কি?) দৈববশত যদি সজ্জন কুসঙ্গে পড়েও, তবু সাপের মণির মতো নিজের গুণ কখনও পরিত্যাগ করে না। (সাপের মণি সাপের সাথে সাথে থাকে, কিন্তু কখনোই নিজধর্ম বা বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুত হয় না; তবে এমন গুণ অর্জন করা যায় কেবল মণি হয়ে উঠতে পারলে তবেই।)




১০. বিধি হরি হর কবি কেবিদ বানী
কহত সাধু মহিমা সকুচানী।।
সো মো সন কহি জাতন কৈসে
সাক বনিক মনিগনগুন জৈসে।।
অর্থ: ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কবি, পণ্ডিত ও সরস্বতী—সকলেই সাধুর মহিমা বলতে (বর্ণনা করতে) সংকোচ করে থাকেন। শাকসবজির ব্যাপারী যেমন মণিমুক্তোর গুণ (বা মূল্য) বলতে পারে না, ঠিক তেমনি আমিও কীভাবে সেই মহিমা (সাধুর মহিমা) বর্ণনা করব? (যেখানে অত বড়ো বড়ো মানুষ ও দেবতাও সাধুর মহিমা বলতে ব্যর্থ হন, সেখানে তা বর্ণনা করার কোনো যোগ্যতাই তো আমার নেই!)




১১. (দোঁহা) বন্দউঁ সন্ত সমানচিত
হিত অনহিত নহিঁ কোউ।
অঞ্জলিগত সুভ সুমন জিমি
সম সুগন্ধ কর দোউ।।
অর্থ: সেই সমদর্শী (ভেদজ্ঞানহীন, নিরপেক্ষ, তুল্যদর্শী, অপক্ষপাতী) সজ্জনগণকে বন্দনা করছি; তাঁদের শত্রু বা মিত্র বলে কেউ নেই—যেমন হাতে সুন্দর ফুল রাখলে তা (ডান বা বাম হাত বিচার না করে) সমানভাবে দুই হাতই সুগন্ধে ভরিয়ে করে দেয়। (জ্ঞানবান অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিতেরা সকলের প্রতি সমদর্শী হন।~~গীতা, ৫/১৮)




১২. সন্ত সরলচিত জগত হিত
জানি সুভাউ সনেহু।
বালবিনয় সুনি করি কৃপা
রাম চরন রতি দেহু।।
অর্থ: জগতের হিতকারী সরলচিত্ত সজ্জনগণ নিজেদের স্বভাব এবং আমার (তুলসীদাসের) অনুরাগ (ভক্তি) (সম্পর্কে) জেনে আমার মতো বালকের (বিনয়ের আতিশয্যে তুলসীদাসজি নিজেকে অপরিপক্ব বালকের সাথে তুলনা করছেন) বিনয়বচন শুনে কৃপা করে শ্রীরামের চরণে রতি (প্রীতি বা ভক্তি বা প্রেম) দান (নিবেদন) করুন। (শ্বেতাশ্বর উপনিষদ এবং গীতায় বিধৃত ভক্তিমার্গ বা ভক্তিযোগের সার্থক প্রয়োগের এ এক অপূর্ব নিদর্শন!)