শ্রীরাধা তাঁর মানবজন্মে একজন গোপিনী হিসেবে সমাদৃতা। তিনি শ্রীকৃষ্ণের বামভাগাংশ থেকে শক্তিরূপে সৃষ্ট হয়েছেন। বৈষ্ণবদের প্রধান গ্রন্থ 'শ্রীমদ্ভাগবত'-এ রাধিকার কোনো ধরনের উল্লেখ নেই; কৃষ্ণভক্তা এক প্রধানা সখীর নির্দেশ আছে মাত্র। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, পদ্মপুরাণ, দেবীভাগবত-পুরাণ, গীতগোবিন্দম্, গোপাল-তপানীয় উপনিষদ, শিবপুরাণ, স্কন্দপুরাণ, নারদপুরাণ গ্রন্থে শ্রীরাধার বিবরণ পাওয়া যায়।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে (ব্রহ্মখণ্ডে, ৫ অধ্যায়ে) আছে—গোলোকে রাসমণ্ডলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবগণের সাথে অবস্থান করছিলেন। এমন সময়ে, তাঁর বামপাশ হতে তাঁরই ইচ্ছায় এক কন্যা আবির্ভূত হয়ে তাঁকে পূজা করতে লাগলেন। গোলোকধামে রাসমণ্ডলে এই কন্যা আবির্ভূত হয়েই শ্রীকৃষ্ণের কাছে ধাবিত হয়েছিলেন, তাই দেবগণ তাঁর নাম রাধা বলে নির্দেশ করেন। এই শ্রীমতী রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং প্রাণ হতে নির্গতা হয়েছিলেন বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের নিজপ্রাণ হতেও প্রিয়তমা।
দেবী রাধা আবির্ভাবমাত্রই ষোড়শী, নবযৌবনসম্পন্না, অত্যুজ্জ্বলবস্ত্রধারিণী, ঈষৎ হাস্যবদনা এবং মনোহারিণী হলেন। এই দেবী অত্যন্ত কোমলাঙ্গী এবং জগতের যাবতীয় সুন্দরী হতেও সৌন্দর্যমণ্ডিতা।
শ্রীরাধা এভাবে আবির্ভূতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে সম্ভাষণ করে তাঁর পদ্মমুখ নিরীক্ষণ করতে করতে হাসিমুখে রত্নসিংহাসনে উপবেশন করলেন। এই সময় শ্রীরাধার সকল লোমকূপ হতে তাঁরই রূপে ও বেশে গোপরমণীগণ আবির্ভূতা হলো। তাঁদের সংখ্যা যেন লক্ষ-কোটি। এই সময় শ্রীকৃষ্ণের লোমকূপ হতে তাঁরই অনুরূপ গোপগণ এবং স্থিরযৌবন নানাবর্ণের গোসমূহও আবির্ভূত হলো।
গোলোকে এভাবেই শ্রীমতী রাধিকার উৎপত্তি হয়েছিল। এই গোলোকোদ্ভবা রাধাই বৃন্দাবনধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বৃন্দাবনধামে অবর্তীণ হবার কারণ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এভাবে বর্ণিত হয়েছে—
ভগবতী মহাদেবকে শ্রীরাধিকার উৎপত্তি, নাম-নিরুক্তি ও ধ্যানাদির বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। দেবদেব মহাদেব জিজ্ঞাসার উত্তরে শ্রীমতী রাধার অতিগোপনীয় জন্মবৃত্তান্ত নিম্নরূপে বর্ণনা করেছিলেন:
একদিন ইচ্ছাময় শ্রীকৃষ্ণ গোলোকে বৃন্দাবনের রম্যবনে রমণ করতে চেয়েছিলেন। ইচ্ছাময়ের ইচ্ছে হওয়ামাত্রই দেবদেবী শ্রীরাধা উৎপন্ন হলেন। এ সময় শ্রীকৃষ্ণ দুই রূপে বিভক্ত হন—দক্ষিণাঙ্গে শ্রীকৃষ্ণমূর্তি এবং বামাঙ্গে শ্রীরাধার রূপ ধারণ করেছিলেন। পরম রমণীয়া রাধিকা দেবী রাসমণ্ডলে রাসবিহারীর সাথে রমণ করতে উৎসুক হলেন। হরিপ্রিয়া নিজ পতিকে রমণোৎসুক জেনে ধাবমানা হয়েছিলেন, এজন্য তিনি 'রাধা' নামে খ্যাত হন। ভক্তগণ 'রা' শব্দাংশ উচ্চারণমাত্রই মুক্তিপদ-প্রাপ্ত এবং 'ধা' শব্দাংশ উচ্চারণ করলে হরির পদে ধাবমান হয়, এ কারণেও তাঁকে 'রাধা' বলা হয়। এই শ্রীমতী রাধা সুদামের শাপে বৃন্দাবনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
কোনো এক সময়ে রাধানাথ গোলোকে বৃন্দাবনে অবস্থিত শতশৃঙ্গ পর্বতের এক জায়গায় বিরজা নামের কোনো এক গোপিকার সাথে বিহার করছিলেন। রাধিকার চার জন দূতী এই বিষয়টি জানতে পেরে রাধার কাছে তা জানান। রাধা এ কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে সেখানকার উদ্দেশে রওনা হলেন। শ্রীকৃষ্ণের সহচর সুদাম শ্রীরাধার আগমন-কোলাহল শুনে শ্রীকৃষ্ণকে সাবধান করে দিয়ে গোপদের সাথে সেখান থেকে পালিয়ে যান। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রেমময়ী রাধার প্রেমভঙ্গের ভয়ে বিরজাকে পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। এদিকে বিরজাদেবী শ্রীরাধার ভয়ে প্রাণত্যাগ করে সেখানেই নদীরূপে অবস্থান করেন। রাধিকা সেখানে উপস্থিত হয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ফিরে এলেন।
পরে শ্রীকৃষ্ণ অষ্টসখার সাথে রাধার কাছে এসে উপস্থিত হলে রাধিকা শ্রীকৃষ্ণকে বিভিন্নভাবে তিরস্কার করেন। সুদাম কৃষ্ণনিন্দা শুনে ব্যথিত হন। তখন তিনি রাধিকাকে তিরস্কার করলে শ্রীরাধিকা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে সুদামকে "তুমি ক্রূর অসুরযোনি লাভ করো!"—এই অভিশাপ দেন। তখন সুদামও রেগে গিয়ে শ্রীরাধাকে এই শাপ দেন—"তুমিও গোলোক হতে ভূলোকে গমন করে গোপের গৃহে গোপকন্যারূপে জন্মগ্রহণ করো। এরপর তুমি শত বৎসরকাল অসহ্য কৃষ্ণবিরহদুঃখ যাপন করবে এবং ভগবান ভূভার-হরণের জন্য অবতীর্ণ হয়ে তোমার সাথে মিলিত হবেন।" সুদামের অভিশাপে রাধা গোকুলে জন্মগ্রহণ করেন এবং রাধার শাপে সুদাম শঙ্খচূড় নামে অসুরযোনি প্রাপ্ত হন।
এই রাধা-বিরহকল্পে রাধিকা গোকুলনগরে বৈশ্যবর বৃষভানুর কন্যারূপে অবতীর্ণ হন। বৃষভানুকান্তা কলাবতীর বায়ুগর্ভ ধারণ করেন, ফলে কলাবতী বায়ুপ্রসব করলে অযোনিসম্ভূত শ্রীরাধা উৎপন্ন হলেন। বারো বছর পর বৃষভানু আয়ান বৈশ্যের সাথে শ্রীরাধার বিয়ে দেন। শ্রীরাধা বৃষভানুসূতায় নিজছায়া সংস্থাপন করে অন্তর্হিতা হন; ছায়ার সাথে আয়ানের বিয়ে হয়। চৌদ্দ বছর পার হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংস-ভয়ের ছলে বালকরূপে গোকুলে গমন করেন। আয়ান কৃষ্ণজননী যশোদার সহোদর এবং গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের অংশস্বরূপ। অতএব সম্পর্কে আয়ান শ্রীকৃষ্ণের মামা। পৃথিবীশ্রেষ্ঠ পুণ্যতম শ্রীবৃন্দাবনের বনে শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলাবিহার ঘটে।
গোপগণ স্বপ্নেও শ্রীরাধার রূপদর্শন পান না। শ্রীরাধা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের ক্রোড়ে বাস এবং আয়ানগৃহে ছায়ারূপে অবস্থান করেন। ব্রহ্মা শ্রীরাধার চরণদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় ছয় হাজার বছর পুস্করতীর্থে কঠোর তপস্যা করেন। পরে ভগবান ভূভার-হরণের জন্য নন্দগোপকূলে জন্মগ্রহণ করলে ব্রহ্মা শ্রীরাধার চরণপদ্মের দর্শন পান। শ্রীকৃষ্ণ পুণ্য বৃন্দাবনধামে শ্রীরাধার সাথে ক্ষণকাল বিলাস করেছিলেন। তারপর সুদামের শাপে রাধাকৃষ্ণের বিচ্ছেদ হয়। পরে বৃষভানু, নন্দ এবং সকল গোপ-গোপী আবারও শ্রীরাধাকৃষ্ণের সাথে গোলোকধামে গমন করেন। শ্রীরাধার এই উপাখ্যানটিকে পাপনাশক এবং পুত্রপৌত্রাদিক্রমে অশেষ মঙ্গলদায়ক হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।
শ্রীকৃষ্ণ দ্বিভুজ ও চতুর্ভুজ, এরূপে বিভক্ত। দ্বিভুজ শ্রীকৃষ্ণের সর্বোত্তমা শ্রীরাধাই পত্নী এবং চতুর্ভুজ কৃষ্ণের মহালক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা ও তুলসী এঁরাই প্রিয়তমা। পণ্ডিতগণ আগে শ্রীরাধার নামোচ্চারণ করে তার পরে কৃষ্ণ নামটি উচ্চারণ করবেন—কৃষ্ণনামের পরে রাধানাম উচ্চারণ করলে ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়ে থাকে। হরি নিজেই কার্তিকী পূর্ণিমার রাসোৎসব উপলক্ষ্যে গোলোকে রাসমণ্ডলে রাসেশ্বরীর পূজা করে রাধাকবচ কণ্ঠে ও বাহ্যদেশে ধারণ করেন। এ সময়ে শ্রীরাধা জগৎপতি কৃষ্ণের পূজা এবং কৃষ্ণও শ্রীরাধিকার পূজা করে থাকেন। (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড, ৪৮-৫০ অধ্যায়)
শ্রীরাধিকার ষোড়শ নাম— রাধা, রাসেশ্বরী, রাসবাসিনী, রসিকেশ্বরী, কৃষ্ণপ্রাণাধিকা, কৃষ্ণপ্রিয়া, কৃষ্ণস্বরূপিণী, কৃষ্ণবামাংশসম্ভূতা, পরমানন্দরূপিণী, কৃষ্ণা, বৃন্দাবনী, বৃন্দা, বৃন্দাবনবিনোদিনী, চন্দ্রাবলী, চন্দ্রকান্তা এবং শতচন্দ্রানিভাননা। শ্রীমতী রাধিকার এই ষোড়শ নাম শ্রেষ্ঠ এবং সকল পাপনাশক হিসেবে পরিগণিত।
এই সকল নাম-নিরুক্তির বিষয় এভাবে নির্দিষ্ট হয়েছে—'রা' শব্দে দান এবং 'ধা' শব্দে নির্বাণ-মুক্তি, তিনি ভক্তবৃন্দকে নির্বাণ-মুক্তি প্রদান করেন বলে রাধা নামে অভিহিত হন। তিনি রাসেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের পত্নী বলে রাসেশ্বরী এবং রাসমণ্ডলে বাস করেন বলে রাসবাসিনী নামে প্রসিদ্ধা। সমস্ত রসিকাদেবীর ঈশ্বরী, এ কারণে পণ্ডিতগণ প্রায় সময়ই তাঁকে রসিকেশ্বরী বলে থাকেন। তিনি পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের প্রাণাধিকা প্রেয়সী, তাই কৃষ্ণপ্রাণাধিকা। শ্রীকৃষ্ণের অতিপ্রিয় কান্তা, তাই কৃষ্ণপ্রিয়া। তিনি অবলীলায় কৃষ্ণরূপ বিধান করতে সমর্থা ও সর্বাংশে শ্রীকৃষ্ণের সদৃশ, এজন্য কৃষ্ণস্বরূপিণী। কৃষ্ণের বামাংশসম্ভূতা বলে শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণবামাংশসম্ভূতা নামে তাঁর কীর্তন করেছেন। রাধা স্বয়ং মূর্তিমতী পরমানন্দরাশি, এজন্য তিনি পরমানন্দরূপিণী বলে কীর্তিত হয়েছেন। 'কৃষ্' অংশে মোক্ষ, 'ণ' অংশে উৎকৃষ্ট এবং আ-কার অংশে দান বোঝায়—তিনি উৎকৃষ্ট মোক্ষদায়িনী, এজন্য কৃষ্ণা। তাঁর বৃন্দাবন আছে বা তিনি বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, এজন্য তিনি বৃন্দাবনী। 'বৃন্দ' অংশ দ্বারা সখিসমূহ ও আ-কার দ্বারা অস্তিবোধক অর্থ বোঝায়, তাঁর সখিসমূহ বিদ্যমান আছে, এজন্য তিনি বৃন্দা। 'বিনোদ' শব্দে আনন্দ এবং এই আনন্দ তাঁর বৃন্দাবনে সম্পূর্ণরূপে বিরাজিত আছে, এজন্য তিনি বৃন্দাবনবিনোদিনী। রাধিকার মুখচন্দ্র ও নখচন্দ্রাবলী নিরন্তর বিরাজমান, এজন্য শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে চন্দ্রাবলী বলে থাকেন। তাঁর মুখকান্তি দিনরাত (সবসময়) চন্দ্রতুল্য বলে তিনি চন্দ্রকান্তা, তাঁর মুখমণ্ডলে নিরন্তর শতচন্দ্রের প্রভা বিদ্যমান, এজন্য তিনি শতচন্দ্রনিভাননা নামে কীর্তিত হয়েছেন।
যিনি ত্রিসন্ধ্যা রাধিকার এই ষোড়শ নাম জপ করেন, তিনি ইহকালে রাধামাধবের পাদপদ্মে ভক্তিলাভ করে আয়ু সমাপ্তান্তে অণিমাদি-সিদ্ধি ও নিত্য শরীর ধারণপূর্বক শ্রীরাধাকৃষ্ণের সেবাকাজে নিযুক্ত হয়ে নিরন্তর তাঁদের সাথে কালযাপন করে থাকেন। (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ড, ১৭ অধ্যায়)
দেবীভাগবতে রাধিকার পূজা ও মন্ত্রাদির বিষয় এভাবে বর্ণিত আছে—মূলপ্রকৃতিরূপিণী চিন্ময়ী ভুবনেশ্বরী হতে জগতের উৎপত্তিকালে প্রাণ ও বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা দুই শক্তিতে আবির্ভূতা হন—প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা রাধা এবং বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা দুর্গা—এই নিখিলবিশ্ব-চরাচরজগৎ এই শক্তিযুগলের অধীন। এঁদের অনুগ্রহ ব্যতীত জীবের মুক্তিলাভ দুর্ঘট। এজন্য জীবমাত্রেরই এই শক্তির আরাধনা করা অবশ্যকর্তব্য। এই শক্তিদ্বয়ের মধ্যে প্রথমে রাধিকা—ইনি শক্তির মন্ত্র, যা ব্রহ্মা-বিষ্ণু প্রভৃতি দেব প্রতিনিয়ত জপ করে থাকেন—শ্রীরাধায়ৈ স্বাহা—এই ষড়-অক্ষর মহামন্ত্রে ধর্মপুণ্য লাভ হয়ে থাকে। এ মন্ত্রের সাথে 'হ্রী' যোগ করে দিলে এটি বাঞ্ছাচিন্তামণি হয়ে থাকে। এ মন্ত্রের মহিমা সহস্র-কোটি মুখে এবং শত-কোটি জিহ্বাতেও বর্ণনা করা যায় না।
প্রথমে গোলোকধাম রাসমণ্ডলে শ্রীকৃষ্ণ মূলপ্রকৃতিদেবীর উপদেশে এই মন্ত্র গ্রহণ করেছিলেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর উপদেশে ব্রহ্মা প্রভৃতি দেব এই মন্ত্র গ্রহণ করেন। রাধিকার পূজা ব্যতীত কৃষ্ণপূজায় অধিকারই হয় না, সুতরাং সকল বৈষ্ণবেরই রাধার পূজা করা অবশ্যকর্তব্য।
রাধা যদি মায়া হন, তবে কৃষ্ণ তাঁর শক্তি। মায়ার যে-শক্তি, তার উদ্ভব তো মায়া থেকেই। তাই শব্দবন্ধটি—'মায়াশক্তি', 'শক্তিমায়া' নয়। মায়া আছে বলেই তার শক্তিও আছে—শক্তি তাই মায়ার অধীন। অনুরূপভাবে, রাধাই কৃষ্ণের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, কৃষ্ণ রাধার অধীন। রাধা সর্বদা কৃষ্ণের রাসেশ্বরী হয়ে রয়েছেন। কৃষ্ণ ক্ষণকালের জন্যও রাধাকে পরিত্যাগ করে থাকতে পারেন না। রাধা শুরুতে, কৃষ্ণ শেষে—কেননা জীবাত্মার জাগরণেই যে পরমাত্মার মহাপ্রকাশ হয়। রাধা আছেন বলেই কৃষ্ণ এ জগতে প্রকাশিত রয়েছেন, তাই রাধার স্থানই আগে—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শ্রীরাধার সমস্ত ভার বহন করেন, তাই রাধার স্থানই শুরুতে। কৃষ্ণ সর্বদাই রাধার অনুগামী হয়ে উদ্বোধিত হন—জীবাত্মাই পরমাত্মার উদ্বোধন ঘটায়। 'কৃষ্ণরাধা' শব্দবন্ধটি তাই সর্বাংশে ভ্রান্ত।
পূজার বিধানানুসারে ধ্যানাদি সম্পন্ন করে যথাযথ মন্ত্রে রাধিকার পূজা করতে হয়। যিনি যথাবিধানে রাসেশ্বরী রাধার পূজা করেন, তিনি বিষ্ণুতুল্য হয়ে থাকেন। যে জ্ঞানবান ব্যক্তি কার্তিকমাসের পৌর্ণমাসী তিথিতে রাধার জন্মোৎসব করেন, রাধা তাঁকে সান্নিধ্যপ্রদান করে থাকেন। গোলোকবাসিনী রাধা কোনো কারণবশত একসময়ে বৃন্দাবনকাননে বৃষভানুর কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই দেবী ভক্তগণের সমস্ত কামনা ধারণ অর্থাৎ সাধন করেন বলে তিনি 'রাধা' নামটি গ্রহণ করেছেন।
শালগ্রামে অথবা সাক্ষাৎ শিলাদিমূর্তিতে মনের মধ্যে যুগলমূর্তির ধ্যান করে অর্চনা করতে হবে; তার পরে শ্রীরাধার অঙ্গ-দেবতাদির পূজা করতে হয়। দেবীর পূজা করে দক্ষিণাবর্তক্রমে অষ্টদলপদ্মের পুরোভাগে পূর্বদলে মালাবতী, অগ্নিকোণে মাধবী, দক্ষিণদলে রত্নমালা, নৈর্ঋতদলে সুশীলা, পশ্চিমদলে শশিকলা, বায়ুদলে পারিজাতা, উত্তরদলে পরাবতী এবং ঈশানদলে সুন্দরী, তার পরে অষ্টদল পদ্মের বহির্ভাগে ব্রাহ্মী প্রভৃতি মাতৃগণ, ভূপুরে দিক্পালগণের এবং বস্ত্র প্রভৃতির পূজা করতে হয়। যথাসামর্থ্য উপচার দ্বারা দেবীর আবরণদেবতাদির পূজা করা কর্তব্য। (দেবীভাগবত, ৯/৫০ অধ্যায়)
রাধাষ্টমীব্রতমাহাত্ম্যের ১৬২-১৬৩ অধ্যায়ে আছে—"...তারপর সেই যুগলমূর্তির সম্মুখক্রমে পাদ্যাদি দ্বারা মণ্ডলপূজা করা কর্তব্য। ক্রমটি এরূপ—যথা পশ্চিমের পীতবর্ণদলে ললিতা, বামদিকের শুক্লদলে চন্দ্রাবতী; বায়ুকোণের কৃষ্ণদলে শ্যামলাদেবী, তার বামে শুক্লবর্ণদলে চিত্ররেখা; উত্তরে রক্তবর্ণদলে শ্রীমতী, তার বামপাশে নীলবর্ণদলে চন্দ্রা; ঈশানে রক্তবর্ণদলে শ্রীহরিপ্রিয়া, তার বামস্থ শুক্লদলে মদনসুন্দরী; পূর্বে পীতবর্ণদলে বিশাখা, তার বামভাগে শুক্লবর্ণদলে প্রিয়া; অগ্নিকোণে শ্যামবর্ণদলে সব্যা, তার বামে শুক্লবর্ণদলে মধুমতী; দক্ষিণে রক্তবর্ণদলে পদ্মা, তার বামে নীলবর্ণদলে শশিরেখা; নৈর্ঋতে রক্তবর্ণদলে ভদ্রা, তার বামদিকে শুক্লবর্ণদলে রসপ্রিয়ার পূজা করতে হবে।" কৃষ্ণপ্রিয়া শ্রীরাধার প্রিয়সঙ্গিনীগণের পূজাকালেও প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ধ্যান উক্ত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
বৃন্দাবনধামে ভগবান রাধিকার সাথে যে রাসলীলা করেছিলেন, তার বিষয়ে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। রাধাতন্ত্রে লিখিত আছে—ভগবান বাসুদেব কাশীপুরে গিয়ে কায়মনোবাক্যে মহামায়ার কঠোর তপস্যা করতে থাকেন। সহস্রাদিত্য গত হলেও (হাজার সূর্য তথা হাজার দিন পার হলেও) তাঁর সিদ্ধি হলো না। তখন মহামায়া দেখা দিয়ে বললেন, "বৎস! ওঠো, কুলাচার বিনা সিদ্ধি হয় না। আমার অংশসম্ভবা লক্ষ্মীকে ছেড়ে কী তপস্যা করছ? এক অতি গুহ্য কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো। আমার এই বক্ষঃস্থলে মাতৃকারূপা চিত্রবিচিত্র মালা আছে। এই মালাগুলিই আমার দূতী; তাঁদের নাম হস্তিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, গন্ধিনী। এদের মধ্যে আমার পদ্মিনী নামের মালাটিই ব্রজে গিয়ে রাধা নামে খ্যাত হবেন। বাসুদেব! তুমি মথুরায় গিয়ে সেই পদ্মিনীর সঙ্গলাভ করো, তাহলেই তোমার সিদ্ধি হবে। আমার অন্যান্য মাতৃকাদেবীও তাঁর অনুচরী হবেন।"
তখন ভগবান বাসুদেব মহামায়ার কাছে পদ্মিনীকে দেখতে চাইলেন, তৎক্ষণাৎ রক্ত-বিদ্যুৎলতাকৃতি পদ্মগন্ধসমন্বিতা মোহিনীরূপধারিণী সখিগণবেষ্টিতা সহস্রদল-পদ্মমধ্যস্থা দেবী পদ্মিনী আবির্ভূত হলেন। বাসুদেব সেই মূর্তি দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হলেন। পদ্মিনী বললেন, "ভগবান! শীঘ্রই ব্রজধামে গমন করুন, সেখানেই আমি আপনার সাথে কুলাচার করব। সেখানে বৃষভানুগৃহে আপনার আগেই আমি জন্মাব।" এই বলে পদ্মিনী মহামায়ার মালা-মধ্যে অন্তর্হিতা হলেন।
চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে পুষ্যানক্ষত্রযুক্ত নবমীতিথিতে মাঝরাতে পদ্মিনীদেবী বিবিধ কমলদলে পরিশোভিত কালিন্দী-সলিলে মায়াময় ডিম্বরূপে আবির্ভূত হলেন। মহামায়া কাত্যায়নী সেই অসীম তেজোময় ডিম্ব নিয়ে কালিন্দীতীরে জপপরায়ণ বৃষভানু সমীপে আবির্ভূত হয়ে বললেন—"বৎস! তুমি সিদ্ধ হয়েছ। তোমার অভিলাষানুযায়ী বরপ্রার্থনা করো।" দেবীকৃপা লাভ করে বৃষভানু দেবীর অনুরূপিণী কন্যা প্রার্থনা করলে, দেবী মহামায়া সেই ডিম্বটি তাঁর হাতে দিয়ে, "বৎস! তোমার পত্নীর ভক্তিতে আমি পরম প্রীত হয়েছি, তোমার পত্নীর কন্যারত্ন লাভ হবে।" বলে অন্তর্হিত হলেন। বৃষভানু সেই ডিম্ব নিজের পত্নীকে দিলেন। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত মনে তা ভালো করে দেখছেন, এমন সময় ডিম্বটি দুই ভাগে বিভক্ত হলে তার মধ্যে ভুবনমোহিনী বিদ্যুৎলতা-কায়া সৌভাগ্যবর্ধিনী কন্যা দেখে তিনি অতিবিস্মিত হলেন। অনন্তর বৃষভানু এবং তাঁর পত্নী কীর্তিদা মিলে কন্যার নাম রাখলেন রাধিকা।
রক্তবিদ্যুৎপ্রভা দেবী ধত্তে যস্মাৎ শুচিস্মিত্তে। তস্মাত্তু রাধিকা নাম সর্বলোকেষু গীয়তে। (রাধাতন্ত্র, ৭ম পটল)
সেই দেবী রক্তবিদ্যুৎপ্রভা ধারণ করতেন বলে সকল লোকে তিনি 'রাধিকা' নামে প্রখ্যাত হন। সেই পদ্মিনী কৃষ্ণকে পাবার জন্য দ্বিতীয় বছরেই ষোড়শোপচারে ব্রহ্মাণ্ডরূপিণী মহাকালীর পূজা করতে থাকেন। রাধাতন্ত্রে বিশেষভাবে লিখিত আছে—
বিষ্ণুবল্লভা মৃগনয়না রাধাই মহামায়া জগদ্ধাত্রী, ত্রিপুরা, পরমেশ্বরী; পদ্মগন্ধিনী পদ্মিনীই তাঁর দূতী; তিনিও কৃষ্ণভক্তা, কৃষ্ণবল্লভা। বৃষভানুর দৃঢ়ভক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে তিনি তাঁর কন্যারূপে জন্ম পরিগ্রহ করেন। তিনিই নির্জন বনবেষ্টিত যমুনার জলমধ্যে পদ্মখণ্ড আশ্রয় করে মহাকালীর মহামন্ত্র জপ করতে থাকেন, তিনিই আবার অপর রাধা সৃষ্টি করেছিলেন। সেই অপর রাধাই বৃষভানুগৃহস্থিতা চন্দ্রাবলী। পূর্বোক্ত রাধিকার যা যা গুণ, পদ্মিনীসৃষ্ট রাধারও তা তা গুণ। এভাবে তিনটি রাধিকা নির্দিষ্ট হয়েছে।
রাধিকা ত্রিবিধা প্রোক্তা চন্দ্রাতু পদ্মিনী তথা। ন পশ্যেং পরমেশানি চন্দ্রসূর্যং শুচস্মিতে। মানবানাং মহেশানি বরাকাণাং হি কা কথা। আত্মনোপহ্নবং কৃত্বা পদ্মিনী পদ্মমাশ্রিতঃ। ত্রিপুরায়াং মহেশানি পদ্মিনী অনুচারিণী। (রাধাতন্ত্র, ৮ম পটল)
এই তিনটি রাধার মধ্যে বৃষভানুগৃহস্থিতা রাধাই কৃত্রিমা, আর অযোনিসম্ভবা পদ্মিনীই পরাক্ষরা। (৭ম পটল)
রাধা প্রজামণ্ডলেশ্বরী ও শ্রীকৃষ্ণের প্রেমভিখারিণী। পৌরাণিক রাধার এবং রূপসনাতন গোস্বামী ও জয়দেব প্রভৃতি কবি-বর্ণিত রাধার রূপ ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাপ্রসূত; ব্রজের রাধা বৃষভানুদুহিতা ও আয়ানবনিতা। রাধিকা কৃষ্ণের প্রেমাকাঙ্ক্ষিণী হয়ে বৃন্দাবনের প্রতিকুঞ্জই যেন অশ্রুপ্লাবিত করেছিলেন।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ২য় অধ্যায়ে রাধিকার রূপ এভাবে লিখিত আছে—ইনি শ্রীকৃষ্ণের বামার্ধ অমূল্যরত্নাভরণা কোটিপূর্ণশশিপ্রভা, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তেজোময়ী, সস্মিতাননা, শরৎপদ্মনিভাননা, মালতীমাল্যমণ্ডিতা, গঙ্গাধারানিভ শুভ্র-মুক্তাহারশোভিনী, সুমেরুগিরিসন্নিভা কস্তুরীপত্রচিত্রিতা, মঙ্গলার্হস্তনযুগশালিনী, নিতম্বশ্রোণিভারার্তা ও নবযৌবনসংযুক্তা।
পক্ষান্তরে, জয়দেবের রাধা সব্রীড় ঈক্ষিতসখীবদনা, দন্তরুচিকৌমুদীযুক্তা, স্কুরদধরসীধুশালিনী, কমলমুখী, খরনয়নশরঘাতবর্ষিণী, তন্বী, নীলনলিনীভিলোচনা, কুচকুম্ভোপরি-পরিহিত-মণিময়হারা, অলক্তরস-রঞ্জিত-স্থলকমলগঞ্জিপদযুগলা।
এ দুটি বর্ণনায় শ্রীকৃষ্ণের রমণোৎসুকত্ব বজায় থাকলেও স্বর্গীয় ও মর্ত্যভাবের পার্থক্য স্পষ্টই পরিলক্ষিত হয়।
রূপ গোস্বামী (আনুমানিক ১৪৭০-১৫৫৯) প্রণীত বঙ্গীয় বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের দুটি প্রধান আকর গ্রন্থের একটি হলো উজ্জ্বলনীলমণি। উক্ত গ্রন্থে শ্রীরাধিকার কান্তরূপ ষোড়শ শৃঙ্গারধারণ করে বিরাজিত, এমন পরিচয় আছে—
তত্র সুষ্ঠু কান্তস্বরূপা যথা।— কচান্তব সুকুঞ্চিতা মুখমধীরদীর্ঘ্যেক্ষণং কঠোরকুচভাগুরঃ ক্রশিমশালিমধ্যস্থলম্। নতে শিরসি দোলতে করজরত্নরম্যৌ করৌ বিধুনয়তি রাধিকে! ত্রিজগদেষ রূপোৎসবঃ।
অথ ধৃতষোড়শশৃঙ্গারা।— স্নাতা নাসাগ্রজাগ্রন্মণিরসিতপটা সূত্রিণী বদ্ধবেশিঃ সোত্তংসা চর্চ্চিতাঙ্গী কুসুমিতচিকুরা প্রবিণী পদ্মন্তো। তাম্বুলাস্যোরুবিন্দুস্তবকিতচিবুকা কজ্জ্বলাক্ষী সুচিত্রা রাধালক্তোজ্জ্বলাঙ্ঘিঃ স্ফুরতি তিলকিনী ষোড়শাকল্পিনীয়ম্।। (শ্রীরাধা-প্রকরণ, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্লোক)
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের শ্রীকৃষ্ণ জন্মখণ্ডের ১৩শ অধ্যায়ে 'রাধা' শব্দের ব্যুৎপত্তি লিখিত আছে। গোপাঙ্গনা রাধা বৃন্দাবনের নিধু-নিকুঞ্জবনে এসে গোপনে কৃষ্ণের সাথে লীলা করতেন। পুলিনে রাসবিহার হতো। আয়ান ঘোষ তা জানতে পেরে রাধার উপর ক্রুদ্ধ হলেন। জটিলা-কুটিলার গঞ্জনায়, রাধার মানরক্ষার্থে কৃষ্ণের কালীমূর্তি-ধারণ ও রাধা কর্তৃক তাঁর পূজা। রাধার সতীত্ব পরীক্ষার্থে জটিলা কর্তৃক সহস্র ছিদ্রপূর্ণ কলসিতে জল আনয়নার্থে আদেশদান। রাধার জল আনয়ন ও সেই জলে কৃষ্ণের রোগমুক্তি। চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে শ্রীকৃষ্ণের গমনের কারণে কৃষ্ণ-প্রেমোন্মাদিনী রাধার দুর্জয় অভিমান, নয়নসলিলে মানসরোবরের উৎপত্তি। কংসনিধনার্থে কৃষ্ণের মথুরাগমনে রাধার বিরহ, রাধার মথুরাগমন ও কৃষ্ণসম্মিলন প্রভৃতি বৃন্দাবনাত্মক রসাশ্রিত ঘটনা মূলত বৈষ্ণব কবিগণের ভক্তিপ্রেমোদ্দীপক অপূর্ব সব রচনা। বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীরাধিকার কৃষ্ণপ্রেমসম্বলিত সমস্ত ব্যাপারবিশেষ বৈষ্ণবসুধীবৃন্দের সখ্যভাবের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।
ভক্তমালগ্রন্থেও রাধার মায়ের নাম কীর্তিদা লিখিত আছে। তাঁর পিতামহের নাম মহাভানু ও মাতামহের নাম বিন্দু। পিতামহীর নাম সুখদা ও মাতামহীর নাম মুখরা। রত্নভানু ও সুভানু তাঁর খুল্লতাতদ্বয়। রুদ্রকীর্তি, মহাকীর্তি ও কীর্তিচন্দ্র মাতুল, মেনকা মাতুলানী, ভানুমুদ্রা পিসী ও কীর্তিমতী মাসী ছিলেন। তাঁর মেসোর নাম কাশ ও পিসার নাম কুশ। লবঙ্গমঞ্জরী, রূপমঞ্জরী, গুণমঞ্জরী, রতিমঞ্জরী, রসমঞ্জরী, বিলাসমঞ্জরী, রাগমঞ্জরী প্রভৃতি সুন্দরী রমণী দাসীভাবে সেবাপরায়ণা। শ্রীরাধিকার জীবনে তাঁর শ্রেষ্ঠ আট সখি তথা অষ্টসখির স্থান বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখছি:
(১) ললিতা: পিতার নাম বিশোক, মাতার নাম বিশারদী, স্বামীর নাম ভৈরব। ললিতা শ্রীমতী রাধিকার চেয়ে ২৭ দিনের বড়ো ছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীরাধিকার প্রধান সখি। (২) বিশাখা: পিতার নাম পারল, মাতার নাম (জটিলার বোনের মেয়ে) দক্ষিণা, স্বামীর নাম বাহিক। শ্রীমতী রাধিকার জন্মদিনেই এঁর জন্ম হয়। (৩) চিত্রা: পিতার নাম চতুর, মাতার নাম চার্বিকা স্বামীর নাম পিঠর। চিত্রা শ্রীমতী রাধিকার চেয়ে ২৫ দিনের ছোটো ছিলেন। (৪) চম্পকলতা: পিতার নাম আরাম, মাতার নাম বাটিকা, স্বামীর নাম চণ্ডাক্ষ। চম্পুকলতা শ্রীমতী রাধিকা হতে ১ দিনের ছোটো ছিলেন। (৫) রঙ্গদেবী: পিতার নাম রঙ্গসার, মাতার নাম করুণা, স্বামীর নাম বক্রেক্ষণ। রঙ্গদেবী শ্রীমতী রাধিকা হতে ৩ দিনের ছোটো ছিলেন। (৬) সুদেবী: রঙ্গদেবীর যমজ বোন, সুদেবী কনিষ্ঠা। সুদেবীর স্বামীর নাম রক্তেক্ষণ (বক্রেক্ষণের কনিষ্ঠ ভ্রাতা)। (৭) তুঙ্গবিদ্যা: পিতার নাম পুষ্কর, মাতার নাম মেধা। তুঙ্গবিদ্যা শ্রীমতী রাধিকা হতে ৫ দিনের বড়ো ছিলেন। (৮) ইন্দুরেখা: পিতার নাম সাগর, মাতার নাম বেলা, স্বামীর নাম দুর্বল। ইন্দুরেখা শ্রীমতী রাধিকা হতে ৩ দিনের ছোটো ছিলেন।
উজ্জ্বলনীলমণি'র শ্রীরাধা প্রকরণে রাধার দ্বাদশ আভরণের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই নবীন-যৌবনা কীরূপ গুণাবলীতে শ্রীহরির মন বেঁধেছিলেন, তার পরিচয় বিবিধ বৈষ্ণব গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণিত আছে।
পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে রাধাজন্মাষ্টমীব্রতমাহাত্ম্যে লিখিত হয়েছে—"মহর্ষি নারদ দেবাদিদেব মহাদেবের নিকট রাধাজন্মমাহাত্ম্য শোনার ইচ্ছে জানালে সদাশিব বলতে লাগলেন, রাজা বৃষভানুর মহিষী মহালক্ষ্মীস্বরূপা শ্রীমতী শ্রীকীর্তিদা হতেই বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীরাধিকা ভাদ্রমাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে শুভদায়ক মধ্যাহ্ন সময়ে জন্মলাভ করেন। রাধাজন্মোৎসবের পূজন, ভজন, ধ্যান ও কর্তব্যানুষ্ঠানাদি বলছি, শ্রবণ করো।"
এরপর তিনি শ্রীরাধিকার পূজাপ্রণালী সবিস্তারে বর্ণনা করলেন এবং বললেন—"উক্তরূপে ভক্ত সামর্থ্যানুযায়ী পূজার আয়োজন করে সংযতেন্দ্রিয় হয়ে পূজা করবেন।" পূজাকালীন ধ্যানও তিনি নির্দিষ্ট করে দিলেন—
হেমেন্দীবরকান্তিমঞ্জুলতরং শ্রীমজ্জগন্মোহনং নিত্যাভিললিতাদিভিঃ পরিবৃতং সন্নীলপীতাম্বরম্। নানাভূষণভূষণাঙ্গমধুরঃ কৈশোররূপং যুগং গান্ধর্বাজনমব্যয়ং সুললিতং নিত্যং শরণ্যং ভজে।
স্বয়ং মহাদেব বলেছেন—যে পুরুষ অথবা নারী রাধাকৃষ্ণপরায়ণ হয়ে বৃন্দাবনবাসী হবেন, তিনিই ব্রজবাসী ও রাধাকৃষ্ণের সঙ্গলাভ করবেন। তাঁর সাথে আলাপে মানুষ মুক্তবন্ধন হয়ে থাকে। যে-ব্যক্তি মুখে রাধা রাধা বলে, রাধানাম স্মরণ করে, রাধা রাধাই যার পূজা-নিষ্ঠা-জল্পনা, সেই মহাভাগ্যবান নিঃসন্দেহে বৃন্দারণ্যে রাধার সাহচর্য পেয়ে থাকে।
পৃথিবী ধন্যা এজন্য যে, পৃথিবীতে বৃন্দাবনপুরী বিদ্যমান। আজও সেখানে মুনিগণের আরাধ্যা রাধা বিরাজ করছেন; তিনি ব্রহ্মাদিরও মহারাধ্যা। সুরগণ দূর হতে যাঁর সেবা করেন, হে দেবর্ষি নারদ, সেই রাধাকে যে ভজনা করে, আমিও তার ভজনা করি। যে-জন কৃষ্ণের সাথে রাধানাম কীর্তন করে, তাঁর মাহাত্ম্যের শেষ নেই, আমিও তা বলতে সমর্থ নই।
নারদ মুনি এইসব বাক্য শুনে মহাদেবকে প্রণাম করে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী গোষ্ঠাষ্টমীতে পূজা আরম্ভ করেছিলেন। যে-ব্যক্তি রাধা-জন্মাষ্টমী ব্রতকথা শ্রবণ করে, সে ধনী, মানী, সুখী ও সর্বগুণে গুণান্বিত হয়। ধর্মার্থী, অর্থার্থী, কামার্থী ও মোক্ষার্থী যদি ভক্তিসংযুত হয়ে নাম, জপ, পাঠ বা স্মরণ করে, তাহলে তাদের নিজ নিজ অভীষ্ট-বস্তু লাভ হয়ে থাকে। (পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডের সদাশিবনারদ সংবাদে রাধাষ্টমীব্রতমাহাত্ম্যের ১৬৩ অধ্যায়ে বর্ণিত)
ভারতবর্ষের বৈষ্ণবসাধনায় ঠাকুরাণী শ্রীরাধা সর্বাগ্রগণ্য তত্ত্বরূপে স্বীকৃত হয়ে আছেন। দার্শনিক যুক্তি অনুসরণ করে ভক্তগণ শ্রীরাধার প্রামাণ্য নিরূপণে অগ্রসর হয়ে শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ-তন্ত্র-সংহিতা প্রভৃতি নানাবিধ স্তরাবলম্বনেই রাধা-কথার প্রামাণ্য সংস্থাপন করেছেন। এই সমুদয় দার্শনিক যুক্তি ও প্রমাণের অবসরে নানাবিধ পৌরাণিক উপাখ্যানমূলক লীলাকাহিনীও এই রসময়ী শ্রীরাধার প্রতি প্রেমিক ভক্তমাত্রকেই একান্তভাবে আকৃষ্ট করেছে।
এমন আকর্ষণের মূলানুসন্ধানের তথ্য থেকে অনুভব করা যায়, হিন্দুদের সর্বস্তরের সাধনপদ্ধতিতেই শক্তিমানের সঙ্গে শক্তিতত্ত্বও নিঃসংশয়রূপে স্বীকৃত হয়েছে। এমনকি বেদান্তের কঠোর জ্ঞানসাধনায় ও একক কূটস্থ (অপরিবর্তনীয় বা নিত্য) ব্রহ্মের পক্ষেও অঘটন ঘটানো সম্ভব হয়নি—মায়ারূপিণী স্বশক্তিকে অবহেলা করে। অন্যান্য ক্ষেত্রে, সাংখ্যাদিদর্শন বা তন্ত্রাদিতে তো তা সমধিক প্রসিদ্ধ। হিন্দুর সর্বথা বা সব বিচারে নির্ভরক্ষেত্র সর্বপ্রাচীন বেদশাস্ত্রেই তার স্পষ্ট প্রকাশ বিদ্যমান।
অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্রূপিণীর ব্রহ্মানুভূতিজনিত দেবীসূক্তে, রাত্রিসূক্তে, অথর্ববেদে, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্ এবং কেনোপনিষদ্ প্রভৃতিতে শক্তিতত্ত্বের রূপপরিচয় সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে এবং এভাবে মায়া বা ব্রহ্মশক্তিরূপে পৃথক প্রকাশসত্ত্বেও তাঁকে ব্রহ্মেরই জ্ঞানবলক্রিয়ারূপা স্বাভাবিকী বা স্বতঃস্ফূর্ত শক্তির পরিচয়ে উভয়ের অভিন্নতাই উপনিষদে দেখানো হয়েছে। অথচ এই অদ্বয় ব্রহ্মেরই একটা কল্পিত ভেদ অনুসরণ করে মায়া ও মায়ী বা শক্তি ও শক্তিমানরূপেই বিশ্বপ্রপঞ্চের মূলকারণত্বের পরিচয় দেওয়া হয় অর্থাৎ অদ্বয়াবস্থার যে বিভিন্ন প্ৰকাশ, তা মায়া বা শক্তি দ্বারাই সম্ভব—একথা উপনিষদ্সিদ্ধ তত্ত্ব।
তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ বলছেন, সগুণ ব্রহ্মের ইচ্ছে হল (সঃ অকাময়ত): ‘বহু স্যাম্’—‘আমি বহু হব।’ কিংবা বৃহদারণ্যকোনিষদে ব্রহ্মের যে অমোঘ সংকল্প—"তাঁর ইচ্ছা"–"স ঐচ্ছৎ"—এ ধরনের ব্রহ্মসংকল্প বা ব্রহ্মশক্তি একই তত্ত্ব। শক্তিতত্ত্ব বিষয়ে সাধকগণ তপস্যা দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, এই শক্তি আত্মগুণে নিগূঢ় বা এটি স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়াত্মিকা পরাশক্তি বা দেবাত্মশক্তি—"দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈর্নিগূঢ়াম্" (শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্)। এর প্রয়োজনীয়তাও তাঁরা জেনেছিলেন—এক ও অদ্বয় ব্রহ্ম একক অবস্থায় স্বাত্মভূত (সুখ-দুঃখ-মোহ ত্রিগুণে আত্মগত), তরঙ্গবৎ অনন্ত আনন্দরসময়ত্ব উপলব্ধি বা আস্বাদন করতে পারছিলেন না, সেজন্যই—অর্থাৎ আত্মস্বরূপোলব্ধির প্রয়োজনেই তিনি সগুণরূপে স্বয়ংই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লেন।
তারপর ক্রমধারার শক্তির অবস্থান্তর দ্বারা অনন্তভাবের মধ্যে নিজেকে অনুপ্রবিষ্ট করে সর্ব-রসাস্বাদন করলেন। নারদপঞ্চরাত্র এ কথাটিকে বড়ো সুন্দর করে সমর্থন করা হয়েছে। এ শক্তিতত্ত্বটিকে আর পৃথক তত্ত্ব বলা চলে না। যদি তাঁর শক্তি আর তিনি অভিন্ন, তবে তাঁর সে স্বরূপ যে সর্বদানন্দময়তা, শক্তিরও তাহলে একই রূপটিই এসে গেল। বিবিধ তন্ত্র এজন্যই চিন্ময়ী বা আনন্দময়ীর কথা বহুভাবে উল্লেখ করে থাকেন।
এখন কথা হলো, এই চিন্ময়ী বা আনন্দময়ীই যদি শক্তির স্বরূপ, তবে তাঁরই পরিণামভূত এই জগৎপ্রপঞ্চেরও চিন্ময়তা ও আনন্দময়তা হওয়াই সংগত, দুঃখাদি বা জড়তা কখনও হতে পারে না; অথচ তা-ই প্রত্যক্ষসিদ্ধ। এক্ষেত্রে তন্ত্রশাস্ত্র, বৈষ্ণবশাস্ত্র ও পুরাণাদিতে দেখা যায়, শক্তিরও আবার ভেদ স্বীকার করা হয়েছে—স্বরূপশক্তি বা চিৎশক্তি, মায়াশক্তি এবং জীবশক্তি বা তটস্থাশক্তি। অর্থাৎ সগুণস্বরূপে ব্রহ্ম যেমন আত্মোপলব্ধির প্রেরণায় নিজেই দ্বিধাবিভক্ত হলেন, তেমনি ব্ৰহ্মবিভাগজা শক্তিও সৃষ্টিপ্রেরণায় পুনরায় ত্রিধাবিভক্ত হয়েছেন। তখন স্বরূপশক্তি ভিন্ন অপর দুটিও এসে গেল— মায়াশক্তি ও জীবশক্তি।
মায়াশক্তিই, সত্ত্ব রজঃ ও তমঃ—এই ত্রিগুণাত্মিকা, পরিণামিনী, এবং তা থেকেই লীলাবিলাসক্ৰমে হলো জগৎপ্রপঞ্চ। বিষ্ণুপুরাণ তা-ই বলেছেন—
বিষ্ণুশক্তিঃ পরা প্রোক্তা ক্ষেত্রজ্ঞাখ্যা তথাপরা। অবিদ্যা-কর্মসংজ্ঞান্যা তৃতীয়া শক্তিরিষ্যতে॥ (৬/৭/৬১)
অর্থ: বিষ্ণুশক্তি বা স্বরপশক্তি হলো পরা বা আত্মিক। ক্ষেত্রজ্ঞা শক্তি, যা জীবভূতা, তা হলো দ্বিতীয়া, তা-ই তটস্থাশক্তি। তৃতীয় হলো অবিদ্যা বা প্রকৃতি অর্থাৎ মায়াশক্তি।
স্বরূপভূতা বিষ্ণুশক্তিকে আবার ত্রিধা ভাগ করা হয়েছে—সন্ধিনী, সংবিৎ ও হ্লাদিনী; অর্থাৎ ব্রহ্মের সৎ, চিৎ ও আনন্দ— এই তিন তত্ত্বে তিন ভাব—ত্ৰিভাবে ত্রিশক্তি। তাই স্বরূপভূতা শক্তিই সচ্চিদানন্দতত্ত্বের ত্রিভাবে সন্ধিনী, সংবিৎ ও হ্লাদিনীময়ী। শ্রীবিষ্ণুপুরাণে ১ম অংশে ১২ অধ্যায়ের ৬৯ শ্লোক বলছেন—"হ্লাদিনী সন্ধিনী সম্বিত্বয্যেকা সর্বসংস্থিতৌ।" (হ্লাদিনী—আহ্লাদকরী, সন্ধিনী—সত্তা, সম্বিৎ—বিদ্যাশক্তিঃ) অর্থাৎ হে ভগবান! হ্লাদিনী, সন্ধিনী এবং সংবিৎ এই তিন মুখ্য অব্যভিচারিণী স্বরূপভূত শক্তি সর্বাধিষ্ঠানভূত তোমাতেই অবস্থিত।
তাতেও ভগবানের সৎ-চিৎ ও আনন্দতত্ত্বের মধ্যে প্রথম দুটি হলো অন্তিমেরই পরিপূরক, আনন্দ বা হ্লাদিনীতেই হয়ে থাকে সর্বতত্ত্বের পূর্ণতা; অর্থাৎ লৌকিক জগতেও যেমন সকল বৃত্তিরই পরিণামে আনন্দপ্রাপ্তিই চরম সার্থকতা, তেমনি লোকাতীত ক্ষেত্রেও আনন্দ-পর্যবসিত হওয়াতেই তাদের সার্থকতা। সুতরাং হ্লাদিনীতে গিয়েই সর্বতত্ত্বের পরাকাষ্ঠা।
এই স্বরূপ-শক্তিকেই বলা হয় যোগমায়া। ভগবানের সঙ্গে এর সাক্ষাৎ যোগ রয়েছে বলে ইনি কখনও ভগবৎস্বরূপকে আচ্ছন্ন করেন না; কারণ ইনিও তো চিৎরূপিণী, তাই ইনি বরং ভগবদ্তত্ত্বকেই প্রকাশিত করে দেন। ব্রহ্মা চণ্ডীতে এই আত্মমায়া যোগমায়ারই আরাধনা করেছিলেন, বাহ্যমায়ার নয়। বাহ্যমায়াই সত্ত্বাদিগুণময়ী ও জগৎরূপে পরিণামশীলা এবং ব্রহ্মের স্বরূপাবরণী। পুরাণে বা ভক্তিশাস্ত্রে এভাবে শক্তির বিভেদ অত্যন্ত স্পষ্ট। দার্শনিক-সিদ্ধান্তে এভাবে মায়ার বিভেদ প্রতীয়মান না হলেও তা একেবারে বিভেদবিহীন—এটাও বলা যায় না। সেক্ষেত্রেও মায়া ও অবিদ্যা মূলত অভিন্ন হলেও একটা বিভেদ প্রদর্শনের চেষ্টাও আছে।
শুদ্ধসত্ত্ব ও অশুদ্ধসত্ত্বের আশ্রয় দ্বারা মায়া ও অবিদ্যা—এ দুটি সংজ্ঞার কথা দর্শনশাস্ত্র পঞ্চদশী'তে বলা হয়েছে। আর এভাবে শক্তি দ্বারা জগৎসৃষ্টি প্রভৃতির লীলায় ভগবান নিজে আপনশক্তিতে অনুপ্রবেশ করে আছেন বলে এই বিশ্বপরিণাম মূলত ভগবৎ-পরিণামই হয়ে দাঁড়াল। এর কারণ, যদিও এই প্রাকৃত-শক্তির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকে না, অর্থাৎ তিনি যেন আত্মবিভাগ করে প্রকৃতিসৃষ্টি দ্বারা তাতেই সকল কর্মভার ন্যস্ত করে কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। যেহেতু তিনি কেবলই আনন্দ-অনুভবস্বরূপ, আত্মারাম; তবু নিজেরই প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টিবিস্তার করে নিজেই তাতে লীলাস্বাদন করেন বলে তাঁরই সৃষ্ট তাঁর থেকে ভিন্ন শক্তির পরিণামে তাঁর পরিণাম হতে আর অবশিষ্ট কী রইল? অথচ প্রাকৃত বস্তুর মতো বিকারী পরিণামভূত নয় বলে এটি অচিন্ত্য অর্থাৎ তর্কের বহির্ভূত বিষয়।
তাহলে দেখা গেল, ভগবদ্নিহিত অনন্ত ভাবতরঙ্গ একক ব্রহ্মে অব্যক্তরূপে স্তিমিত ছিল, শক্তি দ্বারাই তাদের প্রকাশ সম্ভব হলো; অর্থাৎ ভগবানের সকল ঐশ্বর্য ও মাধুর্য নামের ভাবে প্রকটিত হলো। ব্রহ্মের ঐশ্বর্য সম্পর্কে তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ বলছেন—"ভীষাস্মাদ্বাতঃ পবতে ভীষোদেতি সূর্যঃ। ভীষাস্মাদগ্নিশ্চেন্দ্রশ্চ মৃত্যুর্ধাবতি পঞ্চমঃ।।" (২/৭/১) অর্থাৎ তাঁর ভয়ে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাঁর ভয়ে সূর্য উদিত হয়, তথা তাঁর ভয়ে অগ্নি, ইন্দ্র, মেঘ এবং মৃত্যু ঘটে থাকে।
ব্রহ্মের মাধুর্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ (২/৭/১) থেকে 'দুঃখ' প্রবন্ধে লিখছেন—"রসো বৈ সঃ। তিনিই যে রসস্বরূপ। অপূর্ণকে প্রতি নিমেষেই তিনি পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছেন বলিয়াই তো তিনি রস। তাঁহাতে করিয়া সমস্ত ভরিয়া উঠিতেছে, ইহাই রসের আকৃতি, ইহাই রসের প্রকৃতি। সেইজন্যই জগতের প্রকাশ আনন্দরূপমমৃতং—ইহাই আনন্দের রূপ, ইহা আনন্দের অমৃতরূপ।"
ভগবানের এই দুটি রূপের সন্ধান শ্রুতি, স্মৃতি প্রভৃতির দ্বারা জানা গেলেও তাঁকে লাভ করে তাঁর উপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত তা না জানারই তুল্য। এজন্য চরম জানার আকর্ষণেই ভগবদ্লাভ বা ব্রহ্মসিদ্ধি জীবের ঈপ্সিত। কিন্তু দণ্ডধর-রাজরূপে রাজার পরিচয় জানলেও দণ্ডদাতা ও দণ্ডার্হ ব্যক্তিতে যেমন ভীতি-সংকোচ, বিভেদ-ব্যবধান অবশ্যম্ভাবী, তেমনি ঐশ্বর্যময় ভগবানের স্বরূপোপলব্ধিতেও ভয়-সংকোচ বিনাশের আশা কোথায়?
ভয়ে ভক্তি আর নির্ভয়ের প্রেম কখনও এককথা নয়। অথচ শ্রুতি বলছেন, তিনি অভয়স্বরূপ। তাই প্রকৃত ভগবদ্পরায়ণ ব্যক্তি ভগবানের ঐশ্বর্যরূপের চেয়ে বরং ভগবানকে চান আত্মজনরূপে, বিবিধ সংকোচ-ব্যবধানের বিলয় করে আপনরূপে। এই আত্মজন হওয়া বা অপরকে আত্মজন করা—উভয় ক্ষেত্রেই, লৌকিক জগতেও দেখা যায়, প্রীতি-ভালোবাসাই অবলম্বনীয় পথ। তেমনি প্রীতি-প্রেমের মধ্য দিয়ে আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে আত্মজন করে নেওয়ার সাধনাই রসময় ভগবানের মধুর সাধনা।
কথা হলো, ক্ষুদ্র জীব এই বিশেষ শক্তি পাবে কোথায়? দার্শনিক ব্যাখ্যায় দেখা যায়, জীব বলে পৃথক কোনো সত্তাই নেই। ব্রহ্মই প্রকৃতিপরিণত বুদ্ধিতত্ত্বে প্রতিবিম্বিত, তা-ই বলা হয়েছে 'যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ' গ্রন্থের উৎপত্তিপ্রকরণ অংশে—"অনেন জীবেনাত্মনাহনুপ্রবিশ্য"। অথবা যদি ভিন্নরূপতাও স্বীকার করে অংশ, কলা প্রভৃতি বলে সিদ্ধান্ত করা যায়, তাতেও জীবের মধ্যে ব্রহ্মের স্বভাব প্রকারান্তরে মলিনভাবেও থাকতে বাধ্য; অর্থাৎ জীব যদি ব্রহ্ম বা ভগবানের অংশও হয়, তবু তার আত্মশক্তির সন্ধিনী, সংবিৎ ও হ্লাদিনীর একটা রূপ জীবের মধ্যে স্ফুট হোক কি অস্ফুট হোক, শুদ্ধ বা অশুদ্ধ হোক—তা রয়েছেই।
এতে বলা যায়, জীবের মধ্যে অবস্থিত ওই হ্লাদিনী শক্তিই প্রেমরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এই হ্লাদিনীর প্রকৃতস্বরূপ বা মূল অবস্থিতি হলো সন্ধিনী ও সংবিৎ-এরও পূর্ণতাপ্রাপ্তিতে, ব্রহ্মের রসরূপতায়। আনন্দ-ভূমিতে মানুষের মন যখন অবস্থান করে, তখন সমস্ত জগৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আনন্দময় হয়ে ওঠে। আনন্দ থেকে এই জগতের সৃষ্টি, আনন্দের দ্বারা বর্ধিত হয় এবং অবশেষে আনন্দ অভিমুখে প্রতিগমন করে, আনন্দে বিলীন হয়। “আনন্দ ব্রহ্মেতি ব্যজনাৎ”। (তৈত্তিরীয়োপনিষদ্, ২/৭) অর্থাৎ আনন্দই ব্রহ্ম।
মন যখনই এবং যেখানে শান্ত থাকে, এই আনন্দের ক্ষীনতম অনুভূতি আমাদের অন্তর শান্তিতে এবং খুশিতে ভরিয়ে দেয়। মনের মলিনতা এবং বিক্ষেপের জন্য আমরা নির্মল এই আনন্দ উপলব্ধি করতে পারি না। ব্রহ্মানন্দই আমাদের একমাত্র কাম্য। যেটুকু শক্তি আমাদের আছে, যেটুকু জ্ঞান আমাদের আছে, জীবনে যেটুকু আনন্দ পাই—সবই তাঁর কাছ থেকে পাই; যা পাই, তা যে বিশুদ্ধভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে পাই না, তার একমাত্র কারণ—আমরা ঈশ্বরের সাথে একাত্মতা অনুভব করি না; মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আমাদের অহংকার। আমাদের জীবনে চরম ও একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত, আমরা যেন শুদ্ধবুদ্ধির সহায়ে পরমানন্দস্বরূপ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে পারি।
পুরাণ ও ভক্তিশাস্ত্ৰ সকলেই একবাক্যে বলেছেন, এই পরিপূর্ণ হ্লাদিনীই রসময়ী শ্রীরাধা। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ তাই বলেছেন- "পরমাহ্লাদরূপা চ সন্তোষহর্ষরূপিণী"। এই স্বকীয় আহ্লাদ বা হর্ষ-আনন্দ বা রসরূপতা উপলব্ধির জন্যই অদ্বিতীয় ভগবান নিজেকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিলেন, তাই ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ বলছেন, রসময়ের রাসমণ্ডলে শ্রীরাধার সৃষ্টি—
রাসক্রীড়াধিদেবী চ কৃষ্ণস্য পরমাত্মনঃ। রাসমণ্ডলসম্ভূতা রাসমণ্ডলমণ্ডিতা।।
আপত্তি উঠতে পারে, এ তো হলো তত্ত্ব—ভাবময় অবস্থার বিশ্লেষণ; এটার সাথে বৃন্দাবনের গোপকন্যা বৃষভানুদুহিতা শ্রীমতী রাধার আবির্ভাবের সামঞ্জস্য কোথায়?
দার্শনিক যুক্তি অনুসারে, ব্রহ্মেরই শক্তি বা মায়া (বাহ্যমায়া) যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডরূপে বাস্তবে পরিণত হতে পারেন এবং স্বয়ং ভগবানও যদি লীলার জন্য মানবরূপে অবতীৰ্ণ হতে পারেন, তবে সেই দার্শনিক যুক্তিক্রমে ভগবানের সূক্ষ্ণতম হ্লাদিনী শক্তিই-বা স্থূলে এসে কেন বিগ্রহবতী হয়ে লীলানুচরী হতে পারেন না? বিশেষত লীলাই যেখানে জগতের মূলে—"লোকবৎ তু লীলাকৈবল্যম্" (ব্রহ্মসূত্র, ২/১/৩৩),—অর্থাৎ লোকে যেভাবে তাঁকে দেখে, তা কেবলই তাঁর লীলা।
শক্তি বাদে লীলাপ্রদর্শন অস্বাভাবিক। মায়াশক্তিতে লীলাপ্রদর্শন সম্ভব হলো, কিন্তু স্বরূপশক্তিতে তা অপ্রত্যাশিত—এর সদুত্তর কী? বরং বলা যায়, ভগবানের এ রহস্যময় পরম ভক্তিযোগ, যা দীর্ঘকাল জীবের অগোচরে ছিল, সেই পরম যোগতত্ত্ব জগতে ব্যক্ত করার জন্যই ভগবান ও ভগবতী মহাশক্তিকে মানুষের মধ্যে অবতীৰ্ণ হতে হয়েছিল গোপ-গোপিকারূপে। এভাবে দেখা যাচ্ছে, পরম-হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার সত্তা যেমন ভগবদ্স্বরূপ ভগবদ্ভিন্ন শুদ্ধানন্দরূপে, রসরূপে বিরাজিতা; তেমনি জীবের মধ্যেও রয়েছে প্রেম-ভালবাসারূপে মানব-মানবীর আকর্ষণ-বিকর্ষণের আকারে সর্বজীবের আনন্দরসানুভূতির রূপ।
অজ্ঞানাচ্ছন্ন জীব ভগবানের মতো তো মায়াধীন নয়, তাই মায়াবশ্যতা-নিবন্ধিত এ প্রেম কলুষিত, স্বার্থদ্বন্দ্বান্বিত, আত্মবাঞ্ছাপ্রবণ। তাই এ প্রেম প্রকৃত প্রেম নয়; একে বলা যায়: কামনাবাসনার হেতু কাম। সুতরাং তা যতই গভীর ও উন্মাদনাকর হোক, প্রেমের পর্যায়ে কিছুতেই পরিচিত হতে পারে না। তথাপি এই বীজটি মূল সত্তার কোরক। একে শুদ্ধ-শাস্য আত্মবাঞ্ছাহীন পরম তত্ত্বে উন্নীত করে নিতে পারলে সন্ধিনী ও সংবিৎ, দুই-ই পূর্ণতার মতো সিদ্ধিপ্রাপ্ত এবং পূর্ণতাপ্রাপ্তিতে তা যুগলমূর্তির হ্লাদিনীরূপে স্বরূপে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে; অর্থাৎ পরম প্রীতি বা বৈষ্ণবের ভাষায় 'পি-রী-তি' ভাবের সাধনায় আত্মসুখলিপ্সা তিরোহিত হলে প্রিয়তমের প্রীতিমাত্র সম্বলে সর্বত্র প্রিয়তমের শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ অনুভবের তন্ময়তায় গোপীভাবের সিদ্ধিতে ঘটতে পারে এই অন্তরস্থিত কলুষিত কামেরও নবরূপান্তর, প্রেমরূপা হ্লাদিনীর রূপায়ণে শ্রীরাধার স্বরূপপ্রকাশ।
জীবের মধ্যেও এই হ্লাদিনী বা শ্রীরাধার স্বরূপ প্রকটিত হলেই—এই রাধার সঙ্গে শ্রীভগবানের হবে মিলন-লীলা, জীবাত্মা-পরমাত্মার রসসঙ্গ। চিরমধুর ভগবানের মাধুর্যময় স্বরূপে এভাবে সঞ্চারিত হয় আনন্দরতি—ওই শ্রীরাধার স্বরূপ-অনুভূতিতে। বৃষভানুনন্দিনী মহাভাবময়ী শ্রীরাধার ভাই বৃন্দাবনভূমিতে মানবী তনুতে মহাপ্রকাশ—এভাবেই এসেছে জীবের জীবনে পরম সার্থকতা, তাঁর মহাবির্ভাবে ফল-সংসিদ্ধি।