লক্ষ্মীর উৎপত্তি ও আরাধনা

লক্ষ্মীদেবী বিষ্ণুপত্নীরূপে বর্ণিত হয়েছেন এবং বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে পদ্মালয়া, পদ্মা, কমলা, শ্রী, হরিপ্রিয়া, ইন্দিরা, লোকমাতা, মা, ক্ষীরাব্ধিতনয়া (ক্ষীরাব্ধিজা), রমা, জলধিজা, ভার্গবী, হরিবল্লভা, দুগ্গাব্ধিতনয়া, ক্ষীরসাগরসূতা প্রভৃতি নামে পরিচিতি পেয়েছেন। (আয়ুর্বেদ শাস্ত্রবেত্তা দেবেশ্বর প্রণীত প্রামাণ্য গ্রন্থ 'কবিকল্পলতা' অনুসারে)




ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে লক্ষ্মীর উৎপত্তির বিষয়ে এভাবে লেখা আছে—




কোনো সময়ে নারদ নারায়ণকে লক্ষ্মীর উৎপত্তি ও পূজাদির বিষয় জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, সৃষ্টির অগ্রভাগে রাসমণ্ডলস্থিত পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের বামভাগ হতে (জীবাত্মারূপিণী) লক্ষ্মীদেবী উৎপন্ন হন। তিনি অত্যন্ত সুন্দরী ও তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভা। তাঁর সকল অঙ্গ শীতকালে সুখজনক উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে শীতল, কটিদেশ ক্ষীণ, স্তনদ্বয় কঠিন ও নিতম্ব অতি বিশাল। এই দেবী স্থিরযৌবনা এবং তাঁর বর্ণ শ্বেতচম্পকতুল্য। তাঁর মুখমণ্ডল শারদীয় কোটি পূর্ণচন্দ্রের প্রভাকেও লজ্জা দেয়; লোচনদ্বয় শরৎকালীন মধ্যাহ্নের সুবিকশিত পদ্মকেও তিরস্কার করে।




এই দেবী উৎপন্ন হয়েই সহসা ঈশ্বরের ইচ্ছায় দুই রূপে বিভক্ত হন। এই উভয় মূর্তিই রূপে, বর্ণে, তেজে, বয়সে, প্রভায়, যশে, বস্ত্রে, ভূষণে, গুণে, হাসিতে, দর্শনে, বাক্যে, মধুরস্বরে, নীতিতে ঠিক সমান সমান। এই দুই মূর্তি রাধিকা ও লক্ষ্মী। কৃষ্ণের বামাংশসম্ভূতা মূর্তি লক্ষ্মী এবং দক্ষিণাংশসম্ভূতা দেবীই রাধিকা। রাধিকা উৎপন্ন হয়েই শ্রীকৃষ্ণকে কামনা করেন। পরে লক্ষ্মীও কৃষ্ণকে প্রার্থনা করেন। শ্রীকৃষ্ণ এরূপে উভয় কর্তৃক প্রার্থিত হয়ে উভয়েরই অভিলাষ পূরণ করেছিলেন।




তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দক্ষিণাংশ হতে দ্বিভুজ ও বামাংশ হতে চতুর্ভুজ, এই দুই ভাগে বিভক্ত হন। পরে দ্বিভুজ মূর্তিতে কৃষ্ণ রাধিকাকে গ্রহণ করেন এবং নিজের চতুর্ভুজ নারায়ণমূর্তি নিয়ে লক্ষ্মীর প্রার্থনা পূর্ণ করলেন। লক্ষ্মীদেবী স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে সমগ্র বিশ্ব লক্ষ করেন বলে তিনি দেবীগণের মহতী—এজন্য মহালক্ষ্মী নামে খ্যাতা। এভাবেই দ্বিভুজ কৃষ্ণ রাধিকাকান্ত এবং চতুর্ভুজ নারায়ণ লক্ষ্মীকান্ত হয়েছিলেন।




শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও গোপগোপীর সাথে গোলোকে (বৃন্দাবনে) থাকলেন এবং চতুর্ভুজ নারায়ণ লক্ষ্মীদেবীর সাথে বৈকুণ্ঠে গমন করলেন। কৃষ্ণ ও নারায়ণ উভয়েই সর্বাংশে তুল্য। এই লক্ষ্মীদেবী শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা। বৈকুণ্ঠধামই তাঁর পূর্ণাধিষ্ঠান নির্দিষ্ট হলো। তিনি প্রেমে নারায়ণকে আবদ্ধ করে সকল রমণীর প্রধানা হলেন।




এই লক্ষ্মীদেবী ইন্দ্রের সম্পত্তিরূপিণী স্বর্গলক্ষ্মীরূপে, পাতালে ও মর্ত্যে রাজগণের নিকট রাজলক্ষ্মীরূপে, গৃহীগণের গৃহে গৃহলক্ষ্মীরূপে, কলাংশ দ্বারা গৃহিণী ও সম্পদরূপে, গোগণের প্রসূতি সুরভিরূপে, যজ্ঞকামিনী দক্ষিণারূপে, ক্ষীরোদসাগরের কন্যারূপে (ক্ষীরোদসাগর বা ক্ষীরোদ সমুদ্র বা ক্ষীরসাগর হিন্দু পুরাণে বর্ণিত সপ্তসমুদ্রের অন্যতম। এই সমুদ্র পূর্বদিকে অবস্থিত বলে কল্পিত হয়। পুরাণানুসারে, এই সাগর অপ্সরাগণের বিহারস্থল ও বিষ্ণুর আবাসস্থল। পুরাণখ্যাত সমুদ্রমন্থনের ঘটনাটি এখানেই ঘটে। ক্ষীরোদসাগর মন্থন করে চন্দ্র, কামধেনু, লক্ষ্মী, অমৃত প্রভৃতি উঠেছিলেন।), চন্দ্রসূর্যমণ্ডলে, রত্নে, ফলাদিতে, নৃপপত্নীতে, দিব্যস্ত্রীতে, গৃহে, সমস্ত শস্যে, বস্ত্রে, পরিষ্কৃত স্থানে, দেবপ্রতিমাতে, মঙ্গলঘটে, মাণিক্যে ও মুক্তা প্রভৃতিতে শোভারূপে অবস্থান করছেন।




যেখানে সামান্য রূপও শোভিতাবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে লক্ষ্মীদেবী অবস্থিত জানতে হবে; কারণ একমাত্র লক্ষ্মীদেবীই শোভার আধার। তাঁর অবস্থান ব্যতীত শোভা থাকতে পারে না। লক্ষ্মীদেবী যেখানে বিরাজিত থাকেন না, তা হতশ্রী হয়ে থাকে।




লক্ষ্মীদেবী প্রথমে বৈকুণ্ঠধামে নারায়ণ কর্তৃক পূজিত হন। পরে ব্রহ্মা ও মহাদেব তাঁকে পূজা করেন। অনন্তর ক্ষীরোদসাগরে বিষ্ণু, মর্ত্যলোকে স্বয়ম্ভুব মনু, মানবেন্দ্রগণ, ঋষীন্দ্রগণ, মুনীন্দ্রগণ, সাধুগৃহীগণ ও পাতালে নাগগণ যথাক্রমে তাঁর পূজা করেছিলেন। পূর্বে ব্রহ্মা ভাদ্রমাসের শুক্লাষ্টমী হতে সমস্ত পক্ষ ভক্তিপূর্বক তাঁর পূজা দিয়েছিলেন, তখন থেকে ত্রিলোকমধ্যে সেই পদ্ধতিই প্রচলিত রয়েছে।




চৈত্র, পৌষ ও ভাদ্রমাসে শুদ্ধ ও মঙ্গলজনক দিনে বিষ্ণু তাঁর পূজা করেন, পরে ত্রিলোকবাসীও এই তিনমাসে লক্ষ্মীদেবীর পূজা করে থাকেন। মনু পৌষমাসের সংক্রান্তিদিনে প্রাঙ্গণ-মধ্যে লক্ষ্মীর পূজা করেন, ক্রমে এটাও জগতে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে রাজেন্দ্র, মঙ্গল, কেদার, বলদেব, সুবল, ধ্রুব, ইন্দ্র, বলি, কশ্যপ, দক্ষ প্রভৃতি সকলে তাঁর পূজা করেছিলেন। এভাবে সেই সর্বসম্পদস্বরূপিণী সকল ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী সবসময়ই সব জায়গায় সকলের দ্বারা বন্দিত ও পূজিত হচ্ছেন। লক্ষ্মীদেবী বৈকুণ্ঠে পূর্ণভাবে এবং চরাচরব্রহ্মাণ্ডে অংশভাবে বিরাজিত আছেন।




নারায়ণের নিকট লক্ষ্মীদেবীর উৎপত্তি প্রভৃতির বিবরণ শোনার পর নারদের মনে একটি মহাসংশয় উপস্থিত হয়, এই সংশয় নিবারণের জন্য তিনি ভগবানের নিকট প্রশ্ন করেন, লক্ষ্মীদেবী রাসমণ্ডলে আবির্ভূতা হন, কিন্তু এই লোকে তিনি সিন্ধুতনয়া নামে কীভাবে খ্যাতা হলেন? সাগরমন্থন করে দেবগণ কীভাবেই-বা লক্ষ্মীকে লাভ করেন? আপনি আমার এই সংশয় নিরাকরণ করে কৃতার্থ করুন।




তখন ভগবান নারদের প্রশ্নে একটু হেসে বললেন, নারদ! একসময় দুর্বাসা মুনির অভিশাপে দেবরাজ, দেবসমূহ ও মর্ত্যবাসী সকলেই শ্রীভ্রষ্ট হলে লক্ষ্মীদেবী রুষ্ট হয়ে পরম দুঃখিতান্তঃকরণে স্বর্গ পরিত্যাগ করে বৈকুণ্ঠধামে গমন করে মহালক্ষ্মীতে লীন হলেন। একদিন দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত কামোন্মত্তভাবে রম্ভাকে নিয়ে শৃঙ্গারে প্রবৃত্ত ছিলেন। এমন সময়ে হঠাৎ দুর্বাসা মুনি শঙ্করকে পূজা করার জন্য সে জায়গা দিয়া যাচ্ছিলেন। দেবেন্দ্র মুনীন্দ্রকে দেখে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় তাঁকে প্রণাম করাতে মহামুনি দুর্বাসা তখন তাঁকে আশীর্বাদ করে পারিজাত ফুল প্রদান করেন এবং এটা বলে দেন যে, এই ফুল সকল পাপনাশক ও সকল প্রকার মঙ্গলনিদান। তিনি আরও বলেন যে, যিনি ভক্তিপূর্বক শ্রীহরির চরণে নিবেদিত এই ফুল মস্তকে ধারণ না করেন, তিনি সকল স্বগণ-সহ শ্রীভ্রষ্ট হন।




ইন্দ্র তখন অতিশয় কামোন্মত্ত ছিলেন, তাঁর কর্তব্যাকর্তব্য বোধ ছিল না। সুতরাং দুর্বাসা মুনির প্রস্থানের পর তিনি ভুল করে ওই ফুল নিয়ে ঐরাবতের মাথায় প্রদান করেন। ঐরাবত ওই ফুল মাথায় ধারণ করেই ইন্দ্রকে পরিত্যাগ করে বনে গমন করল। ইন্দ্র তৎক্ষণাৎ স্বজনগণ-সহ শ্রীভ্রষ্ট হলেন। ইন্দ্রকে শ্রীভ্রষ্ট হতে দেখে রম্ভাও তখন তাঁকে পরিত্যাগ করে গেল, তখন ইন্দ্রের চমক ভাঙল।




ইন্দ্র মন খারাপ করে অমরাবতীতে গমন করলেন। সেখানে গিয়ে তিনি পুরী অমরাবতী নিরানন্দময়, শত্রুতে পরিপূর্ণ, দীনভাবাপন্ন এবং বন্ধুবান্ধবশূন্য দেখলেন; পরে দূতমুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে দেবগণের সাথে ব্রহ্মার কাছে গেলেন। সব শুনে ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বললেন, দেবেন্দ্র! তুমি আমার প্রপৌত্র, নিরন্তর শ্রীর আশ্রয়ে তুমি উজ্জ্বল দীপ্তি ধারণ করেছিলে। তুমি লক্ষ্মীসদৃশ শচীর ভর্তা, তবুও সবসময়ই তুমি পরস্ত্রীতে লোভ করে থাকো। এর আগে গৌতমের অভিশাপে তোমার সমস্ত দেহ যোনিচিহ্নে ভরে গিয়েছিল, আবারও নির্লজ্জের মতো তুমি পরস্ত্রী-রমণে প্রবৃত্ত হয়েছ। যে পরস্ত্রীর সাথে সংগম করে, তার শ্রী ও যশ নষ্ট হয়। এভাবে নানাপ্রকারে ইন্দ্রকে তিরস্কার করে লোক-পিতামহ ব্রহ্মা ইন্দ্রকে বললেন, এখন ভগবান বিষ্ণুকে আরাধনা করো, তাহলে তিনি তোমাকে আবার লক্ষ্মীপ্রাপ্তির উপায় নির্ধারণ করে দেবেন।




অতঃপর ইন্দ্র অতি কঠোরভাবে নারায়ণের উদ্দেশে তপস্যারত হলেন। নারায়ণ ইন্দ্রের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে লক্ষ্মীকে সিন্ধুকন্যারূপে জন্ম নিতে আদেশ করলে সকল দেব ও দানব মিলে সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। এই সমুদ্রমন্থনে ইন্দ্র সম্পদস্বরূপিণী লক্ষ্মীকে লাভ করেন। নারায়ণের আজ্ঞায় তাঁর‌ই নিজের অংশ হতে সিন্ধুকন্যারূপে লক্ষ্মী আবির্ভূত হন। সমুদ্র হতে উৎপন্ন হয়ে লক্ষ্মী দেবগণকে বরদান করেন, লক্ষ্মীর কৃপায় ইন্দ্র রাজ্যলাভ করেছিলেন ও শ্রীযুক্ত হয়েছিলেন। তখন সকলে মিলে লক্ষ্মীদেবীর স্তব করেন। (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ৩৩-৩৬)




লক্ষ্মীর ক্ষীরাব্ধি হতে আবির্ভাব সম্বন্ধে বিষ্ণুপুরাণে দেখি—শঙ্করাংশে জাত দুর্বাসা মুনি এক বিদ্যাধরীর কাছ থেকে সন্তানকফুলের দিব্য গন্ধমালা চেয়ে নিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে তা উপহার দিলেন। 'শ্রী'র নিবাসভূতা সেই মালা ইন্দ্র কর্তৃক অবহেলিত হলে দুর্বাসা ইন্দ্রকে শাপ দিলেন যে, তাঁর (ইন্দ্রের) ত্রৈলোক্য 'প্রনষ্টলক্ষ্মীক' হবে। এরূপে দুর্বাসার শাপে ত্রিলোকের শ্রী বা যশ বা লক্ষ্মী বিনাশপ্রাপ্ত বা অন্তর্হিত হলে হতবীর্য হৃতশ্রী দেবগণ অসুরগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে স্বর্গভ্রষ্ট হলেন। পিতামহ ব্রহ্মাকে নিয়ে দেবগণ দেবাদিদেব বিষ্ণুর শরণ গ্রহণ করলে বিষ্ণু দেবাসুরে মিলে সমুদ্র-মন্থনের উপদেশ দিলেন; সেই সমুদ্র-মন্থনের ফলেই-




ততঃ স্ফুরৎকান্তিমতী বিকাসিকমলে স্থিতা।
শ্রীর্দেবী পয়সন্তস্মাদুত্থিতা ভূতপঙ্কজা।।
(বিষ্ণুপুরাণ, ১/৯/৯৯)




তখন তাঁকে মহর্ষিগণ শ্রীসূক্তের দ্বারা স্তব করলেন, বিশ্বাবসু প্রমুখ গন্ধর্বগণ তাঁর সামনে গান করতে লাগলেন, ঘৃতাচী প্রমুখ অপ্সরাগণ নৃত্য আরম্ভ করলেন, গঙ্গাদি সরিৎসকল দেবীর স্নানার্থ উপনীত হলেন, দিগ্‌গজগণ হেমপাত্র গ্রহণ করে সর্বলোকমহেশ্বরী সেই দেবীকে স্নান করিয়ে দিলেন; ক্ষীরোদসাগর নিজে রূপধারী হয়ে অম্লানপঙ্কজা মালা দান করলেন এবং স্বয়ং বিশ্বকর্মা দেবীর অঙ্গবিভূষণ সম্পাদন করলেন। এইরূপে স্নাতা, ভূষণ-ভূষিতা এবং দিব্যমাল্যাম্বরধরা হয়ে সেই দেবী সকলের সমুখে বিষ্ণুর বক্ষঃস্থলই আশ্রয় করলেন।




লক্ষ্মীর এই সমুদ্রমন্থনে আবির্ভাব-বর্ণনের পর আরও কিছু পুরাণে বলা হয়েছে, ভৃগুপত্নী খ্যাতিতে উৎপন্না শ্রী (অথবা মতান্তরে দক্ষকন্যা শ্রী) দেবদানবের যত্নে অমৃত-মথনে পুনর্বার প্রসূত হন; অর্থাৎ লক্ষ্মীর এই দেব-কন্যাত্ব বা ঋষি-কন্যাত্ব‌ই লক্ষ্মীর পুনরাবির্ভাব। এই প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে, জগৎস্বামী জনার্দন যেমন বারবার নানাভাবে অবতার গ্রহণ করেন, তৎসহায়িনী শ্রী বা লক্ষ্মীদেবীও একই কাজটি করেন। হরি যখন আদিত্য (বামন) হয়েছিলেন, লক্ষ্মী তখন পুনশ্চ পদ্ম হতে উদ্‌ভূতা হন; যখন ভার্গব রাম হন, তখন ইনি ধরণী হয়েছিলেন; রাঘবত্বে সীতা, কৃষ্ণজন্মে রুক্মিণী এবং অন্যান্য অবতারেও ইনি বিষ্ণুর সহায়িনী। ইনি দেবত্বে দেবদেহা ও মনুষ্যত্বে মানুষী হয়ে বিষ্ণুর দেহানুরূপ আত্মতনু গ্রহণ করে থাকেন। (বিষ্ণুপুরাণ, ১/৯ অধ্যায়)




নারদীয়পুরাণ, ধর্মপুরাণ ও কুর্মপুরাণে আবার লক্ষ্মী ও সরস্বতী শিব-দুর্গার কন্যা। বাংলায় শরৎকালীন দুর্গাপূজার সময় ভগবতীর যে প্রতিমা প্রস্তুত করা হয়, তাতে দুর্গামূর্তির দক্ষিণে ও বামে দুর্গার দুই কন্যার ও কার্তিক-গণেশ দুই পুত্রের মূর্তি থাকে। এই দুই কন্যা জয়া-বিজয়া নামেও পরিচিতা, লক্ষ্মী-সরস্বতী রূপেও পরিচিতা; দেবীর দক্ষিণস্থা কন্যামূর্তি কমলবর্ণা, কমলাসনা এবং কমলহস্তা; বামস্থা মূর্তি হয় শ্বেতপদ্মারূঢ়া বা মরালবাহনা এবং বীণাহস্তা। বাংলার লৌকিক প্রবাদে লক্ষ্মী আবার কার্তিকের স্ত্রী। কখনো কখনো লক্ষ্মীকে গণেশের স্ত্রী বলেও কল্পনা করা হয়। এর কারণ বোধ হয় এই, দুর্গাপূজায় দেবীর শস্য-প্রতীক নবপত্রিকাটি অনেকসময় গণেশের পাশেই বসানো হয়। সান্নিধ্যহেতু এই নবপত্রিকাকে গণেশের স্ত্রী বলে ভুল করা হয়। এই শস্যরূপিণী নবপত্রিকাই আবার কোজাগর লক্ষ্মীপূজায় লক্ষ্মীর প্রতীকরূপে পূজিতা; এভাবেই বোধ হয় লোকবুদ্ধিতে লক্ষ্মী আবার গণেশের পত্নীত্ব লাভ করেছেন।




মার্কণ্ডেয়পুরাণে (১৮ ও ১৯ অধ্যায়) লক্ষ্মী দত্তাত্রেয় ঋষির পত্নী। অসুরগণ কর্তৃক লাঞ্ছিত দেবগণ দত্তাত্রেয়ের শরণাপন্ন হন; দত্তাত্রেয়ের পত্নী লক্ষ্মীর রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবগণ তাঁকে হরণ করে মাথায় তুলে নিয়ে যান; লক্ষ্মী এভাবে মস্তকে স্থাপিতা হওয়ার কারণেই দেবগণ বিজয়লাভ করেন।




প্রসঙ্গক্রমে আমরা লক্ষ করতে পারি, লক্ষ্মীর প্রাচীন মূর্তি কল্পনার ভেতরে গজলক্ষ্মীর প্রসিদ্ধি রয়েছে। এই গজলক্ষ্মীর পরিকল্পনাটি সাধারণত এরকম—সমুদ্রের মধ্যে একটি বিকশিত কমলের উপরে লক্ষ্মী দণ্ডায়মানা, তাঁর দুই দিক হতে দুইটি হস্তী শুণ্ড বা শুঁড়ের দ্বারা স্বর্ণকুম্ভের জলে (অথবা শুধু শুণ্ডোৎক্ষিপ্ত জলে) তাঁকে স্নান করাচ্ছে। আমরা শ্রীসূক্তের ভেতরেই লক্ষ করেছি, লক্ষ্মী নানাভাবে পদ্মের সাথে সংশ্লিষ্টা। (ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, ৩৯/৮ দ্রষ্টব্য) এই শ্রী বা লক্ষ্মী সৃষ্টিরূপিণী—সবদেশেই পদ্ম সৃজনীশক্তির প্রতীকরূপে গৃহীত। এই জন্যই বিষ্ণুর নাভিকমলে প্রজাপতি ব্রহ্মার অবস্থানের কল্পনা। এই জন্যই লক্ষ্মী শুরু থেকেই পদ্মা, পদ্মাসনা, পদ্মালয়া বা কমলা, কমলাসনা, কমলালয়া—এই কমল সলিলোদ্‌ভূত। সেইজন্যই কি লক্ষ্মীর সমুদ্রোদ্‌ভব কল্পনা করা হয়েছে?




আমরা শ্রীসূক্তেই লক্ষ করেছি, লক্ষ্মী পদ্মা, পদ্মবর্ণা, পদ্মস্থিতা, আবার 'আর্দ্রা'। এই পদ্ম ও সাগরের সাথে লক্ষ্মীর সম্বন্ধের ফলেই পরবর্তী কালের রাধা 'পদুমিনী'-র উদরে 'সাগর'-এর ঘরে (অর্থাৎ সাগরের ঔরসে, পদুমিনীর গর্ভে) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) বিষ্ণুপুরাণে দেখছি, সমুদ্রোদ্‌ভূতা পদ্মাসনা লক্ষ্মীকে দিগ্‌গজগণ এসে হেমকুম্ভের দ্বারা স্নান করাচ্ছে। এভাবেই কি সমুদ্রমধ্যে পদ্মস্থিতা লক্ষ্মীর সাথে দুই পাশে গজের কল্পনা গড়ে উঠেছিল? অবশ্য গজলক্ষ্মীর আর একটি রূপ পাওয়া যায়, তা আরও দুর্বোধ্য। সেই রূপে পদ্মস্থিতা লক্ষ্মী একহাতে একটি গজকে ধরে একবার গ্রাস করছেন, আবার তাকে বমন করে বের করছেন। ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা মঙ্গলকাব্যের প্রসিদ্ধ কবি মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ধনপতি-সদাগরের উপাখ্যানে যে 'কমলে কামিনী'-র বর্ণনা করেছেন, তাতেও লক্ষ্মীর এই হস্তী-গ্রাসকারিণী ও হস্তী-বমনকারিণী মূর্তিরই পরিচয় পাই। এই পরিকল্পনাটির উদ্‌ভব কীভাবে হয়েছে, তা স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও এই কল্পনাটিরও যে প্রাচীন ভিত্তি রয়েছে, শ্রীসূক্তের 'পুষ্করিণীং' শব্দের ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে আমরা তার উল্লেখ পাই।




কেউ কেউ এই পরিকল্পনার ভেতরে বৌদ্ধ উপাখ্যান বুদ্ধদেবের মাতৃগর্ভে আবির্ভাবের পূর্বে বুদ্ধ-মাতা মায়াদেবীর হস্তী গ্রাস ও বমনের স্বপ্নের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে আর একটি পৌরাণিক তথ্যও লক্ষণীয়। পুরাণে অঘটন-ঘটনপটীয়সী বিষ্ণুমায়ার বর্ণনায় স্থানে স্থানে বলা হয়েছে যে, এই দেবী সদেবাসুর-মানুষ সর্বজগৎকে গ্রাস করেন, আবার সৃজন করেন। (কুর্মপুরাণ, পূর্বভাগ, ১/৩৫) এটাই কি লক্ষ্মীদেবীর গজ-ভক্ষণ ও গজ-মোক্ষণের তাৎপর্য? বৃহদাকার পশু হস্তী কি এখানে বিরাট বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডেরই প্রতীক মাত্র? (পরবর্তীকালে কবীর, দাদু প্রভৃতি কবির প্রহেলিকা কবিতাতেও এর ইঙ্গিত দেখা গেছে।) 'তন্ত্রসার' প্রভৃতি গ্রন্থে লক্ষ্মীর যে-ধ্যানমন্ত্র দেখতে পাই, সেখানে লক্ষ্মীর উভয়পার্শ্বে হেমকুম্ভধারী করীদ্বয়ের উল্লেখ দেখতে পাই।




খিল-হরিবংশে দেখি, শ্রী, ধী ও সন্নতি নিত্যকৃষ্ণে বিরাজমানা। (১০১/৭৩) বিষ্ণুপুরাণে বিষ্ণুশক্তি মহামায়া ভূতি, সন্নতি, কীর্তি, ক্ষান্তি, দ্যৌ, পৃথিবী, ধৃতি, লজ্জা, পুষ্টি, ঊষা নামে অভিহিতা। (৫/১/৮১) অন্যান্য পুরাণেও বহুবিধা শক্তির উল্লেখ দেখতে পাই। শক্তির এ জাতীয় বহুবিধ উল্লেখের কথা আমরা পঞ্চরাত্র গ্রন্থগুলিতেও লক্ষ করেছি। তন্ত্রসারে ঈশ্বরী, কমলা, লক্ষ্মী প্রভৃতি লক্ষ্মীর দ্বাদশ নাম এবং স্কন্দপুরাণে লক্ষ্মী, পদ্মালয়া, পদ্মা, কমলা, শ্রী, ধৃতি, ক্ষমা প্রভৃতি সপ্তদশ নামের উল্লেখ পাই। বিষ্ণুর শ্রী ও ভূ—এই দুই শক্তি বা শ্রী, ভূ ও লীলা—এই ত্রিশক্তির উল্লেখও অনেক আছে। ব্রহ্মপুরাণে লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মীর ভেতরে বেশ ঝগড়া দেখা যায়। ব্রহ্মবৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, স্কন্দ প্রভৃতি পুরাণে লক্ষ্মীর প্রিয়-অপ্রিয় ব্যক্তি, কার্য ও স্থানের বিশদ আলোচনা রয়েছে।




পুরাণগুলির ভেতরে লক্ষ্মীর যে কতগুলি বর্ণনা রয়েছে, যেগুলি স্পষ্টত কোনো তত্ত্বাশ্রিত নয়, বরং তাতে লক্ষ্মী সম্বন্ধে জনগণের যে সাধারণ বিশ্বাস, তা-ই কবিত্বপূর্ণ বর্ণনায় প্রকাশ পেয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে বলা হয়েছে, মূলপ্রকৃতির ভেতরে যিনি দ্বিতীয় শক্তি, যিনি শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপা, তিনিই পরমাত্মা বিষ্ণুর লক্ষ্মী। তিনি সম্পদ-স্বরূপা, সমস্ত সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। তিনি মনোহারিণী, দান্তা, শান্তা, সুশীলা, মঙ্গলদায়িনী, লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধ, অহংকারাদি দোষবর্জিতা। তিনি পতিভক্তার অনুরক্তা, পতিব্রতা, আদিভূতা, ভগবৎ-প্রাণতুল্যা, প্রেমপাত্রী ও প্রিয়ভাষিণী। তিনি শস্যস্বরূপা, অতএব জীবের জীবন-রূপিণী, মহালক্ষ্মী। তিনি বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুসেবাপরায়ণা, স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী, রাজভবনে রাজলক্ষ্মী, মর্ত্যে গৃহলক্ষ্মী। তিনি সর্বপ্রাণী ও দ্রব্যের শোভাস্বরূপা। (কুর্মপুরাণ, পূর্বভাগ, ১২/২১৯) তিনি নৃপতির প্রভাস্বরূপা, বণিকের বাণিজ্যস্বরূপা, চঞ্চলের চঞ্চলা। (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড, ১/২২-৩০)




বিষ্ণুপুরাণের এক জায়গার লক্ষ্মী-বর্ণনা কোনো স্পষ্ট তত্ত্বমূলক না হলেও গভীর ভাবদ্যোতক। সেখানে বলা হয়েছে, বিষ্ণুর সেই অনপায়িনী শ্রী জগন্মাতা এবং নিত্যা; বিষ্ণু যেমন সর্বগত, ইনিও সেইরূপ। বিষ্ণু হলেন অর্থ, ইনি হলেন বাণী; হরি হলেন নয় (উপদেশ), ইনি নীতি। বিষ্ণু হলেন বোধ, ইনি বুদ্ধি; বিষ্ণু ধর্ম, ইনি সৎক্রিয়া। বিষ্ণু স্রষ্টা, ইনি সৃষ্টি; শ্রী ভূমি, হরি ভূধর; ভগবান সন্তোষ, লক্ষ্মী শাশ্বতী তুষ্টি। শ্রী ইচ্ছা, ভগবান কাম; বিষ্ণু যজ্ঞ, শ্রী দক্ষিণা; আদ্য- আহুতি হলেন এই দেবী, জনার্দন পুরোডাশ। লক্ষ্মী পত্নীশালা, মধুসুদন প্রাগ্বংশ; লক্ষ্মী চিতি (যজ্ঞের ইষ্টক-বেদী), হরি যূপ; শ্রী ইধ্যা, ভগবান কুশ। ভগবান সাম-স্বরূপী, কমলালয়া উদ্‌গীতি; লক্ষ্মী স্বাহা, বাসুদেব জগন্নাথ হুতাশন। ভগবান শৌরি শঙ্কর, ভূতি গৌরী; কেশব সূর্য, কমলালয়া তৎপ্রভা। বিষ্ণু পিতৃগণ, পদ্মা শাশ্বততুষ্টিদা স্বধা; শ্রী হলেন দ্যৌ, আর বিষ্ণু হলেন অতিবিস্তর অবকাশ। শ্রীধর হলেন শশাঙ্ক, শ্রী তাঁরই অনপায়িনী কান্তি। লক্ষ্মী ধৃতি জগচ্চেষ্টা, হরি সর্বত্রগ বায়ু। গোবিন্দ জলধি, শ্রী তাঁর বেলাভূমি; লক্ষ্মী ইন্দ্রাণী, মধুসূদন দেবেন্দ্র। লক্ষ্মী জ্যোৎস্না, সর্বেশ্বর হরি প্রদীপ; জগন্মাতা শ্রী লতা, বিষ্ণু হলেন দ্রুম। শ্রী হলেন বিভাবরী, চক্রগদাধর দেব হলেন দিবস; বিষ্ণু হলেন বরপ্রদ বর, পদ্মবনালয়া হলেন বধূ। ভগবান হলেন নদ, শ্রী নদী; পুণ্ডরীকাক্ষ ধ্বজ, কমলালয়া তাঁর পতাকা। লক্ষ্মী তৃষ্ণা, নারায়ণ লোভ; লক্ষ্মী রতি, গোবিন্দ রাগ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, দেবতির্যক্-মনুষ্যাদির মধ্যে পুরুষ হলেন ভগবান হরি, স্ত্রী হলেন লক্ষ্মী। (বিষ্ণুপুরাণ, ১/৮/১৫-৩২)




অষ্টলক্ষ্মী (আক্ষরিক অর্থে, 'আট লক্ষ্মী') হলেন দেবী লক্ষ্মীর আটটি বিশেষ শাস্ত্রীয় রূপ। তাঁরা সম্পদের আটটি উৎস তথা লক্ষ্মীদেবীর বিভিন্ন শক্তির প্রতীক। অষ্টলক্ষ্মী লক্ষ্মীর অপ্রধান রূপভেদ। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অষ্টলক্ষ্মীর সুপ্রাচীন মন্দির বিদ্যমান। অষ্টলক্ষ্মী কর্তৃক প্রদায়িত 'সম্পদ' কথাটির অর্থ হলো সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, জ্ঞান, শক্তি, সন্তানাদি ও ক্ষমতা। মন্দিরে অষ্টলক্ষ্মীকে একযোগে পূজা করা হয়ে থাকে।




শ্রীঅষ্টলক্ষ্মীস্তোত্রম্ অনুযায়ী অষ্টলক্ষ্মী হলেন:




আদিলক্ষ্মী বা মহালক্ষ্মী: লক্ষ্মীর আদিরূপ এবং ঋষি ভৃগুর কন্যারূপে লক্ষ্মীর অবতার। তিনি 'সাগরকন্যা' নামেও পরিচিতা। সমুদ্র-মন্থনের সময় এই আদিলক্ষ্মী প্রকটিত হন এবং শ্রীবিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেন।




ধনলক্ষ্মী: লক্ষ্মীর অর্থ ও স্বর্ণদাত্রী রূপ, অর্থাৎ তিনি সাধককে সকল বৈষয়িক সুখ ও সমৃদ্ধি প্রদান করেন।




ধান্যলক্ষ্মী: কৃষিসম্পদদাত্রী লক্ষ্মী, যিনি কৃষকের গৃহে নবান্নে ধান্যলক্ষ্মীরূপে পূজিতা হন।




গজলক্ষ্মী: গবাদি পশু ও হস্তীরূপ সম্পদদাত্রী লক্ষ্মী। এছাড়াও এই গবাদিপশু পালন থেকে যে আয় হয়, তা-ও গজলক্ষ্মীর কৃপা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। স্বামী চিদানন্দের মতে, গজলক্ষ্মী রাজক্ষমতাও প্রদান করেন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, গজলক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদ্রগর্ভ থেকে তার হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বসুধা নারায়ণ 'গজলক্ষ্মী' শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন—'গজ' অর্থাৎ 'হাতি'-দের দ্বারা পূজিত লক্ষ্মী।




সন্তানলক্ষ্মী: সন্তানসুখপ্রদায়িত্রী লক্ষ্মী।




বীরলক্ষ্মী বা ধৈর্যলক্ষ্মী: যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব এবং জীবনের কঠিন সময়ে সাহস প্রদানকারী লক্ষ্মী।




বিজয়লক্ষ্মী বা জয়লক্ষ্মী: বিজয় প্রদায়িনী লক্ষ্মী—কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং জীবনের কঠিন সময়ে বাধাবিপত্তি জয় করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রেও বিজয়ালক্ষ্মী গুরুত্বপূর্ণ দেবী।




বিদ্যালক্ষ্মী: কলা ও বিজ্ঞানের জ্ঞান রূপ ধন প্রদানকারিনী লক্ষ্মী।




কোনো কোনো অষ্টলক্ষ্মী তালিকায় লক্ষ্মীর অন্যান্য কয়েকটি রূপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে:




ঐশ্বর্যলক্ষ্মী: ঐশ্বর্যপ্রদাত্রী লক্ষ্মী।




সৌভাগ্যলক্ষ্মী: সৌভাগ্য প্রদানকারিনী লক্ষ্মী।




রাজ্যলক্ষ্মী: যিনি শাসককে আশীর্বাদ করেন এবং মূলত রাজগৃহে অবস্থান করেন।




বরলক্ষ্মী: যে দেবী সুন্দর বর বা আশীর্বাদ প্রদান করেন।




লক্ষ্মী কোন কোন স্থানে অবস্থান করেন এবং কোথায় অবস্থান করেন না, তা নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে এভাবে বর্ণিত হয়েছে—এই লক্ষ্মীচরিত্র পরম পবিত্র, যিনি ভক্তিপূর্বক তা শ্রবণ করেন, তাঁর অশেষ প্রকারে কল্যাণ সাধিত হয়। লক্ষ্মীদেবী সমুদ্র হতে উৎপন্ন হলে তার পরে অঙ্গিরা, মরীচি প্রভৃতি ঋষি তাঁকে পূজা ও স্তব করে বলেছিলেন, "মা! আপনি দেবতাদের গৃহে ও মর্ত্যলোকে গমন করুন।" জগজ্জননী লক্ষ্মী মুনীন্দ্রদের সেই বাক্য শুনে তাঁদেরকে বললেন, "আমি ব্রাহ্মণদের অনুমতিক্রমে দেবতাদের গৃহে ও মর্ত্যলোকে গমন করব। হে মুনীন্দ্রগণ! আমি যাদের গৃহে গমন করব, তার বিষয়ে শ্রবণ করো…




আমি সুনীতি-পুণ্যবান গৃহস্থ এবং রাজাদের ঘরে স্থিরভাবে থেকে তাদেরকে পুত্রের মতো প্রতিপালন করব। গুরু, দেবতা, মাতা, পিতা, বান্ধব, অতিথি এবং পিতৃলোক যাদের প্রতি রুষ্ট থাকেন, আমি তাদের ঘরে যাব না। যে-ব্যক্তি সবসময় দুশ্চিন্তা করে এবং ভয়ে অস্থির থাকে, যে শত্রুগ্রস্ত, যে অত্যন্ত পাপী, যে ঋণগ্রস্ত বা অতিকৃপণ—এমন সব পাপিষ্ঠের ঘরে আমি পা রাখব না। যে-ব্যক্তি দীক্ষা গ্রহণ করেননি, যে সবসময় শোকতাড়িত, অসৎবুদ্ধিসম্পন্ন, যে সবসময় স্ত্রীর বশীভূত, যার স্ত্রী ও মাতা বেশ্যা, যে-ব্যক্তি কটুভাষী ও সারাক্ষণই ঝগড়া করে, যার ঘরে সবসময়ই ঝগড়া-বিরোধ হয়, যার ঘর স্ত্রীলোকপ্রধান, তাদের ঘরে প্রবেশ করব না।




যে-ব্যক্তি হরিপূজা ও হরির গুণকীর্তন করে না, অথবা হরির প্রশংসা করার ইচ্ছেই যার নেই, যে-ব্যক্তি কন্যা-বিক্রয়, আত্ম-বিক্রয় ও বেদ-বিক্রয় করে, যে নরহত্যাকারক, হিংসাপরায়ণ, তাদের ঘর নরকতুল্য—সেখানে আমি যাব না। যে-ব্যক্তি কার্পণ্যদোষে দূষিত হয়ে মা, বাবা, স্ত্রী, গুরুপত্নী, গুরুপুত্র, অনাথ, বোন, মেয়ে এবং আশ্রয়হীন বন্ধুদের দেখাশোনা না করে সবসময় কেবল ধনসঞ্চয় করে, আমি কখনোই তাদের কাছে যাব না। যে-ব্যক্তির দাঁত অপরিষ্কার, পোশাক মলিন, মস্তক রুক্ষ, গ্রাস ও হাসি বিকৃত এবং যে মন্দবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি মলমূত্র ত্যাগ করার সময় ত্যাগকর্তাকে দেখে, যে-ব্যক্তি ভেজা পা নিয়ে শোয় বা পা না ধুয়ে শোয়, যে সকল পোশাক খুলে ঘুমায়, সন্ধ্যাকালে বা দিনের আলোয় শোয়—তাদের ঘরে আমি কখনও পা রাখব না।




যে-ব্যক্তি আগে মাথায় তেল দিয়ে তার পরে অন্য অঙ্গ স্পর্শ করে বা গায়ে তেল মাখে, তেল মেখে যে মলমূত্রত্যাগ বা প্রণাম করে কিংবা ফুল তোলে, যে-ব্যক্তি নখের সাহায্যে ঘাস ছেঁড়ে এবং মাটি খোঁড়ে, যার গায়ে ও পায়ে ময়লা থাকে—তারা আমার কৃপা পায় না। যে-ব্যক্তি সজ্ঞানে নিজের দেওয়া কিংবা পরের দেওয়া ব্রাহ্মণের বৃত্তি বা দেবতার বৃত্তি চুরি করে—তার ঘরে আমার স্থান নেই। যে মন্দবুদ্ধি বা শঠ, দক্ষিণা না দিয়ে যজ্ঞ করে, পাপী এবং মন্ত্র ও বিদ্যা দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে, যে-ব্যক্তি গ্রামযাজী, চিকিৎসক, পাচক ও দেবল, যে-ব্যক্তি ক্রোধবশত বিবাহকর্ম বা অন্যের ধর্মকাজের ব্যাঘাত করে এবং দিনের বেলায় মৈথুন-আচরণ করে—আমি এই ধরনের ব্যক্তির ঘরে যাই না। (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, ২১-২২)




স্কন্দপুরাণ‌ও অনুরূপ সুরে বলছেন—




সুমেরু শৈলের পৃষ্ঠে নারায়ণ সনে।
বিরাজ করেন লক্ষ্মী পুলকিত মনে।।
তৎকালীন কেশব কহেন কমলায়।
হে লক্ষ্মী! নরের কী-বা কর্মের দ্বারায়।।
সদা সুখে থাকো তুমি নিশ্চলা হইয়া।
শুনিতে বাসনা মম বল বিশেষিয়া৷৷ (১)




ওহে কৃষ্ণ! যার গৃহে ধবল-আকার পারাবত রহে। নারী রূপবতী যার।।
কলহ না থাকে, এই তিন যথা রয়। তথায় আমার স্থিতি জানিবে নিশ্চয়।। (২)




হে কৃষ্ণ! যে-জন ধান্যে ভাবয়ে কাঞ্চন।
তণ্ডুলেরে মনে করে রজত যেমন।।
অন্নেতে যাহার তুষ দর্শন না হয়।
তাহার গৃহে থাকি আমি জানিবে নিশ্চয়।। (৩)




হে কৃষ্ণ! যে-জন খাদ্য দ্রব্যাদি পাইয়া।
আপনি সকল নাহি ভক্ষণ করিয়া।।
বিতরণ করি তাহা করয়ে ভক্ষণ।
প্রিয়বাক্য সকলেরে কহে অনুক্ষণ।।
বহুদর্শী লোকের সংসর্গে সদা রহে।
রূপবান, আর বহু বাক্য নাহি কহে।।
কার্য উপস্থিত হলে করে সমাপন।
সেই পুরুষেতে থাকি, শুনো নারায়ণ।। (৪)




ধার্মিক ও রিপুগণে যেবা করে জয়।
বিদ্যাবান হয়ে, হয় স্তাবক নিশ্চয়।।
পর-পীড়নেতে আর নাহি ধায় মন।
অহংকার মনোমধ্যে করে না কখন।।
সকলের অনুরাগ করয়ে প্রকাশ।
সেই মনুষ্যেতে আমি সদা করি বাস।। (৫)




দীর্ঘকালাবধি স্নান করে যেইজন।
অল্পকাল মধ্যে করে সমাপ্ত ভোজন।।
পুষ্প পাইলেই তার নাহি লয় ঘ্রাণ।
উলঙ্গ নারীর দিকে ফিরিয়ে না চান।।
ওহে ভগবান! আমি বলিতেছি নিশ্চয়।
সেই জন আমার অত্যন্ত প্রিয় হয়।। (৬)




দান, সত্য, শুচিত্ব এ গুণত্রয় সার।
আর এক শ্রদ্ধা আছে, মতি তাতে যার।।
সেইজন আমার অত্যন্ত প্রিয় হয়।
ওহে ভগবান! ইহা জানিবে নিশ্চয়।। (৭)




আমার বাসের যে লক্ষণ প্রকরণ।
তার মধ্যে দান এক প্রধান কারণ।।
সেই দান শুদ্ধকালে কাশ্যাদি তীর্থেতে।
যেই নর দেয় কোনো উত্তম ব্যক্তিতে।।
ওহে ভগবান! সেই শ্রেষ্ঠ দান হয়।
সেই দানকর্তা মম প্রিয় অতিশয়।। (৮)




নিত্য আমলকী বৃক্ষে গোময়েতে আর।
শঙ্খেতে ও শুক্লবস্ত্রে স্থিতি কমলার।। (৯)




পদ্মরক্তোৎপলে, শঙ্খে, রেবতীমোহনে।
বৃষভবাহনশিবে, নারায়ণে, ধনে।।
পৃথিবীতে নৃত্যগীত যে যে গৃহে হয়।
হে কৃষ্ণ! তথায় থাকি জানিবে নিশ্চয়।। (১০)




যে প্রকার গুরুভক্তি শাস্ত্রমতে কয়।
সেইরূপ ভক্তিযুক্ত যে-রমণী হয়।।
পতির অনুজ্ঞা সদা করয়ে পালন।
পতির ভুক্তাবশেষ করয়ে ভোজন।।
সেই স্ত্রীর দেহে আমি সদা করি বাস।
স্বরূপ তোমারে এই বলি পীতবাস।। (১১)




হে কৃষ্ণ! যে নারী সদা হর্ষযুক্তা হয়।
স্থিরা ও সর্বদা লোকে প্রিয়বাক্য কয়।।
সৌন্দর্যবিশিষ্টা হয়, ভাগ্যশীলা আর।
লাবণ্যের দ্বারা প্রীতি জন্মায় সবার।।
সর্বদা যতনে করে পতির সেবন।
সেই স্ত্রীলোকেতে আমি থাকি অনুক্ষণ।। (১২)




শ্যামবর্ণা, মৃগসম শোভন নয়ন।
ক্ষীণমধ্যা, ভ্রূযুগল বিশেষ শোভন।।
সুকেশী, সুগতি আর সুশীলা স্বভাব।
সুগভীর নাভি, দন্তপঙ্‌ক্তি সমভাব।।
এ প্রকার সুশোভনা রমণী যে হয়।
তাহাতে আমার স্থিতি শুনো দয়াময়।। (১৩)




যে-নারী কুটিলা, আর পাপাচারে রত।
আপনি হইয়া কর্তা কার্য করে যত।।
আপনার পতিকে করিতে পরাজয়।
ক্রোধপরবশা হয়ে অনুক্ষণ রয়।।
সদা কাল হরে মন্দ আচার আচরি।
সেই প্রেতমুখী স্ত্রীকে আমি ত্যাগ করি।। (১৪)




বাসিপুষ্প, অনেকের সহিত শয়ন।
ভাঙা পিঁড়ি, দুষ্টা নারী করিবে বর্জন।।
তাহা হলে মম কৃপা না হইবে নিশ্চয়।
অলক্ষ্মীর চিহ্ন উপরোক্ত চতুষ্টয়।। (১৫)




চিতার অঙ্গার, হাড়, আর হুতাশন।
ব্রাহ্মণ, গোধন, আর অপর চরণ।।
কার্পাসের কাটি, আর গুরুতর জনে।
করিবে না কভু স্পর্শ এ সব চরণে।।
এ সকল পদ দ্বারা যেবা স্পর্শ করে।
সেই নরাধমে আমি ত্যজিব সত্বরে।। (১৬)




নখ আর কেশধৌতবারি ব্যবহার।
পর্বাদিতে সংক্রান্তিতে সন্ধ্যাকালে আর।।
বিলাস ও বস্ত্র ত্যাগ করিয়া শয়ন।
অন্যেরে না দিয়ে করে মিষ্টান্নভোজন।।
এই কয় দোষ যে জনাতে উপজয়।
তাহাতে আমার কভু কৃপা নাহি হয়।।
এই কয় দোষে লিপ্ত না রহে যে-জন।
আমি তারে কৃপা করি, ওহে নারায়ণ।। (১৭)




শুক্লপুষ্প মস্তকেতে যে করে ধারণ।
সর্বদা পবিত্র রাখে আপন চরণ।।
আপন বনিতা ভিন্ন অন্য বনিতায়।
কখনও না জন্মে মতি, আর অল্প খায়।
উলঙ্গ হইয়া কভু করে না শয়ন।
পঞ্চপর্ব যথামতে করয়ে পালন।।
বহুকাল কমলা ত্যজিলে সেই জনে।
তথাচ এ ছয় রূপ আচার কারণে।।
পুনর্বার লক্ষ্মী লাভ করে সেই জন।
নিশ্চয় এ কহিলাম, ওহে নারায়ণ॥ (১৮)




ঝাঁটার ধূলি ও বায়ু নাহি লাগে গায়।
নীল শেফালিকা পুষ্প না লয় নিশায়।।
বেল, শাক, দধি, আর কপিত্থ মান্দার।
রাত্রিকালে যেই জন না করে আহার।।
সেই জনে মম কৃপা হইবে নিশ্চয়।
অন্যথা নাহিক তাহে, শুনো দয়াময়।। (১৯)




আপনার অঙ্গ আর আপন আসন।
যেই জন কভু নাহি করয়ে বাদন।।
সর্বদা পবিত্র রাখে শিরঃ-পাদদ্বয়।
উচ্ছিষ্ট দ্রব্যাদি কভু মস্তকে না লয়।।
স্নান করি পুনঃ তৈল না করে মর্দন।
আমার কৃপার পাত্রী হয় সেই জন।। (২০)




অন্ধকারে শয়ন করিয়া কাল হরে।
দিবসেতে রাত্রিবাস পরিধান করে।।
মলিন বসন আর কুবেশেতে থাকে।
শুষ্কান্ন ভোজন করে; ত্যাগ করি তাকে।।
এ সকল অবশ্যই করিবে বর্জন।
তাহা হলে হবে মম কৃপার ভাজন।। (২১)




অন্যের দ্বারায় বক্ষ করায় মর্দন।
অন্যায় রূপেতে করে মাল্য আকর্ষণ।।
আলস্য ও অবসন্ন হয়ে সদা থাকে।
কঠিন মৃত্তিকা মাখে; ত্যাগ করি তাকে।।
এ সকল অবশ্যই করিবে বর্জন।
তাহা হলে হবে মম কৃপার ভাজন।। (২২)




শুক্রবার আর অমাবস্যায় যে-জন।
গন্ধদ্রব্য আর তৈল করে না স্পর্শন।
বাম করে নাহি স্পর্শে শির আপনার।
নিশ্চয় সে কৃপাকর্ত্রী হইবে আমার।। (২৩)




অশুচি হইয়া তারা, শশাঙ্ক, ভাস্কর।
দর্শন যে নাহি করে, সে-ই ভাগ্যধর।।
তাহাতে আমার কৃপা উপলব্ধি হয়।
সেই মম প্রিয়পাত্র, শুনো দয়াময়।। (২৪)




মম কৃপালাভ আশা করয়ে যে-জন।
পরধনে পরস্ত্রীতে রাখিবে না মন।
অন্যের অনিষ্ট নাহি সাধন করিবে।
সূর্যোদয় মাত্র শয্যা ত্যজিয়া উঠিবে।।
নখ কি কণ্টক কিংবা রক্ত মৃত্তিকায়।
অঙ্গার কি জল দ্বারা কখনও ধরায়।।
অনর্থক লিখিবে না, শুনো নারায়ণ।
তাহা হলে হবে মম কৃপার ভাজন।। (২৫)




আপনি গাঁথিয়া মালা পরয়ে গলায়।
আপনি চন্দন ঘষি মাখে নিজ গায়।।
নাপিতের নিকেতনে করিয়া গমন।
ক্ষৌরিকার্য সাঙ্গ করে এমন যে-জন।।
তাহার বিষয়ে আর কী বলিব বাড়া।
ইন্দ্রতুল্য হলেও সে হবে লক্ষ্মীছাড়া।। (২৬)




নিন্দিবে না গণক ও ব্রাহ্মণে কখন।
নাচাবে না পদদ্বয়, অতি অলক্ষণ।।
স্ত্রীলোকের প্রতি না করিবে কোপাচার।
ভোজন করিয়া দন্ত মাজিবে না আর।।
এই চারি কার্য যেই জন নাহি করে।
আমার বিশেষ কৃপা তাহার উপরে।। (২৭)




বৃথা মাংস বৃথা অন্ন-ব্যঞ্জনাদি আর।
অর্থাৎ অনিবেদিত যে করে আহার।।
নগ্নাস্ত্রী যে-জন আর দরশন করে।
ইন্দ্রতুল্য হইলেও তার লক্ষ্মী হরে।। (২৮)




গুরুদত্ত-মন্ত্রত্যাগী, পরস্ত্রীতে রত।
বিহিন পবিত্রমার্গ আচার বিরত।।
সেবনীয় ব্যক্তিকে না করিয়া সেবন।
অন্যের করয়ে সেবা হইয়া মগন।।
ইতর লোকের সম আচরণ করে।
সদা পরিবাদ যুক্ত হয়ে কাল হরে।
সে নিষ্ঠুর অহংকারী মানবে নিশ্চয়।
পরিত্যাগ করি আমি, শুনো দয়াময়।। (২৯)




আর্দ্রপদে গিয়া করে অমনি শয়ন।
দিবসেতে রাত্রিবাস বসন ধারণ।।
অর্থাৎ গামছা পরিধান করি রয়।
ভোজন করয়ে না ধুইয়া পদদ্বয়।।
এই সব আচরণ করে যেই নর।
নিশ্চয় তাহারে ত্যাগ করি, গদাধর।। (৩০)




আপন শরীর রাখে অশুচি করিয়া।
দুর্গন্ধ সংযুক্ত বস্ত্র থাকয়ে পরিয়া।।
দুঃখযুক্ত অলঙ্কার; এ সব ত্যজিবে।
প্রসাদিত পুষ্প শিরে ধারণ করিবে।।
তাহা হলে মম কৃপা হইবে নিশ্চয়।
নতুবা তাহার দুঃখ চিরস্থির হয়।। (৩১)




করে মুখে নাসিকায় আর হস্তে পায়।
পৃষ্ঠে নেত্রে চন্দন লেপিলে কষ্ট পায়।। (৩২)




চক্ষুতে যদ্যপি করে চন্দন লেপন।
হইবে মঙ্গল নষ্ট নিশ্চয় এমন।।
যদ্যপি চন্দন করে লেপন বদনে।
ধন নষ্ট হইবেক তাহার কারণে।
শ্রবনে চন্দন দিলে দরিদ্রতা পায়।
পদে পৃষ্ঠে দিলে আয়ু ক্ষয় হয় তায়।।
হস্তে ও নাসিকারন্ধ্রে, লেপিলে চন্দন।
বুদ্ধিনাশ হইবেক নিশ্চয় এমন।।
অতএব ওইসব স্থানে কদাচিত।
চন্দন লেপন করা না হয় উচিত।। (৩৩)




গন্ধ, পুষ্প, জল, রত্ন বহুমূল্যবান।
কিংবা বস্ত্র; যদি কোনো ব্যক্তি করে দান।।
প্রাপ্ত হয়ে পুনঃ তাহা ত্যাগ যেবা করে।
নিশ্চয় অশুভ তার ঘটিবে সত্বরে।। (৩৪)




ছাগলের পদধূলি, গর্দভের আর।
ঝাঁটার ও পদধূলি যোষিৎ জনার।।
স্পর্শ করিবে না, যদি স্পর্শ কেহ করে।
ইন্দ্রতুল্য হলেও তাহার লক্ষ্মী হরে।। (৩৫)




মলিন বসন পরি যেই জন রয়।
দন্ত না ধাবন করে খায় অতিশয়।।
সকল লোকেরে বলে কঠিন বচন।
সূর্য অস্তোদয়কালে করয়ে শয়ন।।
বিষ্ণুর সদৃশ যদি হয় সেই নর।
কমলা তাহাকে ত্যাগ করেন সত্বর।। (৩৬)




হস্ত দ্বারা তৃণভঙ্গ করা অনুক্ষণ।
নখের দ্বারায় করা ধরণীলিখন।।
পদ অপবিত্র রাখা, দন্তে মলা আর।
ম্লান বস্ত্র পরে, কেশ নহে পরিষ্কার।।
নিদ্রানীত হয় প্রাতঃ-সন্ধ্যার সময়।
শয়নসময়ে অঙ্গে বস্ত্র নাহি রয়।।
উচ্চহাস্য, বড়ো গ্রাসে করয়ে ভোজন।
নিজ দেহ নিজাসন করয়ে বাদন।
কুবের ও কেশবের এই কার্য জন্য।
হতশ্রী হইয়া থাকে কে-বা আর অন্য।। (৩৭)




হে কেশব! করিলাম যে সব কীর্তন।
যে-জন পালিবে মম নিষেধ বচন।
আর যাহা আচরিতে বলেছি তোমায়।
যে-জন সর্বদা হবে নিরত তাহায়।।
তাহার উপরে তুষ্ট হইব নিশ্চয়।
যেমত নিশ্চলা তব আছি, দয়াময়।। (৩৮)




শ্রীভাষিত এই মহা স্তব যেই জন।
প্রাতঃ আর সন্ধ্যাকালে করেন পঠন।।
ষড়ৈশ্বর্যে পূর্ণ হয় তাহার ভবন।
সংশয় নাহিক তাহে, জানিবে এমন।। (৩৯)




এই স্তব প্রীতমনে করিলে পঠন।
রোগ হতে পরিমুক্ত হবে রোগীগণ।।
বন্ধন বিমুক্ত হয় বন্ধক জনার।
সকল আপদ হবে নিশ্চয় সংহার।।
যে-প্রকার দিনকর হইলে উদয়।
সমুদয় অন্ধকার পরিত্যাগ হয়।। (৪০)




('লক্ষ্মীকেশব সংবাদ'-এ বর্ণিত লক্ষ্মীচরিত্র; পদ্যানুবাদ: শ্রীভোলানাথ মুখোপাধ্যায়)




গরুড়পুরাণ ১১৪ অধ্যায়ে এবং মার্কণ্ডেয়-পুরাণেও এই লক্ষ্মীচরিত্র বিশেষরূপে বর্ণিত হয়েছে। ধর্ম মানুষকে উন্নত করার জন্য‌ই সৃষ্ট। লক্ষণীয়, লক্ষ্মীকে প্রীত করার জন্য যা যা করতে বলা হয়েছে এবং যা যা করতে নিষেধ করা হয়েছে, তার মোটামুটি সবই মানুষের মঙ্গলার্থেই। প্রাচীন ঋষিকবি কৌশলে মূলত শুদ্ধচৈতন্যসমৃদ্ধ মানবাত্মার উদ্‌বোধনের বার্তাই দিয়ে গেছেন লক্ষ্মীর চরিত্রবর্ণনার আড়ালে।




স্বর্গে দেবগণ কর্তৃক লক্ষ্মী পূজিত হয়েছিলেন, এইজন্য মর্ত্যলোকেও তিনি মানুষ কর্তৃক পূজিত হয়ে থাকেন। পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র এই তিনমাসে লক্ষ্মীপূজার বিধান আছে। বিষ্ণু এই তিনমাসে লক্ষ্মীপূজা করেছিলেন, এজন্য এই তিন মাসেই লক্ষ্মীপূজা বিধেয়। এই তিনমাসে যে তিনবার পূজা হয়ে থাকে, চলিত কথায় তাকে লক্ষ্মীর 'খন্দপালা' (দেশজ ) পূজা বলে। লক্ষ্মীপূজা করে পূজার উদ্দেশ্যে হবিষ্যাশী হয়ে বিভিন্ন নিয়ম পালন করতে হয়। একে চলিত কথার 'পালুনী' বলে।




শুক্লপক্ষে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজা করতে হয়। শুক্লপক্ষীয় বৃহস্পতিবারে শুভ তিথিনক্ষত্রের যদি যোগ না হয়, তাহলে রবি ও সোমবারে পূজা করা যেতে পারে—এই পূজায় বৃহস্পতিবার মুখ্য এবং রবি ও সোমবার গৌণ। বৃহস্পতিবারে যদি পূর্ণা অর্থাৎ পঞ্চমী, দশমী বা পূর্ণিমা তিথি হয়, তাহলে ওই তিথিতে পূজা করাই বিশেষ প্রশস্ত। এর মধ্যে আরও একটু বিবেচ্য বিষয় আছে যে, পৌষমাসে দশমী, চৈত্রমাসে পঞ্চমী এবং ভাদ্রমাসে পূর্ণিমা তিথি বিশেষ উপযোগী। তিথি প্রতিপদ, একাদশী, ষষ্ঠী, চতুর্থী, নবমী, চতুর্দশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, অমাবস্যা ও অষ্টমী তিথিতে লক্ষ্মীপূজা নিষিদ্ধ। সংক্রান্তি, প্রথমমাস, অপরাহুকাল, ত্র্যহস্পর্শ দিন ও রাত্রিকালে এই পূজা করতে নেই। শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা ও পূর্বভাদ্রপদ, এই চারটা নক্ষত্র ও কৃষ্ণপক্ষে কখনও পূজা করা যাবে না।




একটি আঢ়ক ধান দ্বারা পূর্ণ করে সেটি নানা আভরণে ভূষিত করতে হবে, পরে ওই আঢ়কটিকে সুগন্ধ শুক্ল-পুষ্প দ্বারা পূজা করতে হয়। এই পূজায় পৌষমাসে পিষ্টক, চৈত্রমাসে পরমান্ন এবং ভাদ্রমাসে পিষ্টক ও পরমান্ন এবং নানাবিধ উপচার দ্বারা পূর্ব দিকে মুখ রেখে পূজা করতে হবে। যিনি যথাবিধানে এই লক্ষ্মীপূজা করেন, তিনি ইহলোকে নানাবিধ সুখসৌভাগ্য ভোগ করে মৃত্যুর পর বিষ্ণুলোকে গমন করে থাকেন বলে বিশ্বাস করা হয়। লক্ষ্মীদেবীর পূজা স্ত্রীলোকেই করবে, এমন বিধান দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে লক্ষ্মীপূজা হবে, সেখানে ঘণ্টা ও অন্যান্য বাদ্য বাজাতে নেই। ঝিন্টি ও কাঞ্চন ফুল দিয়ে লক্ষ্মীপূজা করা যাবে না। পদ্মফুল দিয়ে লক্ষ্মীপূজা করা হলে তা বিশেষ শুভজনক হিসেবে পরিগণিত হয়। স্কন্দপুরাণে এই বিধানসমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।




এই লক্ষ্মীপূজায় লক্ষ্মী, নারায়ণ ও কুবের এই তিন জনের পূজার বিধান দেখতে পাওয়া যায়। ওই দিনে সরস্বতীর পূজা এবং সরস্বতী পূজার দিনও লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে।




ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে লক্ষ্মীদেবী শ্বেতবর্ণা বলে কীর্তিত হয়েছেন—




শ্বেতচম্পকবর্ণাভা সুখদৃশ্যা মনোহরা
শরৎ পার্বণকোটিন্দুপ্রভাপ্রচ্ছাদিতাননা।
(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখণ্ড, ৩৫ অধ্যায়)




আবার অন্য জায়গায় ইনি গৌরবর্ণা বলে বর্ণিত হয়েছেন। বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণের যে-ধ্যানে লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে, সেই ধ্যানানুসারে, ইনি গৌরবর্ণা। ধ্যানটি—




পাশাক্ষমালিকান্তোজসৃণিভির্যাম্যসৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরূপাঞ্চ সর্বালঙ্কারভূষিতাম্।
রৌক্ষ্মপদ্মব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।




স্কন্দপুরাণোক্ত লক্ষ্মীর ধ্যান—




হিরণ্যবর্ণাং হরিণীং সুবর্ণরজতস্রজম্।
চন্দ্রাং হিরণ্ময়ীং লক্ষ্মীং জাতবেদসমাবহাম্।।
গৌরবর্ণাস্তু দ্বিভুজাং সিতপদ্মোপরিস্থিতামু।
বিষ্ণোবক্ষঃস্থলস্থাঞ্চ জগচ্ছোভাপ্রকাশিনীম্।।




শ্রীং লক্ষ্ম্যৈ নমঃ—এই মন্ত্রে পূজা করতে হয়। পরে লক্ষ্মী, পদ্মালয়া, পদ্মা, কমলা, শ্রী, ধৃতি, ক্ষমা, তুষ্টি, পুষ্টি, কান্তি, মেধা, বিদ্যা, রমা, শ্রুতি, হরিপ্রিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া ও নারায়ণপ্রিয়া এঁদেরকে লক্ষ্মীবীজ—'শ্রীং' মন্ত্রে পূজা এবং তার সাথে লক্ষ্মী নারায়ণ ও বৃহস্পতি কুবের এঁদের‌ও পূজা বিধেয়।




তন্ত্রসার-এ লক্ষ্মীর মন্ত্র ও পূজাদির বিষয় এভাবে বর্ণিত হয়েছে—




অথ বক্ষ্যে শ্রিয়ো মন্ত্রান্ শ্রীসৌভাগ্যফলপ্রদান্।
বস্যাঃ কটাক্ষমাত্রেণ ত্রৈলোক্যমপি বর্দ্ধতে।
(তন্ত্রসার)




'শ্রীং', এই একাক্ষর বীজই লক্ষ্মীর মন্ত্র—এই মন্ত্রে পূজা করলে নানাবিধ সুখসৌভাগ্য লাভ হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বীজমন্ত্র হলো একক মন্ত্র, যা তন্ত্র ও তান্ত্রিক হিন্দুধর্মে প্রদত্ত দেবতার সারাংশ ধারণ করে বলে বিশ্বাস করা হয়। এটি দেবতার আহ্বানের জন্য আচারানুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারিত হয়, যার মধ্যে এটিকে প্রকৃত নাম এবং সেইসাথে প্রকাশ হিসাবে গণ্য করা হয়। এটি প্রদত্ত দেবতার নামের প্রথম কয়েকটি অক্ষর দিয়ে তৈরি একটি রহস্যময় ধ্বনি বলে মনে করা হয়, যার উচ্চারণ অনুগামীকে আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করতে দেয়। এই মন্ত্রগুলি শরীরের চক্রের সাথেও যুক্ত।




প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপন করে পূজাপ্রণালী অনুসারে পীঠন্যাসাদি কর্ম সম্পাদন করতে হয়। পরে লক্ষ্মীর ধ্যান করে পীঠপূজাদি করতে হবে। এই ধ্যানে যথাবিধানে পূজা করে বিসর্জনাদি কর্ম সমাপন করতে হবে। "ঐং শ্রীং হ্রীং ক্লীং"—এই লক্ষ্মীর মন্ত্র চতুবর্গ ফলপ্রদ। এই মন্ত্রে পূজাদি করলে সুখ-সৌভাগ্য-সম্পদ লাভ হয়। এটা ছাড়াও "নমঃ কমলবাসিন্যৈ স্বাহা।"—এই দশাক্ষর মন্ত্রও সকল অভীষ্ট সিদ্ধিপ্রদ। "ওঁ ঐং হ্রীং শ্রীং ক্লীং হেসা জগৎপ্রসূত্যৈ নমঃ"—এই দ্বাদশাক্ষর মন্ত্রে মহালক্ষ্মীর পূজা করতে হয়।




এ সকল পূজার পদ্ধতি ও নিয়ম তন্ত্রসার-এ বিশেষভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে লক্ষ্মীদেবীর স্তব ও কবচাদির বিষয় বিবৃত হয়েছে। যিনি প্রতিদিন লক্ষ্মীদেবীর স্তব ও কবচ পাঠ করেন, তাঁর দারিদ্র্য থাকে না এবং নানাবিধ সুখ-সৌভাগ্য লাভ হয়ে থাকে।




আশ্বিনী পূর্ণিমার দিন কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা ও কার্তিকী অমাবস্যার দিন দীপান্বিতা লক্ষ্মীপূজা হয়ে থাকে।




গৌণচান্দ্র কার্তিক মাসের অমাবস্যা, কার্তিক মাসের অমাবস্যার দিন প্রদোষ সময়ে লক্ষ্মীপূজা করতে হয় এবং এই তিথিতে যথাসামর্থ্য পথ, আপণ, শ্মশান, নদীতট ও পর্বতসানুদেশ দীপমালা বিভূষিত করতে হয়। সূর্য তুলারাশিতে গমন করলে অর্থাৎ কার্তিক মাসে অমাবস্যা তিথিতে নানাবিধ উপকরণ দ্বারা পার্বণশ্রাদ্ধ করতে হবে এবং অপরাহ্ণ সময়ে রাজা নগরে ঘোষণা করবেন, "সকলেই লক্ষ্মীপূজা করো এবং চারিদিকে আলোকিত করার জন্য উল্কাদান করো।" এই ঘোষণার পর সকলে লক্ষ্মীপূজা ও উল্কাদান করবে। স্মার্তচূড়ামণি শ্রীরঘুনন্দন ভট্টাচার্যের লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থ 'তিথিতত্ত্বম্'-এ পূজার বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে।




যদি অমাবস্যা উভয় দিনব্যাপিনী হয়, তাহলে প্রদোষ ব্যাপ্তি দ্বারা সময় নির্ণয় করতে হবে, অর্থাৎ যে-দিনে অমাবস্যা প্রদোষ সময় পাবে, সেই দিন লক্ষ্মীপূজা হবে। কিন্তু যদি দুই দিনে প্রদোষ পায়, অর্থাৎ অমাবস্যা দুই দিনেই প্রদোষ পেয়েছে, এমন হয়, তবে পরের দিন লক্ষ্মীপূজা হবে। উভয় দিনে প্রদোষপ্রাপ্তি হলে পরের দিন লক্ষ্মীপূজা হবে, অমাবস্যা যদি পরদিন একদণ্ড‌ও রাত্রি প্রাপ্ত হয়, তাহলেও আগের দিন পরিত্যাগ করে পরদিন লক্ষ্মীপূজা করতে হবে। এর নাম সুখরাত্রিকা। যদি উভয় দিনের এক দিনেও প্রদোষপ্রাপ্তি না হয়, অর্থাৎ অমাবস্যার দুই দিনের কোনো দিনেই প্রদোষ না পায়, সেক্ষেত্রে পার্বণশ্রাদ্ধের অনুরোধে পরদিনে উল্কাদান এবং পূর্বদিনে লক্ষ্মীপূজা হবে।




এই অমাবস্যার দিন বালক ও অসুস্থ ব্যক্তি বাদে আর কারও দিনের বেলায় খাবারগ্রহণ করতে নেই। প্রদোষ সময়ে যথাবিধানে লক্ষ্মীপূজা করে দেবতার গৃহে দীপবৃক্ষ প্রদান করতে হবে এবং পরে চতুষ্পথ, শ্মশান, নদী, পর্বতসানু, বৃক্ষমূল, গোষ্ঠ, চত্বর, গৃহ ও ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য ভূমি প্রভৃতি সকল স্থান দীপাবলী প্রজ্জ্বলিত এবং বস্ত্রপুষ্পাদি দ্বারা সুশোভিত করতে হবে। এরূপ আলো দেওয়ার নাম দিওয়ালি। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল প্রদেশে বেশ ধূমধাম করে এর উদ্‌যাপন হয়। 'কালীকুলসদ্ভাব' নামক তান্ত্রিক গ্রন্থের মতে, এই দিনে মহানিশায় কালীপূজা করতে হয়।




কোজাগর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা বা লক্ষ্মীপূর্ণিমা। এই দিন নিশীথ সময়ে লক্ষ্মী বলেন—"আজ নারিকেল-জল পান করে কে জেগে আছে? আমি তাকে সম্পত্তি প্রদান করব।" পণ্ডিত সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য কর্তৃক সংকলিত 'পুরোহিত-দর্পণ' গ্রন্থে পাচ্ছি— "আশ্বিনে পৌর্ণমাস্যান্তু চরেৎ জাগরণং নিশি।। ইতি লিঙ্গপুরাণম্।




আশ্বিনের পৌর্ণমাসী নিশিতে জাগরণ করিবে। স্মার্ত ভট্টাচার্য মহাশয় এই স্থলে এরূপ ব্যাখ্যা করেন, যেদিনে প্রদোষ ও নিশীথ সময়-ব্যাপিনী তিথি প্রাপ্ত হইবে, সেই দিনেই কোজাগর-কৃত্য হইবে, যদি পূর্বদিনে নিশীথ সময়ে ও পরদিনে প্রদোষে উক্ত তিথি প্রাপ্ত হয়, তবে পরদিনে তৎকৃত্য হইবে। আর যদি পূর্বদিনে নিশীথকালে উক্ত তিথি হয় ও পরদিন প্রদোষ সময়ে উক্ত তিথিপাত না হয়, তাহা হইলে নিশীথব্যাপিনী তিথিতে, অর্থাৎ পূর্বদিনেই কোজাগর-কৃত্য করিবে।




নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ কো জাগর্তি মহীতলে। জগৎ প্রক্রমতে তস্যাং লোকচেষ্টাবলোকিনী।। তথা-নারিকেলোদকং পীত্বা অক্ষৈর্জাগরণং নিশি। তস্মৈ বিত্তৎ প্রযচ্ছামি কো জাগর্তি মহীতলে। ইতি লিঙ্গপুরাণম্।




আশ্বিনমাসের পূর্ণিমানিশীথে লক্ষ্মী বরদাত্রী হইয়া জগতে বিচরণ করিয়া দেখেন, কে নারিকেল জল পান করিয়া জাগরণপূর্বক অক্ষক্রীড়া (পাশাখেলা) করিতেছে ও তাহার জন্য চেষ্টা করিতেছে। এবং তিনি এই বাক্য বলেন যে, "অদ্য রাত্রিতে যে ব্যক্তি জাগরিত হইয়া অক্ষক্রীড়াদি করিবে, তাহাকে আমি বিত্ত প্রদান করিব।" অতএব এই দিনে ভক্তিপূর্ণহৃদয়ে লক্ষ্মীর পূজা করিতে হয় এবং রাত্রিতে নারিকেল ও চিপিটক দ্বারা পিতৃগণের ও দেবগণের অর্চনা করিবে। অতঃপর বন্ধুগণকে উহা ভক্ষণ করাইয়া নিজে ভক্ষণ করিবে।"




কোজাগর বা কোজাগরী একটি প্রত্যয়নিষ্পন্ন সংস্কৃত শব্দ—কঃ + √জাগৃ + অ। এটা আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি। এর অন্যান্য নাম দ্যূতপূর্ণিমা, লক্ষ্মীপূর্ণিমা, আশ্বিনী পূণিমা। দাশরথী রায়ের পাঁচালী'তে (১৩০৯) পাই "ঘুমে লক্ষ্মী হন বিরূপা, জাগরণে লক্ষ্মীর কৃপা, নৈলে কেন জাগে কোজাগরে"। এই তিথিতে অক্ষক্রীড়া নারিকেল-জলপান ও চিপিটক (চিড়া) ভক্ষণ বিহিত। কোজাগরী নিয়ে একটি সুন্দর প্রবাদও আছে। লক্ষ্মী দেবী মর্ত্যে এলেন। প্যাঁচা আনন্দচিত্তে দেবীর সঙ্গে সারারাত কোলাহল করে বেড়ালো। ভোরের আলো দেখে প্যাঁচা গাছের কোটরে ঢুকে পড়ে এবং আলো দেখে কাঠঠোকরা গাছের কোটর হতে বের হয়ে এল। দেবী কাঠঠোকরাকে দেখে ভাবলেন ইনিই তিনি, যিনি সারারাত আমার সঙ্গে ঘুরেছেন। খুশিমনে মুকুট দিলেন কাঠঠোকরার মাথায়। জন্ম হলো চাকমা প্রবাদের—প্যাঁচায় কুড়কুড়ায়, খোড়ইল্যা সোনার তুক পায়।




ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে কোজাগর বিধান এভাবে নির্ণীত হয়েছে—আশ্বিনমাসের পূর্ণিমার দিনে … এইদিনে গৃহের নিকটবর্তী সকল পথ পরিষ্কার ও সুশোভিত করবে এবং পুষ্প, অর্ঘ্য, ফল, মূল, অন্ন, সর্ষপ প্রভৃতি সংগ্রহ করে গৃহ ভূষিত করবে। এইদিন সকলেই উপবাস করে থাকবে। স্ত্রী, বালক, মূর্খ ও বৃদ্ধ ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হলে দেবতাদের অর্চনা করে খেতে পারে।




লিঙ্গপুরাণে লিখিত আছে—আশ্বিনমাসের পূর্ণিমার রাত্রিতে অক্ষক্রীড়া (পাশাখেলা) করিয়া জাগরণ করিবে, রাত্রিতে লক্ষ্মীপূজা করিবে এবং তখন ইন্দ্রেরও পূজা করিতে হয়। নারিকেল ও চিড়া দ্বারা পিতৃলোক ও দেবতার অর্চনা করিবে। নিমন্ত্রিত বন্ধুগণকেও তাহাই খাওয়াইবে, স্বয়ংও নারিকেল চিড়া খাইয়া থাকিবে। যে-দিনে প্রদোষ ও নিশীথ উভয়ব্যাপিনী পৌর্ণমাসী তিথি, সেইদিন কোজাগরকৃত্য করিতে হয়। পূর্বদিন নিশীথব্যাপিনী ও পরদিন প্রদোষব্যাপিনী হইলে পরদিন এবং পরদিন প্রদোষ না পাইলে পূর্বদিনেই কোজাগর কর্তব্য। (তিথিতত্ত্বম্)