রবিন কোথায় গেছে?


: রবিন কোথায় গেছে?
: সে আর নেই, মারা গেছে।
: মরে কোথায় গেছে?
: তুমি কোথা থেকে এসেছ?
: আমার মায়ের কাছ থেকে।
: তোমার মা কোথা থেকে এসেছে?
: আমার নানির কাছ থেকে।
: কী করে জানলে? তুমি নিশ্চিত?
: নিশ্চিত নই, তবে এরকমই তো হবার কথা!
: হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমরা সবাই-ই ‘হবার কথা’ নিয়ে বেঁচে আছি। এর উৎপত্তি আমাদের বিশ্বাসে, জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায়। আমরা ধরে নিচ্ছি, সবারই উৎপত্তি একই জায়গায়, মানে মায়ের গর্ভে। ধরো, তুমি যে চকলেটটা খাও, তা নানান আকৃতিতে বিক্রি হয়। চাইলে ওটাকে ফুল, নকশা, বৃত্ত বা অন্য জ্যামিতিক গঠন, এমন যে-কোনও কিছুরই রূপ দেওয়া যায়। তবে সবারই মূল উপাদান মোটামুটি একই। তাই এই অর্থে, যখন আমরা চকলেটের কথা বলি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে চকলেটের উপাদানের কথাই বলি। একেক চকলেটের একেক নাম, তবে সব চকলেটের মূলটা এক।
: কিন্তু ক্যাডবেরি তো ক্যাডবেরিই, ক্যাডবেরির সাথে স্নিকারস মিলবে না! তবে এদের মিলটা কোথায়?
: চকলেটের মূল উপাদান না থাকলে আমরা কি ওদের চকলেট নামে ডাকতাম? ক্যাডবেরিকে অন্য নামে ডাকলে কি তার স্বাদটা বদলে যাবে? কিংবা যদি কোনও নামেই না ডাকি, নির্দিষ্ট একটা কাজের মধ্য দিয়ে ক্যাডবেরিকে চেনাই, ওতেও কি কিছু এসে যায়? ধরো, আমরা এখন থেকে ঠিক করলাম, ক্যাডবেরি চকলেট মানেই পর পর তিনটা তালির আওয়াজ। মানে হাতে তিন তালি দিলেই বোঝা যাবে, আমরা ক্যাডবেরির কথা বলছি। তখন কি এর ধর্ম বদলে যাবে?
: না, একই থাকবে। কিন্তু কেউ কেউ তো ক্যাডবেরিকে অন্যভাবেও ডাকতে চাইতে পারে!
: ডাকুক না! কী এসে যায়? আমরা যখন আমাদের পোষা বেড়ালের নাম দিই মিনি, তখন তাকে মিনি ডাকতে ডাকতে সে একসময় বুঝে নেয়, মিনি শব্দটি উচ্চারণ করলে তাকে এখন সাড়া দিতে হবে। যদি বেড়ালের নাম দিই কুকুর, সেক্ষেত্রেও সে তা-ই করবে। এর মানে কী? বেড়ালের নিজের কোনও নাম নেই, আমরা যে নামে ডাকি, সে নামেই তার পরিচয়। এমনকী বেড়ালকে বেড়াল না বলে, অন্য নামে ডাকলেও-বা কী এসে যেত? নামটা যদি লেড়াব হতো, তা-ও প্রাণীটা বদলে যেত না। কারও যখন ঘুম পায়, তখন সে মুখে কিছুই না বলে যদি হাই তোলে, তাতেও আমরা ঠিক বুঝে যাই, তার ঘুম পেয়েছে। অর্থাৎ প্রতীক বা চিহ্নের বা সংকেতের সাহায্যেও এই পৃথিবীর সবকিছুকে সহজেই চেনানো যেত।
: তাহলে নামে কি কিছুই এসে যায় না?
: যায়, এর জন্য আমরা দায়ী। বাঘের নাম বাঘ দিয়েছি বলেই, কাউকে বাঘের বাচ্চা ডাকলে সে রাগ করে না। বাঘের নামটা গাধা দিলে গাধার বাচ্চা ডাকটাও একই গ্রহণযোগ্যতা পেত।
: কিন্তু প্রাণীদের নামে বিভিন্নতা থাকবেই। এ থেকে তো সরে আসা যাবে না, তাই না?
: সরে আসতে কে বলল? আমি শুধু এইটুকুই বলছি, যার নাম যা, তার উপর তার নিজের কোনও হাত নেই। সে বড়ো হয়েছে ওই নামে। নামটা তার অর্জন নয়। তাই কারও নাম দেখে তার সম্পর্কে অনুমান করে নেওয়া যায় না। তোমার মনে যা আছে, তোমার মতামত যা বলে, তোমার পছন্দ বা অপছন্দ যা ভাবে, তার সবই ছুড়ে ফেলে দাও। মনকে বোঝাও, নাম দিয়ে কাউকে চেনা যায় না। ধরো, তোমার সাথে দেখা করতে কেউ এল। তার নামটা যদি তুমি না জানো, তবে কি তোমার মনে নাম নিয়ে কোনও অনুরাগ বা বিরাগের সৃষ্টি হবে? নাম নিয়ে ভাববার আগে সবারই ভাবনা একই রকমের। সেই ভাবনায় থেকে গিয়ে যদি আমরা চলতে পারি, তবে এই পৃথিবীটা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
: তবে তো মানুষে-প্রাণীতে-গাছে’ও তেমন তফাত নেই। এদের সবাই পচনশীল, মৃত্যুর পর এরা সবাই-ই মাটিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
: পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবে না, প্রাণীদের ক্ষেত্রে কাঠামোটা থেকে যাবে। কাঠামো দেখে অন্য প্রাণীদের আলাদা করা গেলেও, মানুষদের আলাদা করা যাবে না। কার ধর্ম কী, কার দেশ কোথায়, কার অবস্থান কী, এসবের কিছুই আর থাকবে না। অ্যানাটমির ক্লাসে কঙ্কালের জাত, বর্ণ, ধর্ম কিছুই নেই, কেবলই বৈশিষ্ট্য আছে। উঁচু বংশের কারও কঙ্কাল নিচু বংশের কারও কঙ্কালের চাইতে আলাদা কোনও কদর পায় না সেখানে। এই সহজ জিনিসটা মাথায় রেখে যদি আমরা বাঁচতে পারি, তবে অনেক ঝামেলা এড়ানো যাবে। যাকে যে নামেই ডাকি না কেন, যাকে যে ধর্মেই চিনি না কেন, যাকে যে রঙেই বুঝি না কেন, যাকে যে অবস্থানেই জানি না কেন, সেইসব ডাকা-চেনা-বোঝা-জানা’র আগে আমাদের মাথায় একটাই বোধ থাকে, তা হলো, সে মানুষ। যদি কেবলই সেই বোধে থেকে গিয়ে তার কাজ ও আচরণ দেখে মানুষ হিসেবে সে কেমন, তা নিয়েই থেকে যাই শেষ পর্যন্ত, তবে অনেক ভুল বোঝাবুঝি ও দূরত্ব-সংঘাত অদৃশ্য হয়ে যাবে।
: তবে কি আমাদের মধ্যে আলাদা আলাদা বিশ্বাসও থাকবে না?
: বিশ্বাসকে আলাদা করে কে? আমরাই তো করি! ধরো, মুরগি যখন ডিমে তা দেয়, তখন সে তার সবটুকু মনোযোগ রাখে সেই ডিমটার উপর। ধৈর্য ধরে একমনে সে কেবলই তার বাচ্চার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার বিশ্বাস, এটাই তার দায়িত্ব, এটাই তাকে করতে হবে। মুরগি সাদা হোক, কালো হোক, আর লালই হোক, বিশ্বাস কিন্তু একই। হয়তো তা দেওয়ার ধরনে একটু-আধটু পার্থক্য থাকতে পারে, তবে উদ্দেশ্য ও ফলাফল সব মুরগির ক্ষেত্রেই অভিন্ন। একেক পথে গিয়েও একই ঠিকানায় পৌঁছে যারা, ওদের মধ্যে আদৌ কি কোনও পার্থক্য আছে?
: বুঝলাম। কিন্তু যে যে পথে হাঁটে, সে সে পথে একই গতিতে হাঁটে কি? এর হাঁটার ক্ষেত্রে একেকটা মানুষ একেক রকমের। তবে ওরা এক হয় কী করে?
: হাঁটার গতির ভিন্নতায় মানুষ ভিন্ন হয় না। তবে ভিন্নতা তৈরি হতে পারে মানুষের অর্জনে, অর্জনের সময়ে। বেড়াল যখন ইঁদুরের পেছন পেছন দৌড়োয়, তখন ইঁদুরটি গর্তে ঢুকে গেলেও বেড়াল অসীম আগ্রহ ও ধৈর্য নিয়ে গর্তের সামনে বসে থাকে, আর ইঁদুরটা বেরোলেই খপ করে ধরে ফেলে! যে বেড়ালের ধৈর্য নেই, সে বেড়ালের ভাগ্যে ইঁদুরও নেই। থাকলেও তা পেতে দেরি হয়। বেড়ালের মনের শক্তিতেই বেড়াল ইঁদুরের নাগালটা পায়। ইঁদুর কিন্তু গর্ত থেকে না-ও বেরোতে পারে! তবে বেরোলে সে বেড়ালের, যদি বেড়ালটা অপেক্ষা করতে জানে। ইঁদুর না-ও বেরোতে পারে, এটা মাথায় থাকে যে বেড়ালের, তার পক্ষে ইঁদুর ধরা কঠিন। মানুষের বেলাতেও তো এইসবই! এর বাইরে আবার কীসের ধর্ম, কীসের জাত, কীসের রং?
: সত্যিই! মানুষে মানুষে পৃথক হয়ে যায় প্রশ্নে, উত্তরে পৌঁছনোর পর মানুষে মানুষে কোনও পার্থক্যই নেই! ভালো কথা, রবিন কোথায় গেছে, তা বললে না তো!
: রবিন যেখানে গেছে ভাবলে তোমার সুবিধে হয়, ধরে নাও, রবিন সেখানেই গেছে। যে যা ভেবে নিয়ে ভালো থাকে আর কি! তোমার সত্য তোমার কাছে জরুরি, আমার সত্য আমার কাছে জরুরি। আসল সত্য হলো, রবিন বেঁচে নেই। রবিনের কাছের মানুষজন বলবে, রবিন মরেনি, রবিন ওদের স্মৃতিতে বেঁচে আছে। অবশ্য, এসবে রবিনের কিছুই এসে যায় না, কেননা রবিন সত্যিই মরে গেছে!