যে প্রেমে আত্মা বাঁচে

তুমি আমাকে বার বার বলো যে আমার আত্মজ্ঞানে যেমন তোমার আত্মজ্ঞান প্রকাশিত, তেমনি আমার নিজপ্রেমে তোমার প্রেম প্রকাশিত। আমাকে এই প্রকাশটা ভালো করে দেখাতে হবে। তুমি বলছ, আমি যে আমাকে নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত, এতেই তোমার ব্যস্ততার সাক্ষাৎ প্রকাশ।




আমার নিজের জন্যে ব্যস্ততা তো আমাকে কখনোই ছাড়ে না। শরীররক্ষার চেষ্টা, ভাবনাচিন্তা, লেখা-পড়া, তোমার ধ্যানধারণা, তোমার কাছে অভিযোগ-প্রার্থনা, এসব কাজেই আমি আমার সুখের জন্যে, শান্তির জন্যে, পরম শ্রেয়র জন্যে চিরব্যস্ত। এই ব্যস্ততা কি সত্যিই তোমার ব্যস্ততা?




আমার জাগরণ থেকে নিদ্রা পর্যন্ত সমস্ত দিনরাতই তো এই ব্যস্ততা চলে। এই ব্যস্ততাই কি তোমার প্রেম? তুমি এমন স্পষ্টরূপে আমাকে এই সত্য দেখাচ্ছ যে আমি তো কোনোক্রমেই অস্বীকার করতে পারছিনে। তাহলে আর এমন অস্থির হয়ে তোমার প্রেম খুঁজে বেড়াই কেন?




এই দৃষ্টিটা হারিয়ে ফেলি। অবিদ্যা অহংকার এসে এই দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখন তো আর সে আচ্ছাদন নেই। মুহূর্তের জন্যে তুমি সে পর্দাটা তুলে নিয়েছ। দেখছি, তুমি নিজে আমাকে, তোমার বুকে নিদ্রিত আমাকে জাগাও, আমার চোখ খুলে তোমার বিশ্বরূপ দেখাও। নিজে আমার মুখ ধুয়ে দাও। আমাকে কাপড় পরাও, আমাকে উপাসনায় বসাও। আমাকে দর্শন স্পর্শ দিয়ে আমার প্রাতঃকালীন আহার করাও। আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঊষাভ্রমণে যাও।




আমাকে তোমার নানা রূপ দেখিয়ে, নানা কথা শুনিয়ে, প্রতি পদক্ষেপে আমাকে চালিয়ে, নিরাপদে আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনো। আমার পড়া-শোনায় আমার সাক্ষাৎ গুরু হয়ে আমাকে জ্ঞানশিক্ষা দাও। কোন গুরু অত ভেতরে এসে, অত উজ্জ্বলরূপে, সত্য প্রকাশ করতে পারে? অত দৃঢ়রূপে মনের ভেতরে সত্য মুদ্রিত করতে আর কে পারে?




আমার লেখার সময় আমার মনে স্মৃতির স্রোতবইয়ে কত মহামূল্য সত্য এনে উপস্থিত করো! হাতের কলমটিকে নিজশক্তিতে চালিয়ে সেসব সত্য লিপিবদ্ধ করো। সভা-সমিতিতে তোমার কথা বলাতে গিয়ে এইভাবেই মনে স্মৃতির স্রোত ব‌‌ওয়াও, বাগযন্ত্রকে চালিত করে সত্য উচ্চারণ করাও, যেসকল হৃদয়-মন আমার বাইরে, আমার অনায়ত্ত, সেসব হৃদয়ে-মনে ভাবের উদয় করো, সেসব মনে সত্য মুদ্রিত করো।




আমাকে নিজে স্নান করাও, আহার করাও। সেই শৈশবে, বাল্যে স্নেহশীলা মা, আত্মীয় বা ধাত্রী যেমন করে স্নান করাতেন, তার চেয়ে আরও কত ধৈর্য, কত বেশি যত্নের সাথে, স্নান-আহার করাও। তাঁরা তো গায়ে জল ঢেলে দিতেন মাত্র, মুখে অন্ন তুলে দিতেন মাত্র। তাঁরা তো শরীর স্নিগ্ধ করতে পারতেন না। তাঁরা তো অন্নের আস্বাদন দিতে পারতেন না, অন্ন পরিপাক করতে পারতেন না।




আমার প্রিয়জন-মিলনে, আমার বন্ধুসমাগমে, আমার হৃদয়ে যে প্রেমের উদয় হয়, যে প্রেমের মিষ্টতা আমাকে তৃপ্ত করে, আমার হৃদয়ের ক্লেশ দূর করে, সে প্রেমকে আমি কেবল আমার প্রেম মনে করি; তুমি এখন বলছ, সে প্রেম তোমার, তুমি আমার হৃদয়ে তা সঞ্চারিত করো, তা জাগিয়ে রাখো।




এ প্রেম নিয়েই আমি তোমার কাছে যাই। তখন তুমি অদ্ভুতভাবে তা বাড়িয়ে দাও, আর আমার হৃদয় তখন অনন্ত হৃদয়ের সঙ্গে এক হয়ে যায়। তখন তো কেউ আর শত্রু থাকে না, পর থাকে না, তখন সকলে আমার আপন হয়ে যায়, সকলের সুখে আমার সুখ হয়, সকলের দুঃখে আমার দুঃখ হয়। তখন তোমার এই শিক্ষার সত্যতা আমি উজ্জ্বলরূপে দেখতে পাই যে, যাকে আমি মোহে পড়ে কেবল আমার প্রেম বলি, যে প্রেম সাক্ষাৎ নিঃসন্দিগ্ধ, অপার, অনন্ত, বিশ্বব্যাপী, সে প্রেম তোমার, তুমি অন্তরতর, অন্তরতম; তুমি প্রেমিকতম, তুমি প্রিয়তম।