অন্যলোকের পথে

এ-ই তুমি: তুমি আত্মা, তুমি প্রাণ, তুমি মন, তুমি জীবন, তুমি বিশ্ব। তুমি দ্রষ্টা, তুমি দৃষ্ট। তুমি শ্রোতা, তুমি শ্রুত। তুমি স্প্রষ্টা, তুমি স্পৃষ্ট। তুমি আঘ্রাতা, তুমি আঘ্রাত। তুমি আস্বাদয়িতা, তুমি আস্বাদিত। তুমি মন্তা, তুমি মত। তুমি বোদ্ধা, তুমি বুদ্ধ। তুমি স্মৰ্তা, তুমি স্মৃত। সমুদয় দেশ, সমুদয় কাল অন্তর্ভূত করে, এক, অখণ্ড অনন্তরূপে তুমি বিরাজ করছ। কিন্তু এই এক, অখণ্ড, অনন্তের ভেতরে কী অদ্ভুত, অনির্বচনীয়রূপে আমি ক্ষুদ্র, সান্ত, তোমার সঙ্গে অভিন্ন অথচ ভিন্নরূপে বর্তমান রয়েছি!




তোমার এক, অখণ্ড আত্মজ্ঞান আমার আত্মজ্ঞানরূপে প্রকাশিত রয়েছে। তোমার বিচিত্র বিশ্বরূপ খণ্ডরূপে আমার নিকট প্রকাশিত করছ, আবার লুকিয়ে ফেলছ। তোমার অনন্ত স্বরূপকে বেড় দিয়ে কেমন করে সন্তান সৃষ্টি করছ, তা কিছুই বুঝতে পারছিনে, অথচ দেখছি, এ-ই তোমার নিত্যক্রিয়া। আমাকে আর আমার মতো অসংখ্য মানবাত্মাকে নিয়ে তুমি প্রতিমুহূর্তে ব্যস্ত রয়েছ। সান্ত তোমার অনন্ত স্বরূপের অন্তর্গত। অপূর্ণকে নিয়েই তুমি পূর্ণ। এ-ই তোমার প্রেম... অনাদি, অনন্ত, নিত্যব্যস্ত, অবিশ্রান্ত।




এই প্রেম দেখে আমি আর অপ্রেমিক, উদাসী, থাকতে পারছিনে। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, আমার হৃদয় তোমার অনন্ত হৃদয়ের সঙ্গে মিশে যাক, আমি তোমার নিত্য প্রবাহিত প্রেমস্রোতে ভেসে যাই। এই স্রোতে ভাসতে পারছিনে বলেই আমার যত দুঃখ, যত পাপ। তুমি তোমার অসংখ্য সন্তান নিয়ে নিত্য ব্যস্ত, আর এই প্রেমব্যস্ততাতেই তোমার চির-শান্তি, চির-আনন্দ। তুমি সন্তানগত-প্রাণ, তোমার নিজের কোনও অভাব নেই, অভাববোধ নেই, সন্তানের হিতচিন্তা ছাড়া তোমার আর কোনও চিন্তা নেই। এই নিরবচ্ছিন্ন সন্তান-বাৎসল্যেই তোমার শুদ্ধতা, পূর্ণ পবিত্রতা।




আমি অপ্রেমিক, স্বার্থপর, নিজের ক্ষুদ্র চিন্তা, ক্ষুদ্র বাসনা-কামনা নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত। তাতেই আমি অশান্ত, অসুখী। তাতেই আমি পাপী, অপবিত্র। আমাকে শান্ত সুখী করা, নিষ্পাপ পবিত্র করা তোমার ইচ্ছা; কিন্তু আমার শতচেষ্টাতেও তোমার ইচ্ছা আমার জীবনে পূর্ণ হচ্ছে না। আমার সমুদয় চেষ্টার ভেতরে অবিদ্যা, অহংকার রয়েছে, তোমা থেকে স্বতন্ত্রতা-বোধ রয়েছে। আমি বুঝতে পারছি, এই জন্যেই আমার সকল চেষ্টা নিষ্ফল হচ্ছে।




আমি অকিঞ্চন, অনন্যশরণ হয়ে তোমার কৃপার উপর নির্ভর করতে পারছিনে। আমাকে তোমার উপর একান্ত নির্ভরতা দাও। আমার চক্ষু তোমাতে স্থির হোক, আমি অনিমেষ দৃষ্টিতে তোমার অবিশ্রান্ত ব্যস্ত প্রেম দেখি। আমার হৃদয় ঔদাস্য, উপেক্ষা, অপ্রেম, স্বার্থপরতা ছেড়ে তোমার অনন্ত হৃদয়ের সঙ্গে এক হোক। আমার সমস্ত মনোবৃত্তি তোমার অবিশ্রান্ত সেবাকার্যের সঙ্গে যোগ দিক।




আর বিলম্ব কেন গো? এখানকার জীবনবেলা তো অবসান-প্রায়। জীবন্মুক্তির আস্বাদন দিয়ে, নিত্যধামের আভাস দেখিয়ে আমায় মহাযাত্রার জন্যে প্রস্তুত করো, যেন প্রসন্ন মনে তোমার হাতে হাত দিয়ে লোকান্তরের পথে পা দিতে পারি।