যে পথ পরম মঙ্গলের

আমার উপর তোমার ভালোবাসাটা কী, তা অনেকসময় বুঝতে চেষ্টা করি। আমি যাদের ভালোবাসি, তাদের আমি কী চাই, তা ভেবে তুমি আমার কী চাও, তা বুঝতে চেষ্টা করি। তুমি আমার কী চাও, তা তো সাক্ষাৎভাবেও দেখছি। তুমি আমার প্রকৃত মঙ্গল চাও। আমার খাওয়া-পরা, সুখ-স্বচ্ছন্দতা চাও কেবল উপায়রূপে। এ সকল যে আমার প্রকৃত মঙ্গল নয়, তা বুঝতে পারছি। আমার প্রকৃত মঙ্গল দেখছি তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ-যোগ।




তুমি আমাকে যত বস্তু দিয়েছ, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ জিনিস দেখছি তোমার পরিচয় পাওয়া। তুমি যে সত্য, জ্ঞান, অনন্ত, তুমি যে আমার প্রাণ, জীবনের আধার, আশ্রয়, একমাত্র, অখণ্ড, প্রেমময়, পূর্ণ পবিত্রস্বরূপ, এ যে জানতে দিয়েছ, এ-ই তোমার শ্রেষ্ঠ দান। তোমাকে দেখা, তোমাকে ভালোবাসা, তোমার সঙ্গে ইচ্ছাযোগে যুক্ত হওয়া, এ-ই আমার পরম মঙ্গল। এই পরম মঙ্গল যে তুমি আমাকে দিচ্ছ, আরও দেবে, আরও সত্যরূপে, পূর্ণরূপে, দেবে, এতেই আমার উপর তোমার ভালোবাসা।




আমি অনেকসময় ভাবি, আমার সঙ্গে অন্য প্রাণীর বেশি তফাৎ কি? তারা ছ-দিন খেয়েদেয়ে আমোদ করে মরে যাবে। আমিও তো তাদেরই মতো একটা জন্তু, আমার উপর তোমার কী-ইবা বেশি একটা ভালোবাসা? তুমি এর উত্তরে বার বার দেখিয়ে দাও যে জন্তু হিসেবে আমি তো তাদের চেয়ে ঢের বড়োই, তার উপর আমাকে এই যে জিনিসটা দিয়েছ, তা তো আদতেই তাদের দাওনি।




তুমি আমার কাছে আত্মপ্রকাশ করেছ, আর আত্মপ্রকাশ করে আমার ভালোবাসা চাইছ, আনুগত্য চাইছ। তোমার সঙ্গে এই আধ্যাত্মিক যোগে আমার জন্তুত্ব গিয়েছে, আমার আত্মত্ব হয়েছে। এই সম্বন্ধটা কিন্তু আমি জেনেও ভালো করে জানছি না, ধরছি না। আমার আত্মত্ব জেগেও জাগছে না। আমি তোমার সঙ্গে প্রেমভক্তির যোগসাধন করতে পারছিনে। আমার প্রকৃত মঙ্গললাভের দিকে অগ্রসর হতে পারছিনে।




এইমাত্রই তো তুমি বললে যে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার অর্থ এই যে, তুমি আমার পরম মঙ্গল চাও। চাও কেমন করে বুঝব যখন দেখছি, আমার প্রকৃত মঙ্গল থেকে আমি কত দূরে পড়ে আছি? তোমাকে দোষ দিচ্ছি, কিন্তু তুমি দোষ নিচ্ছ না। তুমি বলছ, "পরম মঙ্গলের পথ আমি তোমায় বার বার দেখিয়ে দিচ্ছি, তুমি সে পথে চলছ না, আমি কী করব?" তা-ও তো বটে! এ তো আর নাকে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাবার কথা নয়। এ যে স্বাধীনতার রাজ্য। তুমি স্বাধীন প্রেম, স্বাধীন সেবা চাও।




তুমি জোর করে আমায় প্রেমিক করবে না। তা করার কোনও মানেও নেই। আমি তবে তোমায় চোখে চোখে রাখব, তোমাকে হৃদয় দেবো, তোমার ইচ্ছা আমার ইচ্ছা হবে। তুমি আমাকে যখন আমার পরম মঙ্গল দেখিয়েছ, আর সে মঙ্গল যখন আমারই হাতে, তখন আমি সে মঙ্গলকে পায়ে ঠেলব না।