যে ঐশ্বর্য আঁধার সরায়

তোমার ঐশ্বর্য, তোমার বিচিত্রতা‌ সমস্ত কিছু সরিয়ে দিয়ে, একেবারে নির্জনে, নিভৃতে, কেবল অন্ধকারের মধ্যে তোমাকে আত্মারূপে দেখতে, ধরতে চেষ্টা করছিলাম; তেমন তো কৃতকার্য হলাম না। তোমাকে আত্মারূপে দেখছিলাম বটে, কিন্তু সেই দেখাতে বিশেষ তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। ওই অন্ধকারটুকু সরিয়ে নিলে তো আমার অস্তিত্ব একেবারেই লুকিয়ে যেত, যেমন সুষুপ্তিতে সব লুকিয়ে যায়। এই নিষ্ফল চেষ্টাতে তুমি বরং আমাকে দেখিয়ে দিলে এক দিকে তোমার ঐশ্বর্য, আর অন্য দিকে যে আমার দৈন্য, এই প্রভেদবোধেই তোমার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ হয়।




প্রভেদ ছেড়ে অভেদ দেখতে গিয়ে উপলব্ধি হারাই। বিশ্বগতিতে, সুষুপ্তিতে তুমি স্পষ্টরূপে দেখিয়ে দাও যে তোমার বিচিত্র বিশ্বরূপ আমার ক্ষুদ্র সাময়িক জ্ঞানের উপর নির্ভর করে না। অনন্তরূপে, অনন্তকালে তুমি জীবের সাময়িক উপলব্ধির কিছুমাত্র অপেক্ষায় না থেকে তোমার পূর্ণৈশ্বর্যে বর্তমান থাকো। আমার উপর তোমার কোনো নির্ভরতা নেই, কিন্তু আমি সম্পূর্ণরূপেই তোমার উপর নির্ভর করছি। যা-কিছু আমার বলি, তা আমার সুষুপ্তিতে সম্পূর্ণরূপে তোমাতেই লুকিয়ে যায়, 'আমি'-বোধ, 'আমার'-বোধ কিছুই আর থাকে না।




তুমি আমার নিদ্রাভঙ্গ করো, বিস্মৃতির অন্ধকার সরিয়ে ক্রমশ জীবনলীলা স্মরণ করাও, তোমার লুকানো বিশ্বরূপ ক্রমশ পুনঃপ্রকাশিত করো। এই ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমার প্রভেদ, অভেদ দুই-ই দেখি। সর্বাধার, সর্বজ্ঞ, এক, অখণ্ড, অনন্ত পুরুষ হিসেবে তুমি নিজে থেকে ভিন্ন, সসীম, অল্পজ্ঞ, অল্পশক্তি, জীব সৃষ্টি করে তার কাছে খণ্ডাকারে নিজেকে প্রকাশিত না করলে এই ব্যাপার, এই জীবলীলা, জগৎলীলা সৃষ্টি হতে পারত না। জীব তোমার থেকে ভিন্ন, অথচ তার সবই তোমার, তোমার কাছ থেকেই প্রাপ্ত। তার নিজস্ব, স্বাধীন, স্বতন্ত্র কিছুই নেই। এ-ই তো সৃষ্টির রহস্য, রহস্য অথচ সত্য।




সত্যস্বরূপ তুমি যা নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত, তা সত্য বই আর কী হতে পারে? জ্ঞানস্বরূপ তুমি যা না করে থাকতে পারছ না, তা নিরর্থক, নিষ্প্রয়োজন হতে পারে না। অনন্তস্বরূপ তুমি যা তোমার অব্যক্ত স্বরূপের ভেতর থেকে ব্যক্ত করছ, তা মূল্যহীন হতে পারে না। যার কাছে নিজেকে প্রকাশ করছ, শক্তির পরিচয় দিচ্ছ, তার মূল্য নিশ্চয়ই অনন্ত, সে নিশ্চয়ই তোমার প্রেমপাত্র। কেবল প্রেমপাত্র‌ই নয়, তুমি তার কাছে প্রেম চাও। তাকে প্রেমিক করে, তোমার সঙ্গে যুক্ত করে, ধন্য করতে চাও। আমাকে দিয়ে এই কথা বলাচ্ছ, আরও কত বার বলিয়েছ, কিন্তু আমি তা বলবার কিছুমাত্র উপযুক্ত নই। আমি তো প্রেমিক হতে পারলাম না, আমায় জীবন তো ধন্য হলো না, কৃতার্থ হলো না।




আমার জীবনের প্রতি স্পন্দনে আমি তোমার প্রকাশ দেখি, ব্যস্ততা দেখি, কিন্তু সেই দেখাতে আমার হৃদয় পরিবর্তিত হয় না, আমার জীবন প্রেমময় হয় না, যোগময় হয় না। এই দেখার ফল কী তবে? একমুহূর্তে দেখা, পরমুহূর্তে ভোলা... এইভাবে জীবন নিষ্ফল হচ্ছে। তোমার পরিচালিত জীবন, তোমার অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেমে পরিচালিত জীবন নিষ্ফল হবে, তা-ও তো বিশ্বাস করতে পারছি না।




তবে সফলতা দেখাও। তোমার প্রেম, তোমার মঙ্গলময় অভিপ্রায়, উজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত করো। চঞ্চল দৃষ্টি স্থির করো। ক্ষুদ্র, অসার থেকে চিন্তাকে সরিয়ে এনে তোমার ঐশ্বর্যে, তোমার সৌন্দর্যে, তোমার মাধুর্যে স্থাপন করো। হৃদয়ের অন্তরতম, নিভৃততম স্থান থেকে তোমার দিকে প্রেমস্রোত প্রবাহিত করো। তোমার প্রেমে মগ্ন হয়ে এ জীবন সার্থক করি।