প্রেমের পথে বাধা যা

প্রেমের পথে বাধা যা বলি... 'আমি' আর 'আমার', আমার দেখা, শোনা, জানা; আমার দৃষ্ট, শ্রুত, জ্ঞাত; সবই তো তোমার হয়ে যায়। সব বিদায় করে দিয়ে যখন অন্ধকারে বসি, তখনও সেই অন্ধকারের জ্ঞাতা 'আমি', আর 'আমার' জানা অন্ধকার, তুমি ও তোমার হয়ে যায়। তখন 'তুমি' থেকে স্বতন্ত্র 'আমি' আর ‘আমার' কিছুই থাকে না। অহংকার তখন চূর্ণ হয়ে যায়। তা-ই চাই।




তুমি যে বলো যে তুমি ছাড়া স্বতন্ত্র আমি কিছু নই, তা স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করার জন্যে ভিড় থেকে নির্জনে যাই, আলোক ছেড়ে অন্ধকারে যাই। কিন্তু তোমার সঙ্গে অভেদ উপলব্ধি করেও দেখি, তোমার সঙ্গে আমার অভেদের অবিরোধী ভেদ রয়েছে। তোমার বিশ্বরূপ বিদায় করে দিই; তা অল্প অল্প করে ফিরে আসতে থাকে। দূর নিকটের দৃশ্য স্মরণ হতে থাকে, অতীতের ঘটনা বর্তমানের স্মৃতিতে উদয় হয়। তোমার কাছে দূর নিকটের ভেদ নেই, অতীত বর্তমানের ভেদ নেই, সবই তোমার ভেতর সমানভাবে, নিত্যভাবে রয়েছে। সবই তোমার কাছ থেকে আমাতে ফিরে আসে। তুমি কিছুই হারাও না, আমি সব হারাই, আবার ফিরিয়ে পাই।




তোমাতে আমাতে এই ভেদ অস্বীকার করতে পারিনে। কিন্তু সুষুপ্তিতে এই ভেদবোধটাও আমার থাকে না। তখন 'আমি'-বোধটাও তোমাতে লুকিয়ে যায়। কিন্তু এই লুকানোর অবস্থাতে আমার কিছুই তো নষ্ট হয় না। জাগ্রতে আমার ‘আমি’-বোধ তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও। ক্রমশ আমার অর্জিত জ্ঞানসম্পত্তি ফিরে এসে আমার জাগ্রত জীবন রচনা করে। এই জাগ্রত জীবনে 'তুমি' 'আমি'র লেনাদেনা, ভেদাভেদ ক্রমাগত চলতে থাকে।




এই লীলা যে প্রেমের লীলা, তা তো তুমি আমাকে সহস্র বার দেখিয়েছ। কেউ তো এই লীলা করতে তোমাকে বাধ্য করে না, তুমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই লীলা করো। তোমার ভালো না লাগলে তুমি এই লীলা করতে না, ভালো লাগে বলেই করো। আমাকে তোমার থেকে ভিন্ন করে সৃষ্টি করে লালন-পালন করা, জ্ঞানশিক্ষা দেওয়া, প্রেমশিক্ষা দেওয়া, আমার প্রেম চাওয়া, এসব তুমি করতে না, যদি আমাকে ভালো না বাসতে। এ-ই তো সৃষ্টির সারতত্ত্ব, সারমর্ম, যা তুমি আমাকে দেখাচ্ছ।




আমার শিক্ষা কতটা হয়েছে, এই সারতত্ত্বটা, এই মর্মকথাটা, বার বার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। ভালোই হলো। এতে আমার জ্ঞানের অহংকার চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এমন সারকথা যে ধরে রাখতে পারে না, যাকে বার বার এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, তার জ্ঞান তো কিছুই হয়নি, তার জ্ঞানের বড়াই তো একেবারে ব্যর্থ। এই রূপে আমার অহংকার চূর্ণ করেই বুঝি তুমি আমাকে তোমার করবে, তোমার প্রেমে প্রেমিক করে কৃতার্থ করবে? তা-ই হোক।




প্রেমিক হবার পক্ষে বাধা যে কত আছে, তা আমি জানি না, তাই অত বুড়ো হয়েও কেন প্রেমিক হলাম না, এ-ই ভেবে আকুল হই, সময় সময় নিরাশ হই। তুমি আমাকে কেন এখনও প্রেমিক করলে না, এই বলে তোমার বিপক্ষে অভিযোগ করি। অন্য অনেককে তুমি হয়তো অপেক্ষাকৃত সহজ উপায়ে প্রেমিক করেছ। আমার বেলায় অন্য ব্যবস্থা দেখছি! 




অভিযোগ করে কী করব? আমার বাঞ্ছিত পথে নয়, তোমার অভিপ্রেত পথে তুমি আমাকে প্রেমধামে নিয়ে যাবে। ‘নিয়ে যাবে’---এই যে আশ্বাস দাও, এতেই সন্তুষ্ট থাকি। এতেই তো যেন অনেকটা এগিয়ে যাই। আর কি বেশি দেরি আছে তবে?