মেয়েটি হারেনি!

হায় হায়! ব্যাপার হলো এই………
ডাক্তার যারা, তারাই ভাল নেই!
হ্যাঁ, সাইকোলজিতে পড়ছে, এর মানেই ও খুব মন নিয়ে ঘাঁটছে আর মনের সব অসুখ সারিয়ে নিচ্ছে। এমনটা কি? হয়তো এমনটাই, কিন্তু নিজের মনটাই ভীষণ খারাপ হয়ে আছে! হয় না এমন? হয় তো! প্রায়ই হয়!
মেয়েটা জীবনে কখনওই সেকেন্ড হয়নি, মানে এটা নয়, থার্ড হয়েছে, বরাবরই ফার্স্ট হয়েছে। শার্প, চটপটে! বন্ধুদের মাঝে আলাদা করে চেনা যায় খুব সহজেই। হাসিখুশি, নিজের কষ্টটা কখনওই কাউকেই বুঝতে দেয় না। কারোর উপর নির্ভর না করে চলতে শিখে এসেছে সেই ছোটবেলা থেকেই। জীবনে কিছু পাওয়া বলতে যা বোঝে সবাই, তেমন কিছু পাওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, তার কিছুই করার বাকি রাখেনি সে। ও জানে, ও কী। দুঃখ একটাই, আর কেউ অতোটা জানল না। সবাই যাকিছু জেনেছে তাকিছু একটুখানিই, কিন্তু আরও জানার কথা ছিল। ওর জীবনে না-পাওয়া বলতে ছিল প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকুর ঘাটতি। আচ্ছা, ‘প্রাপ্য স্বীকৃতি’ বলে কিছু কি আছে আদৌ? স্বীকৃতি যা আছে, সবই তো ‘প্রাপ্ত’। তবে, এর আগে আমরা ‘প্রাপ্য’ জুড়ে দিই কেন? সে আলোচনায় এখন যাচ্ছি না।

তো, যা বলছিলাম। স্বীকৃতি। কীরকম সে স্বীকৃতি?
ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় ও কখনওই প্রিফেক্টশিপ পায়নি। অথচ ওর ব্যাচমেটদের চাইতে কোনো দিক দিয়েই ও পিছিয়ে ছিল না। She always dreamt to lead, but always she had to follow!
এসএসসি এবং এইচএসসি দুটোতেই ও ছিল বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ১০ জনের ভেতরেই, কিন্তু বুয়েটে, মেডিক্যালে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোথাও ও চান্স পেল না। কত কত ছেলেমেয়ে কিছু না চাইতে কতকিছু পেয়ে গেল আর ও অনেক পরিশ্রম করেও কোথাও পড়ার যোগ্যতাটুকু পর্যন্ত দেখাতে পারল না। ওরই বান্ধবী, যে স্কুল-কলেজে স্রেফ পাস করলেই খুশিতে আটখানা হয়ে উঠত, সে মেডিক্যালে চান্স পেয়ে গেল। ওর বয়ফ্রেন্ড বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর আর কোনোদিনও ওর ফোন আর ধরল না। ক্রমেই ও একা হয়ে যেতে লাগল, কিংবা ওকে একা হয়ে যেতে হচ্ছিলো।

এমন নয় যে, ওদের সুখ দেখে ওর খুব কষ্ট হতো; এমনও নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে ওর যে ফ্রেন্ডটি, সে এখন ফুচকা খেতে গেলে ওকে ফোন করে ডেকে নেয় না বলে ওটা ভেবে ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে থাকে। তবুও এইচএসসি’র গণ্ডিটার পর কী কী যেন হয়ে গেছে! সবকিছু আর আগের মতো নেই। আগে যা যা হতো না, হুট করেই তা তা হওয়া শুরু হয়ে গেলে মানতে ও মানিয়ে নিতে অনেক ধাক্কা সামলাতে হয়।
সেই ছোট্ট মেয়েটি একটা সময়ে আবিষ্কার করলো, আশেপাশের সবাই আসলে ওকে দেখতে চায়, ও কে, সেটা দিয়ে নয়; ও কী, সেটা দিয়ে। সবাই কেমন জানি হতাশার দৃষ্টি নিয়ে ওর চোখের দিকে তাকায়। কখনও কখনও সে চাহনিতে করুণাও থাকে। আস্তে আস্তে লজ্জায় আর সংকোচে ও চোখ নামিয়ে কথা বলা শিখে নেয়।

ওর বাবা-মা’র, ওর সবচাইতে আদরের ভাইয়ারও ওর ওপর একটা সময়ে আস্থা কমতে শুরু করে। ওরা বিশ্বাস করে ভাবতে শুরু করে, ও এর চাইতে বেশি আর কী-ই বা করতে পারত? এসবকিছু ওকে আস্তে আস্তে নিজেকে এবং নিজের আশপাশটাকে ঘৃণা করতে শিখিয়ে দিল!
সবাই এটা বলতে ও ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেল, ও আসলে পড়াশোনা ঠিকমতো করেনি। নাহলে সবাই ভাল ভাল জায়গায় চান্স পেল, ও কেন পাবে না? পড়ার টেবিলে বসে বসে মোবাইল গুঁতোগুঁতি করা ছাড়া তো আর কিছুই করেনি ও। আসলে ওর মাথায় কিছু নেই। মুখস্থবিদ্যা দিয়ে কোনোরকমে পাবলিক পরীক্ষাগুলি পার করে আসল জায়গায় এসেই ধরাটা খেলো! ওদের কথার ধরণে কোনো আক্ষেপ নেই, সহানুভূতি নেই, বরং কীরকম যেন একটা বিজয়ের দ্যুতি ওদের চোখেমুখে। ও ভাল কোথাও চান্স পেলে ওদের কষ্টের আর আফসোসের কোনো শেষ থাকত না। অন্যের পরাজয়ে নিজেকে জয়ী ভাবে যারা, ওরা তাদের দলে। হায়! ওই দলটাই ভারি!

জীবনের বাস্তবতার কাছে মুখ থুবড়ে ওর ঠিকানা হয়েছিলো এই: ১ম বর্ষ, সাইকোলজি, ইডেন কলেজ, ঢাকা। হাতের খুব কাছে, অথচ নাগালের কত দূরে বুয়েট, ডিএমসি, ডিইউ!

জীবনের এই নতুন অধ্যায়টিতে ওর নিজেকে খুব অনাহূত ভেবে ভেবেই দিন কাটতে লাগল। কারোর সাথেই কথা বলতে ওর একটুও ভাল লাগে না। এমন নয় যে, ওর আশেপাশের কেউ ওর সাথে মেশে না। ও নিজেই সবার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। ভেতরে ভেতরে যে কষ্টটা ওকে প্রতিনিয়তই শেষ করে দিচ্ছে, সেটাকে আড়াল করতেই ও নিজেকে আড়াল করে করে দিনগুলি কাটাচ্ছিল। আগেও যে ওর অনেক বন্ধুটন্ধু ছিল, এটা নয়। কিন্তু এতোটা তীব্র যন্ত্রণা তো কখনওই সে অনুভব করেনি! তবে কি এই যন্ত্রণা আসলে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে?
একটা সময় ছিল যখন ওর সঙ্গী ছিল বই, মুভি, মিউজিক। এসব পাশে থাকলে ওর আর কিছুই লাগত না। নিজেকে নিয়ে ও সবসময়ই বেশ মজায় মেতে থাকত। Amélie মুভির মেয়েটির মতোই ওর পৃথিবীটা ছিল বড় স্বপ্ন-ঘেরা। নিজের মনে গান গাইলে মনে হতো, এই গান গেয়েই তো তাইরে-নাইরে-না করে ছোট্ট জীবনটা কেটে যাবে। বড় মিষ্টি গলা ছিল ওর। ও এখন মাঝেমাঝেই ভাবে, “আচ্ছা, আমি এখনও গাইলে কেউ কি বলবে, বাহ! কী মিষ্টি গলা!” ও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না, নোবডিদের গলা মিষ্টি হয় কিনা! যারা কোথাও চান্স পায় না, ওদের হাসি কি অন্যরকমের? ওদের দেখতে কি একটু ভিন্ন মনে হয়? এসব ভাবতে ভাবতে ওর আর কিছুই ভাল লাগে না, ও কোনোকিছুতেই শান্তি পায় না। ও খেয়াল করে দেখল, ইদানিং ও আয়না দেখতেও ভুলে যাচ্ছে। যে মেয়ে আয়না দেখতে ভুলে যায়, সে মেয়ের চাইতে বেশি কষ্টে পৃথিবীর আর কেউই নেই! তার মানে কি ও সবচাইতে দুঃখী হয়ে যাচ্ছে দিনদিন?

“বাবা, আমাকে একটা ভায়োলিন কিনে দেবে? আমি ভায়োলিন বাজানো শিখবো!” আদরের মেয়েকে বাবা হেসে ভায়োলিন কিনে দিয়েছিলেন। সে ভায়োলিনের ওপরে ধুলোর স্তরটা ক্রমশ উঁচু হতে থাকে প্রতিদিনই। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর কত কত জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখবে বলে ঠিক করে রেখেছিল ও। এখন ওর একটা কলম কিনতেও দোকানে যেতে ইচ্ছে করে না। জীবনটা এখন ওর কাছে বিশাল একটা শূন্য! প্রতিটা দিনকে ও খুব কষ্টেসৃষ্টে টেনে টেনে নিয়ে যায়। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে ও একটু একটু করে ফুরিয়ে যায়, কিন্তু হায়, দিন আর ফুরোতে চায় না। এক ধরণের অস্থিরতা ওকে প্রতিটা মুহূর্তেই তাড়িয়ে বেড়ায়। কী যেন নেই! কী যেন নেই!! অথচ ও নিজেই জানে না, কী নেই।
মাত্র ০.০৩ নম্বরের জন্য ও পড়ে ইডেনে আর ওর ফ্রেন্ড পড়ে ডিইউ’তে। মাত্র ১ ঘণ্টার পরীক্ষায় ওর জীবনের সব হিসেবনিকেশ চুকে গেছে। দূর থেকে যখন ওর ফ্রেন্ডকে দেখে তখন ওর খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদতে! কিন্তু ও কাঁদে না। ওকে যে কখনওই কাঁদতে শিখতে হয়নি! তবে কি জীবনের কোনো একটা অধ্যায়ে এসে সবাইকেই কাঁদতে শিখে নিতে হয়? সবাই কি এখন ওর দিকে তাকিয়ে এটাই ভাবে, “তোমাকে কাঁদলেই বরং ভাল দেখায়!” ওর চোখের জলটাও যে কষ্ট থেকে আসে, এটা সবাইই কীভাবে যেন ভুল মেরে বসে আছে! আচ্ছা, ওর চোখের জলটা কি এখনও নোনতাই আছে?
ও এখন ভাল ভাল গান শুনে লুকিয়ে, কোনো ভাল মুভি দেখলে কাউকেই ওটা দেখতে বলে না, একটা ভাল বই পড়লে খুশি হয়ে সে বইয়ের গল্প কারোর কাছেই ও এখন আর করে না। এ পৃথিবীতে যাদের কেউই চায় না, তারা সুন্দর হয় কীভাবে? যারা সুন্দর নয়, তারা সৌন্দর্যের কী-ই বা বোঝে? ওর মনে পুরো পৃথিবীর মানুষের উপর এক ধরণের ভীষণ চাপা অভিমান জমতে থাকে। ওকে কেউই বুঝতে চায় না। ওকে কেউই ভালোবাসে না। ওর থাকা না-থাকাতে কারোর কিচ্ছু এসে যায় না। ও এইসব ভাবতে থাকে। কলেজের পরীক্ষায় ও যখন প্রথম হলো, তখনও আত্মীয়স্বজনরা বলল, “কলেজে ওরকম ফার্স্ট হয়-ই!”

ও এখন ইউটিউবে গান শোনার সময় আগের মতন গানের লিরিক ডাউনলোড করে আর চোখের সামনে রাখে না। ওর যে এখন শুধুই মেলোডিটা দরকার! মোলায়েম সুরে ওরা যা ইচ্ছে বলুক, ওর ওতে কিছুই এসে যায় না। সুন্দর কথা অনুভব করার শক্তিটুকুও ওর এখন আর নেই। যে গান একটা সময়ে পরপর ৫বার শুনলেও ওর কোনোদিনই ক্লান্তি আসেনি, এখন সে গান একবারও পুরোটা শোনার শক্তি পায় না ও। যার নিজের জীবনটাই এলোমেলো, সে Life is Beautiful মুভি দেখে ‘ওয়াও!!’ বলে উঠলে সবাই কেমন করে জানি তাকিয়ে বলে, “আদিখ্যেতা!!”

পরিচিত কেউ কেউ হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, “তুমি কীসে যেন পড়?” এটা কাউকে অপমান করার একটা ধরণ। এর মানে, “তোমাকে মনে রাখার কী আছে?” জেনেও “আপনার নামটা কী যেন?” এটা জিজ্ঞেস করে মানুষ এক ধরণের অসুস্থ আনন্দ পায়। “তুমি কীসে যেন পড়?” জিজ্ঞেস করার মানেটা ও ঠিকই বুঝতে পারে। তবুও হাসিমুখে বারবারই একই উত্তর দিয়ে যায়। ও ভাবে, পাক না একটু সুখ! ওকে ঘিরে সবাই একটু করুক না ওরকম তাচ্ছিল্যমাখা ঠাট্টা! খুশি হয়ে ওঠাটাই বড় কথা! হোক একটু! পৃথিবীটা ষড়যন্ত্র করে কাউকেই আর ওর কথা মনে রাখতে দিচ্ছে না।

ইদানিং ওর ধারণা, ও বাদে সবাই দিনদিন সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। ও এ পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত মানুষ। যে নিজেকে অসুন্দর ভাবে, তার চোখে সবাইই সুন্দর। ওর ক্ষেত্রে এটা তীব্রভাবেই হচ্ছে। “ইসস! কারোর একটুখানি সুন্দর আমি পেয়ে যেতাম! ভুলে হোক, তবুও!” এই আফসোসেই ওর দিনগুলি কাটে, রাতগুলি ফুরোয়।

পরীক্ষাশেষের ছুটিতে বাসায় এলে ও কখনওই বাসা থেকে বের হয় না, কারোর সাথেই দেখা করে না। সবাই ধরেই নিয়েছে, মুখ আড়াল করে থাকাটাই ওর নিয়তি। ও হাসলে বেহায়াপনা, কাঁদলে দেখানেপনা! এর চাইতে একা থাকাই ভাল। সব কষ্ট নিজের সাথে, সব সুখও!
যাকে ও সবচাইতে কাছের বান্ধবীদের একজন ভাবত, একদিন সে মেয়েটি ইডেনের সামনে এসে সারাটা সন্ধ্যা গল্পটল্প করে হলে ফিরে গেল। “কীরে আমাদের এখানে এলি, বললি না যে?” “সরি রে! বলতে হবে, এটা জানতাম নাতো!” এ উত্তরের প্রচণ্ড ধাক্কায় সে একেবারে ভেঙেচুরে গেল যেন! হায়! বুয়েটে আর্কিটেকচারে পড়া মেয়েটা সেকেন্ড ইয়ারেই ভাঙতে শিখে গেছে!
একদিন সন্ধ্যায়। ল্যাপটপে বাজছে সিম্পল প্ল্যানের I Can Wait Forever. শুনতে শুনতে ওর হঠাৎই মাথায় শুধু এই কথাটি এল: I can’t wait forever! এটাই বাজতে লাগল বাজতে লাগল…….। মাথা থেকে কিছুতেই কথাটা বের হচ্ছিলো না। বারবারই মনে হচ্ছিলো, আর নয়, এখনই সময়। কিছু একটা করতেই হবে! জীবনটা হেরে যাওয়ার জন্য না। When you call my heart stops beating/ When you’re gone it won’t stop bleeding ……. এতো যন্ত্রণা নিয়ে সারাজীবন ধরে প্রতীক্ষা করে থাকার দরকারটাই বা কী? অনেক হয়েছে। দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমি আরও একবার নিজেকে খুঁজে দেখতে চাই! এতদিন ধরে সে শুধু এইটুকুই ভেবে এসেছে, কিছুই ঠিক নেই। সবকিছু আজ এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার কিছুই করার নেই। পৃথিবীটা আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে! শুধু আমিই দুঃখী! সে হঠাৎ করে ভাবতে শুরু করলো, ঠিক আছে, আমার যেভাবে করে পড়াশোনা করা উচিত ছিল, সেভাবে করে হয়তো আমি করতে পারিনি। কিন্তু এতে কিছু পাই বা না পাই, এর পুরো দায়ভারই তো আমার! কার কী এসে যায়? আমার জীবনটা আমার মতো। আমি ভাল হলে ভাল, খারাপ হলে খারাপ। এতে অন্যের মাথাব্যথা কেন? কই, কেউ তো এসে দুটো ভাল বুদ্ধি কোনোদিনও দিল না! শুধু এটা বলতেই ওদের যত আরাম, “তুমি এই, তুমি সেই! তুমি হেন, তুমি তেন!!” আমার ব্যাপারে নাক গলানোর অন্যরা কে? আমার জীবনটাকে বাজে বলার সাহস ওরা পায় কোত্থেকে? আমি পড়িনি, পাপ করেছি, পাপের ফল আমিই ভোগ করছি। আমিই তো ভোগ করছি, না? আর কেউ তো করছে না! তবে আমাকে আঘাত করছে কেন সবাই? আচ্ছা, আমিই বা কেন করতে দিচ্ছি? সবাইকেই কেয়ার করে বাঁচতে হবে কেন? কই, আমি মনখারাপ করে থাকলে কেউ তো মনভাল করে দিতে আসে না! তাহলে ওদের ছোটোলোকিতে মনটা খারাপ করে থাকি কেন? আমি তো একটা সময়ে অল-রাউন্ডার ছিলাম। সবাই ভাল বলতো, আমার কাজের প্রশংসা করতো। সেই আমি তো আমিই আছি! তবে আগের আমি’কে আরও একবার খুঁজে দেখতে সমস্যাটা কোথায়? অনেক সহ্য করেছি, অনেক মেনে নিয়েছি। আর না! আর কতদিন এভাবে করে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াবো? জীবন তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! সাথেই আছে বরাবরের মতো! তবে আমি পালাবো কী করে?

ডিপ্রেশন কাটাতে ও একজন সাইকোলজিস্টের চেম্বারে গেল। ভদ্রমহিলা ওদের কলেজেরই এক্স-ক্যাডেট। ওর সব কথা শুনলেন। শুনে বললেন, “একটা রিস্ক নাও তো দেখি! ঘুরে দাঁড়াতে হলে তোমাকে প্রথমেই তোমার পুরোনো কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফার্স্ট ইয়ারে ফার্স্ট হয়েছ, এটা ভুলে যাও। এক বছর কোনো জায়গায় ফার্স্ট হওয়ার মানে এই না যে, পরের বছর একই জায়গাতেই ফার্স্ট হতে হবে। দেড় বছর হারানোর কষ্টটা মাথায় রেখে বসে থেকো না। আরও দেরি হয়ে গেলে আরও কষ্ট নিয়ে আরও সময় কাটানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। এটা নিয়ে এখুনি তোমাকে ভাবতে হবে। বাইরে চলে যাও। দেশের সবকিছুকেই তুমি দেখছ একটা বিষণ্ণ চাদরঘেরা। হয়তো হ্যালুসিনেশন, কিন্তু গত দেড়টা বছর এ নিয়েই তো বাঁচছ! এভাবে জীবন চলে না। চললেও চলতে দিয়ো না।”
ওখান থেকে আসার পর সে নিজের ভাবনাজগতে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল! ভাবতে শুরু করলো, “সে নিজে আসলে কী চায়? এমন কী আছে যা করলে সে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে? বন্ধুদের কাছ থেকে মুখ লুকিয়ে থাকতে হবে না কী করলে?” অনেক ভেবেটেবে সে ঠিক করলো, আর দেশে থাকবে না। সে এইবার সবার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে। হোক কাপুরুষের মতো কাজ, তবুও! যে করেই হোক, জীবনটাতে বাঁচতে হবে! ওর বাবা-মা’র সাথে এ নিয়ে কথা বলল। ওদের অনেক নিকট আত্মীয়স্বজনই দেশের বাইরে থাকেন। কানাডায়, অস্ট্রেলিয়ায়, ইংল্যান্ডে, আমেরিকায়। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ কোনো ধরণের হেল্প করতে চাইলেন না। উল্টো ওর বাবা-মা’কে এটা বোঝালেন, “ইডেন কলেজ খারাপ কোথায়? ও এর চাইতে ভাল আর কী করবে? যা করছে, সেটা ভাল করে করতে বলেন। পারলে দেখেশুনে একটা বিয়ে দিয়ে দেন। দেখবেন, সব ঠিক! মেয়েদের এতো বড় বড় স্বপ্ন দেখার কী আছে?” কেউ কোনো তথ্য দিয়ে কিংবা খোঁজ জানিয়ে বিন্দুমাত্রও হেল্প করলেন না। উল্টো ওর বাবা-মা’কে বড় বড় কথা শুনতে হল। ওরা ধরেই নিয়েছিলেন, ওকে ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্যই ফোন করা হয়েছে। চরম অপমানে উনারা অনেক কাঁদলেন। ওকে বললেন, “তুই উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা না করে যেখানে আছিস, সেখানেই মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” বাসায় ওকে আরও অনেক কটু কথা শুনতে হল।

ও কখনওই কারোর সামনে কাঁদত না। সেদিনও কাঁদেনি। যেদিকেই তাকাচ্ছিল, সেদিকেই শুধু হতাশার কথা ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। কিন্তু ও এতে একটুও দমে না গিয়ে বরং আরও দ্বিগুণ জেদে নিজেকে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে নেয়ার রক্তশপথ নিল। এভারেস্টজয়ী বাংলাদেশের প্রথম নারী নিশাত মজুমদারের একটি কথা ওর মাথায় গেঁথে গেল: “স্বপ্নের আবার জেন্ডার কীসের?” নিজের প্রতি নিজেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল: কাউকেই লাগবে না ওর। ও একাই পারবে। ………… মানুষের জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে, যখন শুধু নিজের মনের কথাই শুনতে হয়। কারোর কাছে শোনার মতন ভাল কিছু না পেলে, কী দরকার ওর সাথে কথা বলার? বরং, ও যাতে আমার জীবনের কোনোকিছু নিয়েই আর কখনওই নিজের মতামতের মাতব্বরি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা প্রয়োজনে নিজ দায়িত্বে করা ভাল।

আমেরিকান সেন্টারে নানান সময়ে বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার, অ্যাডমিশন ফেয়ার হয়। সেখানে গেলে ভার্সিটি প্রোফাইল, স্কলারশিপ, টিউশন ফি, ভিসা প্রসেসিং ইত্যাদি নিয়ে জানা যায়। ও নিজেই ওসব জায়গায় গিয়ে গিয়ে সব খবরাখবর নিতে লাগল। বাসায় এসে ভার্সিটির ওয়েবসাইটগুলিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে ওদের নানান রিকোয়ারমেন্টসহ বিভিন্ন কিছু জানতে শুরু করলো। ও দেখল, লোকে বাইরে পড়তে যাওয়াটা যতটা কঠিন বলে, ততটা কঠিন নয় আসলে। অনেকেই আছে, যারা যা জানে না, তা নিয়ে এমনভাবে বলতে থাকে, যেন অনেককিছুই জেনে গেছে। ওদের সাথে কথা বলার চাইতে কারোর সাথেই কথা না বলাও ভাল। ও নিজেই চেষ্টা করতে লাগল। এসব করতে গিয়ে কলেজের অনেক পরীক্ষাই ওর ঠিকমতো দেয়া হয়নি। ৩ জন ক্লাসমেট ক্লাসের পড়াশোনার সব খোঁজটোজ ওকে নিয়মিত দিয়ে অনেক হেল্প করেছিলো। মজার ব্যাপার হল, ও যাদেরকে প্রকৃত বন্ধু ভাবত, ওদের বেশিরভাগই ওর এসব দেখে ওকে ভীষণভাবে ঈর্ষা করতে শুরু করছিলো। এতোটাই, ওরা ওকে সহ্যই করতে পারত না, এমন। কখনওই কোনো ব্যাপারে হেল্প করতো না, বরং ভুলভাল তথ্য দিত। ……. সময় এলে মানুষ চেনা যায়!

ও নিজে নিজে পড়াশোনা করে IELTS দিল, SAT এ বসল। IELTS এর স্কোর 7.5, SAT এ 1710. এরপর নিজ দায়িত্বে ৪টা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে অ্যাপ্লাই করলো। সুখের বিষয়, এর মধ্যে ৩টাতেই অ্যাক্সেপ্টেড হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত একটাতে ও ভর্তিও হয়ে গেল। Wichita State Universityতে, সাবজেক্ট বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি এবং এমএসসি করার জন্য ৫ বছরের ভিসা। নতুন ঠিকানায় পাড়ি জমাল, অনেক ধাক্কা সামলে নিতে নিতে জীবনের অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত রূপের সাথে পরিচিত হতে লাগল, সম্পূর্ণ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতিটা জীবনে প্রথমবারের মতো টের পেল। ও এখন চেষ্টা করছে আরো বেটার কোনো ভার্সিটিতে যাওয়ার। জীবনটাকে ও যেরকম করে দেখেছিলো, জীবনটা ওর কাছে সেভাবে করেই ধরা দিয়েছে। ধরা দিয়েছে? নাকি, ও-ই বাধ্য করেছে ধরা দিতে? ওর শক্তি ছিল মাত্র ৩টি: নিজের উপর প্রচণ্ড বিশ্বাস। প্রচুর পরিশ্রম করার মানসিকতা। স্বপ্ন ছোঁওয়ার সাহস।

আমেরিকায় জীবনটা ওর জন্য খুব যে সহজ, তা কিন্তু নয়। ও একাই ওখানে গেছে। এর জন্য যাকিছু করতে হয়েছে, একাই করেছে সবকিছু। ওখানে ওর অনেক কাছের আত্মীয়স্বজন থাকেন। ও যেখানে থাকে, তার খুব কাছেই থাকেন ওর আপন মেজোমামা। কিন্তু ও কারোর সাথেই দেখা করে না। কাউকেই কোনো ব্যাপারেই হেল্প করতে অনুরোধ করে না। যখন ওর খুব দরকার ছিল, তখন তো আর কাউকেই ও পাশে পায়নি। একটুখানিও সহযোগিতার কেউ বাড়িয়ে দেয়নি। বরং পেয়েছে তাচ্ছিল্য, বাধা, হতাশার কথা। আর কিছুই না। অবশ্য এটাও ঠিক যে, সবার এর চাইতে বেশি কিছু দেয়ার ক্ষমতা থাকেও না। পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষ আছে। এক। যারা ভাল কথা বলতে পারে না বলে বাজে কথা বলে। দুই। যারা ভাল কথা বলতে পারে না চুপ করে থাকে। ভাল থাকতে চাইলে প্রথম শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে অনেক অনেকদূরে থাকতে হবে। ও একা একা বেশ আছে। ওর সুখ এবং দুঃখ, দুটোর জন্যই ও একাই দায়ী। এইতো সেদিন রাস্তা পার হতে গিয়ে ছোটোখাটো একটা দুর্ঘটনায় পড়ে গেল। হাঁটু এবং গোড়ালিতে বেশ চোটও পেল। মেডিক্যাল ইনস্যুরেন্স করানো ছিল না। ওখানে ডাক্তার দেখাতে অনেক টাকা লাগে। ওর কাছে যে অতো টাকা নেই। এক্সরেও করায়নি। কিছু মেডিসিন খেয়েছে শুধু। আস্তে আস্তে সেরে উঠছে। যার পকেটে টাকা নেই, বিদেশে তার জীবনটা ততটা সহজ নয়। তবুও ও কাউকেই কিছু জানায় না। বাংলাদেশে ওর বাবা-মা জানে উনাদের একমাত্র কন্যা Alice in Wonderland এর মতো কোথাও আছে। ফোনে কথা হলে ও বানিয়ে বানিয়ে সব Fairy tale শোনায়, যাতে ওর কথা ভেবে কেউ কষ্ট না পায়। মাঝেমাঝে ওর অনেক খারাপ লাগে, কেন জানি ভীষণ কান্না পায়, মনে হতে থাকে, জীবনে এমন একজন বন্ধু দরকার যার সামনে কোনো অস্বস্তি ছাড়াই কেঁদে ফেলে নিজেকে হাল্কা করা যায়। ও হাত বাড়ায়। কাউকেই পায় না। ওর লাগবে না কাউকেই! ও নিজেই নিজের ক্ষত সারাতে শিখে গেছে! জীবনটা এভাবেই কেটে যাচ্ছে। কাটুক না! দেখা যাক না কী হয়!

এই মেয়েটি কে, সে খোঁজ আমি দেবো না।
গল্পটা সত্যি কী বানানো, সেটাও বলবো না।
শুধু এইটুকু বলবো, ওর আজকের সবকিছুর জন্য যদি ৩ জন মানুষেরও কোনো সামান্যতমও ভূমিকা থাকে, তাদের মধ্যে একজন আমি, কিংবা আমার লেখা। এই কথাটি আমার নয়, ওর নিজের। ওর কৃতজ্ঞতাবোধ দেখে আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেছে। ওর এই জার্নির কথা ভাবতেও যে কতটা আনন্দ লাগে, সেটা বুঝিয়ে লেখার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি। ওকে আমি স্যালুট জানিয়ে লিখেছি, You’re that girl who has decided not to live the life she was not born for. আমি কখনও ওর জন্য তেমন কিছু আলাদা করে করেছি বলে মনে পড়ে না। ওর সাথে একবার এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিলো ১০ মিনিটের জন্য, কয়েকবার ইনবক্সে চ্যাটিং করেছি, দুইবার ফোনে কথা হয়েছে। এইতো! ও আমার লেখাগুলি বারবার পড়েছে। কিন্তু ওটা সম্পূর্ণই ওর কৃতিত্ব। আমি তো স্রেফ এইজন্য লিখি যাতে কখনও কখনও এমনকিছু লিখে ফেলতে পারি, যা পড়লে কেউ মনখারাপ করে থাকবে না। সবাই মন থেকে বিশ্বাস করুক, আমিও পারবো! স্রেফ এইটুকুই! এতেই আমার সুখ!!

প্রার্থনা করি, ও অনেক ভাল থাকুক, ভালোমানুষ হয়েই থাকুক, অনেকদূর যাক। আমি দূর থেকে দেখবো, খুশি হয়ে উঠবো আর মনে মনে বলে যাবো, Hats off!!