মায়া

মায়া মানেই কঠিন একটা জাল। মানুষ ধীরে ধীরে মায়ায় পড়ে যায়। কারও কথার, কারও চোখের, কারওবা কণ্ঠের।

যার কথার মায়ায় পড়বেন, তার প্রতিটি শব্দকেই কবিতা মনে হবে। যার কণ্ঠের মায়ায় পড়বেন, তার বলা প্রতিটি বাক্যই গান মনে হবে। যার চোখের মায়ায় পড়বেন, তার চোখের দিকে তাকালেই আপনি অচেনা গভীর এক সমুদ্রে ডুবে যাবেন। মায়া বড়ো জ্বালা!

মানুষ হুট করে প্রেমে পড়লেও কখনও হুট করে কারও মায়ায় পড়ে না। মায়ায় পড়ে ধীরে ধীরে, আর ধীরে ধীরে তৈরি-হওয়া যে-কোনও জিনিসই কঠিন ধরনের হয়। তরল সিমেন্ট যেমন ধীরে ধীরে জমে পাথরের মতো হয়ে যায়, একটু একটু করে চলা নদী যেমন সাগরে মিলে যায়, একটা ছোটো চারাগাছ যেমন বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী প্রকাণ্ড বটগাছ হয়ে যায়, ঠিক মায়াও তেমনি বাড়তে বাড়তে একটা শেকড়-গাড়া শক্ত গাছের মতো হয়ে যায়, চাইলেই যাকে আর উপড়ে ফেলা যায় না। দরকার হলে মানুষ নিজেকে ছাড়তে পারে, তবু মায়া ছাড়তে পারে না।

হুট করে কারও প্রেমে পড়লে হুট করে উঠেও যাওয়া যায়, কিন্তু ধীরে ধীরে কারও মায়ায় পড়লে আপনি সেখানে চোরাবালির মতো গেড়ে যাবেন, আর উঠতে পারবেন না শতচেষ্টা করলেও।

মায়া বড়ো কঠিন জিনিস। বইয়ের তাকে দীর্ঘকাল অযত্নে পড়ে-থাকা পুরোনো বইটা পোকায় খেলে খুব কষ্ট লাগবে, দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহৃত চুলের ক্লিপটা ভেঙে গেলে ডাস্টবিনে ফেলতে গিয়ে কী এক নিবিড় মায়ায় উলটেপালটে বার বার ছুঁয়ে দেখি, অফিস যেতে প্রতিদিন দেখা-হওয়া পাগলাটে কুকুরটা মারা গেলে মধ্যরাতে তার জন্য মনটা মুচড়ে মুচড়ে উঠবে। যে আপনার কেউই হয় না, একবার তার মায়ায় পড়ে গেলে দেখবেন, সে আপনার পুরো পৃথিবীটাই হয়!

মায়া মানেই বড্ড কঠিন এক জাল, যে জালে এক বার পড়লে তা আপনাকে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে ফেলবে, আপনি ধীরেই আরও গভীরতর মায়ায় আটকে যাবেন, বেরোনোর পথ খুঁজে পাবেন না কিছুতেই। মানুষ সব ধরনের বন্ধন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, কিন্তু মায়া থেকে সহজে বেরোতে পারে না। এক মায়াই যেন এ সংসারের ধ্রুব কায়া!
এজন্যই চলে যাবার অনেক পথ খোলা থাকার পরও আমরা চলে যাই না। ছেড়ে যাবার অনেক কারণ থাকার পরও আমরা ছেড়ে যাই না। ব্যাঙের মতো হাত-পা গুটিয়ে ওই এক পুরোনো গর্তেই এক জায়গাতেই কীরকম যেন নিশ্চেষ্ট নির্ভার হয়ে বসে থাকি।

যন্ত্রণায় প্রাণ যায় যায়, মায়াটা তবু থেকেই যায়!
Content Protection by DMCA.com