মায়া যতটা কাঁদায়

মানুষ কী অদ্ভুত! সে ভাবে, সে কাঁদছে ভালোবাসার জন্য, অথচ সে আসলে কাঁদছে মায়ার জন্য। হ্যাঁ, কখনও কখনও মানুষ ভালোবাসায় নয়, প্রেমেও নয়, বরং মায়ায় পড়ে কাঁদে। যে মানুষটি জীবনের সবচাইতে বড়ো ক্ষতটি হৃদয়ে গভীরভাবে লেপটে দিয়ে চলে গেল, সে মানুষটির কথা মনে পড়লে কখনওবা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, দুচোখ ফেটে জল আসে। ভরদুপুরে তার কথা মনে পড়লে বুকের মধ্য থেকে হু হু করে মোচড় দিয়ে কান্না আসে। কোথায় যেন পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, আর হতেই থাকে।




মস্তিষ্ক প্রশ্ন করে, মানুষটি এখন আমার কে হয়?
মন উত্তর দেয়, মানুষটি এখনও আমার জীবন হয়!




চলে-যাওয়া মানুষটি আঘাত দিয়েছে, এই ভাবনাটি যতটা কষ্ট দেয়, তার চেয়ে শতগুণে বেশি কষ্ট দেয়, এই মানুষটিই একসময় আমার সামান্য ব্যথাতেও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠত, এই অবিনশ্বর স্মৃতিটি। এই মানুষটিই একটা সময় বড্ড আদুরে গলায় গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। যে মানুষটি মুখের উপর ফোনকলটা কেটে দিয়ে তৃতীয় কোনও নতুন কণ্ঠে হৃদয় ভেজাচ্ছে, সে মানুষটিই এককালে আমার কণ্ঠ না শুনে কিছুতেই ঘুমাতে পারত না। সময় কত কিছুই বদলে দেয়!




আমরা মানুষটির জন্য নয়, বরং মানুষটির সাথে জড়িয়ে-থাকা স্মৃতিগুলির মায়ায় আটকে থাকি বলেই যন্ত্রণায় এমন করে সারাক্ষণ কাতরাই। হৃদয়টা শুধুই পোড়ে আর পুড়তেই থাকে।




কোথাও থেকে তার প্রিয় গানটি ভেসে এলে মন কেঁদে ওঠে, যে গানটি একসময় তার অপূর্ব বেসুরো গলায় শোনার জন্য আমি প্রতীক্ষায় থাকতাম। তার প্রিয় রং, পছন্দের কবিতা, কিংবা তার প্রিয় কোনও টঙের দোকান দেখেও ভীষণ মনকেমন করে। সেইসব মনকেমনের মুহূর্তে ঠোঁট কামড়ে জেগে ওঠে চাপাকান্না, কখনও চোখের তারায় নাচে মৃদুহাসি।




একসময় আমরা মানুষকে নয়, স্মৃতিকে ঘৃণা করতে শিখে যাই। হ্যাঁ, একটা-না-একটা সময় তার সাথে বসে-থাকা সেই টঙের দোকান, তার হাত ধরে হেঁটে-যাওয়া সেই রাস্তা, এমনকি তার সাথে ঘোরা সেই হুডতোলা রিকশাটাকেও আমরা ঘৃণা করতে শিখে যাই। ছেড়ে-যাওয়া মানুষটিকে নয়, বরং ফেলে-আসা সময়টাকেই বড্ড প্রতারক মনে হয়। তবু সেইসময়ের ভালোবাসার মানুষটির জন্য আমৃত্যুই মনের কোথায় যেন নাম-না-জানা কিছু একটা থেকে যায়। সেই কিছু একটা আমাদের প্রতিনিয়তই বাঁধতে থাকে---ভালোবাসায়, ক্ষমায়, প্রার্থনায়।




ভালোবাসা একসময় মরে যায়, থেকে যায় কেবলই একধরনের অভ্যস্ততা। সেই স্মৃতিমথিত অভ্যস্ততা আমাদের কলজের প্রতিটি ইঞ্চি চিবিয়ে খায়, গিলে খায়। সেখান থেকে পালাতে চাইলে মনে হয়, আমার মধ্য থেকেই আমি পালাই কী করে! শরীরে অসুখ হলে চিকিৎসায় বাঁচা যায়, কিন্তু অন্তর পুড়ে গেলে বাঁচার আর কোনও পথই খোলা থাকে না।




আমাদের শরীরে, মনে এই স্মৃতিই জমতে থাকে উইয়ের ঢিবির মতো। সে উইপোকা আমাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খায়, শরীরের মৃত্যুর বহু আগেই মনের মৃত্যু ঘটে যায়। আমরা এই মৃত মনটা নিয়ে জীবনকে টেনে হিঁচড়ে বাঁচিয়ে রাখি। মনে রাখতে পারা, এই গুণটি স্কুলের পরীক্ষার জন্য যতটা সমাদৃত, জীবনের পরীক্ষার জন্য ততোধিক আত্মঘাতী।




স্মৃতির কোনও ইরেজার হয় না। যদি হতো, তবে দেখা যেত, এই পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ স্বস্তি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত, যারা নিজের হাতেই খুন হয়েছে এই স্মৃতির দহন থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে।




মানুষটি এখন অন্য কারও হয়ে গেছে, এই সত্যটা একসময় গা-সওয়া হয়ে যায়। সওয়া যায় না কেবল সেই স্মৃতিটাই যে---এই মানুষটি, হ্যাঁ, এই মানুষটিই একদিন আমার ছিল...আগাগোড়া শুধু আমারই ছিল!




এই পৃথিবীতে আসলে কেউ কারও হয় না। এই বোধটা যখন আসে, তখন সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যায়।




কারও লাশও আমাদের ততটা কষ্ট দেয় না, যতটা কষ্ট দেয় তার সাথে কাটানো প্রিয় হন্তারক স্মৃতিগুলি।




এইজন্যই বোধ হয় ছেড়ে-যাওয়া মানুষটি ফিরে এলেও বার বারই শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিই, যদিও এর পরমুহূর্তেই দেখি, কার জন্য জানি ঘড়ির কাঁটাটি থেমে থাকতে চায়, জ্যোৎস্না দেখলে চোখ ভিজে ওঠে, বৃষ্টি ছুঁলে ঠোঁট কাঁপতে থাকে...হায়, কার জন্য যেন প্রতিদিনই একবার করে মরে যাই! মানুষটাকে নিতে পারি না, অথচ মানুষটারই স্মৃতিটাকে ছাড়তে পারি না---এর নামই বেঁচে-থাকা।