মধ্যবিত্ততা



আমি খুব প্রয়োজন না হলে মিথ্যে বলি না, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি বেঁচে-যাওয়া পয়সা দিয়ে দুইএকটা বই বাদে আর তেমন কিছু কিনি না, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি অর্ধেক ডিমের মধ্যেই পুরো ডিমের সুখটা সন্তুষ্টি নিয়ে খুঁজে পেতে জানি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি হাত পাততে শিখিনি ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ হাতের জোরটা ঠিকঠাক থাকে, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি ঘাম, মগজ ও রক্তের দামে সম্মান কিনে বাঁচতে শিখেছি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আজও মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে স্বর উঁচু করে কথা বলতে পারি না, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি পকেটখরচটা বাঁচিয়ে কিছু পয়সা পথশিশুদের দিয়ে দিতে পারি হাসিমুখেই, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আজও শ্রমের বিনিময়ে ভাগ্য বদলানোর ছেলেমানুষিতে আস্থা রাখি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি কখনও দামি সুস্বাদু খাবার খেতে পেলে খুব আয়েশ করে খেতে পারি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি নেহায়েতই বাধ্য না হলে ধার চাইতে পারি না নিজের সাথে হাজারো যুদ্ধ করেও, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি অন্যের পেছনে না লেগে নিজের পেছনেই সারাক্ষণ লেগে থাকি ভাগ্যান্বেষণে, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি নিখুঁত হওয়ার চেষ্টায় রাতের পর রাত খরচ করে ফেলি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি কখনও কাউকে ঠকিয়ে তার প্রাপ্য টাকা নিজে ভোগ করতে শিখিনি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আমার আত্মসম্মানবোধের কাছে পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্যকেও তুচ্ছ ভাবি পরম স্থৈর্যে, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আত্মানুসন্ধানের পেছনে ছুটতে ছুটতে অন্যের সমালোচনার সময়ই কখনও করে উঠতে পারি না, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আজও চাকরিপ্রাপ্তিকেই স্বর্গপ্রাপ্তি ভাবি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আমার সন্তানকে কেবল একটু হাসতে দেখলেই সমস্ত ক্লান্তি ভুলে যেতে পারি মুহূর্তেই, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি মানুষকে ঈর্ষা করার বদলে অনুপ্রাণিত হতে শিখেছি সেই ছোটোবেলাতেই, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি পয়সা বাঁচিয়ে চলাকেই জীবনের ধর্ম হিসেবে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি অপ্রাপ্তির খাতায় অশ্রু লেপটে দেওয়ার বদলে প্রাপ্তির খাতায় হাসি লটকে রেখে বাঁচতে জানি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি কান্না গিলে ফেলে বাঁচতে জানি, দুঃখকে চেপে রেখে হাসিমুখে চলতে জানি, কষ্টকে ব্যক্তিগতই রেখে দিতে জানি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি বিরিয়ানির প্লেটে চোখ রেখেও ডালভাতের সানকিতে পরম তৃপ্তিতে আস্থা রেখে বাঁচি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি আজও হৃদয়ের খোলা জানলায় বসে মানুষের কষ্টকে অনুভব করতে জানি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের কাঁধটাকে প্রতিনিয়তই শক্ত করে গড়ে তুলি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।
আমি স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থেকে আঁধার হাতড়ে হাতড়েও আলোর পথেই হাঁটতে পারি, কেননা আমি মধ্যবিত্ত।


যদি এইসবের কোনও ব্যত্যয় কখনও দেখো আমার মধ্যে, সেদিন নিশ্চিত জেনো, আমি আর মধ্যবিত্ত নই, আমি নিজের অবস্থানকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে এনেছি ছোটোলোকের পর্যায়ে। আছে কিছু মধ্যবিত্ত মানুষ, যারা অক্ষমের ক্রোধ দেখিয়ে এমন কারও মাথার উপর চড়ে বসতে চায়, যার অবস্থান এতটাই উঁচুতে যে তার মাথায় চড়তে গেলে নিজের মাথাটা যথেষ্ট শক্ত হতে হয়। মাথাটাকে শক্ত না করেই মুখ আর বাহুর উপর ভর করে চলে যারা, ওদের দাম নেমে যায় সেই উঁচু লোকটির পায়ের জুতোরও নিচে। ওরা উঁচু লোকটিকে ক্রমাগত বিরক্ত ও আহত করে চলে যাতে সে তার পায়ের জুতোর চাইতেও কম দামি কারও কথা ক্ষণিকের জন্য হলেও মাথায় রাখতে বাধ্য হয়। নিজের জুতোর সাথে গল্প কেউ করে না। যার জায়গা জুতোরও নিচে, সে-ও এসে গল্প জুড়তে চায়---জোর করে, বিরক্ত করে, নিজের কদর্যতাকে টেনে সামনে নিয়ে এসে! সময় সাক্ষ্য দেয়, ওদের জীবনে এর বেশি সাফল্য তেমন একটা চোখে পড়ে না। বুড়ো হয়ে যাবার পর নাতিনাতনিদের সামনে নিজের বীরত্ব তুলে ধরতে ওরা বলবে, ‘জানিস, একদিন সেই লোকটির মাথায় জায়গা পেয়েছিলাম, আমি আজীবনই ছিলাম যার জুতোরও নিচে!’ অল্প বয়সে ছোটোলোক, বেশি বয়সে ছোটোমানুষ। এইটুকুই ওদের অচ্ছেদ্য জীবনচক্র! নিজেকে নিয়ে গল্প করার কিছু-না-কিছু তো লাগেই! গল্পের উপজীব্যই গল্পের কথককে চেনায়। হ্যাঁ, ওদের মধ্যবিত্ত বলে না, ছোটোলোক বলে। আবারও মনে করিয়ে দিই, আমি মধ্যবিত্ত বলেই ঈর্ষায় পুড়তে থাকার বদলে অনুপ্রাণিত হতে শিখেছি।


মধ্যবিত্ততা! এ কোনও সাময়িক অবস্থানের নাম নয়, এ এক শাশ্বত অনুভূতির নাম! বড়ো দামি সে অনুভূতি! অর্থের অস্থায়ী সীমানা পেরিয়ে বহুদূরে তার চিরস্থায়ী আবাসভূমি। সারাজীবনই টিকে থাকে মনের এই চেতনাঐশ্বর্য! এই অনুভূতি বাঁচে যতটা বিত্তে, ততোধিক বাঁচে চিত্তে! এই পৃথিবীতে অনেক কিছু আছে, যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। সেগুলির মধ্যে সবার উপরে মধ্যবিত্ততা।


ক্রোধে ঈর্ষায় পুড়ে খাক, ঈর্ষণীয়কে ধরে নেয় যে হন্তব্য,
মধ্যবিত্তের দেয়ালটা ভেঙে ছোটোলোকিতেই তার গন্তব্য।