ভালোবাসায় বোঝাপড়া

যাদের কেউ নেই, ওরা যতটা একা, তার চাইতে অনেক বেশি একা ওরাই, যাদের কেউ বুঝতে চায় না।




যাদের আশেপাশে অনেকেই আছে, ওদের দেখে আপনার নিজের একাকিত্ব নিয়ে রায় দিয়ে ফেলবার আগে খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওদের ধারেকাছেও এমন একজন‌ও মানুষ আছে কি না, যে পাশে থাকলে নিজেকে আর একা লাগে না। অনেকের ভিড়ে একা হয়ে থাকবার চাইতে বড়ো দুর্ভাগ্য আর হয় না।




পাবেন এমন অনেককেই, যাদের কাছে ওদের কাছের তো বটেই, এমনকি দূরের মানুষগুলিও প্রত্যাশা করে বসে থাকে অনেকটা বোঝার দায়টুকু, অথচ ওদের বোঝে, এমন কেউ কোথাও নেই। একটা মানুষ, তাকে কেউ বোঝেই না, অথচ সে সবাইকে বোঝার দায়টি নিজের কাঁধে চেপে বেঁচে আছে! ভাবতে পারেন!




দিন এভাবেই গড়ায়। একটা সময় পরে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশের কেউ তো নয়‌ই, সে নিজেও নিজেকে ঠিক বোঝে না আর। অন্যদের বুঝতে বুঝতে সময় কাটাতে হয় যাদেরকে, নিজেকে বোঝা তাদের আর হয়ে ওঠেই-বা কোথায়? নিজেকে বুঝতে না-পারার মতো অসহায়ত্ব সত্যিই বড্ড তীব্র!




মানুষ ভালোবাসা-প্রেম চায় যতটা, তার চাইতে অনেক বেশি চায়, অন্তত একটি মানুষ হলেও তাকে বুঝুক। প্রায়‌ই দেখা যায়, যে মানুষটিকে বুঝবার ও জানবার চেষ্টা সে করেই যাচ্ছে নিরলসভাবে, সে মানুষটি তাকে বোঝেই না। বোঝার চেষ্টাটুকুও করে না কখনও। এতগুলি মানুষ এ পৃথিবীতে, অথচ তাকে বুঝতে পারে, এমন একটা মানুষের খোঁজে তার জীবনের সমস্ত স্বস্তিই যেন উবে যায়! সাথে হতে থাকে দ্রুত আয়ুক্ষয়!




জানেনই তো কী হয়!
মেয়েটি ভাবে, হায়, ও আমায় ভালোবাসেই না!
ছেলেটি ভাবে, হায়, ও আমার ভালোবাসা বোঝেই না!
মেয়েটি ভাবে, যদি ও একটু বুঝত, কতটা ভাবি আমি ওর জন্য!
ছেলেটি ভাবে, যদি আমি সত্যিই বোঝাতে পারতাম, আমার ভেতরের কতটা জুড়ে রাখি ওকে!
হায়, এ সংসারে ভালোবাসার চাইতে ভালোবাসা বোঝানোর দায়টা সবসময়ই বড়ো!




প্রকৃতপক্ষে, মানুষ তাকেই ভালোবাসতে চায়, যে তাকে বোঝে। ‘আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতে পারি!’ এমন অনুভূতির চাইতে প্রার্থিত অনুভূতিটি হচ্ছে, ‘আমি তোমাকে বাংলা বইয়ের মতো পড়তে পারি!’




যখন এমন কেউ আপনার পাশে থাকে, যে আপনাকে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু আপনাকে বোঝে না কিছুতেই, তবে তার প্রতি আপনার হৃদয়ে তেমন একটা ভালোবাসা অনুভূত হবে না। ভালোবেসে ফেলাটা বড্ড সহজ, বোঝাটাই কঠিন। কেন, জানেন? আপনি কাউকে ভালোবাসেন আপনার নিজের মতো করে, আর তাকে বুঝতে হয় তার নিজের মতো করে। আপনার কাছ থেকে মূলত দ্বিতীয়টিই সে চায়, প্রথমটি এ জীবনে সে অনেক পেয়েছে! যখনই আপনি প্রথমটির উপর ভর করে আপনার ভালোবাসার দাবি খাটাতে চাইবেন, তখনই সূচনা হবে অনিবার্য সংঘাতের।




দিনশেষে, মানুষ যতটা চায় ভালোবাসার মানুষ, তার চাইতে অনেক বেশি করে চায় একজন বোঝার মানুষ। এ পৃথিবীতে জন্মের দায় মেটাতে গিয়েই মানুষ ভালোবাসতে শিখে যায় আপনাআপনিই, তবে কাউকে বুঝতে চাইলে অনেক সাধনার প্রয়োজন হয়। সেই দিক থেকে বলা যায়, সম্পর্ক ভাঙে বা গড়ে মূলত বোঝার জায়গাটা থেকে, ভালোবাসার জায়গাটা থেকে নয়।




প্রাক্তনকে আজও ভালোবাসি যদিও, তবু বুঝতে আজও পারি না!...অসংখ্য মানুষ ঠিক এরকম একটা অনুভূতি বুকে বয়ে নিয়েই বেঁচে আছেন। ওদের জিজ্ঞেস করেই দেখুন না!




সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয় তখনই, যখন সেখানে বন্ধুত্বটুকু টিকে থাকে স্পষ্ট অবয়বে। পাশের মানুষটি যখন আপনাকে বুঝতেই পারে না, তখন তার সাথে থাকলেই বরং একাকিত্ব বেশি গ্রাস করে। প্রেম কিংবা বিয়ে মানুষকে খুব বিশ্রীভাবে বেঁধে ফেলে, তখন মুক্তি পেতে দ্বারস্থ হতে হয় বন্ধুত্বের কাছে। বন্ধুকে সবই বলা যায়, আর বলে ফেলতে পারলে, সেভাবে করেই নিজেকে মেলে ধরতে পারলে অনেক কিছুই বোঝা সহজ হয়। প্রায়ই দেখা যায়, বন্ধুত্বের মধ্যে নিছকই দাম্পত্য ঢুকে গেলে দাম্পত্য ও বন্ধুত্ব, দুই-ই পালিয়ে যায়; অন্যদিকে, দাম্পত্যের মধ্যে বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব ঢুকে পড়লে দাম্পত্য ও বন্ধুত্ব, দুই-ই আরও নিবিড় হয়।




কার‌ও কাছ থেকে কিছু লুকোনোর মানেই হচ্ছে, সেখানে সহজ বন্ধুত্ব নেই, বিশ্বাস নেই, সততা নেই। সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে সম্পর্কটি টিকে যায় শেষপর্যন্ত। সেই বের হবার রাস্তাটা দুজনকেই সচেতনভাবে চেষ্টা করে বের করতে হয়। অবশ্য, ওরকম সচেতনতার শুভসূচনাটি কখনও কখনও হয় কোনও-না-কোনও আকস্মিক টানা-পোড়েন থেকে। ওরকম দুইএকটি টানা-পোড়েনই সম্পর্ককে বাঁচিয়ে দেয়। বন্ধুত্বে কিছুই লুকোতে হয় না, কেননা লুকোনো সব কিছুকেই বন্ধুত্ব সহজে মেনে নিতে জানে, যা জানে না প্রেম কিংবা দাম্পত্য।




মানুষ ভালোবাসে আর ভাবে, আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটিকে জয় করব। সত্যি বলতে কী, কাউকে জয় করবার প্রথম ধাপটিই হচ্ছে তাকে ঠিক তার মতো করে বুঝতে পারা। আপনি যদি কাউকে না-ই বোঝেন, তবে আপনার সমুদ্রসমান ভালোবাসাতেও তার কিছুই এসে যায় না! এ কারণেই ‘প্রেম’ শব্দটির চাইতে ‘বোঝাপড়া’ শব্দটি অনেক জরুরি। কার‌ও একাকিত্ব দূর করতে চাইলে সবার আগে তাকে বুঝতে হবে। মানুষ ভালোবাসাহীনতায় একা হয়ে যায় না, বোঝাপড়াহীনতায় একা হয়ে যায়। যাকে কেউই ভালোবাসে না, সে-ও বেঁচে থাকতে পারে। আর যাকে এমন কেউ ভালোবাসে, যে তাকে কিছুতেই বোঝে না, তার পক্ষে বেঁচে থাকাটা বড্ড যন্ত্রণার!




একাকিত্বের অর্থ মনের মানুষের অভাব নয়, বোঝার মানুষের অভাব। ভালোবাসার মানুষ অনেকই তো পাওয়া যায়, বোঝার মানুষ পাওয়া যায় কি একজনও?