ভালো থাকতে চাইলে

 ভালো থাকতে চাইলে অনেক কিছু নিয়ে জানতে হয় না। যা যা আমাদের ভালো লাগে না, খুব দরকার না হলে সেগুলি নিয়ে ভাবারই-বা কী আছে? দেশ-বিদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতিসহ এরকম আরও যা-কিছু আছে, যা নিয়ে আপনার একটুও আগ্রহ নেই, যে যা-ই বলুক না কেন, তা নিয়ে না ভেবেও আপনি দিব্যি একটা জীবন আনন্দে কাটিয়ে দিতে পারবেন। যা আরেকজনের ভালো লাগে, তা আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে। এরকম হতেই পারে, কোনও ব্যাপার না! কে কী বলল না বলল, ওসব পাত্তা দেবার কোনও প্রয়োজনই নেই।
  
 আপনার কাজ কাজের জায়গায়, জীবন জীবনের জায়গায়। এই দুই নিয়ে কখনও প্যাঁচ না লাগালেই ভালো। কাজ আপনার জীবনের একটা অংশ মাত্র। এমন এক জনও মানুষ নেই, যিনি মৃত্যুর আগে আফসোস করে গেছেন, আহা, আরও একটু বেশি সময় অফিসে কাটাতে পারতাম! অফিস অফিস করে নিজের জীবনের সমস্ত সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে দিলে এমন বাড়তি কিছু পাবেন না, যা না পেলে আপনার অনেক বড়ো কোনও ক্ষতি হয়ে যেত! আমি দেখেছি, ইঁদুরদৌড়ে দৌড়োতে দৌড়োতে মানুষ একসময় মানুষ আর থাকে না, একটা ইঁদুরে পরিণত হয়।
  
 আপনার এমন কী আছে, যা আর কারও নেই? আপনি যে ভার্সিটিতে পড়েছেন, সেখানে আপনার মতোই হাজারো মানুষ পড়েছে। আপনি যে রেজাল্ট করেছেন, সে রেজাল্ট আরও অনেকেই করেছে। আপনি যে চাকরি বা ব্যাবসাটা করছেন, আপনিই একমাত্র ব্যক্তি নন, যিনি এটা করতে পারছেন। আপনার আগেও অনেকে তা করেছেন, এখনও করছেন, সামনেও করবেন। কিন্তু মাত্র একটা জায়গা আছে, যেখানে আপনি এক ও অনন্য। আপনার নিজের জীবনের সমস্ত দায়িত্ব এক আপনি নিজে বাদে আর কেউ নিতে পারবে না। আপনার যে জীবনটা, সে জীবনটা আপনি যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই তৈরি হবে। অদৃষ্টের কিছু হিসেব এখানে আছে যদিও, তবু আপনার সিদ্ধান্ত ও চেষ্টার একটা স্পষ্ট প্রতিফলন আপনার জীবনে আছেই। অফিসে, বাসে, গাড়িতে, আপনার চেকবইতে, আপনার ল্যাপটপের বা মোবাইলের সামনে যে আপনাকে সবাই দেখে, তার বাইরেও একটা মানুষ আপনার হৃদয়ে, আপনার সমস্ত আত্মায় বাস করে। সে মানুষটাকে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া না নেওয়া পুরোপুরিই আপনার নিজের হাতে।
  
 মানুষ ইদানীং নিজের সঙ্গে গল্প করতে ভুলে যাচ্ছে কিংবা সময় পাচ্ছে না কিংবা সময় দিচ্ছে না। এর বাজে প্রভাবটা গিয়ে পড়ে সরাসরি মানুষের কাজের উপর। এতে কাজের মান খারাপ হয়, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিও ঘটে। সারাক্ষণই যদি মাথায় অফিস, প্রমোশন, গাড়ি-বাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্সের টেনশন থাকে, তবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সময়টা আমরা আর কখন পাবো?
  
 শেষ কবে সমুদ্রের গর্জন শুনেছেন? শেষ কবে নদীর তীরে পুরো একটা বিকেল কাটিয়েছেন? শেষ কবে ভোরবেলায় পাখির কিচিরমিচির অনুভব করেছেন? শেষ কবে পুকুরের জলে ঢিল ছুড়েছেন? শেষ কবে কোনও প্রিয় মানুষের সঙ্গে অখণ্ড মনোযোগে আড্ডা মেরেছেন? যদি সময়টা হয় অনেক আগের, তবে এর মধ্যেই একটা সময় বের করুন। সময় কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমরা টের পাচ্ছি না। একসময় আর কিছুই করার থাকবে না। আমাদের হাতে ততটা সময় নেই, যতটা আছে বলে আমরা বিশ্বাস করে ভাবি।
 মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে রাখুন। ল্যাপটপটা দূরে সরিয়ে রাখুন। টেলিভিশনটাও ছাড়বেন না। পৃথিবীতে এমন এক জনও মানুষ নেই, যার এই তিনটি জিনিস বন্ধ থাকলে পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে যাবে।
  
 নিজের সঙ্গে গল্পে মাতুন, নিজেকে সময় দিন। একটা ভালো বই পড়ুন, নিজের পছন্দের কোথাও বেড়াতে যান। পাহাড়ে, সমুদ্রে কিংবা অন্তত কাছের কোনও মাঠ বা পার্ক থেকে ঘুরে আসুন। অপরিচিত কারও উপকার করুন। যার সঙ্গে আপনার কোনও স্বার্থের সম্পর্ক নেই, এমন কারও সঙ্গে কথা বলুন, তার জীবনের গল্প শুনুন। এমন কাউকে সময় দিন, যে আপনার কাছ থেকে সময় চায় এবং যাকে সময় দিলে আপনার কোনও লাভ নেই। সবার কাছ থেকেই কিছু-না-কিছু শেখার আছে।
  
 আপনি যাকে ভালোবাসেন, তার জন্য প্রার্থনা করুন। যে আপনাকে ভালোবাসে, তার সঙ্গে একটু ভালো আচরণ করুন। ভালোবাসা ও ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করা, দুই-ই খুব ভালো কাজ। এই দুই ভালো কাজের পুরস্কার আছে। অপেক্ষা করুন, পুরস্কারটা যথাসময়ে পেয়ে যাবেন।
 রাস্তায় হেঁটে বেড়ান। মানুষ দেখুন, মানুষের জীবন দেখুন। ফুচকাওয়ালা কীভাবে প্লেটে ফুচকা সাজায়, রিকশাওয়ালা কীভাবে রিকশা টানে, ভিখিরিরা কীভাবে লোকের মন জয় করার চেষ্টা করে, এইসব খেয়াল করে দেখুন। পথশিশুদের সঙ্গে গল্প করে দেখেছেন কখনও? ওদের জীবনটাও যে আপনার আমার জীবনের পথসংস্করণ, তা কি জানেন? চাঁদের আলোয় ভিজেছেন শেষ কবে? আকাশভরা জ্যোৎস্না হলে চারপাশটা কেমন দেখায়, মনে আছে এখন? ফাগুনের পূর্ণিমারাতে চাঁদের রংটা কেমন হয়, সত্যিই কি জানেন?
  
 আমরা যতটা ভাবি, জীবনটা ততটা খারাপও না। ধরেই নেবেন না যে হাতে অনেক সময় আছে। ব্যাংকের কিছু টাকা নিজের খুশির জন্য উড়িয়ে দিন। কিছু টাকা অসহায় মানুষের মঙ্গলের জন্য খরচ করে ফেলুন। দেখবেন, ভালো লাগছে। ভালো লাগলে কেমন লাগে, তা মরার আগেই অনুভব করুন। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান, কিছু বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে সময় কাটান। সময়টা নষ্ট হবে না, মনের শান্তির জন্য সময় খরচ করতেই হয়।
  
 সবাই-ই জীবনে ভালো কিছু করতে চায়। কিন্তু ভালো থাকতে না পারলে ভালো কিছু করেও-বা কী লাভ? ঘড়ি থেমে নেই। টিক টিক টিক…চলছে। আমরা ভাবি, বেঁচে আছি। অথচ আমরা কেবলই নিঃশ্বাস নিচ্ছি, এর বেশি কিছু নয়। বাবা-মা মরে যাবার আগ পর্যন্ত আমরা সবাই ধরে নিই, ওরা বুঝি মরবে না। একইভাবে, আমাদের নিজেদের নিয়েও আমরা ওরকম করে ভাবছি। কোথাও খুব ভুল হচ্ছে। সত্যিই সময় ফুরিয়ে আসছে। যে আলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, তা অন্ধকারের কথাই জানিয়ে দিচ্ছে।
  
 সাতপাঁচ না ভেবেই একদিন বাচ্চাদের স্কুল থেকে ঘুরে আসুন। আরেকদিন ফুলের বাগানে চলে যান। কিংবা দূরের কোনও পাহাড়ে। একাই যান। সঙ্গে যদি এমন কাউকে নিতে হয়, যে মানুষ আপনার মনের মতো নয়, তবে একা যাওয়াই ভালো। ছোট্ট জীবন। মরার আগেই বেঁচে নিন। যারা মারা যাচ্ছে, ওদের কেউই, আপনার আমার মতোই, কখনও ভাবতে পারেনি যে, এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। মৃত্যুর কোনও দিনক্ষণের হিসেব নেই।
 জীবনটা স্রষ্টাপ্রদত্ত একটা উপহার। এই যে বেঁচে আছি, না থাকলেই-বা পৃথিবীর এমন কী ক্ষতি হয়ে যেত? যা যা করার জন্য এমন ব্যস্ত হয়ে থাকি, আপনি আমি না থাকলে কি সেগুলি আটকে থাকত? যে কাজের জন্য আমরা অপরিহার্য নই, সে কাজের কথা ভাবতে ভাবতে জীবনের সমস্ত সুখ-স্বস্তি-আনন্দ-হাসি শেষ করে দেবার কী মানে?
  
 আজকের দিনটাতে বেঁচে আছেন, এর মানে কোনোভাবেই এ নয় যে কালকের দিনেও আপনি বেঁচে থাকবেনই। জীবনের গ্যারান্টি ঠিক এই মুহূর্ত পর্যন্তই। যতটা পারেন উপভোগ করে নিন। দিঘিতে পদ্ম ফুটে আছে, বাগানের ওদিকে বাচ্চারা খেলছে, আকাশে নীলে কিছু ঘুড়ি উড়ছে। সূর্য এখনও ডোবেনি, আলো এখনও নেভেনি, দু-চোখ মেললেই দেখার সুযোগ এখনও আছে। সুখী হতে শিখুন; ধরে নিন, আজকেই জীবনের শেষ দিন। আপনি দুঃখ পেলে কারও কিছুই এসে যায় না। ওরকম মুখে মুখে সবাই দুঃখী হবার ভান করতে পারে, দিনশেষে নিজের কষ্ট এক নিজেকেই ভোগ করতে হয়। শেষমেশ বেঁচে যেহেতু থাকতেই হচ্ছে, তখন না হেসে কী লাভ?