ভালোবাসার দর্শন

মানুষ দুই জায়গা থেকে নিজেকে বদলে ফেলে, সামনে এগিয়ে যাবার শক্তি পায়:


এক। বুকের রক্ত ও চোখের জল থেকে।
দুই। শরীরের ঘাম থেকে।


আর যার বুকের রক্ত ও চোখের জল, এই দুই মিলে তাকে ঘুমোতেই দেয় না, সারাক্ষণই আঘাত করতে থাকে তার মনে ও মস্তিষ্কে, শরীরের ঘাম ঝরাতে বাধ্য করে---যতক্ষণ প্রাণ থাকে, ততক্ষণই,---তাকে আটকে রাখবে, এমন শক্তি পৃথিবীতে নেই।


আবেগ জিনিসটা ভীষণ ভালো, যদি তা নিজেকে ভালো রাখতে ব্যবহার করা হয়। যে আপনার আবেগের দাম দেয় না, তার পেছনে ওটা নষ্ট করার সত্যিই কোনও মানে হয় না। জোর করে কাউকে দিয়ে কিছু করানো যায়, এটা আমি বিশ্বাস করি না। যা-কিছুই ঘটুক না কেন, ভুল মানুষকে ব্রেইন থেকে ডিলিট করে দিতে জানার চাইতে বড়ো আর্ট আর নেই। ডিলিট করতে পারছেন না? কোনও সমস্যা নেই, শুধু নিজেকে স্থির রাখুন, অন্য কাজে মনোযোগী হয়ে পড়ুন। দাঁতে দাঁত চেপে হলেও নীরব থাকুন, বাকিটা আপনাআপনিই হয়ে যাবে। হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন না কোনওভাবেই, সময় যেতে দিন, পরিস্থিতি সামলে নেবার ক্ষেত্রে সময়ের চাইতে বড়ো জাদুকর আর নেই। মনে রাখতে হবে, যত বেশি কাউকে নিয়ে কষ্ট পাবেন, তত বেশি আপনি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা আবেগ নয়, এটা মানসিক অসুস্থতা।


ভুল কারও জন্য বেপরোয়া হয়ে বাঁচার সত্যিই কি কোনও অর্থ আছে? কী হয় এতে? তাকে কষ্ট দেবেন? তাকে যদি কষ্টই দিতে পারেন, তবে আমি বলব, আপনি আসলে তাকে ভালোবাসেনই না, আপনি কেবলই ইগোর খেলায় জিততে চাইছেন। নিজেকে কষ্ট দেবেন? এর চেয়ে বোকামি আর আছে, বলুন তো? নিজেকে সেই মানুষটার জন্য কষ্ট দিচ্ছেন যে আপনার এই কষ্টের খোঁজ রাখবার সময়ই পাচ্ছে না?


কাউকে ভালোবাসেন? এ তো ভালো কথা। দুটো কাজ করলে আপনার এই ভালোবাসা আপনাকে ভালো রাখবে। এক, সেও আপনাকে ভালোবাসবেই, এই প্রত্যাশা থেকে সরে আসা। ভালোবাসা কোনও উভয়মুখী বিক্রিয়া নয়, এই পৃথিবীর প্রায় ভালোবাসাই একমুখী। দুই, সে সারাজীবনই আপনার পাশে থাকবে, এমন অদ্ভুত চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসা। মানুষ মুক্ত পাখির মতো, মানুষের পায়ে শেকল পরানো সম্ভব নয়।


ভালোবাসার তুলনায় ভালোবাসার মানুষটি খুবই তুচ্ছ একটা সত্তা। ভালোবাসা আপনি ধরে রাখতে পারবেন, ভালোবাসার মানুষটিকে নয়। যদি জোর করে দুটোকেই ধরে রাখতে চান, তবে আপনার জন্য অসীম যন্ত্রণা সবসময়ই বরাদ্দ। বেঁচে থাকাটা আনন্দের। ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকাটা আরও বেশি আনন্দের---ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকুক না থাকুক। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যাকে পাশে রেখে মানুষ বাঁচে কিংবা যাকে পাশে রেখে মানুষকে বাঁচতে হয়, তাকে মানুষ সারাজীবন চেষ্টা করেও ভালোবাসতেই পারে না। পাশে থাকতে পারা ও ভালোবাসতে পারা---সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো ব্যাপার।


আমাদের কী হয়, জানেন? আমরা ভুল মানুষটাকে ভালোবাসতে বাসতে, যারা আমাদের ভালোবাসে, তাদের দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভুলে যাই! ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসার প্রত্যাশা করলে, আমি বলব, আপনি ভালোবাসতে জানেনই না। আপনার প্রত্যাশার চাপে পিষ্ট হতে হতে সে মানুষটির মধ্যে একসময় বিতৃষ্ণার জন্ম নেবে। কারও মনে একবার বিতৃষ্ণা চলে এলে, আর যা-ই হোক, ভালোবাসা অন্তত থাকে না, ক্রমেই তা চলে যায়। যদি আপনার প্রিয় মানুষটির মধ্যে আপনার জন্য ভালোবাসাটাকে জিইয়ে রাখতে চান, তবে কখনওই তার মনে আপনার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাতে দেবেন না।


ভালোবাসার মানুষটি শত চেষ্টার পরও আপনার সাথে থাকতে চাইছে না? ছেড়ে দিন না! কী দরকার নিজের আত্মসম্মানবোধটাকে এতটা বিকিয়ে দেবার? জোর করে কিছু হয়? জোর করে তো মানুষ পোষা কুকুরের ভালোবাসাও আদায় করতে পারে না, আর মানুষ তো অনেক পরের কথা!


এমনও হতে পারে, সে হয়তো আপনাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু আপনার অতিপ্রত্যাশা ও বেপরোয়া ভাবটাকে সে সহ্যই করতে পারে না। এদিকে আবার আপনি এই দুই থেকে নিজেকে বের করতেও পারবেন না। ইটস ওকে! অন্য কাউকে খুঁজে নিন। আমাদের মনটা কোনও ক্রীতদাস নয় যে তাকে একটা ঘরেই সারাজীবনের জন্য আটকে রাখতে হবে।


খুব ভালো হয় যদি নদীর স্রোতের মতন হতে পারেন। সামনের দিকে বয়ে চলুন, সুন্দরকে উপভোগ করুন, ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিতে চাইলে দিন, তবে কোথাও আটকে যাবেন না ভুলেও। নিশ্চিতভাবেই কষ্ট পাবেন আটকে গেলে। মনের বয়স যত বাড়ে, প্রত্যাশা তত কমে। ভালোবাসার ক্ষেত্রে, আপনি নিজেকে নিজে কষ্ট না দিলে আপনাকে কষ্ট দেবার ক্ষমতা এই পৃথিবীর আর কারও নেই। ভালোবাসেন, আবার কষ্টও পাচ্ছেন? এর জন্য আপনি নিজেই দায়ী। আপনার প্রত্যাশা, আপনার কর্তৃত্বপরায়ণতা ও আপনার ইগো আপনাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না।


ভালোবাসলে ছেড়ে দিতে জানতে হয়।
যদি সে ফিরে আসে, তবে সে আপনার।
যদি সে ফিরে না আসে, তবে অন্য কেউ আপনার।
কাউকে পাওয়া আর কাউকে ভালোবাসা---কখনওই এক কথা নয়।
দ্যাটস ইট!