দুঃস্বপ্নের মতো ধ্রুব

হৃদয়ের নৈবেদ্যে, আমার ভালোবাসার পূজার্হরূপে পুজো করেছি প্রতিদিন‌ই যাকে...
নিজের সবটুকু দিয়ে যাকে আগলে রেখেছি সকল কষ্ট বেদনা থেকে...
প্রত্যেকটা দিন‌ই এঁকেছি যাকে আমার মনের ক্যানভাসে, পরমযত্নে...
যাকে অসীম ভরসায় এই জীবনে বেঁচে-থাকার শক্তি বলে মেনে নিয়েছি...
আজ সে-ই কিনা ভালোবাসার নামে, এক হিসেবি অভিযানে আমাকে পুরোপুরিই নিংড়ে নিয়ে নিঃশেষ করে দিল!
আজ সে-ই কিনা আমার এ জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচার প্রধান কারণটা হয়ে উঠল!
আজ সে-ই কিনা সকল আস্থাব্যঞ্জনাকে উপহাস বানিয়ে নিজেকে সুদক্ষ এক অভিনেতা প্রমাণ করল!
কী বলব আমি তাকে?
কী বলব?
প্রতারক?
পূজনীয় দেবতা?
মহামানব?
না কি এক দানব বলব?
কী বললে তাকে আমার এই যন্ত্রণা থেকে আমি একটু হলেও মুক্তি পাবো!
এ যে ভয়ানক যাপন!
এ যে অসহ্য যন্ত্রণা!
শরীরের প্রতিটি রক্তকণিকাকে এখন যে আমার বিষ ঠেকছে!
ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতর বাহির।
আমি যে ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছি!


হে অদৃষ্টপুরুষ!
এ কেমন পরিহাস তোমার!
এ কার কাছে তুমি আমায় বলি দিয়ে দিলে!
এ কে?
কে?
দানব? মহামানব? কে সে?
আমি যে সমস্ত কিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব রিক্ত হয়ে পথে বসে আছি!
আর যে সহ্য হয় না!
হে ঈশ্বর,আমায় বেঁচে থাকার সাহসটুকু দাও!
এ কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমায় দাও, হে প্রভু!
দুঃখ দিয়েছ, মনে নেই কোন‌ও খেদ,
এবার দুঃখ ব‌ইবার শক্তিটুকু দাও, প্রভু!


শুধু কিছু প্রশ্নের উত্তর আমার চাই...
কেন এ পরিহাস?
কেন আমিই...?
এ কীসের এত শাস্তিবিধান?
কী আমার এমন অপরাধ?
কী আমার মুক্তির পথ?
কবে আসবে আমার সুসময়?
নিয়তির সামনে এসে একবার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই!
শুধু একবার...


এত কিছু লিখে কেন ফেলছি, একটু বলি। এ কোন‌ও কবিত্ব নয়, এ কেবলই বিষাদযাপন! আসলে জীবনে কখন কোন পরিস্থিতি সামনে এসে উপস্থিত হয়, তার কিছুই বলা যায় না। এতটাই অনিশ্চিত সব কিছু!
অবশ্য যেখানে বেঁচে থাকাটাই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, সেখানে অন্য যে-কোন‌ও ব্যাপার তো বহু দূরের‌ই বটে!
এমন অনিশ্চিত একটা জীবনে তবুও নিশ্চিতভাবে কিছু ঘটনা ঘটেই যায়। সেইসব ঘটনা কখনও কষ্টের হতে পারে, কখন‌ওবা সুখেরও হতে পারে! আবার কপাল খুব বেশি খারাপ বা ভালো হলে একই ঘটনার দুই রকমের সুনিশ্চিত রূপ আপনি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মতো প্রত্যক্ষ করবেন। সেটাও আসলে অনিশ্চিত! এরকম অনিশ্চিত জীবনে কিছু-একটা বা কিছু কিছু নিশ্চিতভাবে ঘটে-যাওয়া ঘটনা নিয়েই তো আমাদের এ আশ্চর্য বেঁচে-থাকা! অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা-ই...


ওহ্, আমি রোদসী। আমি আসলে গল্পকার নই, কোন‌ও লেখিকাও নই। তবে এই মুহূর্তে আমি একজন খেয়ালি মনের বিচ্ছেদপন্থি প্রেয়সী। একসময় আমাকে কেউ নক করলে আমি তাকে ভাবতাম লুচ্চা, আর নক না করলে তাকে ভাবতাম অহংকারী। সেই অবস্থান থেকে সরে আসার পর জীবনের সবচাইতে বড়ো ধাক্কাটি খেলাম।


আমি খুবই সাধারণ একটি মেয়ে। দেখতে চলনসই, তবে আহামরি কিছু নই। ভালোভাবে বলতে গেলে, স্মার্টনেস আছে আমার মধ্যে, তবে ফিজিক্যাল বিউটি অত নেই। আর পড়াশোনা বা যোগ্যতা, এসব বিচারেও ততটা আমলে আনবার মতো তেমন কিছুও আমার নেই। তবে বরাবরই আমি আমার যোগ্যতার একটু বাইরে গিয়ে কিছু যদি অর্জন করতে পারি কখনও, তবে সেটাই ভীষণ ভালো লাগে। আর এটাই যে কখনও জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, তেমন ভাবিনি আগে।


এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আমার এই জীবনে আসে। পরিচয়টা ফেইসবুকে। আমার থেকে বয়সে বেশ বড়ো। তার থেকেও, যোগ্যতায় অনেক বড়ো। আর দেখতেও দারুণ। সব মিলিয়ে পারফেক্ট যাকে বলে আরকি। তো এরকম একজন আমার জীবনে প্রিয়জন হয়ে আসবে, তা-ও আবার তার নিজের আগ্রহে, এটা কখন‌ও স্বপ্নেও ভাবিনি। দুঃস্বপ্নের মতো করে হলেও এই ঘটনাটা আমার জীবনে ঘটেই গেল!


তবে আরও কিছু বিষয় ছিল, তার আর আমার ভালোলাগার বিষয়গুলো অনেকটাই এক ছিল। এই যেমন সাহিত্য, বইপড়া, খুনসুটি-করা, গুছিয়ে কথাবলা এবং এরকম আরও কিছু বিষয়; যার কারণে আলাপটা জমতে বেশি অসুবিধে হয়নি। তবে আমি তখন না বুঝলেও পরে বুঝেছি, এই ভালোলাগার বিষয়গুলো আসলে শুধু বিষয় পর্যন্তই রয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে কোথাও আমিই ছিলাম না।


তো যা-ই হোক, এরকমভাবে এগোতে থাকে সম্পর্কটা। খুনসুটি, ভালোলাগা, ভালোবাসা এরকম আরও কিছু অপার আনন্দে আবেগে ভেসে প্রেম তখন জমে রীতিমতো ক্ষীর! সকালে, বিকেলে, রাতে আমাদের কথা হয়, টেক্সটের বিনিময় ঘটে। সে যেন আমাকে তার জীবনের অন্যতম ঈশ্বরপ্রদত্ত উপহার মনে করত, এমনটাই সে আমাকে সবসময় অনুভব করিয়েছে। আমি শুধু ভাবতাম আর ভাবতাম, এত সুখও ছিল আমার কপালে, প্রভু! এ সুখ সইবে তো শেষঅবধি?


আমার আরাধ্য আমার আশঙ্কাকে মিথ্যে করেননি। এই মানুষটাকে আমি আমার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে আগলে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তার সাথে কাটানো সময়টাকে আমার মনে হতো যেন স্বর্গপ্রাপ্তি! আর ভাবতাম...এ যুগে এমন মানুষও হয়! এখন বুঝি, হ্যাঁ, আসলে এ যুগে এমন মানুষই হয়! কী হাস্যকর কী হাস্যকর!


তাকে আমি ভালোবেসে অনেক কিছু লিখতাম। শুধুই তার জন্য, তাকে ভালোবেসে। আমি জানতাম না, সে আমার এই ভালোবাসা, ভালোবাসায় তাকে লেখা সমস্ত কথা এভাবে নিলামে তুলবে! এভাবে প্রয়োজন, শুধুই প্রয়োজন বানিয়ে হিসেবের খাতায় আমাকে তুলে রাখবে।


এই মানুষটা, দেড় বছর যেতে না যেতেই, এক অন্যরূপে আমার সামনে এল! তার এমন রূপ আমি আগে দেখিনি! সে এখন সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ। এ কি সেই মানুষটা, যে কিনা একসময় আমার ঘুমের জন্য নিজের সমস্ত কাজ ফেলে নিজেই তাড়াতাড়ি ঘুৃমিয়ে পড়ত? কই, এখন তো আমি রাতের পর রাত জাগি, কখনও তো সে একবার জানতেও চায় না, আমি জেগে আছি কি না, আমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করি কি না...


এরকমভাবে আরও অসংখ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে আমার কাছে প্রকাশ্য হয়, যা আমাকে প্রতিটি মুহূর্তে ভেঙেচুরে একেবারে শেষ করে দিয়েছে! ভালোবাসার এতটা নিখুঁত আন্তরিক অভিনয়‌ও যে করা যায়, কোন‌ও মিথ্যেও যে এতটা বাস্তবিক হতে পারে, এসব কিছু সে আমার জীবনে না এলে আমি কখনও বুঝতাম না।


তার জীবনে এখন আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। আমি একজন প্রতারককে ভালোবেসেছি, এবং এটা যে কী যন্ত্রণার, তা, যে ভালো না বেসেছে এমন কাউকে, সে কিছুতেই জানে না। এখন বুঝি, আমরা যা-কিছুই করি না কেন, তা যদি ভালোবাসার দোহাইয়ে করি, তবে পরবর্তীতে অনেক যন্ত্রণা পেতে হয়। কার‌ও জন্য ভালোবেসে কিছু করার চাইতে ভালোলাগা থেকে তা করা অনেক ভালো।


সে এখন দিব্যি আছে। আমি যদি লাশ হয়ে রাস্তার পাশে পড়েও থাকি, সে একবার ঘুরে দেখবেও না, এতটাই ভালো আছে সে। সে যাবার সময় বলে গেছে, আমি নাকি কোন‌ও দিনই তার কেউ ছিলাম না, অযথাই তাকে বিরক্ত করেছি। আমি নাকি প্রচণ্ড রকমের লোভী আর স্বার্থপর। আমি তাকে অতটা গভীরভাবে ভালোবাসতাম বলে আমাকে সে সাইকোপ্যাথও বলেছে। আমি নাকি তাকে একটুও শান্তি দিতে পারিনি। এরকম আরও অনেক অভিযোগ, প্রতারণা সে আমাকে উপহার দিয়েছে।


তবে এটা ঠিক যে অভিনয়ের খাতিরে হলেও সে আমাকে অনেক সহ্য করেছে। হা হা হা...। সে এখন খুব বেশি ভালো আছে, আমি তা জানি। তার চোখে আমি নাকি এখন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন একটি মানুষ। কী অদ্ভুত, তাই না!


তবুও সে ভালো থাকুক। তার কোনও ক্ষতি হোক, এটা আমি চাই না। আমার একটি ফোঁটাও চোখের জলের দাম যেন তাকে মেটাতে না হয়, এটাই আমার প্রার্থনা। আর যেই কষ্ট সে আমাকে দিয়েছে, সেই কষ্ট যেন সে কখনও না পায়, কারণ অতটা কষ্ট সে সহ্য করতেই পারবে না! এ কষ্ট সহ্য করা যায় না।


আরও অনেক কথা বলার ছিল। অত কিছু ঠিক গুছিয়ে বলা গেল না। তবে এখন আমার জন্য পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু আর নেই। মানুষ আসলেই শ্রেষ্ঠ প্রাণী! জীবন দেওয়া থেকে শুরু করে জীবন নেওয়া পর্যন্ত, সবটাই তাকে দিয়ে হয়!


তার মতো ভালো আমাকে কেউ কখনও রাখেনি, আর তার মতো কষ্টও আমায় কেউ কখনও দেয়নি। সে সুযোগ‌ই আমি এ জীবনে কাউকে কখনও দিইনি। মানুষ বড়ো অদ্ভুত প্রাণী, সে কাউকে কষ্ট দেবার সুযোগ পেলে দিয়েই ফেলে! আমার এই অনিশ্চিত জীবনে সুনিশ্চিতভাবে ঘটে-যাওয়া সেই নরকবাস আমাকে হয়তো আজীবনই কাঁদাবে।